#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৩
পড়ন্ত বিকেল। নিরিবিলি প্রভন্জনের ছন্দে ছন্দে দৃঢ় হচ্ছে পাখিদের নীড়ে ফেরার আহব্বান। মোড়ের বাঁকে বাঁকে জ্বলছে হলদে ল্যাম্পপোস্ট। সন্ধ্যা বরণের তোড়জোড় আয়োজন। একটু পড়েই জগতজুড়ে আঁধার নামবে যে!
কয়েক’টা কুচকুচে কাক মাঝে মাঝেই দলবেঁধে উড়ছে, আবার ডানা ব্যাথা হয়ে গেলে এদিক ওদিক এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে পেটে পাখনা গুঁজে। কন্ঠে তাদের একই সুরের হরেকরকম বুলি।
কা কা কা। অথচ একেকজনের ডাক একেকরকম। অদ্ভুত না?
ছাদের পুরু ইটের রেলিংয়ের উপর দু’টো সাদা পায়রা অভিমানের গল্প করে যাচ্ছে অনেকক্ষণ যাবত। মুনতাহা বুঝেনা তাদের ভাষা। তবে দেখতে ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। মাথায় ঝুঁটিওয়াটা পায়রাটা মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। পাশের পুরুষ পায়রাটা তাকে মানানোর চেষ্টায় অব্যাহত। মুনতাহা হাসলো। মিষ্টি করে হাসলো। মেয়েরা এতো অভিমানিনী হয় কেনো?
—“মুনতাহা।”
একটা রাশভারি ডাক। অন্যমনষ্ক চেতনায় হঠাৎ এই পিছুডাক যারপরনাই পিলে চমকে দিলো মুনতাহার। শরীরটাও কেঁপে উঠলো খানিকটা। মুখের হতচকিত, বিমূড় ভাবটা বিন্দুমাত্র লুকোনোর চেষ্টা না করে ঘাড় ফেরালো সে। আরশাদ দাড়িয়ে আছে।
পরণে সেই সাদা শার্ট। তবে মুনতাহা জানে, লোকটার একটা শার্ট নয়। তার অনেকগুলো সাদা শার্ট। আলমারির একপাশভর্তি করে ঠাসা সাদা শার্ট। অফিস গেলে সবসময় সে এই রঙ-ই পরে কিনা!
ঝুপ ঝাপ ডানা ঝাপটানোর শব্দ! মুনতাহা ডাকের উওর না দিয়েই রেলিংয়ের দিকে তাকালো। আরশাদের অকস্সাৎ দারাজ ডাকে ডানা ঝাপটে উড়ে গেছে পায়রাদুটো। সে নিজেই তো ভয় পেয়েছে পায়রাদুটো পাবে না কেনো? মূহুর্তেই ঘুটঘুটে অমাবস্যায় ঢাকা পড়লো এতক্ষনের পূর্ণিমার মতো উজ্জল চেহারাটা। আরশাদ পাশে এসে দাড়িয়েছে। মুনতাহা তাকে সুযোগ না দিয়েই কন্ঠভর্তি অভিযোগ নিয়ে বলল,”আপনি ওদের কে উড়িয়ে দিলেন কেনো?”
আরশাদ চিবুক উঁচিয়ে সরুচোখে একবার দেখলো কবুতর দু’টোকে। সাদা পালকে ভর্তি হাত- পা দুটোর-ই। দামি জাতের বোঝা যাচ্ছে। তাদের মাথার উপর উড়ে বেড়াচ্ছে বেমালুম। চোখ নামিয়ে মুনতাহার দিকে দৃষ্টি দিলো সে। পূর্ণচোখে তাকিয়ে কাঠকাঠ কন্ঠে বলল,
—“আপনি এসময় ছাদে কি করছেন?”
মুনতাহা ধীরগতিতে পলক ফেললো। বোঝার চেষ্টা করলো তার ছাদে আসার সাথে উনার কি সমস্যা হতে পারে? অবশেষে বুঝতে না পেরে শূন্যকন্ঠে উওর দিলো,”কিছু করছিনা।”
আরশাদের চোখের ভাষা যেনো আরো কঠিন হলো। আশেপাশে প্রায় সন্ধ্যা। মেয়েটাকে কতবার ফোন করেছে হিসেব নেই। না পেয়ে মাকে ফোন করবে তক্ষুনি ফোনের চার্জ শেষ। শেষমেষ চিন্তায় পড়ে অফিস ফেলেই চলে এসেছে। বাসায় এসে একবার ঘরে দেখেছে, নেই। আম্মা বললো, ভার্সিটি গিয়েছে আজ। ফিরেনি মনেহয় এখনো। অথচ পাঁচটার আগেই বাড়ি ফেরার কথা।
আরশাদ একই সুরে বলল,”আমি কয়বার ফোন করেছি? ফোন কোথায় আপনার?”
মুনতাহা পিটপিট করলো। আরশাদের কথায় মনোযোগ নেই তার।
আরশাদের যেখানে দাড়িয়ে আছে তার থেকে একটু পিছেই পানি ট্যাংকি। এলোমেলো উড়ে তার উপরেই বসেছে একটা পায়রা। আরেকটা উড়ছে। সেদিকেই সব ধ্যান যেয়ে আটকেছে মুনতাহার। আরশাদের প্রশ্নের উওরে সেদিকে তাকিয়েই কোনরকম ছন্নছাড়া উওর দিলো সে,”ফোন…ফোন নিচে মনেহয়।”
আরশাদ তপ্ত শ্বাস ফেললো। মেয়েটার মনোযোগ নেই একদম। তার শাসন আদৌ কানে যাচ্ছে কি না সন্দেহ!
মুনতাহা দু’কদম এগিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেয়ে দাড়ালো। আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঘুরে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—“আংকেল বাসায়?”
—“না, নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে।”
পায়রাদুটো আবার উড়ে রেলিংয়ে বসলো। পাশাপাশি। আরশাদ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। মুনতাহা আচমকাই পায়ের পাতায় ভর দিয়ে একহাতে মুখ চেপে ধরলো তার। আরশাদ হকচকালো। মুনতাহা জোর দিয়ে বলল,
—“চুপ, কথা বলবেন না। আপনি কথা বললেই ওরা উড়ে যায়।”
আরশাদ হতভম্ব চাইলো। সামান্য কবুতরের জন্য মেয়েটা এমন ডাকাতের মতো তার মুখ চেপে ধরেছে? আশ্চর্য? কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে চেয়ে থেকে ধীরগতিতে মুনতাহার হাতের উপর হাত রাখলো সে। আস্তে করে সরিয়ে নিতে চাইলেই আরো জোরে চেপে ধরলো মুনতাহা। চোখে তার স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা! ঘোর মানা!
আরশাদ বারণ শুনলোনা। আলতো করে হাতটা সরিয়ে নিচু কন্ঠে বললো,”বলছিনা, কথা বলছিনা। শান্ত হন।”
তার নামানো কন্ঠে শান্ত হলো মুনতাহা। আরশাদ হাতটা নামালো ঠি ক তবে ছাড়লোনা। সূর্য ডুবে গেছে। নীল আকাশ ধূসর হচ্ছে। পশ্চিমপাশে ছেঁয়ে গেছে মধ্যান্হের বিদায়বেলা। একটা দৈবাৎ হাওয়া ছুঁয়ে গেলো সর্বাঙ্গ। মাথার কাপড়টা পড়ে গেলো মুনতাহার। কপালের চুল আলগোছে ঠোঁট ছুঁয়ে গেলো। আরশাদ এককদম এগুলো। ঠোঁটের কোঁণে তর্জনী ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে চুলগুলো সরালো। কানের পাশে গুঁজে দিলো হাল্কা করে। মুনতাহা থতমত খেয়ে নিজেই ডানহাত উঠিয়ে ওড়নাটা তুলে নিলো। আরশাদ ধ্যান দিলোনা। সটান দাড়িয়ে কবুতর দু’টোর দিকে দৃষ্টি স্হির করে বলল,”আপনার কবুতর এতো পছন্দ?”
মুনতাহা ঠোঁটচেপে উওর দিলো,”হু।”
আরশাদ হাসলো,”আপনাকে কিনে দিবোনে। ঠিক এমন দুটো কবুতর। ঠিকাছে?”
মুনতাহা মিনমিন করলো,”আচ্ছা।”
হাত ধরে কিছুক্ষণ ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো আরশাদ। মুনতাহার একাধারে চেয়েই রয়েছে। হাল্কা কেঁশে গলা পরিষ্কার করলো আরশাদ। বললো,
—“এতো কি দেখছেন? আসুন, নিচে চলুন।”
মুনতাহা মাথা নাড়ালো,”না, আরেকটু। ওর রাগটা ভাঙুক। দেখে যাই।”
আরশাদ কপাল কুঁচকায়,”কার রাগ?”
—“মেয়ে পায়রাটার।”
—“পাগল হয়েছেন? কি সব বলছেন? এজন্যই চুল ছেড়ে ছাদে আসতে মানা করি। চলুন, নিচে চলুন।”
মুনতাহা বাঁধা দিলো। ধরে রাখা হাতটা টেনে বললো, “না, দাড়াননা একটু।” এটুকু বলেই একনিশ্বাসে আরশাদকে সবটা বললো সে। কথা শেষ হতেই ভ্রু উঁচায় আরশাদ। বিস্ময়ের দু’চারটা পলক ফেলে বলে,”আপনি কি বাচ্চা মুনতাহা?”
মুনতাহা কপাল কুঁচকে ভ্রুকুটি করে তাকাতেই সে আবার বলে, আচ্ছা দেখুন, দেখুন। দাড়াচ্ছি।”
পায়রাদের রাগ শেষমেষ ভাঙলো বোধহয়। মেয়ে পায়রাটা বাঁকানো মুখ ঘুরিয়ে তাকালো।
মুনতাহা উল্টোদিকে ঘুরে গেলো হুট করে। আরশাদের হাত টান দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
—“আচ্ছা চলুন।”
আরশাদ হাসে। পায়রাদুটো তখন ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে অভিমান নিভাচ্ছে।
~চলবে~