#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৮

ব্যস্ত পথের কিনার ঘেঁষে রাধাচূড়ার মোহনিয়া হাসি। মাথায় ফোঁটা লাল মুকুটে দূর্নিবার সৌন্দর্যের অহং। শেষ দুপুরের সোনারঙা রোদপাটিতে কয়েকজোড়া ক্লান্ত কাঠশালিক চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছে, মাঝেমধ্য আবার ঘাড় বাকিয়ে ঠোঁট ঠুকরে ঠুকরে চুলকে নিচ্ছে ডানা-কাঁধপিঠ।
উশৃঙ্খল হর্ণের শব্দ, বাসের ধোঁয়ায় জটালো পরিবেশ। হরহামেশার শহরের রাস্তাভর্তি থোকা থোকা যানযটের মাঝেই ভীড়হীন ফার্মেসির সামনে বাইক থামালো প্রাপ্তবয়স্ক এক দীর্ঘদেহী যুবক। গায়ের আকাশীরঙা ভেজা শার্ট দেখে সূর্য বোধহয় মায়া করেই তার উপর রোদ লাগালোনা। রাধাচূড়া বোধহয় প্রেমে পরেই একটু দুলিয়ে দিলো তার ডালপালা। একটু ঠান্ডা বাতাসে শান্তি মেলাতে চাইলো যুবকের দেহে। অথচ বোকা রাধাচূড়া জানেই না,’যার ভেতরে উথালপাতাল তার বাহিরে শান্তি মেলানোর চেষ্টা বৃথা বই কিছুনা।’
দীর্ঘক্ষণ বাইকের হ্যান্ডেল চাপা ঘর্মাক্ত লালাভ হাতে হেলমেটের কাঁচ উঠালো যুবক। কাঁচের উপর সহসাই ছাপ বসে গেলো আঙুলের ঘামের। ফার্মেসীতে বসে থাকা পন্চাশোর্ধ ব্যক্তিটাকে বলতে হলোনা, যুবককে দেখামাত্র একপাতা নির্দিষ্ট ওষুধ বের করে বাদামী রঙা প্যাকেটে ঢোকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
যুবক হেলমেট খুলেছে ততক্ষণে। রাধাচূড়া প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে তার গতি বাড়িয়েছে। সাঁই সাঁই করে দুলছে পাতাভর্তি ডালপালা। যুবক ক্লান্তিহীন অবসাদ চোখে তাকাল। কনুইয়ের কাছে কপালের ঘাম মুছে, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে আওয়াজ বাড়িয়ে বলল,

—“দু’পাতা দিন চাচা, কালরাতে এগারোটার দিকে ঘুরে গিয়েছি। আপনি তো আগেই দোকান বন্ধ করে নিরুদ্দেশ।”

উওর এলো,
—“অতো রাইতে কি আর দোকান খোলা রাখা যায় বাজান? ওষুধ তো গোনাই আছিলো। তুমি তো দুইদিনের ডা বাড়াইয়া নাও। তাও শ্যাষ হইলো ক্যম্নে?”

ঘর্মাক্ত যুবক হাসে। হাসির ফাঁকে ঢাকার চেষ্টা করে মনের মলিনতা। ঢাকা পরে কিনা জানেনা তবে চাচা আর সংলাপ বাড়ায়না। কথামতো আরেক পাতা ওষুধ প্যাকেটে ভরে স্ট্যাপলার মারে সশব্দে।
যুবক মানিব্যাগ মেলেছে। সূর্য তখন তেরছাভাবে আলো ফেলেছে মানিব্যাগের এককোঁণে। যেখানটায় প্লাস্টিকের আবরণের ভেতর দেখা যাচ্ছে এক যুবতীর সাদা কালো ছবি। নাহ্, কোনো হাস্সোজ্জ্বল চেহারা নয়। বরং গাছের ফাঁকে আটকে যাওয়া ওড়নার আচঁল ধরে বিরক্তিতে ভরা মুখটাই অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেখানে। একপাশে ঝুলছে তার লম্বা বেণি। ছবিটা ঝাপসা। ক্যামেরাটা কেঁপে গেছিলো। পাশের টং দোকানভর্তি মানুষ ছিলো যে। কেউ দেখে ফেললে!
যুবক স্মিত হাসে। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল বুলায় পার্সপোর্ট সাইজের সাদাকালো ছবিটার উপর। ঠোঁটের হাসি অজান্তেই গাঢ় হয়। কোঁণ ছড়িয়ে যায় গোপনে। শহরের প্রেমহীন রাস্তার ধারে দাড়িয়ে এক ভয়ংকর প্রেমিকের মনে নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠা পবিত্র প্রেমকে সম্মান জানিয়েই বোধহয় একটা তাজা রাধাচূড়া ডাল ছুটে যায়। নিজ ইচ্ছায় জীবন বিসর্জন দিয়ে টুপ করে পড়ে রংহীন ছবিটার উপর। যুবক অবাক হয়। ভাবনায় ভাটা পড়ে। চিবুক উচিয়ে মাথার উপর তাকায় সে। লালফুলগুলো হাসছে যেনো। আহা!
আচ্ছা, মুনতাহা ঠি ক কতদিন হাসেনা?

—“ভাই, আপামনি রে দিয়েন।”

ডাকে ধ্যান ভাঙল। দ্রুত মানিব্যাগ ভাঁজ করে ফেলল যুবক। রাধাচূড়াটা অযত্নে পড়ে গেলো ধূলোমাখা রাস্তায়।
একটা ছোকরা ছেলে। বয়স দশ-এগারো। শ্যামলা চেহারা। হাতের বাদামী কাগজের প্যাকেটের উপর আরেকটা সিভিটের পাতা ধরা। বোঝা যাচ্ছে সেটাই তার আপামনিকে দেয়ার কথা বলছে ছেলেটি। আরশাদ মুচকি হাসে। ছেলেটার কোকড়ানো চুলে আদুরে হাত বুলায়। মানিব্যাগটা হাল্কা খুলে আঙুলের চিমটিতে টাকা বের করতে করতে বলে,
—“বাসায় আসিস না কেনো? আপামনি তো রোজই বলে তোর কথা।”

ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায় চোখের কালো মনি। আরশাদ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিতেই দোকানের ভেতরে থেকে চাচা ভরাট গলায় বলে,
—“ওটার টাকা দেয়া লাগবেনা।”

আরশাদ জোর করেনা। লাভ হবেনা। শুধু ওষুধের দাম মিটিয়ে প্যাকেটটা পকেটে ভরে নেয়। রাধাচূড়া তখনো দুলছে। প্রেমে সে কুপোকাত। হেলমেটটা পরতে পরতেই বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ঘুমকাতুরে মুনতাহা এখন ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমোয়না। চোখের নিচে দু’ইন্চি কালির পরত বসে গেছে। ঘুমের ওষুধে সারারাত বুঁদ করে রাখলেও ওষুধের সময় কেটে গেলেই আবার সেই নিদ্রাহীনতা।
একসময় মেয়েটা বেলা অবেলা ঘুমাতো। অফিস থেকে ফিরে তার এলোমেলো ঘুম দেখাই ছিলো আরশাদের একমাত্র ভালোলাগার কর্ম। অথচ.. অথচ এখন?
আরশাদ আকাশের দিকে চাইলো। সাদা শুভ্র মেঘে একফোঁটা গলিত স্বর্ণের সূর্য।
প্রথম প্রথম মুনতাহা ওষুধ খেতেই চাইতোনা। ডাক্তার বলেছিলো এমন না ঘুমিয়ে থাকলে শরীর আরো খারাপ হবে। তবু সে জোর করতোনা। কিন্তু…কিন্তু মেয়েটা যখন সারারাত পাশে শুয়ে মৃতের মতো দু’চোখ মেলে ঘরভর্তি অন্ধকারে চেয়ে থাকতো, মাঝেমধ্য উঠে বসে,”আব্বু এসেছে”, “আব্বু এসেছে” বলে হাঁসফাঁস করতো, তখন আর পারতোনা আরশাদ। দু’গাল চেপে ওষুধ মুখে দিয়ে দিতো। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়তো। তারপর ধীরে ধীরে, একটাসময় মুনতাহা নিজেই হা করতো। একটা ওষুধ খাইয়ে পানির গ্লাস নামিয়ে রাখলে বলতো,”আরেকটা দিন, আমার ঘুম আসেনা।”
আরশাদ ওষুধের পাতা ড্রয়েরে রেখে ড্রয়ের তালা দিয়ে রাখে। চাবিটা নিয়ে আসে সঙ্গে। মেয়েটা একবার ঘুমের জন্য একসাথে দুটো ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। সে কি দৌড়দৌড়ি!

হেলমেটের বেল্ট লাগিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় আরশাদ। ধোঁয়াটে বাতাস ছেড়ে চাকা ঘুরলো।
সেই চাকার নিচেই লাল রাধাচূড়াটাকে পিষ্ট করে বাইক ছুটালো আরশাদ।
মোড়ের বাঁক ঘুরে আরেকটা দোকানের সামনে থামলো বাইক। আরশাদ নেমে দাড়াল। কিছুক্ষণের পর্যবেক্ষণে ঠোঁট ফুঁড়ে বেরোলো,
—“একজোড়া নিবো। ওই ঝুঁটিওয়ালা গুলো। কতো পড়বে?”

কাঁচা হলুদের আচঁলে গাঢ় কমলা ফুলের বাগান। পিঠে এঁকেবেঁকে লুটিয়ে পড়েছে দীর্ঘ ঢিলে বেণি। রাঙা
রোদ সরাসরি পরেছে গলার কাছে। চিকচিক করছে স্বর্ণের চেইন। ব্যালকনির ফ্লোরে পা ভাঁজ করে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে এক রুপবতী দু:খিনী। সারারাত নির্ঘুম ছটফটানোর ফলাফল হিসেবে ব্যাথায় এখন মাথার খুলি ফেঁটে চৌচির।

কলিংবেল বাজলোনা, তবে দরজা খোলার খুটখাট শব্দে ঘাড় ঘোরালেন আনতারা। ছেলের মুখ দেখার আগে নজরে এলো তার হাতে ধরা বড় একটি খাঁচা। ভেতরে দুটো সাদা পায়রা কৌতুহলী চোখে এদিক ওদিক দেখছে। আরশাদ খাঁচাটা নামিয়ে রাখলো মাটিতে রাখলো। দরজা আটকে পায়ের জুতো খুললো। আনতারা
কবুতর দুটির দৃষ্টির ন্যায় কৌতুহলী কন্ঠে ই বললেন,
—“কবুতর এনেছিস কেনো?”

আরশাদ মুচকি হাসে। অকপটে বলে,”ওর কবুতর খুব পছন্দ আম্মা। একবার কিনে দিবো বলেছিলাম। সেজন্যই আরকি..”

—“ভালোই করেছিস। এদের সাথে একটু ব্যস্ত থাকলেও হয়।” আনতারার কন্ঠে ক্ষীণ আশা। আরশাদ হাসে শুধুই। খাঁচাটা তুলে নিয়ে বলে,
—“কই ও? ঘরেই? দুপুরে খায়নি তাইনা? তুমি একটু খাবারটা বেড়ে দাও আম্মা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবো। আসলে সারারাত ঘুমোয়নি তো। খেতেও তো ভাল্লাগে না।”

কথায় আছে,”আজ মরলে কাল দুদিন।” মৃত মানুষকে নাকি কেউ মনে রাখেনা। একসময় সবাই ভুলে যায়।
অথচ আজ আড়াইমাস পেরিয়ে গেলো মুনতাহা অসুস্থ। মাহতাব সাহেবের মৃত্যুর পরে মেয়েটা সেই যে অসুস্থ হলো। খাবারের প্রতি অনিহা বেড়ে গেলো, চুপচাপ মেয়েটা যেনো এবার বোবাই হয়ে গেলো, একমনে কি যেনো ভাবতো বসে বসে, ঘুমাতে পারতোনা রাতে। শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হলো। সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে নিয়ে গেলো। উনি বললেন, বাবাকে ভুলতে পারেনা। বাবার আকস্মিক মৃত্যু ভুলতে পারেনা। ব্রেনে এফেক্ট করে। যে করেই হোক, বাবাকে ভুলে থাকতে হবে।
কতদিন গিয়েছে এমন, সারারাত বুঝিয়ে বুঝিয়ে রেখে ভোরবেলা উঠেই তাকে নিয়ে কবরস্থানে ছুটেছে আরশাদ। মুনতাহা যেয়ে চুপচাপ বসে থেকেছে ঘন্টার পর ঘন্টা।
আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার। জীবনটা তার দীর্ঘশ্বাসেই আটকে গেছে যেনো। কবুতরগুলো উড়ছে, লাফাচ্ছে খাঁচা ভরে।

মুনতাহার চোখ বোজা। আরশাদ অবাক হয়। বিস্ময় নিয়ে দেখে। মেয়েটা ঘুমিয়ে পরেছে? সত্যি নাকি মিথ্যে? ভ্রম নাকি কল্পনা?
খাঁচাটা নামিয়ে রাখে নিশব্দে। দু’কদম এগোতেই চোখ মেলে মুনতাহা। হঠাৎ পাওয়া মুক্তো-ঝিনুকটা যেনো সেখানেই হারিয়ে যায়। আরশাদ তবু হাসে। বলে,”ওহ, জেগে আছেন? আমি ভাবলাম ঘুমিয়ে পরেছেন।”
মুনতাহা পলক ঝাপটানোর চেষ্টা করে। আরশাদ হাঁটুগেড়ে বসলো। বহুদিনের অভ্যাসবশত কপালের চুল কানে গুঁজে দিয়ে বলল,”দুপুরে খাননি কেনো? চলুন খাবেন।”

মুনতাহা হেলানো শরীর সোজা করে। দূর্বল হাতে চোখ কচলে ক্ষীণ কন্ঠে বলে,”আপনি ওষুধ এনেছেন?”

—“এনেছি। কিন্তু কিছু একটু খেয়ে তারপর খেতে হবে। ঘুমোলে আপনি মাঝরাতের আগে উঠবেননা মুনতাহা।”

মুনতাহা মাথা নাড়ায়। পিছে কিছু একটা চোখে পড়তেই দৃষ্টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। আরশাদ তার চোখ অনুসরণ করেই বলে,

—“আপনার পায়রা। পছন্দ হয়েছে?”

মুনতাহা উওর দেয়না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে খাঁচার দিকে। চোখে কি একটু খুশি দেখা যায়? একটু আনন্দ উচ্ছাস দেখা যায়? আরশাদ বুঝে না।

ভাতের ছোট্ট লোকমাটা মুখে নিয়েই বাঁধ সাধলো মুনতাহা। কপাল কুঁচকে চরম অনিহায় বলল,”আর না।”
আরশাদ প্লেট নামিয়ে রাখলো। বিষাদ চোখে দেখলো, পাতে তখনো অর্ধেকের মতো ভাত পরে আছে।
মুনতাহা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে রেখেছে। আরশাদ বা’হাতে টেবিলের উপর থেকে ওষুধটা তুলে খাইয়ে দিয়ে বলল,”ঘুমান। চোখ লাল হয়ে আছে কেনো? মাথা ব্যাথা কমেনি?”

মুনতাহা দু’পাশে মাথা নাড়ায়। অর্থ্যাৎ,”কমেনি।”
ছোট্ট মস্তিষ্কে হাই পাওয়ারের ওষুধ কাজ করে তাড়াতাড়ি। নিমিষেই ঘুম ধরে যায় চোখে।
মুনতাহা ঘুমিয়ে পড়ে। মাথাটা পাশে হেলে পরতেই আরশাদ এলোপাথারি ঠোঁট ছোঁয়ায় তার মলিন চাঁদমুখে। বারান্দা থেকে পায়রাদুটোর ডাক শোনা যাচ্ছে। বাকবাকুম বাকবাকুম।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here