#অপ্সরী
৬.

রাত সাড়ে এগারোটা। দাওয়াত থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে হাফিজ সাহেব। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে মুন্নি বেগম৷ কনুইয়ে ভর দিয়ে হাতের তালুতে মাথা রেখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন তিনি৷ আয়নায় স্বামীর হাসি হাসি মুখটা দেখতে পাচ্ছে মুন্নি বেগম। লোকটা কিছু একটা ভেবে মিটমিট করে হাসছে। ঘাড় ফিরিয়ে ভ্রু উচিয়ে তাকালো সে। বললো,

– কি? মিটমিটায়া হাসো কেন?
– তোমার আমার বিয়ের কয় বছর হইলো?
– বিশ।
– বিশ বছর ধইরা একটা কথা তোমার বাপ আর আমি তোমার কাছে লুকাইছি। শুধু তুমি না, সবার কাছেই লুকাইছি।
– কি কথা?
– লতিফ মাস্টারের চল্লিশায় তোমার বাপ আর আমি আমরা দুইজনই দাওয়াতি ছিলাম৷ সেইদিন আব্বার পাশে বসছিলাম খাইতে। উঠান ভরা মানুষের সামনে থেইকা তোমার আব্বা উইঠা যাইতে পারে নাই। খাইতে বইসা উইঠা গেলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। এমনিতেই তোমারে আমারে নিয়া পুরা গ্রামে কথা রটারটি চলে তখন। তারমধ্যে আব্বার সেই চেয়ার ছাইড়া উইঠা আসা হয়তো আরো কথার খোরাক হইতো। তাই আর আব্বা উঠে নাই৷ আব্বার পাশে বইসা আমি তার প্লেটে মাছের টুকরা তুইলা দিতে দিতে বলছিলাম, আমারে আপনে পছন্দ করেন না কেন? আপনার মেয়েরে তো আমি কোনো কষ্টে রাখব না৷ খুবই সুখে থাকবে সে৷ আপনার মেয়ের সুখ দেইখা সন্তুষ্টিতে আপনার চোখ মন জুড়ায় যাবে৷ তখন দুই হাত তুইলা আপনে আমার জন্য দোয়া করবেন আর আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাবেন আমার মত এমন সুপুরুষরে আপনার মেয়ের জামাই হিসাবে পাইছেন।
– এ্যা? এই কথা বলছো আব্বারে? আব্বা তোমারে কিছু বলে নাই?
– তোমার কি ধারণা সে আমারে কিছু না বইলা ছাইড়া দিছে? তোমার বাপ করলো কি, পান খাইয়া কালা দাগ ফালানো দাঁতগুলা বার কইরা হাসতে হাসতে আমার প্লেটে ডাইল তুইলা দিয়া বললো,
– কুত্তার ছাও রে, কুত্তার ছাও! ভরা মজলিস দেইখা বাইচ্চা গেলি৷ নয়তো আমি ইদ্রিস আলী তোরে এতক্ষণে কুইট্টা মাটির ভিত্রে গাইরা থুইতাম।
– তোমার সাহস কত্ত গো মাইশার আব্বু!
– এরপর আমি কি করছি জানো?
– কি?
– তোমার বিরহে দেবদাসের হাল হইছিলো আমার৷ খাওয়া নাই, ঘুম নাই, শান্তি নাই৷ কিচ্ছু ভাল্লাগে না৷ ভাত খাই ভাল্লাগে না, সিগারেট খাই ভাল্লাগে না, মদ খাই ঐটাও ভাল্লাগে না। ভাল্লাগে খালি তোমারে আমি বিয়ে করতাছি ঐ স্বপ্ন দেখতে৷ তোমার আব্বার ঐ কথা শুইনা আমি দুই সেকেন্ডে বিদ্রোহী হইয়া গেলাম। উনারে বললাম,

– মাইয়্যা দিলে দিবেন না দিলে নাই। এমন ছোট সাইজের মুন্নি আমি বস্তায় ভইরা যখন তখন পালাইয়া গিয়া বিয়ে কইরা নিতে পারি৷ ঐটুক জোর এই কুত্তার ছাওয়ের আছে৷

শব্দ করে হেসে উঠলো মুন্নি বেগম। স্ত্রীকে গভীর মনোযোগে দেখছে হাফিজ সাহেব। এই হাসিটা, ঠিক এই হাসিটার প্রেমেই পড়েছিলেন তিনি বহুবছর আগে৷ সেই যে পড়লেন, এখন পর্যন্ত উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। তার সন্তানের মা প্রতিদিন যেকোন একবেলা এসে এমন করে হাসে আর তাকে প্রেমের বালুচরে ফেলে দেয়। তখন তার কল্পনায় এসে সেই কিশোরী মুন্নি দুই বেনী হাতে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,

– উইঠা আর কি করবেন আপনে? থাকেন, এইখানেই পইড়া থাকেন।

টুল ছেড়ে এসে স্বামীর পাশে আসন ধরে বসলো মুন্নি বেগম৷ বললো,

– এতবছর বলো নাই কেন?
– এমনেই বলি নাই৷
– আব্বা কেন বলে নাই?
– হইতে পারে লজ্জায় বলে নাই। ঐরকম প্রভাবশালী একটা মানুষরে আমি দিনে দুপুরে হুমকি দিয়া আসছি এইটা কি খুব আনন্দের বিষয়?
– বিয়ের আগে যাই হোক, আব্বা কিন্তু বিয়ের পরে তোমারেই বেশি পছন্দ করতো। মারা যাওয়ার আগে তো বললোই হাফিজ আমার মেয়ের জামাই না, এটা আমার আরেক ছেলে।
– তুমি কি জানো আজকে আমি তোমার আব্বার জায়গায় আইসা দাঁড়াইছি?
– মানে?
– মানে তোমার প্রিয় পাত্র আজকে আমার কাছে খাবার টেবিলে বইসা মাইশারে চাইলো। আমি ওরে দুষ্টামি কইরা হাবিজাবি বললাম। ও খুব ক্ষেপলো আমার উপর। হুমকি দিয়া গেলো মাইশারে সে উঠায়া নিয়া বিয়ে করবে৷

আবারও সজোরে হাসতে শুরু করলো মুন্নি বেগম। স্বামীর হাতে চিমটি কেটে বললো,

– এইবার বুঝো কেমন লাগে?
– কেমন আবার লাগবে? ভালোই লাগছে, খারাপ না৷ নিজেও ঐ পথ পার কইরা আসছি৷ তার কষ্ট আমি বুঝি। সে আসছিলো আমারে পটাইতে, আমারে সে পটাইতে পারছে৷ ও আমার মতনই। ধইরা নাও এই ছেলে আমার প্রতিচ্ছবি। মাইশারে আমার মতন যত্নে সে রাখতে পারবে।
– হুমকি দিলো আর এইটা শুইনাই ওরে নিজের মত ভাইবা নিলা?
– না, ভুল বললা। এই সামান্য এক কথায় নিজের মত তারে মনে করার ভুল আমি করবো তোমার মনে হয়? সেই সকালে ওর পিছনে লোক লাগাইছি, সন্ধ্যা নাগাদ ওর জীবনবৃত্তান্ত সব আমার হাতে৷ সে কোন হসপিটালে জন্ম হইছে সেই খবর থেকে শুরু কইরা এখন সে কোথায় চাকরি করে, ছুটির দিনে সে কোথায় গিয়া আড্ডা দেয়, মানুষ হিসাবে কেমন সব খবর আমি নিছি। সব যাচাই কইরাই আমি মাইশারে ওর হাতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিছি৷ কলিজার এক অংশ আমি যখন কাউরে দিব তখন তো আর যার তার হাতে দিয়া দিব না তাই না?
– এত খোঁজ কেমনে নিলা?
– এত জানার দরকার কি? মেয়ে বিয়ে দেয়ার চিন্তা ঢুকছে মাথায় সেই চিন্তা আমি নামায়া দিতাছি এইটা নিয়া সন্তুষ্ট থাকো। তবে আমি এখনও বলব মাইশা বিয়ের উপযুক্ত হয় নাই। সংসারের কাজ করা ছাড়াও আরো অনেক কথা বাকি থাকে। বিয়ে দিব ঠিকাছে কিন্তু মেয়ে আমার বাড়ি থাকবে। অনার্স শেষ করবে তারপর আমি ধুমধাম কইরা মেয়ে ঐ বাড়ি পাঠাব। এই শর্তে রাজি থাকলে আমি এখন বিয়ে দিব নয়তো ওরা ওদের ছেলের জন্য অন্যদিকে মেয়ে খুঁজুক।
– আমি কি এখনই একটা কল করব ঐ বাসায়?
– নাহ্, রাত অনেক হইছে। কাল সকালে ফোন দাও।
– ছেলে যে আমার কি পছন্দ হইছে গো মাইশার আব্বু!
– আইচ্ছা মুন্নি একটা কথা বলো তো, হাসিব আর আমার মধ্যে তো বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই৷ ওরে তোমার এত ভাল্লাগছে তাইলে তুমি আমারে বিয়ের আগে কেন পছন্দ করতা না? বিয়ের পরেও তো আমারে দেখলেই ছ্যানছ্যানায়া উঠতা। এখনো প্রায়ই খুন্তি হাতে আমারে শাসায়া যাও। এত বৈষম্য কেন বলো তো?

ইউটিউবে গভীর মনোযোগে মাইশা মুভি দেখছে। ভেতরে ভেতরে টানটান উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছে সে৷ কয়েক সেকেন্ড বাদেই খুন রহস্য সমাধান হতে যাচ্ছে। এমন মুহূর্তে বাঁধ সাধলো হাসিব। মাইশাকে কল করছে সে৷ বিরক্তিতে চেহারা কুঁচকে আসে মাইশার। রিসিভ না করলে লোকটা বারবার কল করতেই থাকবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল রিসিভ করলো সে। ওপাশ থেকে হাসিব বললো,

– কল করার সঙ্গেই রিসিভড! আমার কলের অপেক্ষা করছিলে?
– মুভি দেখছিলাম। একটু পরই খুনি কে সেই সমাধান হয়ে যেত, অযথাই কল করে আমার মজাটাই মাটি করে দিলেন৷
– খুনি দেখতে চাইলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখো, অযথা সিনেমায় খুনি খুঁজে সময় নষ্ট করার দরকার কি?
– আপনি আমাকে কথায় কথায় খুনি বলেন কেন?
– বলবো না? আমার আবেগ ভরা বুক ব্যাথাকে গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা বানিয়ে দিলে। এটা শুনে আমি স্ট্রোক করে মারা যাইনি এই তো বেশি! শোনো মেয়ে, তোমার বয়সটা হচ্ছে রোমান্টিক মুভি দেখার বয়স। এই বয়সে থ্রিলার মুভি দেখা ভালো না, মন শক্ত পাথর হয়ে যায়। খুব খারাপ প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কে। খুন করতে ইচ্ছা হয়। মানুষ খুন করা বেশ জটিল কাজ, তাই মানুষ খুন না করে তোমার মত থ্রিলার প্রেমীরা মানুষের আবেগগুলোকে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। বলতে পারো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আরকি! এই দেখো না তুমিই তো আমার সব আবেগ পায়ে পিষে মেরে ফেলার প্রতিজ্ঞা করেছো।
– আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমার মন পাথর হয়ে গেছে?
– হ্যাঁ, হয়েছে তো। বুঝতে পারোনি এখনো? ১৯ বছর হয়ে গেলো অথচ একটা প্রেমও করতে পারলে না। কতশত প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে। কারো আবেগ তোমার মনে এখনো দোলা দিতে পারলো না৷ এগুলো তো মন পাথর হওয়ারই ফলাফল। তোমার বয়সী মেয়েদের মন হতে হবে তুলার মত তুলতুলে। রঙিন আবেগে উড়ে উড়ে বেড়াবে। একটু ন্যাকামো করে কথা বলবে। দিনরাত আমার মত আধপাগল প্রেমিকদের ভালোবাসি ভালোবাসি বলে পুরো পাগল বানিয়ে দিবে৷

কল কেটে দিলো মাইশা৷ ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিলো বালিশের পাশে৷ খাটে বসে আয়নায় নিজেকে দেখছে সে। চুলে হাত বুলিয়ে ভীষণ মনোযোগে নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে৷ সত্যিই কি কারো আবেগ বুঝার মত ক্ষমতা তার নেই? কেন কারো প্রেম নিবেদন আজও মনে দোলা দিলো না? কেন কখনো ইচ্ছে হলো না লম্বা একটা পথ কারো হাত ধরে হাঁটতে কিংবা কারো ভালোবেসে উপহার দেয়া গোলাপটা খোপায় গেঁথে নিতে?
চুলের ভেতর থেকে হাতের আঙুলের ফাঁকে বেলিফুলের ছেঁড়া টুকরা বেরিয়ে এলো। লোকটা তখন রাগে গজগজ করছিলো খুব! এমন অদ্ভুত আচরন কেন করে লোকটা? কেউ প্রেমে পরলে বুঝি এমন অদ্ভুত হয়ে যায়? নাকি লোকটা জন্ম থেকেই অদ্ভুত?

গাল ফুলিয়ে বসে আছে মাইশা৷ তার হাতে কোকের বোতল। মাথায় আপাতত তার অসংখ্য চিন্তার পাহাড়। রাণী গোলাপি রঙের সিল্ক শাড়ী আর মায়ের স্বর্ণের গয়না পড়ে নিজেকে বউ বউ লাগছে তার। বাবা পুরো পাঁচ লিটার কোক কিনে দিয়েছে আজ। ঘুম থেকে উঠেই বালিশের পাশে কোকের বোতল দেখতে পেয়ে খুশিতে বাবা বলে চিৎকার করে ছুটে গিয়েছিলো বাবার ঘরে৷ তখনও একবারের জন্যও মনে হয়নি বাবা তাকে এই বোতলগুলো ঘুষ হিসেবে দিয়েছে, ভালোবেসে না৷ আহ্লাদে গদগদ হয়ে বাবার গা ঘেষে বসে ধন্যবাদ জানাতেই একহাতে মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো হাফিজ সাহেব৷ নরম সুরে বললো,

– আব্বু তোকে খুব ভালোবাসি।
– হ্যাঁ আব্বু জানি তো! এটা কি আমাকে বলতে হবে?
– আব্বুকে বিশ্বাস করিস?
– হ্যাঁ করি৷
– আব্বু কখনো তোর জন্য খারাপ কিছু পছন্দ করেছি?
– না। তুমি এখন পর্যন্ত আমার জন্য যা কিছু এনে দিয়েছো সব কয়টাই বেস্ট ছিলো।
– আমি তোকে যদি এখন একটা বর পছন্দ করে এনে দেই তুই কি তাকে ফিরিয়ে দিবি?

কিছু মুহূর্ত চুপ করে রইলো মাইশা। খুব কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেললো তার বাবা। এই প্রশ্নের উত্তর কি দিবে বাবাকে? হতভম্ব হয়ে হাফিজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলো মাইশা। তার কাঁধে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে হাফিজ সাহেব জিজ্ঞেস করলো,

– কিরে? বল? আমার পছন্দ মেনে নিবি? বিশ্বাস আছে তো আব্বুর পছন্দে?
– বিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কেন আব্বু?
– আমার উপর বিশ্বাস থাকলে আমার পছন্দ তোর পছন্দ হবে। তোর জন্য সেরাটাই আমি বেছে নিয়েছি৷
– আমি কি তাহলে আর পড়বো না?
– অবশ্যই পড়ালেখা করবি৷ যতদূর পড়তে চাস পড়বি।
– আমাকে তো তাহলে এই বাসা ছাড়া চলে যেতে হবে৷
– কে বললো এখনই যেতে হবে? তুই থাকবি এই বাসায়। এরপর তোর যখন ইচ্ছা হবে তখন নিজের সংসারে যাবি৷
– ছেলেটা কে? হাসিব?
– হুম।
– উনাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
– খুব।
– কেন?
– কেন পছন্দ হয়েছে সেটা এখন তোকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না৷ বিয়ে হোক, নিজেই বুঝে নিবি৷
– আমার তাকে একদম পছন্দ না৷ অদ্ভুত সব আচরণ করে৷
– বললাম তো আব্বু তোকে সেরাটাই এনে দিব। বিশ্বাস রাখ আমার উপর৷
– কোকের বোতলগুলো কি আমাকে ঘুষ দিলে?
– ধরে নে সেরকমই কিছু।

বাবার বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলতে পারেনি মাইশা। আজ সকালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ মা হলে হয়তো এতক্ষণে ঝগড়া বেঁধে যেত৷ বিয়ের সিদ্ধান্ত বাবা নিয়েছে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিলো সে৷ সকাল থেকে তোড়জোড় দিয়ে রাতের আয়োজন চলছে। মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসবে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে এই নিয়ে মুন্নি বেগমের যেন উত্তেজনার শেষ নেই৷ মাইশার মামা চাচাদেরও আসতে বলা হয়েছে এই আয়োজনে৷ তারা সেই বিকেলেই চলে এসেছে সপরিবারে৷ এশার আজানের আগ দিয়ে এসেছে হাসিবের পরিবারও৷ ড্রইংরুমে মুরুব্বীরা সবাই বসে আলাপ করছে। মাইশার ঘরে বাচ্চারা হুড়োহুড়ি করছে। আর মাইশা আয়নায় তাকিয়ে থেমে থেমে এক চুমুক করে কোক খাচ্ছে আর একের পর এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যাচ্ছে। এইযে মাথায় এত এত চিন্তারা অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে সেই খবর কি এই চিৎকার করে ছুটোছুটি করতে থাকা বাচ্চাগুলো জানে? কারো দুশ্চিন্তার মুহূর্তে কানফাটানো চিৎকার যে দুশ্চিন্তাকারীর মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেই খবর কি তাদের আছে? ইচ্ছে হচ্ছে সবকয়টাকে ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বের করে কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে একটা লম্বা ঘুম দিতে৷ দুশ্চিন্তার মুহূর্তগুলোতে দুনিয়া ভেঙে ঘুম পাওয়ার অভ্যাসটা তার বহু পুরোনো৷ কোকের বোতল খাটের এক কোণায় রেখে শুয়ে পড়লো মাইশা। চোখটা বন্ধ করতেই পায়ের আঙুল টেনে তার মামী বললো,

– তুমি এই সময় ঘুমাবা? কেন?
– ঘুম পাচ্ছে।
– তোমাকে ঐ ঘরে ডাকছে৷ উঠো, আসো আমার সঙ্গে।
– এতক্ষণ ধরে সেজেগুজে অপেক্ষা করছি আমাকে ডাকবে বলে, ডাকলো না৷ এখন একটু চোখটা বন্ধ করতেই ডাকতে চলে এলে!
– এতক্ষণ তোমার বাবার সঙ্গে হাসিবের দুলাভাইর তর্ক চলছিলো৷ তোমার বাবা শর্ত দিয়েছে তোমাকে তিনবছর নিজের কাছে রেখে অনার্স কমপ্লিট করাবেন। এই শর্তে রাজি থাকলে উনি এখন আকদ করাবেন নয়তো এই বিয়ে বাতিল।
– বাতিল? সত্যি বাতিল? হয়ে গেছে বাতিল?
– ইশ! মেয়ের খুশি দেখো না! কোনো বাতিল টাতিল হয়নি। এই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর বিয়ে তোমার।

মুখ শুকিয়ে এলো মাইশার। তার চোখে পানি ছলছল করছে। অস্পষ্ট হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,

– ওহ!

চোখের পানি চেপে ধরে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো মাইশা৷ শাড়ীর কুঁচি আর আঁচল আরেকদফা ঠিকঠাক করে নিয়ে ড্রইংরুমে গেলো। ঐ বাড়ি আর এই বাড়ির লোক মিলে ড্রইংরুম ভরা লোকজন। সেখানে পা রাখতেই সবাই তাকিয়ে রইলে মাইশার দিকে৷ পুরো ঘরভরা লোকজনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মাইশা চোখ নিচে নামিয়ে ফেললো৷ এভাবে কেন তাকিয়ে আছে সবাই? এই ঘরে কি আর কেউ নেই? লজ্জা আর অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে যায় মাইশা৷ ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে বাবার পিছনে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে৷

মধ্যরাত। হাসিবরা বিদায় নিয়েছে আরো ঘন্টা দেড়েক আগে। এই বাসার মেহমানরা সবাই বিদায় নিয়েছে আধঘন্টা হলো। কাপড় পাল্টে আয়নার সামনে বসে চুল বেণী করছে মাইশা। ড্রেসিং টেবিলের উপর ভাইব্রেট হতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে একবার তাকালো মাইশা৷ সেই মানুষটার নাম্বার স্ক্রিনে ভাসছে। বেণীর শেষাংশে রাবার ব্যান্ড আটকে কল রিসিভ করে চুপ করে রইলো মাইশা। কয়েক সেকেন্ড পর ওপাশ থেকে হাসিব বললো,

– কল রিসিভ করে চুপ হয়ে থাকো কেন? এটলিস্ট হ্যালো তো বলবা!
– কাল থেকে বলবো।
– মন কি খুব খারাপ?
– না।
– মিথ্যুক! তখন তোমার বাসায়ও দেখলাম তোমার মন খারাপ। মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো৷ এখন কন্ঠ শুনেও বুঝতে পারছি তুমি আপসেট। কেন বলো তো? বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই?
– এত জেনে আপনি কি করবেন?
– বলতে চাচ্ছো না?
– না।
– আচ্ছা, যখন বলতে ইচ্ছে হয় তখনই বলো৷ এখন বলো তো, তখন মাথা নিচু করলে তো করলে আর একবারের জন্যও মাথা তুলে তাকাওনি। তোমাকে আংটি পড়িয়ে দিচ্ছিলাম তখনও আমার দিকে একবারও দেখো নি। কেন?
– এমনি।
– বিয়েটা কি একদমই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না? আমাকে কি খুব অপছন্দ করো?
– না, ইচ্ছে হচ্ছে না। আপনাকে আমার একদম পছন্দ হয়নি৷
– তাহলে বাসায় না করে দাওনি কেন?
– আব্বু সহজে আমার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। হোক সেটা কাপড় কেনার মত ছোট সিদ্ধান্ত কিংবা কোন কলেজে ভর্তি হবো সেটার মত কোনো বড় সিদ্ধান্ত। ছোট থেকে আমি আমার নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেই। আব্বু আমাকে সেই স্বাধীনতা দিয়েছে৷ তবে আব্বু যখনই আমার জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমি সেটা বিনা তর্ক বিতর্কে মেনে নিয়েছি। আমার পুরো পৃথিবী একদিকে, আমার আব্বু অন্যদিকে৷ আব্বু যদি বলে মাইশা তুই এক্ষুনি ছাদ থেকে ঝাপ দিয়ে মরে যা, আমি সেটাই করবো। কোনো আপত্তি ছাড়াই করবো। আমি জানি আব্বু আমার জন্য যা সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই বেস্ট। আপনাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তও আমার আব্বুর৷
– শুধুমাত্র বাবার কথা মেনে নিতেই আমাকে বিয়ে করছো? আমার প্রতি কোনো আগ্রহই নেই তোমার?
– না নেই। কেন হবে আগ্রহ? আপনাকে আমি চিনি তিনদিন যাবৎ। এই তিনদিনে আমাকে অপমান, আমার কান মলে দেয়া, আমার খোপার ফুল টেনে ছিঁড়ে ফেলা ছাড়া আর কি করেছেন আপনি যে আগ্রহ জন্মাবে?
(চলবে)

-মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here