#অবাক_মেঘের_বাড়ি
সূচনা পর্ব
সুরমা
-তোমাকে খুব দেখতে মন চাইছে প্রিয়তমা।
-ইশ! সব সময় এতো দেখতে মন চায় কেন? প্রত্যেকদিন দেখতে হয় নাকি? সকালেই তো দেখা হলো।
-সারাদিনে মাত্র একবার দেখেছি। আর আমাদের দেখা হয়েছে দশ ঘণ্টা আগে। আমার তো ইচ্ছে করে তোমাকে সব সময় আমার চোখের সামনে রেখে দেই। তুমি আয়না হলে না কেন প্রিয়তমা। সারাক্ষণ আমার চোখে বেঁধে রাখতাম। তোমার মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করতাম।
-আয়না বানিয়ে ফেললেই তো পারো। না করেছে কে?
-খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করছি। এবার একটু ব্যালকনিতে আসো সোনাটা?
-কেন? তুমি কি এখন আবার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছো নাকি?
-না। তবে তুমি ব্যালকনিতে আসলে আমি তোমায় দেখতে পাবো। আসো। প্লীজ।
-না। আসতে পারবো না। আমি এখন কাজ করছি।
-কি কাজ করছো এই রাত্রি বেলা?
-বলা যাবে না।
-কাজ ফেলে দিয়ে আসো। আমি অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। মশা আমাকে খেয়ে ফেলছে।
-সকালে তো দেখে গেলে। এখন আবার কেন? যাও বাসায় গিয়ে রেস্ট করো। সারাদিন অফিসে কাজ করেছো। এখন নিশ্চয় তুমি ক্লান্ত।
-এমন করো কেন? আমার জন্য একটুকুও কষ্ট হয়না? প্লীজ আসো।
-আমি এখন কিছুতেই তোমার সামনে আসতে পারবো না। প্লীজ প্লীজ প্লীজ। লক্ষ্মীটি। এখন বাসায় যাও।
-আসবে নাতো? আচ্ছা আসতে হবে না তোমাকে। কথাটা বলেই অবাক ফোনটা কেটে দেয়। অনুপমা হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। অবাক রাগ করলো নাতো আবার? ইশ! ছেলেটা এতো পাগলামি করে কেন?
অনুপমা আবার অবাকের নাম্বারে কল করে। কিন্তু অবাক ফোনটা রিসিভ করছে না। অনুপমার মুহূর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। অবাক তার জন্য কষ্ট পেলো। সে এতো ট্রাই করে অবাক যেন কোনদিন তাঁর কোনো কাজে যাতে কষ্ট না পায়। কিন্তু আজকে মনে হলো তাঁর সমস্ত চেষ্টা বিফলে গেলো। অনুপমা মন খারাপ করে বসে থাকে।
অবাক এসে অনুপমার বাসার কলিং বেল বাজায়। দুইবার বাজাতেই প্রিতি এসে দরজা খুলে দেখে দরজার সামনে অবাক ব্যাগ কাধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা শার্ট কালো প্যান্ট। চুল গুলো এলোমেলো। মুখের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে তার উপর দিয়ে ছোট কাটো একটা ঝড় গেছে। প্রতি মুখ বাকিয়ে বলে,
-আবার কি মিস্টার অবাক সাহেব? প্রিতির কথা শোনে অবাক হেসে জবাব দেয়,
-তোদের দেখতে এসেছি।
-মিথ্যা কথা বলো নাতো। যাও, তোমার অনু তাঁর নিজের রুমেই আছে। অবাক হেসে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। প্রিতি দরজা লাগিয়ে চলে যেতে নিলে অবাক বলে,
-পুচকি, আমার উপর রাগ করেছিস? প্রিতি অবাকের দিকে তাকায় বাঁকা চোখে। সে চোয়াল শক্ত করে বলে,
-তোমার সাথে কথা নেই মিস্টার অবাক সাহেব।
-আমি ভুল কিছু করেছি?
-জানি না।
-অভিমান করিস না। বল না কি হয়েছে।
-তুমি সকালে বলে গেলে আমাকে আজ মম খাওয়াতে কাসফিয়াতে নিয়ে যাবে। বাট সারাদিন একটা কলও কর নি। অবাক জিভে কামড় দিয়ে বলে,
-ইস রে! সরি। ভুলে গেছি। এই কান ধরলাম। আর কখনও ভুল হবে না। আসলে অফিসে কাজ ছিল প্রচুর। মাথায় আসেনি তোর কথা।
-থাক আর বলতে হবে না। আপু যদি বলতো তাহলে ঠিক মনে থাকতো। হুম। প্রিতি মুখ বাকিয়ে চলে যায়। অবাক হা করে প্রিতির যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে।
কাজল রেখা নিজের রুম থেকে বের হতেই চোখ যায় ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে থাকা অবাকের উপর। তিনি এগিয়ে আসেন অবাকের কাছে। কাজল রেখা ডাকলেন,
-অবাক। ফুফির ডাক শুনে চমকে তাকায় সে। অবাক নরম কণ্ঠে বলে,
-জ্বি ফুফি?
-তুমি এখন আবার এখানে?
-আ,স,লে ফুফি। অবাক মাথা নিচু করে হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে। কাজল রেখা ভালোই বুঝতে পারছেন অবাক তাঁর বড় মেয়ে অনুর কাছেই এসেছে। তিনি বললেন,
-এভাবে সব সময় দেখা সাক্ষাত ভালো না। আমি জানি তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসো। তবে, ওপেন এতো মিলামেশা কম করবে। অবাক নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাজল রেখা আবার বললেন,
-তোমার মাকে আসতে বলো। তোমার সাথে সব কথা বলা যাবে না। অবাক নম্র কণ্ঠে বলে,
-ঠিক আছে ফুফি।
-বেশিক্ষণ অনুর সাথে আড্ডা দিবে না। দশ বিশ মিনিট কথা বলে তুমি বাসায় যাবে।
-আচ্ছা। অবাক পা বাড়ায় অনুর রুমের দিকে। অনুকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তার সালোয়ার একটু উপরে উঠিয়ে রেখেছে। ওড়না কোমরে গুজে রেখেছে। হাত দুটো দুদিকে মেলে ধরে রুমে পায়চারী করছে। অবাক রুমে ঢুকে অনুর হাত ধরে টান দিয়ে তাকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে অনুর থেকে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়।
অনু চোখ বড় বড় করে দেখছে অবাককে। অনুর এমন চাহনি দেখে অবাক ফিকফিক করে হেসে দেয়। অনু মুখটা কাঁচুমাচু করে তাকায় অবাকের দিকে। অবাক হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। অনু মুখটা অসহায় করে বলে,
-তুমি এভাবে হাসছো কেন? অবাক অনেক চেষ্টার পর নিজের হাসিটা আটকে বলে,
-তুমি এমন সং সেজেছো কেন? মাথায় কি দিয়েছো?
-ইশ! কি বলে। মাথায় প্যাক লাগিয়েছি। আর তুমি চলে আসলে বাসায়?
– কেউ যদি একটু ব্যালকনিতে যেতে না পারে তাহলেতো বাসায় আসতেই হবে। আর তুমি এই রাত্রি বেলায় মাথায় এসব দিছো কেন? ঠাণ্ডা লাগবে না?
-উঁহু।
-হাতে কি? এদিকে আসো দেকি কি দিয়েছো। অবাক অনুর হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলে,
-তুমি হাতে সব সময় এতো মেহেদি লাগাও কেন?
-ভালো লাগে।
-পাগলি, এই রাতের বেলায় এসব কি করছো। এই জন্য আমার সামনে আসতে চাও নি?? অনু মাথা নিচু করে বলে,
-হুম।
-এভাবে তোমাকে আরো মায়াবতী লাগছে। তোমাকে যেভাবেই দেখি স্বর্গের পরীর মতো লাগে। অবাকের কথা শোনে অনু লজ্জায় নেতিয়ে যায়। অবাক অনুকে টেনে নিজের কাছে এনে বলে,
-আর লজ্জা পেতে হবে না লজ্জাবতী ললনা। অবাক অনুর থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে জিজ্ঞেস করে,
-মুখটা এমন শুকনা লাগছে কেন? খাও নি কিছু? অনু মাথা নাড়িয়ে না বলে। অবাক বিস্ময় নিয়ে বলে,
-এখনো খাওনি কেন? রাত নয়টা বাজে। অনু তার দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-দেখোনা হাতে মেহেদি পরেছি। খাবো কিভাবে? অবাক অনুর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,,
-হুম। বুঝলাম।ঠিক আছে তুমি বসো। আমি আসছি। অনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই অবাক রুম থেকে বের হয়ে যায়। অনু গিয়ে বসে বিছানায়। আর একা একাই বলে, ‘ সাহেব আমাকে সব সময় কিসব বলে। প্রথম বলেছে সং। এখন আবার বলে মায়াবতী। ঢং।’
অবাক ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে প্রিতি ভাত খাচ্ছে আর রিমি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। অবাক বলে,
-ভাবীজান। তোমার ননদীর খাবারটা দাওতো। রিমি অবাকের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
-দেবরজি যে। কখন আসলে?
-কিছুক্ষণ আগে।
-ইশরে। আমার দেবরটার কতো কষ্ট । প্রতিদিন একবার হলেও এ বাড়িতে এসে চক্কর দিয়ে যায়। তা দেবরজি, এতো কষ্ট না করে আমার ননদীকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেই তো পারো।
-হুম। নিবো। এখন অনুর খাবারটা একটা প্লেটে দাও। আমি ওর রুমে দিয়ে আসি।
-কেন? অনু নিচে আসতে পারছে না?
-ওর মাথায় প্যাক লাগিয়েছে। অবাকের কথা শুনে প্রিতি বলে,
-আল্লাহ মানুষ মানুষের কতো খেয়াল রাখে। আর আমি সারাদিন না খেলেও কেউ বলে না। অবাক প্রিতির মাথায় ঠুকা দিয়ে বলে,
-আপনি কখনও না খেয়ে থাকেন না ম্যাডাম। একবারের জায়গায় দু তিন করে খান এটা সবাই জানে। প্রিতি খাবারটা রেখে রাগি স্বরে বলে,
-তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমি পেটুক??? প্রিতি নাক ফুলিয়ে তাকায় অবাকের দিকে। অবাক একটা হাসি দিয়ে বলে,
-আল্লাহ! আমি তোকে কখনও পেটুক বলতে পারি বল? তুই আমার মিষ্টি বোনটি। এই নে। আরো খা। কতো শুকিয়ে গেছিস। অবাক বাটি থেকে একটা বড় মাছের পেটি প্রিতির প্লেটে তুলে দেয়।
প্রিতি চোখ বড় বড় করে তাকায়। রিমি একটা প্লেটে খাবার দিয়ে অবাকের দিকে এগিয়ে বলে,
-এই নাও তোমার বউয়ের খাবার। অবাক হাসি দিয়ে খাবারটা নিয়ে অনুর রুমে চলে যায়। প্রিতি রিমির দিকে চেয়ে বলে,
-আচ্ছা ভাবী তোমারও কি মনে হয় আমি বেশি খাই?
-একদমেই না ছোট ননদিনী। তবে এখন থেকে একটু বেশি করে খেয়ো। কেমন শুকিয়ে যাচ্ছো তুমি। কথাটা বলেই সে এখান থেকে কেটে পড়ে। আর প্রিতি কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে খেতে শুরু করে। আর একা একা বলে,
-আমাকে কেউ ভালোবাসে না। কেউনা। আজকে আমারও যদি একটা জামাই থাকতো তাহলে আমাকে কেউ এভাবে বলতে পারতো না।
অবাক খাবার নিয়ে গিয়ে দেখে অনু বিছানার উপর পা ভাজ করে বসে আছে। অবাক গিয়ে বসে অনুর পাশে। অনু অবাকের হাতে খাবারের প্লেট দেখে বলে,
– একি। তুমি এখানে খাবার নিয়ে এসেছো কেন?
– তুমি এখন খাবে তাই।
– আমি গোসল করে খেয়ে নিবো তুমি চিন্তা করো না।
– এহ। আসছে চিন্তা না করতে। গাধী। দেখেছো শরীরের অবস্থা? এতো চিকন থাকলে চলবে? তুমি ঠিক সময় খাওনা বলেই এরকম অবস্থা তোমার।
– বলেছে তোমাকে। আমি ঠিক মতই খাই। আর আমি যথেষ্ট মোটা। আরো মোটা হলে আমাকে মটু লাগবে। দেখতে খারাপ লাগবে।
– তুমি যতটা পারো মোটা হও। আমার তো কোনো সমস্যা নাই। অবাক খাবার মেখে অনুর মুখের সামনে নিয়ে বলে,
– হা করো।
– আমি পরে খাবো বলছি তো।
– আমি বললাম না হা করতে? অনু বাচ্চাদের মতো মুখটা করে হা করে। অবাক অনুর এমন মুখ দেখে হেসে বলে,
– পাগলি একটা। এমন করছো কেন? অনুর চোখ জলজল করছে। সে ধরা গলায় বলে,
– আমি মোটা হয়ে গেলে আমাকে তোমার সাথে মানাবে না। দুজনকে একসাথে পঁচা লাগবে। লোকজন আমাদের দেখে বলবে এই এতো হেন্ডসাম ছেলেটার কপালে কি জুটলো। তখন তোমার খারাপ লাগবে।
– আমার খারাপ লাগবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি অনু। তোমার রূপ না। তাছাড়া তুমি দেখতে খারাপ না। স্বর্গের হুরপরীর মতো তুমি। অপ্সরী। অনু নিজের মেহেদি রাঙা হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
– শোনেছি প্রেম করলে নাকি একজন আর একজনের হাচ্চুটাকেও সুন্দর বলে। অনুর এমন কথা শোনে অবাক হো হো করে হাসতে থাকে। তার হাসি কিছুতেই থামছে না। অনু তাকিয়ে আছে অবাকের মুখের দিকে।
আর মনে মনে বলছে, ‘ আল্লাহ! ছেলেদের হাসি এতো সুন্দর কেন? যে হাসি দেখে হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়। অবাক, তুমি এতো সুন্দর কেন? এতো ভালো কেন? কেন আমাকে এতো ভালোবাসো? আমি যে সারাক্ষণ তোমাতে বিভোর হয়ে থাকি। তুমি হীনা বেঁচে থাকা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে প্রিয়তমেষু।’
অবাক ভাত মেখে অনুকে খাইয়ে দিতে থাকে। অনু একদম বাচ্চাদের মতো করে বসে খায়। অনু বলে,
-অবাক,
-হুম,
-তুমি খাবে না? অবাক অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে অনু তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অবাক মুচকি হেসে বলে,
-আম্মা আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকবে। আমি বাসায় গিয়ে খাবো।
-আমার সাথে একটু খাও। অবাক হেসে বলে,
-তাহলে আমাকে খাইয়ে দাও। অনু তাকায় কাঁচুমাচু হয়ে। সে নিজের মেহেদি মাখা হাতের দিকে চেয়ে থাকে। অবাক দেখছে অনু কি করে। অনু মুখটা কালো করে আবার একটা হাসি দিয়ে বলে,
-দাঁড়াও হাত দুটো ধুয়ে আসি। অনু উঠতে গেলে অবাক নিজের বাম হাত দিয়ে অনুর এক হাত ধরে বলে,
-আরে পাগলি। ধুতে হবে না। আমি খাবো না।
-তুমি মাত্রই তো বললে খাইয়ে দিতে।
-এমনি বলেছি। আম্মা বসে থাকবে। এখানে খেয়ে গেলে বাসায় আর খেতে পারবো না। অনু নিজের ঠোঁট ভাঙ্গে। অবাক বলে,
-তোমাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয় পাখিটা। অনু মুখে ভাত নিয়ে বলে,
-কেন? আমি কি করেছি?
-কিছু করনি। বাট নিজের যত্ন নিচ্ছ না। এভাবে থাকলে চলবে না।
-আমি ভালোই আছি।
-হুম। তাতো দেখতেই পাচ্ছি। অনুর খাওয়া শেষ হলে অবাক অনুকে পানি খাইয়ে দিয়ে বলে,
-আমি এখন আসি। বাসায় যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। অবাক বিছানা থেকে উঠতে নিলে অনু উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,
-তুমি আমায় অনেক ভালোবাসো। তাই না অবাক? অনুর কথা শোনে অবাক আবার বিছানায় বসে বলে,
-সন্দেহ আছে?
-না। আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি অবাক। আমাকে কখনও দূরে সরিয়ে দিও না। তোমাকে ছাড়া যে আমি মরেই যাবো। অনু হাত মেলে অবাককে জড়িয়ে ধরতে নিলে অবাক বাঁধা দিয়ে অনুর হাতের দিকে ইশারা দিয়ে বলে,
-উঁহু। হাতে মেহেদি। আর আমার সাদা শার্ট। অনুর মনটা খারাপ হয়। সে আবার বিছানায় বসে। কিন্তু মুখটা কালো করে রাখে। অবাক অনুর বিষয়টা বুঝতে পেরে অনুকে জড়িয়ে ধরে। অনুও খুশি হয়। কিন্তু অনু অবাককে আঁকড়ে ধরতে পারছে না। সে হাত দুটো পাখির পাখনার মতো মেলে রাখে। যাতে অবাকের শার্টে মেহেদি না লাগে।
অবাক নিচে এসে দেখে প্রিতি টিভি দেখছে। রিমিও তার পাশে বসে আছে। অবাক বলে,
– ভাবি আসি। অবাকের কথা শুনে প্রিতি রিমি দুজনেই অবাকের দিকে তাকায়। প্রিতি বলে,
– চলে যাচ্ছ কেন? থেকে যাও। কাল তো আবার কষ্ট করে আসতেই হবে। প্রিতির কথা শুনে রিমি মিটমিট হাসে। অবাক বলে,
– তোদের বাসায় তো থাকার এক্সট্রা রুম নেই। থাকবো কোথায়? নাহলে থেকেই যেতাম।
– কেন? তুমি তোমার অনুর রুমে থাকবে। অবাক চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– তাহলে তুই কোথায় থাকবি?
– আমি না হয় কোথাও একটা থাকবো। অবাক এগিয়ে গিয়ে প্রিতির বেণী ধরে টান দিয়ে বলে,
– খুব পাকনা হয়েছিস না? প্রিতি আর্তনাদ করে বলে,
– ছাড়ো তো লাগছে। অবাক প্রিতির চুল ছেড়ে দিলে প্রিতি আবার বলে,
– আল্লাহ কত রকম প্রেম দেখবো। যারা পায় তারা ড্রাম ভর্তি প্রেম পায়। যারা পায় না তারা এক চিমটিও পায় না। এ কেমন বিচার তোমার। অবাক রিমি দুজনেই হেসে দেয়। প্রিতি মুখে বেংচি কাটে। অবাক বলে,
– কাল ঝগড়া করবো। তোর জন্য এক চিমটি ভালোবাসা আনার চেষ্টা করবো। আজ আসি। আম্মা কল করতেছে।
– আম্মারে ফোনে বলো আম্মা আমি বউ রেখে আসতে পারছি না। অবাক হাসে। কি সব কথা বলে মেয়েটা।
বিলকিস বেগম নিজের রুমে ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। ঘড়িতে রাত ১১.২২। এখনও ছেলে আসার নাম নেই। মাঝে মাঝেই ছেলে এমন রাত করে বাসায় ফিরে। জীবনে অনেক যুদ্ধ সংগ্রাম করে ছেলেকে বড় করেছেন তিনি।
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। ছেলের বয়সও কম হয়নি। এখন বিয়ে নিয়ে চিন্তা করতে হবে। নাহলে ছেলেটা ছন্নছাড়া হয়ে যাবে। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আরাম করে চেয়ারে হেলান দিলেন। কাজের মেয়ে বিন্তি ডাক দিলে তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে বলেন,
– কি হয়েছে?
– আম্মা অনেক রাত হয়েছে। আপনে খেয়ে ফেলেন।
– অবাক এসেছে?
– না আম্মা। ভাইজান এখনো আসেনি। বাসায় আসলে তো আপনের রুমেই আগে আইতো।
– তা ঠিক। আচ্ছা তুই যা। খেয়ে শুয়ে পড় গিয়ে।
– আপনে খাবেন না আম্মা??
– অবাক আসলে একসাথে খাবো।
– ভাইজান কোন সময় আহে ঠিক নাই। আপনের তো ওষুধ খেতে হবে। নইলে শরীর খারাপ করবে।
বিলকিস বেগম চুপ করে আবার চোখ বন্ধ করলেন। বিন্তি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।
অবাক বাসায় আসে রাত ১২টার দিকে। কলিংবেল বাজালে বিন্তি দরজা খুলে দেয়। অবাক বলে,
-আম্মা কোথায়?
-আম্মাজান নিজের রুমে।
-আম্মা খেয়েছে?
-না ভাইজান। আম্মাজান খায় নাই। কতবার বললাম ভাত খেয়ে ওষুধটা খেয়ে নিতে। কিন্তু আম্মায় বলে আপনে আইলে এক সাথে খাইবো। অবাক ড্রয়িংরুমে সোফার উপর ব্যাগটা রেখে মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
মায়ের রুমে গিয়ে দেখে বিলকিস বেগম চোখ বন্ধ করে আছেন। অবাক মায়ের সামনে হাটু গেড়ে বসে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে আলতো করে ডাক দেয়।
-আম্মা। ছেলের কথা শোনে বিলকিস বেগম চোখ মেলে তাকান। চোখটা লেগেই গেছিল। তিনি অবাক কে সামনে দেখে সোজা হয়ে বসে বলেন,
-চলে এসেছিস?
-তুমি খাওনি কেন এখনো? তোমার না রাতে ওষুধ আছে।
-তোকে রেখে কখনও খেয়েছি বল? বিলকিস বেগম অবাকের চুলে হাত দিলেন। অবাক অপরাধী কণ্ঠে বললো,
-মাফ করো আম্মা। দেরি করে ফেলেছি। তুমি বসো আমি তোমার খাবার নিয়ে আসি। অবাক উঠতে গেলে বিলকিস বেগম বলেন,
-খাবার রুমে আনতে হবে না। আমি ডাইনিং রুমে যাচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে আয় এক সাথে খাবো। অবাক কথা বাড়ালো না। সে সোজা নিজের রুমে চলে আসে। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে এসে দেখে বিলকিস বেগম টেবিলে বসে আছেন।
অবাক গিয়ে বসে মায়ের পাশের চেয়ারটায়। বিলকিস বেগম বলেন,
-অফিসে কি কাজের চাপ বেশি? এতো লেট হলো যে???
-আসলে আম্মা আমি অফিস থেকে বের হয়ে একটা কাজে গেছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেছে। রাস্তায় জ্যামও ছিল প্রচুর।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
অবাক ডিনার শেষ করে নিজের রুমে আসে। রুমে এসেই শুনতে পায় তার মোবাইল বাজছে। অবাক বুঝতে পারছে অনু কল করছে। এই সময় অনু ছাড়া তাকে কল দেওয়ার মতো কেউ নাই। অবাক ফোনটা হাতে নিয়ে একটা হাসি দিয়ে কলটা রিসিভ করে। ফোনের ওপাশ থেকে অনু বলে,
-বাসায় কখন পৌঁছেছো?
-১২টার দিকে।
-একটা কল করে তো বলও নি।
-সরি সোনা পাখি। বাসায় এসে দেখে আম্মা না খেয়ে বসে আছে। তাই ফ্রেশ হয়ে আম্মাকে নিয়ে ডিনার করেছি। মাত্রই ডিনার শেষ করে রুমে এসেছি। আম্মার রাতে ওষুধ আছে। ঠিক মতো ওষুধ না খেলে অসুস্থ হয়ে যায়।
-অহ। আচ্ছা ঠিক আছে।
-কি করছো এতো রাতে? ঘুমাও নি কেন?
-তোমার কথা মনে পড়ছিল। ভেবেছিলাম তুমি বাসায় পৌঁছো কল দিবে। আমি তোমার সাথে কথা বলবো।
-আচ্ছা এখন ঘুমাও। সকালে কথা বলবো। বেশি রাত জাগলে চোখের নিচে কালি পড়বে। তখন আমার জানপাখিটাকে দেখতে খারাপ লাগবে। অবাকের কথা শুনে অনু অভিমানী কণ্ঠে বলে,
-আমার সুন্দর্য যদি নষ্ট হয়ে যায় তখন বুঝি তুমি আমায় আর ভালোবাসবে না?
-ভালোবাসবো না কেন? তোমাকে জনম জনম ভালোবাসতে চাই। শুধু এই জনম নয়। এর পরও যদি কোনো জনম থাকে সেই জনমেও আমি তোমাকে চাই প্রিয়তমা।
একজন যেন আর একজনের জন্য বেঁচে থাকি যতদিন বেঁচে থাকি এই পৃথিবীতে। আর অনু, আমি আগেও বলেছি। আমি তোমার রূপ নয়, তোমাকে ভালোবাসি। আর চোখের নিজে কালি পড়লে তুমি নিজেই আমার কাছে এসে কান্না করবে আর বলবে,
‘অবাক দেখো আমার চোখের নিচে কালি পড়েছে। আমাকে বিশ্রী দেখা যাচ্ছে। অবাক হাসে। অনু বলে,
-বলবো না। আমি এখন তোমার সাথেই কথা বলবো। আজ সারা রাত দুজন কথা বলবো। অবাক হেসে বলে,
-পাগলি একটা। সারা রাত কি কথা বলবে? অবাক রুম থেকে বের হয়ে ব্যালকনিতে আসে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
-অনু ব্যালকনিতে আসো। অনু চমকে উঠে। সে শুয়ে অবাকের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছিল। অবাকের কথা শুনে সে লাফ দিয়ে উঠে বসে। একটু উচ্চস্বরে আনন্দিত কণ্ঠে বলে,
-তুমি কি আবার আমাদের বাসার সামনে চলে আসলে নাকি? অনুর কথা শুনে অবাক শব্দ করে হেসে দেয়। অনু মুখটা কাঁচুমাচু করে বাচ্চাদের মতো বলে,
-হাসছো কেন?
-মাত্রই তো আসলাম তোমার কাছ থেকে। এখন আবার কি উড়ে চলে আসলাম নাকি। অনু আহ্লাদ নিয়ে বলে,
-তাহলে ব্যালকনিতে আসতে বললে কেন?
-আরে পাগলি ব্যালকনিতে গিয়ে দেখো আজ আকাশটা কি সুন্দর। কি স্নিগ্ধ রাত। কতো বড় একটা চাঁদ আকাশের বুকে। বাহিরে হিমহিম শীতল বাতাস। আজ রাতটা প্রেমময়। অনু উঠে নিঃশব্দে ব্যালকনির দরজা খুলে। রুমে প্রিতি ঘুমিয়ে আছি। তার ঘুম খুব পাতলা। অল্প শব্দে হুট করে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন রাগে কটমট করতে থাকে। অনু চুপ। অবাক আবার বলে,
-অনু,
-হুম
-ব্যালকনিতে এসেছো?
-হুম
-ভালো লাগছে না? অনু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
– প্রেমময় রাত প্রিয়তমেষু হীনা কিভাবে ভালো লাগে বলতো? দুজন এক সাথে হাতে হাত রেখে মাঠে ঘাসের উপর জোছনা বিলাস করতে পারলে আজকের রাতটা সার্থক হতো। রাত নিজেও গর্বিত হতো। অবাক শীতল কণ্ঠে বলে,
– সেই রাতটা আসতে বেশি দেরি নেই। তুমি নীল শাড়ি পরবে। আর আমি সাদা পাঞ্জাবি। তোমার পায়ে পায়েল, হাতে এক ঝাক কাচের চুড়ি। যখন দুজন দুজনের আঙ্গুলের ভাজে আঙ্গুল রেখে হাঁটবো তখন রিমঝিম শব্দ হবে।
মৃদু বাতাসে তোমার খোলা চুল উড়বে। আর আমি চেয়ে থাকবো তোমার পানে। জোছনার আলোয় তোমার মুখটা মায়ায় ভরপুর হবে। আমি হারিয়ে যাবো তোমাতে। এমনভাবে আমরা প্রত্যেকটা চাঁদনী রাতে জোছনা বিলাস করবো। অবাক একাই কথা বলছে।
অনুর চোখে ঘুম জড়ো হয়েছে। সে ব্যালকনির ডিবানে ঝিমিয়ে যাচ্ছে। অবাক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ফোনে অনুর ভারী নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে। অবাক আদুরে কণ্ঠে ডাক দেয়,
– অনু
– হুম।
– এখন তুমি রুমে গিয়ে বিছানায় শোও।
– বলো না শোনতে ভালো লাগছে।
– তুমি ঘুমিয়ে যাচ্ছ।
– ঘুমাবো না। বলো।
– কাল বলবো। আজ তো অনেক রাত হয়েছে। যাও গিয়ে ঘুমাও। আমার কাল অনেক কাজ আছে। অনু ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে,
– ওকে। অবাক হেসে বলে,
– রুমে গিয়ে কিন্তু ঘুমাবে। এখানেই ঘুমিয়ে যেয়ো না।
– হুম।
– শুভ রাত্রি মাই সোল।
– হুম।
চলবে————–