#অবাক_মেঘের_বাড়ি
পর্ব : ২৪
সুরমা
চারজন পশ্চিম বীচে গিয়ে বসে। দক্ষিণ পশ্চিমের সুন্দর্য মানুষকে মোহিত করে। অনেক লোকজন দল বেঁধে বসেছে সেখানে। জমিয়েছে গানের আসর। প্রমি জিজ্ঞেস করে,
– মেঘ তুমি গান পারো? মেঘ অবাকের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
– ভালো পারি না। একটু একটু পারি। প্রমি বলে,
– আমি আর সাকিল মাঝে মাঝে গান গাই। আমরাও তেমন পারি না। একটু একটু পারি। তবুও যেদিন বৃষ্টি হয় আর আমি আর সাকিল দুজনেই বাসায় থাকি সেদিন দুজন এক সাথে গান গাই। বৃষ্টি মানেই রোমাঞ্চকর একটা পরিবেশ। আর সাথে প্রিয় মানুষের সাথে গান হলে প্রেম জমে খির। ঠিক বলছি না মেঘ? মেঘ জোরপূর্বক হাসে। অবাক মেঘের দিকে আড়চোখে তাকায়। প্রমি অবাকের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ভাইয়া আপনি গান গাইতে পারেন? অবাক নিঃসঙ্কোচে উত্তর দেয়।
– পারি। গান গাইতে আমার ভালো লাগে।
– তাহলে তো হয়েই গেলো। চলুন আমরাও গানের আসর বসাই। স্নিগ্ধ পরিবেশে মনোমুগ্ধকর গান। হেব্বি কাটবে বিকেলটা। আমার আবার গান শুনতে খুব ভালো লাগে। চারজন একসাথে বসে মুখোমুখি। প্রমি আবার বলে,
– আমরা জুটি বেঁধে গান গাইবো। আমি আর সাকিল গাইবো। আপনি আর মেঘ। অবাক মেঘ দুজনেই একে অপরের দিকে তাকায়। মেঘ বলে,
– না না। আমি এতো ভালো গান পারি না। উনি ভালো গান গায়। আমি সাথে সুর দিলে গানের মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। উনি একাই গান গায়বে। উনার গান খুব ভালো হয়। তোমরা দুজন আগে গাও। আমরা শুনি। সাকিল বলে,
– আচ্ছা যেমন তোমার ইচ্ছে। তবে আমরাই আগে গাই। সাকিল আর প্রমি গান সিলেক্ট করে। দুজন একসাথে গান গায়। মেঘ আলাদা একটা গানের কয়েকটা কলি গায়। তার কিছুতেই গান গাইতে ইচ্ছে করছে না। সাকিল আর প্রমি কি সুন্দর করে এস সাথে গান গাইলো। অবাক একবারও বললো না চলো আমরাও এক সাথে গান গাই। অবাক গান গায়
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
তোমায় পেয়ে হয় যে মনে
আর জনমেও সাথে ছিলাম
আমরা দুজন মনের সুখে
অনেক জনম ঘুরে এলাম
চিরদিনই থাকবে একই
আমাদের এই ভালবাসা
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
তুমি আমার অনেক আপন
মেনে নিয়েও বলে এমন
হওনা তুমি আরো কাছে
হওনা তুমি আরো আপন
এক সাগরে মিলবো বলে
তোমার আমার স্রোতে ভাষা।
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি
আজকে আমার প্রাণ পেয়েছে
অনেক নতুন ভাষা
অনেক দিনের স্বপ্ন যে
অনেক দিনের আশা
বলছি তোমার কানে কানে আমার তুমি
বলছি আমার গানে গানে আমার তুমি।।
অবাকের গান মেঘ তন্ময় হয়ে শুনছে। তার মনে হচ্ছে অবাকের গানটা তার জন্যই নিবেদিত। সে আগেও একবার অবাকের কণ্ঠে গান শুনেছে। তখন কণ্ঠে এতো মুগ্ধকর ছিল না। মেঘ কল্পনাও করতে পারে নি অবাকের কণ্ঠ এতো মধুর। তার মনে হচ্ছিল অবাকের কণ্ঠ থেকে মুক্তা ঝরে পড়ছে। মেঘ আর মেঘের মধ্যে নাই।
সে অবাকের কণ্ঠে ডুবে গেছে। গান শেষ হলে সাকিল প্রমি দুজন হাত তালি দেয়। কিন্তু মেঘ তখনও গালে হাত দিয়ে অবাকের দিকে তাকিয়েই রয়েছে। অবাক বিষয়টা খেয়াল করলে তার একটু অস্বস্তি লাগছিল। অবাক একটু নড়েচড়ে বসলো। কিন্তু এতে মেঘের কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেলো না। একটু পরে এই বিষয়টা প্রমি লক্ষ করলো। প্রমি মেঘকে হাল্কা ঝাকালে মেঘ চমকে উঠে।
-কি হয়েছে?
-কখন থেকে এভাবে চেয়ে কি দেখছো? কোনো কথা বলছো না কেন?
-না এমনি। আমি গান শুনছিলাম।
-গানতো সেই কখন শেষ হলো।
-ওহ! গানটা এতো মিষ্টি ছিল। কি বলবো আমার খুব মজা লাগছিল। বুঝতেই পারি নি কখন গান শেষ হয়ে গেছে। প্রমি বিস্মিত হয়। সাকিল চোখ টিপে বলে,
– তাই নাকি? এতো মজা লাগছিল?কেমনে বুঝলে গানটা মিষ্টি? আমাকে বলো আর একবার আমিও দেখবো।
-খেয়ে দেখেছি। প্রমি সাকিল দুজনেই মেঘের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। সাকিল বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
-গান আবার খাওয়া যায় নাকি?
-কেন খাওয়া যাবে না। মানুষ বাতাস যদি খেতে পারে তাহলে গান কেন খাওয়া যাবে না?
-বাতাস কেউ খায় না। উপভোগ করে তৃপ্তি পায়।
-তাহলে আমার ভাষায় সেই তৃপ্তিটাই খাওয়া। যা পেট আর মন দুটোই ভরে যায়। এবার সবাই চুপ করে যায়। অবাক অপলকে মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখে মেঘ মাথাটা নিচে দিয়ে বসে আছে। মেয়েটাকে সে যতটা ছোট মনে করে মেয়েটা মোটেও ততটা ছোট না।তবে কিছুটা বাচ্চা বাচ্চা স্বভাব এখনও আছে এটা ঠিক। অবাক নিরবতা ভেঙ্গে বললো,
-এবার চলো রিসোর্টে যাওয়া যাক। অনেক আড্ডা হয়েছে। রাতে আমরা বার্বিকিউ পার্টি করবো। প্রমি বলে,
-হু চলুন।
অনুর ঝাড়বাতি বানানো শেষ। এখন ঝাড়বাতিতে লাইট লাগাচ্ছে। প্রিতি এসে দেখে ঝাড়বাতি কমপ্লিট। প্রিতি বলে,
-ওয়াও! ঝাড়বাতিটা তো খুব সুন্দর হয়েছে। এখন এই ঝাড়টা কোথায় লাগাবি? অনু প্রিতির দিকে না তাকিয়েই বলে,
-ড্রয়িংরুমে।
-আমাদের ড্রয়িংরুমে?
-তা নয়তো কার ড্রয়িংরুমে?
-তোর শ্বশুর বাড়িতেও একটা সুন্দর ড্রয়িংরুম আছে। সেখানেও তো লাগাতে পারিস। অনু চোখ তুলে তাকায় প্রিতির দিকে। প্রিতি আবার বলে,
-কষ্ট করে বানিয়েছিস। ইচ্ছে হতেই পারে নিজে যেখানে থাকবি সেখানে লাগাতে। তাই বললাম। অনু কিছু না বলে কাজ করতে থাকে। প্রিতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
-যাই হোক। আমি একটা কাজে এসেছি। আমার উপর গুরু দায়িত্ব পড়েছে।
-কি কাজ?
-যাদের ইনভাইট করা হবে তাদের লিস্ট তৈরি করা। তুই কাকে কাকে ইনভাইট করতে চাস? নাম বল। আমি কার্ড পাঠিয়ে দিবো।
-আমার তো ইনভাইট করার মতো তেমন কেউ নেই।
-তোর বান্ধবীদের? অনু চুপ করে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
-আচ্ছা কয়েকটা কার্ড আমার হাতে দিয়ে দিস। আমি নিজেই দিয়ে দিবো।
-ওকে ডিয়ার। প্রিতি রুম থেকে বের হয়ে যায়। অনুর মোবাইলের রিংটোন টা বেজে উঠে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার। রিসিভ করবে কি করবে না ভাবতে থাকে। সাথে সাথেই কলটা কলটা কেটে যায়। অনু ফোনটা বিছানায় রাখতেই আবার কল আসে। অনু কলটা রিসিভ করে।
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম
-ওয়ালাইকুম সালাম
-কে বলছেন?
-আমি ইমন
-আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?
-তোমার নাম্বার পাওয়াকি খুব কঠিন কাজ? অনু চুপ করে থাকে। সত্যি তো। তার নাম্বার তো পাওয়া ইমনের জন্য খুবই সহজ। ইমন জিজ্ঞেস করে,
-কল দিয়ে ডিস্টার্ব করলাম? এবারও অনু চুপ। ইমন বলে,
-চুপ করে থাকলেতো কিছুই বুঝতে পারবো না। কিছুতো বলতে পারো। অনু শীতল কণ্ঠে বলে,
-বলুন কি বলার জন্য কল করেছেন।
-আমি ফোন করে কি তোমাকে সমস্যায় ফেলে দিলাম?
-না
-তাহলে কল রিসিভ করছিলে না কেন?
-কাজ করছিলাম।
-আচ্ছা তাহলে কাজ করো। পরে কল দিবো।
-আপনি কি বলার জন্য কল দিছেন বলুন। আমি শুনছি।
-তোমার কেন মনে হলো আমি প্রয়োজনে কল করেছি? প্রয়োজন ছাড়া কি কল করতে পারি না? অনু আমতাআমতা করে বলে,
-না মানে এমনি মনে হলো।
-তুমি অনেক বুদ্ধিমতী। আর আমার যা মনে হচ্ছে আমার সাথে কথা বলতে তুমি অস্বস্তি বোধ করছো। যাক, কাজের কথা বলি। আম্মা কাল বিয়ের মার্কেটে যাবে । উনারা চাইছেন তুমি নিজেই নিজের জন্য সব কিছু চয়েজ করো। তাই কল দিয়েছি। যাতে কাল তুমিও আমাদের সাথে চলো। আপুও যাবে।
-আমার যেতে হবে না। আপনারা নিজের মতো পছন্দ করুণ। আমার অপছন্দ হবে না।
-আমরা সবাই জানি তুমি অপছন্দ করবে না। তবে তুমি সঙ্গে গেলে আম্মা খুশি হবে। অনু আনমনে বলে,
-আমার কাজেই এখন সবাইকে খুশি করা। ইমন উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-কি বলছো? আমরা কেউ তোমার উপর জোর কাটাচ্ছি না। কোন কাজ তোমার মন বিরুদ্ধ হলে করো না। জোর করে মনকে কষ্ট দেওয়ার মানেই হয়না। আর প্রত্যেকটা মেয়ের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। বিয়ে নিয়ে প্ল্যান থাকে। আমি চাইছিলাম তোমার সেই স্বপ্নটা পূরণ হোক। তাই তোমাকে যেতে বলেছি। অনু চমকে উঠে। সে নিজেও বুঝতে পারেনি কি বলে ফেলেছে। ইমনকে এসব বলে কি লাভ? ইমনতো তার পরিস্থিতির জন্য দায়ী না। অনু অপরাধী কণ্ঠে বলে,
-সরি। আসলে কি বলতে কি বলে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। কাল আমি আপনাদের সাথে যাবো।
-ঠিক আছে। ভালো থাকো। অনু বলে,
-একটা কথা বলার ছিল।
-বলো
-আমার সঙ্গে প্রিতিকে নিলে কি আপনাদের কোনো সমস্যা হবে?
-না না। সমস্যা নাই। তোমার যাকে ইচ্ছে হয় সঙ্গে নিও।
-থ্যাংকস।
-হুম। রাখি। আল্লাহ হাফেজ।
-আল্লাহ হাফেজ।
অবাক আর মেঘ রিসোর্টে ফিরে আসে। রাতে বারবিকিউ পার্টি আছে। অবাক মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– কিছুক্ষণ রেস্ট করো। একটু পর বের হবো। অবাক ওয়াশরুমে ঢুকে। মেঘ বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে। তার আজ খুব ভালো লাগছে। অবাক তাকে ভালোবাসে। এর থেকে সুখময় মুহূর্ত আর হয়না। এখন তো অবাককে মনের কথাটা বলায় যায়। মুখ ফুটে না বললে কেউ বুঝতেও চায় না। অবাক বাবুর কাছে বলতে হবে হবে। মেঘ ভাবনায় ডুবে।
অবাক শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। আজকেও অবাক গা খালি। অবাকের নগ্ন শরীর দেখে মেঘের সারা শরীরে কাঁপুনি তৈরি হয়। মেঘ উঠে অবাকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অবাক ভ্রু নাচায়। মেঘ এক ঝটকায় অবাককে জড়িয়ে ধরে। অবাক কল্পনাও করেনি মেঘ এমন একটা কাজ করবে। অবাক হতভম্ব হয়ে দাঁড়ায়। অবাকের নগ্ন বুকে মেঘ নাক ডুবায়। মেঘের গোলাপি ঠোঁট আলতো করে কয়েকবার অবাকের বুকে লাগায়। অবাকের সারা শরীর শিরশির করে উঠে। সে শীতল হয়ে যায়। মেঘ অবাকে বুক আঁকড়ে ধরে বলে,
– আই লাভ ইউ অবাক বাবু। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। অবাক স্থির হয়ে যায়। মেঘ অবাককে শক্ত করে ধরে বলে,
– আমাকে একটু ভালোবাসুন না অবাক বাবু । আমাকে একটু ভালোবাসুন। আমি আপনাকে আপন করে পেতে চাই। সাকিল ভাইয়া প্রমি আপুকে কতটা ভালোবাসে। ওদের এতো ভালোবাসা দেখে আমার কষ্ট হয়। আমার কান্না পায়। আমি কেন আপনার ভালোবাসা পাচ্ছি না? আমার অপরাধ কি অবাক বাবু? অবাক বাবু আমিও আপনার ভালোবাসা চাই। আপনাকে আমার করে পেতে চাই। আমাকে আর দূরে সরিয়ে রাখবেন না। অবাক কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
মেঘের কাণ্ডে সে বেকুব হয়ে যায়। মেঘ মাথা তুলে অবাকের মুখের দিকে তাকায়। মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। চোখের পাপড়ি গুলো লম্বা লম্বা। পানি লেগে জটলা হয়ে আছে। অবাকের চোখে আজ একপৃথিবী সমান মায়া। ভেজা চুল গুলো কপালের উপর পড়ে আছে। মাত্রই শাওয়ার নেওয়ার কারণে অবাককে অন্য সময়ের থেকে বেশি স্নিগ্ধ লাগছে। অবাকের পিংক কালার ঠোঁটজোড়া মেঘের চোখে নেশা জড়িয়ে দেয়। মেঘ অবাকের পায়ের উপর নিজের পায়ের আঙ্গুলে ভর করে দাঁড়ায়। অবাকের গলায় এক হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে। অবাক আবুল হয়ে মেঘের চোখের দিকে তাকায়। মেঘ এক ঝটকায় অবাকের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বিলিন করে দেয়।
অবাক এক ঝটকায় মেঘকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। মেঘ গিয়ে পড়ে বিছানার উপর। অবাক রাগে লাল হয়ে যায়। মেঘ এমন কিছু করতে পারে ভাবতেই পারেনি। এমন একটা কাণ্ডের জন্য অবাক মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মেঘ উঠে বসে অসহায় হয়ে বলে,
– কি হলো? আমাকে এভাবে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন কেন? অবাক রাগের বশে মেঘের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। থাপ্পড় খেয়ে মেঘে মাথা গিয়ে বিছানায় লাগে। মেঘের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে উঠে বসে কান্না মাখা কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করে,
– আপনি আমাকে মারছেন কেন? আমি অন্যায় কি করেছি? অবাকের চোখ দুটো আগুনের মতো লাল হয়ে যায়। শরীরের শিরা গুলো শিরশির করে উঠে। অবাক শক্ত হাতে মেঘের অপর গালে আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। মেঘ একদম বিছানা থেকে নিচে পড়ে যায়। অবাক রাগি কণ্ঠে বলে,
– বেয়াদবির একটা লিমিট থাকে। নিজেকে কি মনে করো? লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে ফেলেছো? নিজের জায়গাটা ভুলে যাবে না। কোন সাহসে আমাকে কিস করলে? এতো সাহস তোমাকে কে দিলো? এমন একটা কাজ কোন সাহসে করলে? মেঘের চোখে জলের বন্যা বইতে শুরু করে। অবাকের চড়ের আঘাতে মেঘের গাল লাল হয়ে যায়। মেঘ উঠে দাঁড়ায়। শীতল কণ্ঠে বলে,
– আমি আমার জায়গাটা ভুলে যাই নি অবাক বাবু। আমি অন্যায় কিছুও করিনি। আমি আপনার স্ত্রী। আপনার উপর হালাল হক আছে। আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আপনাকে কিস করার। অবাক এবার রাগে ফুঁসতে থাকে। মেঘের কথা শোনে সে চিল্লিয়ে উঠে।
– কিসের অধিকার? আমি তোমাকে স্ত্রী হিসাবে মানি না। মানি না স্ত্রী হিসাবে। যেখানে তোমাকে স্ত্রী হিসাবে মানি না সেখানে অধিকারের প্রশ্নই আসে না। তোমাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি। আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো। তোমার সাথে লাইফ লিড করা আমার পক্ষে সম্ভব না। অবাকের কথাগুলো শুনে মেঘের রাগ উঠে যায়। অবাকের গলায় ঝুলে থাকা টাওয়ালটা টেনে ধরে বলে,
– তাহলে আমাকে বিয়ে করেছিলেন কেন? আমি জোর করে আপনাকে বিয়ে করেছি? বিয়ে করার সময় না করলেন না কেন? আমাকে কি পুতুল মনে হয়? আমার কষ্ট হয়না? নিজের ভালোবাসার মূল্য আছে? আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই? আমি গরীব বলে আমার কোনো কিছুর মূল্য নাই?
আমিও রক্তে মাংসে তৈরি। আমারও ইচ্ছে হয় ভালোবাসা পেতে। প্রিয় মানুষটার হাতে হাত রেখে চলতে। আমাকে কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন? অবাক স্থির হয়ে দাঁড়ায়। মেঘ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অবাকের বুকে মাথা লাগিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আমার অপরাধটা কোথায় আমায় একটু বলবেন? কেন অন্য পাঁচটা মেয়ের মতো আমার জীবনটা হয় না? কেন আমার জীবনে এতো কষ্ট? কিসের জন্য আপনি আমাকে এতো অবহেলা করুণ? মেঘ কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ে।
অবাক মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেঘের কান্নাটা এখন অবাককে কষ্ট দিচ্ছে। একদিকে সে মেঘকে ফেলতেও পারছে না অন্যদিকে নিজের ভালোবাসার মানুষ অনুকেও ভুলতে পারছে না। অবাক কি করবে নিজেও জানে না। এই মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার অধিকারতো তার নেই। অবাক একপাশে গিয়ে নিজের মাথার চুল নিজেই টানতে থাকে।
রেস্টুরেন্টে বারবিকিউয়ের জন্য আগেই কথা বলে রেখেছিল অবাক। প্রমি আর সাকিল গিয়ে অবাক আর মেঘকে নিয়ে আসে। মেঘ আসবে না। প্রমি জোরপূর্বক মেঘকে নিয়ে আসে। কিন্তু সন্ধ্যা রাতের ঘটনার পর থেকে মেঘ টু করেও শব্দ করে নি। এমনকি অবাকের দিকে একনজর তাকায়ও নি। শুধু কেঁদেই গেছে। অবাকেরও আজ বাইরে বের হওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু মেঘের কথা চিন্তা করেই বের হতে হলো। রুমে থাকলে মেঘের কান্না থামবে না।
অবাক বিশ রকম মাছের বারবিকিউ অর্ডার দিয়েছিল। সাকিল প্রমি দুজনেই কন্টিনিউ কথা বলে যাচ্ছে আর খাচ্ছে । কিন্তু অবাক আর মেঘ দুজনেই চুপচাপ। অবাক অল্প অল্প খাচ্ছে। কিন্তু মেঘ মাছে হাত দিয়েও দেখেনি। প্রমির নজরে পড়ে মেঘ। মেঘকে আজ বড্ড চুপচাপ মনে হচ্ছে। প্রমি জিজ্ঞেস করে,
– কি ব্যাপার মেঘ? খাচ্ছও না কথাও বলছো না। কিছু হয়েছে? মেঘ মাথা নাড়িয়ে না বলে। প্রমি বলে,
– তাহলে এভাবে চুপ করে আছো কেন?
– ভালো লাগছে না।
– কেন কি হয়েছে? অবাক মাথা না তুলেই বলে,
– বাসার কথা খুব মনে পড়ছে। আম্মাকে মিস করছি। অবাক মনোযোগী শ্রোতা। সে শুধু মেঘের কথা গুলো শোনেই যাচ্ছে। সাকিল বলে,
– আহারে! বাচ্চা মেয়েটা এতদিন ধরে আম্মাকে ছেড়ে আছে তো তাই। প্রমি বলে,
– ফোনে কথা বলনি?
– বলেছি
– তাহলে তো হলই। আর এখন মন খারাপ করো নাতো। নেও। খাও। খুব মজা মাছ গুলো।
– আমি খাবো না আপু। তোমরা খাও। অবাক বলে,
– খেয়ে দেখো ভালো লাগবে। সবাই নিজেদের মতো খায়। কিন্তু মেঘ একবারো মুখে দেয়নি। অবাক বলা সত্ত্বেও মেঘ খায়নি।
রাত ১ টা বাজে। মেঘ দাঁড়িয়ে আছে ব্যলকনিতে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। মেঘ খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে এজীবনে অবাকের ভালোবাসা তার পাওয়া হবে না। চারপাশে মৃদু আলো। আকাশ পরিষ্কার। তারা গুলোর মিটমিট আলোয় ঝকঝকে নয়। এখানে বিদ্যুৎ না থাকায় রুম গুলো যথেষ্ট আলোকিত নয়।
অবাক অনেক্ষণ রুমে মেঘের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু মেঘ আসে নি। অবাক বুঝতে সক্ষম মেঘের মনে বড্ড অভিমান জমা হয়েছে। অভিমান জমা স্বাভাবিক। বাচ্চা মেয়েটাকে এভাবে বলা উচিত হয়নি। সে ভুল করেছে। এতো ছোট একটা মেয়ের মনে এতো আঘাত দেওয়া ঠিক হয়নি।
কথাগুলো বুঝিয়েও বলা যেত। অবাকের মনে অপরাধবোধ কাজ করছে। অবাক ব্যলকনিতে এসে দেখে মেঘ বাহিরে মুখ করে তাকিয়ে আছে। অবাক মেঘের সাথে কথা বলার সাহস খুঁজে পাচ্ছে না। তবুও বলতে হবে। অন্তত একটা সরি বলতে হবে। অবাক একটু এগিয়ে গিয়ে অপরাধী কণ্ঠে বলে,
– মেঘ আই য়্যাম সরি। তখন তোমার সাথে এমন বিহেভ করা উচিত হয়নি। অবাকের কণ্ঠ শোনেও মেঘ একবারও অবাকের দিকে ফিরে তাকায় নি। শুধু মেঘের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের একটা শব্দ পায় অবাক। অবাক মেঘের পেছন গিয়ে দাঁড়ায়।
– আসলে তখন আমার রাগ উঠে গেছিল। আর রাগ উঠলে আমি কি করি না করি খেয়াল থাকে না। মেঘ ঘুরে দাঁড়ায়। রাতের আঁধারে অবাকের চেহারা স্পষ্ট বুঝতে পারছে মেঘ। মেঘের চোখ জলে ভরে উঠে। কান্নায় বুক ফেটে যায়। মেঘ ধরা গলায় বলে,
– আমাকে সরি বলার দরকার আছে? আমি কে বলুন তো? আমার মতো একটা মেয়েকে আপনি নিজের ঘরে জায়গা দিয়েছেন সেটাই তো অনেক কিছু। আমি আবার বেহায়ার মতো আপনার ভালোবাসা দাবী করছি। মেঘের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ি। মৃদু আলোতেও মেঘের চোখের পানি অবাকের চোখকে ফাকি দিতে পারেনি। অবাক মন অস্থির হয়ে উঠে। অবাক উতলা হয়ে বলে,
– আমি কখনও তোমাকে এতোটাও ছোট মনে করিনি। আমি অনুকে ভালোবাসি। তোমার সাথে যা করছি অনুর জন্য করছি। ওকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখনও অনুই আমার কল্পনায় বসবাস করে। অনুর জন্যই আমার ভালোবাসা নিবেদিত।
– আর আমার জন্য শুধু কষ্ট নিবেদিত? অবাক বাবু আপনার কাছে আপনার ভালোবাসা যতটুকু মূল্যবান আমার কাছে আমার ভালোবাসা তারচেয়েও বেশি মূল্যবান। আমার ভালোবাসা পবিত্র। আল্লাহর দেওয়া অশেষ রহমত। আমি কেন আমার ভালোবাসা পাবো না বলুন? আমিতো অন্যায় কোনো আবদারও করিনি। শুধু একজন স্ত্রীর অধিকার চেয়েছি।
– মেঘ তুমি এখনও অনেক ছোট। বড্ড অবুঝ।
– আমি অবুঝ না। আমার বুঝার মতো ক্ষমতা আছে। আমি এডাল্ট। আপনি আমাকে অবুঝ, ছোট বলে এড়িয়ে চলতে পারেন না। মেঘ অবাকের সাথে মিশে যায়। অবাককে জড়িয়ে ধরে বলে,
– একবার আমাকে কাছে টেনেই দেখুন না। আমাকে আপনার বুকে একটু জায়গা দিন না। আপনার ভালোবাসা পাওয়ার পর আমি মরে গেলেও আর কোনো আশা থাকবে না। একবার আমাকে আপনার ভালোবাসার স্পর্শ পাওয়ার মতো ভাগ্যবতী বানান না।
আমি যে আপনার ভালোবাসার জন্য কাঙ্গালি হয়ে আছি। আপনাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। যতটা একজন আদর্শ স্ত্রী তার স্বামীকে বাসে আমি ততটাই ভালোবাসি আপনাকে। আমাকে পর করে দিবেন না প্লীজ। আপনার কাছে থাকতে দিন।
অবাকের মাথা হ্যাং। মেঘকে বুঝানোর মতো ক্ষমতা তার নেই। অবাক মেঘের মাথা নিচের বুক থেকে তুলে দুহাত দিয়ে চেপে বলে,
– আমার ভালোবাসা চাও না? ভালোবাসায় পাওয়ার মাঝে শুধু সুখ নয় অনেক কষ্টও থাকে।
– ঠিক আছে। সুখের সন্ধান করতে গিয়ে যদি কষ্ট পাই তাতেও আমার দুঃখ নেই। তবুও আমি আপনাকে চাই। আপনার ভালোবাসা পেলে আমার যত কষ্টই হোক সেই কষ্টটাকে আমি সুখ হিসাবে বরন করে নিবো। অবাকের চোখ গরম হয়।
– ভালোবাসা চাই। স্ত্রীর অধিকার চাই। বেশ! তাহলে তাই হোক। অবাক মেঘকে পাঁজাকোলা তুলে নেয়। মেঘ দুহাত দিয়ে অবাকের গলা জড়িয়ে ধরে। অবাক মেঘের চোখে চোখ রেখে বলে,
– আজ তোমাকে তোমার না পাওয়া সুখের ঠিকানায় নিয়ে যাবো।
চলবে——-