অমানিশা❤️পর্ব-৩
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

সেদিন কেনো যেনো খুব ঝড় নামলো। একটা প্রকান্ড ঘন মেঘ পুরো শহরটাকে ঢেকে ফেললো সন্ধ্যে হতে না হতেই। কালবৈশাখীর আগাম বাতাস শুরু হলো। বস্তির টি-নের চালাগুলো লন্ডভন্ড হলো। আশেপাশে কেমন একটা রণ রণ ভাবমূর্তি ফুটে উঠতেই ঘটলো আরেক বিপত্তি। মহাবিপত্তি!
মাহতাব সাহেব একটা কাজে বেরিয়েছিলেন। ঝড়ের কবলে আটকা পরলেন তিনি। বড়রাস্তায় গাছ উপরে বাজে অবস্থা। চলাচলের জো নেই। তাছাড়া এমন ধুলোঝড় বের হবারও উপায় নেই। তুমুল বজ্রপাত হচ্ছে। জগত মহাজগত থরথর করে কেঁপে উঠছে। রিখটার স্কেল ধরে মাপলে বোধহয় ছয়- সাত ছাড়িয়ে যেতো।
ঘড়িতে তখন সাতটা দশ। মুনতাহাকে আনতে যাবার কথা সাড়ে ছ’টার দিকে। একা একা সে আসতে পারেনা। পারেনা বলতে আজ পর্যন্ত কখনো আসেনি। সবসময় তিনিই পৌছে দিয়ে আসেন আবার যেয়ে নিয়ে আসেন।
ফোন করছে ফোন বন্ধ।
অতিমাত্রার দুশ্চিন্তায় মাহতাব সাহেবের প্রেশার বেড়ে গেলো হুরহুর করে। শেষমেষ কোনরকম উপায়ন্তর না পেয়ে আরশাদকে ফোন লাগালেন তিনি। ব্যাংক বন্ধ আজকে। সরকারি ছুটি। বাসায়ই থাকার কথা।

পকেটে ফোন ভাইব্রেট হতেই ঠোঁট থেকে সিগারেট সরালো আরশাদ। সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বা’হাত থেকে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলো কাঠের বেন্চির উপর। রাস্তার মাঝে পথশিশুদের ঝপাঝপ উত্তাম- মাত্তামের দিকে চেয়ে ফোন বের করলো। একঝলক নাম্বারটা দেখে রিসিভ করলো অলস ভঙ্গিতে। আঙ্গুলের অভিজ্ঞ টোকায় সিগারেটের ডগায় জমা ছাই ফেলতে ফেলতে সালাম দিলো।
মাহতাব সাহেব ভূমিকা না করেই বললেন,”তোমার তো আজকে অফিস নেই। তুমি কি বাসায় আছো আরশাদ?”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকালো। বললো,”না আংকেল, বিকেলে একটা কাজে বের হয়েছি। এখনো ফিরিনি। কোনো দরকার?”

মাহতাব সাহেব বড়সড় শ্বাস ফেলে বললেন,”একটু দরকার তো ছিলোই” এটুকু বলে একটু থামলেন তিনি। একমূহুর্ত ভেবে বললেন,”আমি এক জায়গায় আটকা পরেছি। কেমন ঝড় দেখছোই তো। সমস্যা হলো আমার মেয়েটা এখনো ভার্সিটিতে। ওকে আনতে যাওয়ার কথা ছিলো। এখন তো বের হওয়াই সম্ভব হচ্ছেনা। ও একা আসতে পারেনা। এখনো অপেক্ষা করছে। বুঝোই তো, রাত হয়ে গেছে। ফোন করছি ফোন বন্ধ। তুমি যদি কাছাকাছি থাকো তাহলে ওকে একটু নিয়ে আসতে পারবে বাবা?”

আরশাদ আধখাওয়া সিগারেটটা ড্রেনে ফেলে দিলো। কালো পানির স্রোতে তরতর করে হারিয়ে গেলো জলন্ত ছোট্ট অগ্নিকুন্ডটা। বাইকের উপর রাখা গাঢ় বেগুনী ছাতাটা ভিজে গেছে। এখনো ভিজছে। ভিজেই যাচ্ছে বিগত আধঘন্টা যাবত।
চায়ের দাম মিটিয়ে দিলো আরশাদ। দোকানের ছাউনি থেকে বেরিয়ে হেলমেট পরতে পরতে বললো,” কোন ভার্সিটি আংকেল?”
____________
ইটের পিলারে কাঁধ ঠেকিয়ে শুষ্ক নয়নে মূলফটকের দিকে চেয়ে রয়েছে মুনতাহা। মাঝেমধ্য দমকা বাতাসে লম্বা আচঁল এলোমেলো উড়ে ফের শান্তশিষ্ট বিড়ালছানার মতন গায়ের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। পরিবেশটাই কেমন ঝিঁমানো। তার মতে,এমন ঝড়বৃষ্টির দিনে কাঁথামুড়ি দিয়ে বিছানাজুড়ে সংসার পাতার মতো সুখ বোধহয় এ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। সাথে ফোনছাড়া কিছুই আনেনি। আর তাও এখন নিজের কার্যশক্তির সমাপ্তি ঘোষনা করে নিশ্চিন্তে হাতের মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্থ্যাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জ নেই।
মুনতাহা অযথাই পাওয়ার বাটনে দু’তিনবার চাপ দিলো। নিষ্ফল অনর্থক চেষ্টা। বৃষ্টির গতিক আরো বেড়েছে। সারারাতেও থামবে বলে মনে হয়না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এদিক ওদিক তাকালো সে। এখনো সবাই যায়নি। যদিও ওর ইয়ারের মেয়েরা নেই কিন্তু সিনিয়র ভলেন্টিয়াররা আছে। ওদের যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। ঝড়ে মাঠের প্যান্ডেল ভেঙেচুরে গেছে। সে নিয়েই বোধহয় কোনো সমস্যা হয়েছে। ভেতরের দিকে আলো জ্বলছে
কিন্তু এপাশের বাতি বন্ধ।
মুনতাহা পিলারে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজলো। কানের পিছের চুলগুলো নিরুদ্দেশ উড়ছে। গুঁজে দেয়ার মতো শক্তিটাও পাচ্ছেনা হাত। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা। সবেমাত্র একটুআধটু ঘুম ধরতেই কেউ মুখের উপর কৃত্রিম ওলোট ছুড়ে দিলো। ফ্ল্যাশলাইট। মুনতাহা বিরক্তিতে কপাল কুচকে পিটপিট করলো। মুনতাহাকে তাকাতে দেখে আঙ্গুলের ছোয়ায় লাইট নিভিয়ে দিলো আরশাদ। মুনতাহা তখন পুরোপুরি সজাগ না হলেও বিস্ময়ে সজাগ হতে বেশিক্ষণ লাগলোনা। আরশাদ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে গমগমে ভরাট গলায় মৃদু শাসনের স্বরে বললো,
—“আপনি কোন আক্কেলে এই কোণার মধ্যে দাড়িয়ে আছেন মুনতাহা?”

মুনহাতা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। দেখার চেষ্টা করলো। স্পষ্ট না হলেও, বোঝা যাচ্ছে লোকটা পুরো কাকভেজা। সাদা শার্ট গায়ের সাথে সেঁটে আছে। মনের মতো অদ্ভুত প্রশ্ন জাগলো,”লোকটার কি একটাই শার্ট? যখন দেখে তখনই শুধু সাদা!”
আরশাদ ঝুঁকে হাতের বেগুনী ছাতাটা মুনতাহার পায়ের কাছে পিলারের সাথে ঠেকিয়ে রাখলো। মুনতাহা ত্রস্ত পায়ে একটু সরে গেলো। আরশাদ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে সোজা হলো। বিনা নোটিশে মুনতাহার শাড়ির আচঁল টেনে হাত মুছতে মুছতে বললো,” ভয় পেয়েন না। আপনার আব্বুর পাঠিয়েছে আমাকে। বাসায় পৌছে দিতে বলেছে। আপনি নাকি একা একা যেতে পারেন না।”
মুনতাহা আরশাদের ভাবলেশহীন আচঁল টেনে হাত মোছা দেখে ওপরপাশের কাপড় খামছে ধরলো। চরম অসম্মতিতেও মিনমিন করে করে বললো,
—“আপনি আমার আচঁল দিয়ে হাত মুছছেন কেনো?”

—“দেখতে পাচ্ছেন না ভিজে গেছি? অন্ধ আপনি?”

মুনতাহা আমতা আমতা করলো। প্রত্যুওর করলোনা। আরশাদ তখনো হাত মুছে যাচ্ছে।
আচমকাই হৃদয়কাঁপানো বজ্রপাত হলো। মুনতাহা হুড়মুড় করে একটু ভেতরের দিকে চলে গেলো। আরশাদ পাশাপাশি থাকায় দুরত্ব ঘুঁচলো খানিকটা। বিদ্যুতের আলোয় জবজবে হওয়া আরশাদকে দেখে কেনো যেনো খুব খারাপ লাগলো। শিথিল হলো সে। খামছে ধরা আচঁল ছেড়ে দিলো। মিনমিন করে বললো,”আপনি ছাতা থাকতে এমনে ভিজেছেন কেনো?

—“বাইকের মধ্যে আমার মাথায় ছাতা ধরবে কে মুনতাহা? ওটা আপনার জন্য এনেছি।”

—“ওহ্।”

আরশাদ আচঁল ছাড়লো। পকেট থেকে ফোন বের করলো। পলিথিনে মোড়ানো সত্ত্বেও আংশিক ভিজে গেছে।
আরশাদ যখন ফোনটাও তার আঁচলেই মুছলো মুনতাহার একমূহুর্তের জন্য মনে হলো সে শাড়ির বদলে ঘর মোছার অতি অশোভনীয় ত্যানাটাই গায়ে জড়িয়ে এসেছে। যার কাজ শুধু এবং শুধুই মাত্র মোছামোছি করা।
ঘড়িতে আটটা পাঁচ। আরশাদ মাহতাব সাহেবের নাম্বারে ডায়াল করে মুনতাহার দিকে এগিয়ে দিলো। বললো,

—“আব্বুর সাথে কথা বলুন, টেনশন করছিলেন। আপনাকে ফোনে পায়নি।”

মুনতাহা ফোনটা হাতে নিয়ে মৃদুস্বরে উওর দিলো,
—“চার্জ শেষ হয়ে গেছে।”

মাহতাব সাহেব কল রিসিভ করলেন প্রথমবার রিং হতেই। মুনতাহা কিছু বলার আগেই রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,” আরশাদ পৌঁছেছো? মুন ঠি ক আছে? ওকে পেয়েছো বাবা? ও তিন নাম্বার গেটেই দাড়িয়ে থাকে।”

মুনতাহা একঝলক আরশাদের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে নিমীলিত কন্ঠে বললো,”আমি ঠি ক আছি আব্বু।”

ওপাশের রুদ্ধশ্বাসে চাপা কন্ঠটা সরে গেলো,
—“ও আল্লাহ! আম্মু? আমি সরি মা। বুঝিইনি ঝড় ছেড়ে দিবে। তুই আরশাদের সাথে চলে আয়। ও বাসায় পৌছে দিবে। ভয়ের কিছু নেই।”

মুনতাহা সাথে সাথে প্রশ্ন করলো,
—আমি উনার সাথে কেনো যাবো আব্বু? তুমি না বলেছো কাউকে বিশ্বাস করতে না? উনাকে কেনো করবো?”

মাহতাব সাহেব একটু ভাবলেন। মেয়েকে কি বলবে? শেষমেষ বললেন,”কারণ, আমি বলেছি তাই?”

মুনতাহা মেনে নিলো একবারেই। বললো,”আচ্ছা, ঠি ক আছে।”

আরশাদ আড়চোখে দেখছিলো। বাতাসে ভেজা ভেজা ভাব। মুনতাহার উশৃঙ্খল বেয়াদব চুলগুলোকে ইচ্ছে করছে এক থাপ্পড়ে কানের পিছে গুঁজে দেয়। আঁচলটাকে মনে হচ্ছে টেনে সেফটিপিন দিয়ে কোমড়ের সাথে সিটিয়ে দেয়। কি চরম অসভ্য! উড়েই যাচ্ছে! উড়েই যাচ্ছে!
বাতাসটাকে থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতা থাকলে হয়তো তাও করে দিতো।
মুনতাহা কান থেকে ফোন নামালো । আরশাদের দিকে এগিয়ে দিলো ধীরগতিতে। আরশাদ চোখের পলক ফেললো। মুগ্ধতাটা লুকিয়ে ফেললো যত্ন করে। ফোনটা হাতে নিয়ে না তাকিয়েই বললো,
—“বৃষ্টি একটু কমুক, তারপর যাই।”

মুনতাহা মাথা নাড়ালো শুধু। পরের সময়গুলো খুব অসস্তিময়, জটপাকানো এক একটা সেকেন্ড, এক একটা মূহুর্ত যেনো এক একটা মহাকাল।
বৃষ্টি কমলোনা। বরং বাড়লো আরো। শেষমেষ বৃষ্টি নিয়েই বেরিয়ে পড়লো আরশাদ। মুনতাহার উপর ছাতা ধরে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দাড়ালো। রিকশা নেই। বাইকে যাওয়া সম্ভব না।
মুনতাহা একহাতে বাহুর শার্ট টেনে ধরেছে।
অবিরাম হর্ণের আওয়াজে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো যখন আরশাদ ঠি ক সে সময়েই ডাকলো,

—“মুনতাহা?”

উওর এলো,”হু?”

আরশাদ কন্ঠ খাদে নামিয়ে ধীরগতিতে বললো,
—“আপনি জানেন? বছরে বিশেষ কিছু দিনে আকাশে ‘ব্লাড মুন’ দেখা যায়। বাংলায় বলতে পারেন,’লাল চাঁদ’। রুপালি চাঁদের রংটা সেদিন রক্তিম থাকে।…প্রশংসা কিনা জানিনা তবে আপনাকে এখন, এই মূহুর্তে ঠি ক ব্লাড মুনের মতন লাগছে। লাল চাঁদ।…একটা চাঁদ আমার পাশে দাড়িয়ে আছে। বিশ্বাস হয়?”

~চলবে~

[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কার্টেসী দিয়েও কপি করবেন না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here