অমানিশা❤️
লেখিকা_মালিহা_খান❤️
পর্ব-১০

গোসল সেড়ে খাবার টেবিলে এলো আরশাদ। ভেজা চুল না মুছে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে রাখা তার চিরকালের অভ্যাস। আজও নিয়ম লঙ্ঘন হয়নি।
মুনতাহা তখন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কি যেনো খাচ্ছে। সাবিনা বেগম একটু আগে ঘরে গিয়েছেন। সকাল ঠি ক দশটার পর গোসল করেন তিনি।
আরশাদ এসে বসেছে টের পেয়েও সে মাথা তুলেনি। চামচ দিয়ে খুটখাট করে কাটছে আর মুখে তুলছে, চিবাচ্ছে, আবার কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আরশাদ বিরক্ত করলোনা। নিশব্দে নিজের প্লেটটা টেনে নিয়ে খাবারে মনোনিবেশ করলো। মেয়েটা খায়ও চড়ুই পাখির মতোন। একটু একটু করে। অল্প অল্প করে।
গুমরে মরা নিরবতায় কাটলো অনেকক্ষণ। আরশাদের খাওয়া শেষের দিকে। মুনতাহা তখনো বাটির জিনিসটাই খেয়ে চলেছে একমনে। আরশাদ কপাল কুঁচকালো। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই বুঝলো, মেয়েটা বার বার ছোট্ট ছোট্ট হাই তুলছে, ডানহাতে চোখ কচলাচ্ছে।
ঘাড় বাকিয়ে ঘড়ির দেখলো আরশাদ। দশটা দশ। মুনতাহা এসেছে প্রায় অনেকক্ষণ। ঘুম পাচ্ছে তবু বসে আছে কেনো? আস্তে করে ডাকলো,

—“মুনতাহা?”

মুনতাহা মুখ তুলে তাকালো এতক্ষণে। ঠোঁটজুড়ে মিষ্টির রস। বাটির ভিতর আধখাওয়া সাদা মিষ্টি। চোখের ঘুম লুকোনোর নিষ্ফল প্রয়াস। আরশাদ নিমত্তের মতো সবটা মুখস্থ করলো। মেয়েটা খুব সাধারণ। আহামরি কিছু নয়। অনারম্বরেই ভীষণ আড়ম্বর!
অত:পর অতীক্ষ্ন মৃদু স্বরে বললো,

—“আপনাকে আম্মা ডেকে এনেছে?”

মুনতাহা উপরনিচে মাথা নাড়ায়। আরশাদ আবার প্রশ্ন করে,”আব্বুকে বলে এসেছেন?”
এবার আর ইশারায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে না পেরে মুখ খুললো মুনতাহা। ঠোঁটে লেগে থাকা রস বড্ড আঠালো। কিছুক্ষণ মুখবন্ধ থাকলেই আঠায় আঠায় দু’ঠোট লেগে যায়। মুনতাহা বারকয়েক জিভ দিয়ে চেঁটেপুটে উওর দিলো,” আব্বু-ই তো দিয়ে গেলো।”

—“আংকেল বাসায় নেই?”

মুনতাহা আবার মাথা নাড়ালো। আরশাদ বুঝলো,”মাহতাব সাহেব বাসায় নেই, মেয়েটার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে, মা হয়তো কোনো কাজে ডেকেছিলো কিন্তু রান্নার চক্করে বেমালুম ভুলে গেছে যে মুনতাহা এখনো টেবিলেই অপেক্ষা করছে, আর মেয়েটা কোনো কাজ না পেয়ে আধঘন্টা যাবত একটুকরো মিষ্টি নিয়ে খুটখাট করছে।”
দীর্ঘ ভাবনা শেষে প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো আরশাদ।
মা কে ডাকলো হাল্কা উচ্চস্বরে। আনতারা হম্বিতম্বি করে আসলেন। আরশাদের বলতে হলোনা। মুনতাহাকে দেখে তিনি নিজেই হায়হায় করে উঠলেন,

—“ওহ মা, তুমি তো বসে আছো। দেখেছো, আমার মনেই নেই। তুমি ডাক দিবেনা? পাগল মেয়ে। এমনে বসে থাকে চুপচাপ?”

মুনতাহা হাসলো নাকি না বুঝলোনা আরশাদ। তবে উঠে দাড়িয়ে মায়ের উদ্দেশ্য বললো,

—“কিজন্য ডেকেছো আম্মা?”

আনতারা মিষ্টি করে হাসলেন। আরশাদ অবাক হলো। মায়ের এই অকৃত্রিম হাসিটা দেখেনা অনেকদিন।
একবছর না? হ্যাঁ, প্রায় একবছর-ই তো। বাবা চলে গেছেন গোটা একটা বছর হয়ে যাবে কিছুদিন পর।
আনতারা মিষ্টি হাসি বজায় রেখেই বললো,

—“গয়না গুলো নিয়ে আসলাম না কাল? ওকে মানায় নাকি দেখি। এসো মুনতাহা। আমার ঘরে এসো মা।”

মুনতাহা উঠে দাড়ালো। আরশাদ একবার তাকালো তার দিকে। বিড়বিড় করলো,”ওকে সবতেই মানাবে আম্মা।”
অত:পর ঠোটের কোঁণ প্রসারিত করে মনে মনে তোলপাড় করে মনের ভেতরেই বাক্য আঁওড়ালো,”তাছাড়া, চাঁদের আবার অলঙ্কার লাগে নাকি? তার অঙ্গে অঙ্গে তো এমনিতেই অপার্থিব সৌন্দর্যের অগাধ- অহর্নিশ বিচরণ।”

আনতারা আলমারি ঘেটে লালরঙা গয়নার বাক্স বের করলেন। একটা নয়, দুটো নয়। পরপর কয়েকটা। মুনতাহার সেদিকে খেয়াল নেই। গোল গোল চোখদুটো যেয়ে আটকেছে জানলার গ্রিল গলিয়ে সামনের বাসার জানলার উপরের কার্নিশে বসে থাকা দুটো জালালি কবুতরের দিকে। কবুতর দু’টোকে সে চিনে। আব্বুকে দিয়ে গমের দানা আনিয়ে রাখে। যখন ছাদে যায় হাতের করে নিয়ে যায়। ছড়িয়ে দিতেই কি সুন্দর খায়!

দূর্বল মনস্বিতার সুঁতো ছিঁড়ে গেলো আনতারার ডাকে। তিনি বাক্স খুলতে খুলতে বলছেন,”তাড়াহুড়োয় মন মতো বানাতে পারিনি। দোকানের ডিজাইন থেকেই নিয়ে এসেছি। দেখি পড়তো মা।” তার হাতে গলার হাড়।
মুনতাহা বাধ্য মেয়েটির মতো মাথা ঝুঁকিয়ে দিলো। আনতারা পরালেন। ঘাড়ের চুল নিজেই ঠিক করে দিলেন। এতেই ক্ষ্যান্ত হলেন না। হাতের বালা- চুড়ি, কালের দুল, নাকের টানা নথটাও ধরে দেখলেন। মুনতাহা হকচকিয়ে বললো,”বিয়ে হলে এগুলো সব পরে থাকতে হবে আন্টি?”

আনতারা হেসে ফেললেন। ছেলে আসলেই কাল বাদে পরশু বিয়ে করছে, খুশি মনে ধরছেনা। ঢেউখেলানো হাসি নিয়েই বললেন,” আরে নাহ, পাগল মেয়ে। এই ভারি ভারি জিনিস সবসময় পরে থাকতে কে বলেছে? এসব তো আমি শখ করে নিয়েন আসলাম। পছন্দ হয়নি?”

—“না হয়েছে, খুব সুন্দর হয়েছে।”

আনতারা হাসলেন। মুনতাহা তখন আবারো বাইরে তাকিয়েছে। আনতারা এই প্রথম বোধহয় দেখলেন কোনো মেয়ের গহনার প্রতি অনিহা। দামী দামী গহনার থেকে তার বোধহয় পাশের বাসার জানলায় রোদপোহানো ছাইরঙা কবুতর দুটিই ভীষণ প্রিয়!

দুপুরের দিকে বেরোলো মুনতাহা। আনতারা জোরজবরদস্তি খাবার খাইয়েই ছেড়েছে। এই ফ্ল্যাট থেকে ওই ফ্ল্যাট। আরশাদ তাও ভেতরে ঢোকা পর্যন্ত দিতে এসেছে।
মুনতাহা ঢুকলো। দরজা আটকাবে নাকি না ভাবলো কিছুক্ষণ। সিদ্ধান্তে পৌছে যেতেই তার ভাবনায় গুঁড়েবালি ঝেড়ে দিয়ে আরশাদ দরজার পাশের দেয়ালে একহাত রেখে পরিষ্কার গলায় বললো,

—“বিয়ে কবে জানেন তো? আংকেল বলেছেনা?”

মুনতাহা মোমের পুতুলটির মতো মাথা নাড়ালো। মানে, সে জানে।
আরশাদ মনে মনে শোকপ্রকাশ করলো কিছুক্ষণ। মেয়েটা কথা কম বলে। অথচ এই অবুঝকে কে বোঝাবে, ওই মিনমিনে কন্ঠস্বর তার কত প্রিয়। আর বোঝানো হলোনা।
আরশাদ বোঝাপড়া বাদ দিয়ে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলো,”কবে? বলুন।”

মুনতাহার ছোট্ট, সংক্ষিপ্ত উওর,”পরশুদিন।”

আরশাদ মুচকি হাসলো। যাক, বলেছে কিছু। একটু ঝুঁকে চোখে চোখ রেখে বললো,

—“আম্মাকে নিয়ে মার্কেটে যাবো একটুপর। বিয়ের দিন কি পরবেন বলুন।”

এবার চিন্তাগ্রস্থ লাগলো মুনতাহাকে। একটু এলোমেলো, জ্ঞানশূন্য লাগলো। যেনো তাকে এ ধরণীর সবচেয়ে জটিল, দুর্বোধ্য, নিষ্করুণ প্রশ্নটি করা হয়েছে। উওর সাথেসাথেই এলোনা। আরশাদকে একাধারে চেয়ে থাকতে দেখে মুনতাহা শেষমেষ আমতাআমতা করলো,”আপনি নিয়ে এসেন কিছু একটা।”

প্রতিদিনকার মতোন সেদিনটাও ভীষণ সাধারণ। এক্কেবারেই গতানুগতিক। কোনো বিশেষত্ব নেই। নিত্যদিনের রুটিনমাফিক সকাল হয়েছে, বেলা গড়াতেই বিশাল দৈত্যাকার সূর্য উঠেছে, আবার গোধুলীলগ্নে তা পাড়ি জমাচ্ছে জগত আন্ধার করে।
মাহতাব সাহেব বাসায় ঢুকে খানিকটা অবাক হলেন। মুনতাহা কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। হ্যাঁ, মেয়েটার ছোটবেলা থেকে বালিশে মাথা রাখলেই ঘুমিয়ে পড়ার মতোন স্বভাব। বড্ড ঘুমকাতুরে। হিসেব করে রাখলে ঠিক দেখা যেতো জীবনের অর্ধেক সময় সে ঘুমিয়েই কাটিয়েছে।
কিন্তু তবু, আজ তো বিয়ে পড়ানো হবে। মেয়ে জানেও। তাও ঘুমাচ্ছে কেনো? মাহতাব সাহেব সমীকরণ মেলাতে পারলেন না।
তার পিছে আরশাদ। হাতে মিষ্টির প্যাকেটের সাথে আরো কিছু খাবারপত্র। দু’একজন পরিচিত আসবে। এছাড়া আর কোনো হট্টগোল নয়। ঘরের মানুষ নিয়েই শুধু বিয়েটা পড়ানো হবে।
মুনতাহাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকালো সে। মাহতাব সাহেব বুঝতে পারলেন। হাল্কা কেঁশে নিজ থেকেই বললেন,”চিন্তা করোনা, ও মাঝেমধ্যেই এখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে। উঠে যাবে একটু পর। কাজি আসতে তো এখনো দেরি আছে।”
আরশাদ সম্মতিসূচক হাসলো। প্যাকেটগুলো টেবিলে রাখলো। মাহতাব সাহেব কি করতে জানি নিজের ঘরে গেলেন। আরশাদ একধ্যানে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো মুনতাহার দিকে। গায়ের কাঁথাটা পা থেকে সরে গেছে। মেয়েটা এমন জড়োসড়ো হয়ে আছে কেনো?
না না করেও ঘরে ঢুকলো সে। আম্মা আসবে একটু পর। সাজিয়ে টাজিয়ে দিবে একটু। পায়ের কাঁথাটা ঠিক করতেই ভ্রু কুঁচকালো আরশাদ। তাড়াহুড়ো করে যেয়ে দাড়ালো মুনতাহার মাথার কাছে। একটুক্ষণ কিছু একটা পরখ করতেই সব যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো মূহুর্তেই। রুদ্ধশ্বাসে চিৎকার করে ডাকলো সে,”আংকেল? আংকেল এদিক আসেন।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here