#অপেক্ষা
পর্ব 1+2+3
ভার্সিটির গেটের সামনে দাড়িয়ে আছি।আজকের দিনটা আমার জন্যে অনেক স্পেশাল।নিজের স্বপ্নের ভার্সিটিকে প্রথম বারের মত সামনাসামনি ভাবে দেখতে পারব।সেই সাথে হালকা একটা ভয়ও কাজ করছে।খুব বেশি সময় নেই আর হাতে। মাত্র মাস খানেক বাকি আর।তারপর এডমিশন টেস্ট নামক অগ্নিপরীক্ষা। জানিনা ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে কিন্তু আমি যথাসাধ্য চেস্টা করেছি।রাত দিন এক করে পড়াশুনা করেছি যাতে এই ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাই।
বই খাতায় মাথা গুজে যখন আমি জ্ঞান চর্চায় ব্যস্ত বাবা রুমে এসে বললেন
-মা জনিস তো শুধু বই পড়লেই জ্ঞান বাড়ে না। কখনো চোখে দেখা জিনিসও জ্ঞান বাড়ায়।এইভাবে শুধু বই পড়া মানে মরিচীকার পেছনে ছোটা।তার চেয়ে বরং চল ভার্সিটি ঘুরে আসি।নিজের বহুদিনের লালন করা স্বপ্নকে পূরনের সুযোগ তাই আর হাতছাড়া করতে পারিনি।নির্ধারিত দিনে বাবা মা আর দুই বান্ধবীমিলে হাজির হলাম সেই স্বপ্নের ঠিকানায়। ঠিক যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর জায়গাটা পুরোটাই যেন স্বপ্নের মত। সদ্য ফোটা ফুলের উপর মৌমাছির মত নেচে বেরাচ্ছি আমরা। কখনো বা মুগ্ধ চোখে দেখছি কখনো বা ছবি তুলা নিয়ে পাগলামি করছি।ঘুরতে ঘুরতে আব্বু আম্মু এক পর্যায়ে হাপিয়ে উঠলেন।তবুও আমাদের দেখা যেন শেষই হয় নি।এক পর্যায়ে আম্মু বলে উঠলেন
-এই তোরা যা বাকিটা ঘুরে আয়।আমরা একটা টং এ বসে ততক্ষনে চা খাই।
আম্মুর কথা শুনে আমাদের যেন খুশি আর ধরে না!একটা বিল্ডিং এর সামনে গিয়ে দেখি বড় হল রুমে একজন টিচার ভাষন দিচ্ছেন।হয়তো বা কোন সম্মেলন বা কোন সমাবেশ হচ্ছে।সবাই যে যার মত গিয়ে বসে যাচ্ছে।কোন বাধ্য বাধকতা নেই।জিনাত আমার হাত ধরে বলল
-এই কায়া চল ভেতরে যাই।
আমি চোখ বড়বড় করে বললাম
-মাথা খারাপ!এইটা ভার্সিটির স্টুডেন্টদের জন্যে।ধরা পরলে শেষ সব।
আনি বলল
– আরে ধরা কেন পরবি?বলব যে আমরা এই ভার্সিটিরই স্টুডেন্ট।
-আর আইডি কার্ড দেখতে চাইলে?
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
জিনাত হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল
-বলব যে বাসায় রাখে আসছি তাড়াহুড়োয়।এখন তো চল।
আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দুজনেই রেগে গেল।
-তুই যাবি না তো?থাক তাহলে এখানে।এই আনি চল তো।
বলেই জিনাত আনির হাত ধরে সুন্দর রুমের ভিতর ঢুকে গেল।
আমি এখনো দোটানায় পড়ে আছি ভেতরে যাব কিনা।জিনাত আর আনির পরে অনেকেই আমাকে ক্রস করে রুমে ঢুকেছে।সবাই গিয়ে সুন্দর মত বসে যাচ্ছে।ধীরে ধীরে পুরো রুমটাই লোকারন্য হয়ে যাচ্ছে।জিনাত আর আনি আমাকে ইশারা করছে ভেতরে যাওয়ার জন্যে।চোখে বন্ধ করে বুক ভরা নিশ্বাস নিলাম আমি।এখন হালকা সাহস আসছে মনে।জিনাত আর আনি আমার জন্যে জায়গা রেখেছিল।কিন্তু আমি গিয়ে পৌছানোর আগ মুহুর্তেই একজন এসে সেই জায়গায় গিয়ে ধুপ করে বসে পড়ল।মাথা তুলে দেখি প্রায় সবগুলো সিটই ফিলাপ হয়ে গেছে।লাস্টের দিকে কোনে একটা সিট এখনো ফাকা আছে।কেউ বসার আগেই আমি এগিয়ে গিয়ে সেখানে বসে পড়লাম।তবে বসাটা খুব বেশিক্ষন স্থায়ী হল না। মিনিট পাচেক এর মধ্যেই এক দলছেলে লাঠি চাকু নিয়ে রুমে ঢুকল।চারদিকে হই হই রৈ রৈ পড়ে গেল।ছেলেগুলো চেয়ার টেবিল ভাঙা শুরু করেছে।সবাই যে যার মত ছুটে চলছে।কে কোন দিকে যাচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমি হা হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।মাথা উচিয়ে দেখি জিনাত আর আনি তাদের জায়গায় নেই। ভীড়ের মধ্যে তারা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি একজন গুন্ডা টাইপ ছেলে হকি স্টিক হাতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।পেছনে ফিরতে গিয়ে দেখি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।ছেলেটা আমাকে মারার জন্যে হকি স্টিক তুলতেই আমি দুহাতে মুখ ঢাকলাম।
কয়েক সেকেন্ড নিরবতার পর শুনতে পেলাম কেউ একজন বলে উঠলেন
-কতবার বলছি মেয়ে আর বাচ্চাদের গায়ে হাত তুলবি না! যা এখান থেকে৷
চোখ খুলে দেখি আমার সামনে সাদা পাঞ্জাবী পড়া একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছেন।আমার দিকে ফিরে বললেন
-সবাই পালাচ্ছে আর তুমি বলদের মত এইখানে দাঁড়ায় আছ কেন?ভয় পাওয়ার দরকার নাই। চল এখান থেকে।
ছেলেটা আমার হাত ধরে সুন্দরমত হল রুম থেকে বের করে আনল।কিন্তু সেই হাত ধরা গেট পর্যন্তই স্থায়ী হল।গেটের বাইরে আসা মাত্রই এমন একটা ভাব যেন আমাকে সে চিনেই না।আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সে বুক পকেট থেকে একটা সানগ্লাস চোখে এটে সামনের দিকে পা বাড়াল।তার পিছু নিল দুজন চামচা টাইপ ছেলে।
আশেপাশের সবাই ছোটাছুটি করছে।জিনাত আর আনি কোথায় আছে জানি না। আব্বু আম্মুকে খুজতে হবে আমার।তার আগে আমাকে এই বিল্ডিং থেকে বের হতে হবে।কিন্তু কোনদিকে যাব তাও জানিনা।অগ্যতা সেই সাদা পাঞ্জাবী পড়া ছেলেটার পিছু নিলাম। কিছুদূর এগোতেই সিড়ি দেখতে পেলাম।এই সিড়ি বেয়েই আমরা বিল্ডিং এ ঢুকেছিলাম।চুপচাপ হাটছি এমন সময় কানে ভেসেএল একজন চামচা টাইপ লোক ছেলেটাকে বলছে
-বস সাদা পাঞ্জাবীতে আপনাকে পুরাই হিরো লাগতাছে।
পাশের কালো মত ছেলেটা আরেকটু মাখন মেরে বলে উঠল
-আরে কি বলিস বসরে সব রংগেই হিরো লাগে।
ছেলেটার কথা শুনে খুব হাসি পেল আমার।কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম।
-সব রঙ সবাইকে মানায় না।হলুদে ক্ষ্যাত লাগবে কালোতে পার্ফেক্ট মানাবে।
খুব আস্তে সাদা পাঞ্জাবী পড়া ছেলেটার কাছ ঘেষে শুধু এতটুকু বলেই পাশ কাটিয়ে চলে আসলাম।
.
.
সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে দেখি একই অবস্থা।চারদিক জুড়ে হৈচৈ চিল্লাচিল্লি।প্রধান ফটকের দিকে আগাতেই দেখি সেখানে বড় একটা তালা ঝুলছে।তার মানে এখন বের হবার কোন উপায় নেই।কি করব এখন আমি!কোথায় যাব?আমার কাছে ফোনো নেই ।
নানা রকম চিন্তায় যখন আমি সন্ধিহান কাধের মধ্যে কারো স্পর্শ পেয়ে আমি পেছন ফিরে তাকালাম।একজন হিজাব পড়া আপু আমার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
-এই মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?এখানে থাকা সেফ না। চল আমার সাথে।
আমি কিছু বলার আগেই আপু আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন।
.
.

হোস্টেলে আপু আমাকে নিজের রুমে নিয়ে আসলেন।রুমটা ছোট আর জিনিসপত্রে ঠাসা হলেও বেশ গোছানো।আপু আমাকে উনার ্বেডের উপরে বসতে বললেন।
-কোন ডিপার্টমেন্ট এ তুমি?ফার্স্ট ইয়ার?
হিজাব খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলান আপু।
আমি কিছু বলার আগেই একদল লোক হুরমুড় করে রুমে ঢুকে গেল।হঠাত করে মানুষজনকে আসতে দেখে আমি আর আপু দুজনেই চমকে গেলাম।চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি সেই সাদা পাঞ্জাবি পড়া ছেলেটা তার তার চামচা দুজন এসেছেন।তখন ভীড়ের মধ্যে উনাকে ভালো করে দেখতে পারিনি।কিন্তু এখন সামনাসামনি দেখে আমি পুরোই হা হয়ে গেলাম।দুধে আলতা চেহারা।চোখ দুটোর উপরে কালো চশমার পাহারা বসানো।চশমাটা খুলে সরু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
পেছন থেকে আপু বলে উঠলেন
-রেওয়াজ তুই এখানে কি করছিস?
-দিপা তুই একটু বাইরে যা।ওর সাথে আমার একটু কথা আছে।
-কিন্তু রেওয়াজ….।ওকে এইভাবে একা….?
-চিন্তা করিস না।মেয়েদের সম্মান করতে জানি আমি।
আপু কোন কথা না বলে চুপচাপ বের হয়ে গেলেন।উনি এখনো এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ।এখন খানিকটা ভয় লাগছে আমার।উনি তো আমাকে চিনেন না ।তাহলে আমার সাথে উনার কি কথা থাকতে পারে!
-তখন কি বলেছিলে জানি?
বাম হাতে পাঞ্জাবির বোতমগুলো খুলতে খুলতে আমার দিকে আসছেন উনি।
আমি ভয়ে জড়সড়ো হয়ে কাপা কাপা গলায় উত্তর দিলাম
-ক…ক…..কই??কিছু বলিনি তো।
-হলুদে আমাকে মানায় না তাই না?
-না…না…না…তো।মানায়।মানে আমি জানি না।
উনি হালকা হেসে নিজের পাঞ্জাবিটা খুলে ফেললেন।আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন
-ধর এটা।
আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ হাত বাড়িয়ে পাঞ্জাবিটা নিলাম।উনি পেছনে হাত বাড়াতেই একজন চামচা টাইপ লোক উনার দিকে একটা হলুদ পাঞ্জাবি বাড়িয়ে দিল।চোখের নিমিষেই পাঞ্জাবিটা পড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালেন।এদিক ওদিক ঘুরে আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে বললেন
-মন্দ বল নি।Yellow doesn’t suit me.
কথাটা বলেই আবার হলুদ পাঞ্জাবীটা খুলে ফেললেন।হাত বাড়াতেই আবার আগের লোকটা হলুদ পাঞ্জাবিটা নিয়ে একটা কালো শার্ট এগিয়ে দিল।
উনি শার্টটা পড়ে আরেক দফা আয়নায় নিজেকে দেখলেন।আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন
-মানতে হবে চয়েস আছে তোমার।কোন ইয়ারে তুমি?আর কোন ডিপার্ট্মেন্ট?
উনার কথার কোন জবাব আমার কাছে নেই।আমি সুন্দরমত মাথা নামিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলাম।
-কি হল কথা বলছ না কেন?
-জ্বি…জ্বি…আমি আসলে…..
-তোতলামি ছাড় সোজা সুজি উত্তর দেও।
-আমি এই ভার্সিটির না।আমি এডমিশনের স্টুডেন্ট।এই ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা ছোট থেকেই তাই আব্বু আম্মু আর ফ্রেন্ডদের সাথে ভার্সিটি ঘুরতে এসেছি।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলাম আমি।
চোখ তুলে দেখি উনি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
-চল আমার সাথে।
বলেই উনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন।আমি জানি না কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন উনি আমাকে ।কিন্তু উনার সাথে যেতে মন্দ লাগছে না ।উনি একে একে আমাকে পুরো ভার্সিটি ঘোরালেন।হঠাত করে চোখ পড়ল একটা পুকুরের কাছে।পুকুরের ঘাটটা বাধানো আছে অনেকগুলো সিড়ি দিয়ে।দূর থেকেও দেখা বোঝা যাচ্চগে পুকুরটা বেশ গভীর।আমি এগিয়ে যেতেই একজন দারোয়ান গোছের লোক আমার পথ আগলে বললেন
-এই দিকে যাওয়া যাবে না।
মন খারাপ করে ঘুরে তাকাতেই উনি আবার আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন।বেশ খানিকক্ষন সময় কাটালাম পুকুড় পাড়ে।পা ডুবালাম পুকুরের শীতল জলে।উনি আমাকে ছোটখাটো প্রশ্ন করছেন আর আমি উত্তর দিচ্ছি।কখনো ছোট কখনো বা বড় ।উনি খুব মনযোগ সহকারে আমার প্রতিটি কথা শুনছেন।ঘুরতে ঘুরতে কখন যেসময় পেরিয়ে গেছে টেরই পাইনি।বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।আমি যেন এতক্ষন অন্য এক দুনিয়ায় ছিলাম।ভুলেই গিয়েছিলাম আমি কোথায় আছি।সন্ধ্যার আওয়াজ কানে আসতেই যেন সম্মতি ফিরে পেলাম।সময়ের সাথে সাথে বাড়তে লাগল অস্থিরতা।প্রচন্ড ভয় লাগছে এখন আমার।নিজের জায়গায় যেন জমে গেলাম আমি।
কথা বলতে বলতে অনেকটা দূরে এগিয়ে গিয়েছিলেন উনি।পাশ ফিরে আমাকে দেখতে না পেয়ে পিছনে ফিরে তাকালেন তিনি।
-কি হল?থামলে কেন?
আমি ভয়ে ভয়ে উনার দিকে চোখ তুলে তাকালাম।আমার অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে উনি মুচকি হেসে বললেন
-ভয় পেয়ো না।আজকের রাতটা হোস্টেলে থাক দিপার সাথে।কাল সকালে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।দেখবে তোমার বাবা মা তোমাকে ঠিকি খুজতে আসবেন।
উনার কথার জবাবে আমি শুধু মাথা নাড়ালাম।
.
.
উনার কথা কাটায় কাটায় সত্য হয়েছিল।সকালে উঠে সত্যিই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।গেট খুলে দেওয়া হয়েছে।পুরো ক্যাম্পাস গিজগিজ করছে।আমি দেরী না করে সেই টংগ এ গেলাম যেখানে আব্বু আম্মুর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল।
আমার অনুমান ঠকই ছিল।উনারা ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন যাতে আমরা তাদেরকে খুজে পাই।ভীর ঠেলে কাল আনি বের হয়ে গেলেও জিনাত্ত আর আমি আটকা পরে যাই ভিতরে।প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছিলেন কিছু দুষ্কৃতিকারী হঠাত হামলা করে ক্যাম্পাসে।তাই তাদের ঠেকাতে প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। আজ সকালেই আবার ভার্সিটীর গেট খুলে দেওয়া হবে।তাই আব্বু আম্মু দেরী না করে সকালেই চলে এসেছেন ।বের হয়ে আসব তখনি জিনাত বলে উঠল সে ভুলে তার ব্যাগ হলে ফেলে রেখে এসেছে।আমি ওর সাথে যাওয়ার বাহানায় এদিক ওদিক দেখছি আর রেওয়াজকে খুজছি।
কাল রাতের পর থেকে ছেলেটার কোন পাত্তাই নেই।এটা কোন কথা হল!একটূ খোজও নিবেন না!কেনই বা নিবেন!উনি তো আমাকে চিনেন ও না।ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।আচ্ছা আমি উনাকে নিয়ে এত ভাবছি কেন?
কথাগুলো ভাবছি আর আগাচ্ছি হঠাত করে কেউ আমার হাত ধরে টান দিল।চেচানোর আগেই মুখ চেপে ধরে বলল
-শশশশহহহহহহ……।আমাকে খুজছিলে বুঝি!
আমি নিজেকে সামলে বললাম
-না….না.. নাতো আপনাকে কেন খুজব?
আমার কথায় হেসে ফেললেন উনি।আলতো করে আমার গাল টেনে বললেন
-মিথ্যে বললে বেশ কিউট লাগে তোমাকে।
কথাটা বলেই উনি চলে যাচ্ছিলেন।তখনি আমি পেছন থেকে বলে উঠলাম
-আবার কবে দেখা হবে!
উনি আমার কাছে ফিরে এসে বললেন
-দেখ কায়া এটা তোমার পড়াশুনা করার সময়।বছরের পর বছর যে স্বপ্নটাকে নিজের করে রেখেছ সেটা পূরনের সময় ।আমি চাই না আমার জন্যে তোমার কোন ক্ষতি হোক।মন দিয়ে লেখাপড়া কর তোমার স্বপ্ন পূরন কর।তারপর না হয় দুজন দুজনের মাঝে হারানোর স্বপ্ন বুনব।ততদিন অপেক্ষায় থাকো ।আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্যে।
কথাটা বলেই সে আমার কপালে আলতো করে চুমু একে চলে গেলেন।
.
.
৪ মাস কেটে গেছে।আমি রেওয়াজের কথা রেখেছি।পূরন করেছি নিজের স্বপ্নকে।আজকে আমার ভার্সিটির প্রথম দিন।যে প্রাঙ্গনে আমি একদিন আগন্তুক ছিলাম আজ আমি তার অংশ।রেওয়াজের কোন খোজ আমি জানি না।খোজ বললে ভুল হবে ওর নামটূকু ছাড়া কিছুই জানিনা।তবে এবার জানবো।গলায় ওড়না পেচিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভার্সটির উদ্দেশ্যে।আজকে অবসান ঘটোবে রেওয়াজ আর আমার অপেক্ষার।
#পার্ট_০২
.
.
অপেক্ষার মানেই যন্ত্রনা। অপেক্ষার প্রতিটা প্রহর যেন সূচের মতো বুক চিরে চলে যায়।রেখে যায় গভীর ক্ষত।রেওয়াজের সেই প্রথম দেখায় আমাকে বাচানো,পাশাপাশি হাটা,এলোমেলো গল্প বলা,বিদায় বেলায় আমার কপালে আলতো করে চুমু খাওয়া প্রতিটাই আমার মনের মধ্যে খোদাই করা আছে।ওর সাথে কাটানো একটা মুহুর্তও ভুলিনি আমি।যেন আমার সামনে চলমান সিনেমা দৃশ্য। এই ভার্সিটির প্রতিটা অলি গলি সে আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।যেখানেই যাই না কেন ওর ছোয়া মিশে আছে।প্রায় ১ ঘন্টা যাবত ক্লাসে বসে আছি।প্রথম ক্লাস তাই স্যার সবার নাম জানছেন।পরিচয় পর্ব শেষ করে সবাই দল বেধে ছুটল ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে।আমি হাজার টা না করলেও কোন অযুহায় খাটল না।নতুন জায়গায় জোর খাটানোটাও কেমন স্বভাব বিরুদ্ধ।তবে যেখানেই যাই না কেন আমার নজর এক জনকেই খুজছে বারে বার।কোথায় সে!
আচ্ছা আমি কি তাকে আদৌ খুজে পাব!কিভাবে খুজব তাকে?শুধু নাম ছাড়া তো আর কিছুই জানি না।সবাই জানাজানি হলে ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়াবে।চার মাস আগে যে ছেলে আমাকে এক গুন্ডার হাত থেকে বাচিয়েছিল আমাকে ভার্সিটি ঘুরিয়েছিল তাকে আমি পাগলের মত খুজছি।এটা পাগলের প্রলাপ নয়তো আর কি!
তবে আমি জানি আমি রেওয়াজকে কেন খুজছি।আমার কপালে ওর আলতো করে ঠোটের ছোয়াকে আবার অনুভব করতে চাই আমি।অবসান ঘটাতে চাই ওর আর আমার স্বল্প মিলনে সৃষ্ট অজানা অপেক্ষার প্রহরের।
.
.
কথায় বলে দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়। অপেক্ষার প্রহর ভালোবাসার ব্যাকুলতা বাড়ায় কাছে পাওয়ার ইচ্ছা জাগায়।আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছে রেওয়াজকে ভালোবাসতে। ওর হাত ধরে সেই পুকুর পাড়ে হাটতে। কিন্তু কোথায় সে! কোথায় পাব আমি তাকে?
ক্যানটিনে বসে আড্ডা দিচ্ছি সবাই হঠাত করে দিপা আপুকে দেখতে পেলাম।দূর থেকে দেখে প্রথমে চিনতে অসুবিধা হলেও পরে ঠিকি চিনে ফেলেছি।আপুকে দেখা মাত্রই আমি দৌড়ে গিয়ে উনার কাছে গেলাম।কাছে দাঁড়িয়ে পরিচয় দেওয়ার পর আপু বললেন
-ওহ আচ্ছা ঠিকাছে।
ব্যাস তারপর ব্যস্ত হয়ে পরলেন নিজ কাজে।আমি মোটেও অবাক হলাম না।এই চার মাসে আপুর লাইফে অনেকেই এসেছেন। অনেক জুনিয়রের সাথে পরিচিত হয়েছেন আজকে।হাজারের ভীড়ে আমাকে ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আপু মাথা তুলে বললেন
-কিছু বলবে?দাঁড়িয়ে আছ যে!
-আসলে আপু…কিভাবে বলব বুঝতেছিনা…..।
-কোন সমস্যা? সংকোচ না করে বলে ফেল।
-আপু আমি কায়া।৪ মাস আগে ভার্সিটি ঘুরতে এসে একটা ঝামেলার কারনে আটকা পরেছিলাম।আপনি আমাকে আপনার হোস্টেলে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই রাতটা আপনার সাথেই ছিলাম আমি।
আমার কথা শুনে আপু খানিকটা মনে করার ভাব করে হেসে বললেন
-আসলে অনেকেই তো আসে থাকে আবার চলে যায় সবার কথা কিভাবে মনে রাখি বল!আচ্ছা তুমি চিন্তা কর না। মনে পরলে আমি বলব তোমাকে।তুমি এখন যেতে পার।
কথাটা বলেই আপু আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরবেন তার আগেই আমি বলে উঠলাম
-আপু রেওয়াজ কোথায়?
রেওয়াজের নামটা শুনতেই আপুর চেহারা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কে রেওয়াজ!আমি কোন রেওয়াজ কে চিনি না। দেখ মেয়ে নতুন এসেছ ভালো করে পড়াশুনা কর।
কথা শেষ হতে না হতেই আপু ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে রওয়ানা দিলেন। দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলেন ক্যাফের বাইরে। আমি আপুর পিছু নিব তখনি রিহাম ডেকে উঠল
-এই কায়া চল ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে।
আমি পেছন ফিরে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালাম।
.
.
ক্লাস হচ্ছে কিন্তু মনযোগ বসাতে পারছিনা।পুরোটা ক্লাস শুধু একটা চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রেওয়াজের নাম শুনার সাথে সাথেই কেন দিপা আপুর চেহারার রঙ উড়ে গেল!দিপা আপু তো রেওয়াজকে চিনেন তবে কেন অস্বীকার করলেন?কেন বললেন যে উনি রেওয়াজকে চিনেন না?আচ্ছা আপু কি কিছু লুকাচ্ছেন?রেওয়াজ ঠিক আছে তো?
হঠাত করেই এক রাশ দুশ্চিন্তার কালো মেঘ মনের মধ্যে ভর করে এল।মনের আকাশ ভিজে উঠল অঝোর ধারায়।
ক্লাস থেকে বের হয়ে সোজা গিয়ে পৌছালাম গার্লস হোস্টেলে।আপুর রুম নাম্বার আমার মনে আছে।আল্লাহ করে যাতে আপু রুম চেঞ্জ না করেন।
৪০৯ নম্বর রুমের সামনে গিয়ে দরজা নক করলাম। বেশ খানিকক্ষণ নক করার পর আপু দরজা খুললেন। আমাকে দেখেই উনি যেন ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন।কাপা কাপা গলায় বললেন
-তু…তু…তুমি…..?তুমি এখানে কি করছ?আ…আ..আমি ব্যস্ত আছি।পরে এসো
বলেই আপু দরজা লাগিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন।আমি বা হাত বাড়িয়ে দরজা আটকালাম।চোখে মুখে পাথর কঠিনতা ফুটিয়ে বললাম
-রেওয়াজ কোথায় আপু?
-কো..কো…কোন রেওয়াজ?আমি কোন রেওয়াজ কে চিনি না।
-৪ সেপ্টেম্বর ঠিক দুপুর ২ঃ০৫ মিনিটে যে রেওয়াজ আমাকে আপনার এই রুম থেকে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেই রেওয়াজ কোথায় আপু?
-কি যা তা বলছ?আমি কোন রেওয়াজকে চিনি না।তুমি যাও তো এখান থেকে।
-আপু রেওয়াজ কোথায়?
-কোথায় আমি কি জানি!ভার্সিটিতে তো আরও মানুষ পরে। ১৭ ব্যাচে তো আরও মানুষ আছে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর না!আমার কাছে কেন এসেছ?যাও এখান থেকে।
কথাটা বলেই মুহুর্ত দেরী না করে আপু আমার মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দিলেন।আমি মিনিট দুয়েক ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার সামনে।তারপর পেছন ফিরে বের হয়ে আসলাম হোস্টেল থেকে।
একমাত্র দিপা আপুই ছিলেন যে রেওয়াজকে চিনতেন। ওকে জানতেন।এখন দিপা আপুও মুখ ফিরিয়ে নিলেন।কিন্তু তাতে কি আপু একটা ক্লু তো দিয়েছেন। মানে রেওয়াজ ১৮ ব্যাচের। তাহলে আমি ১৭ ব্যাচের জকোন ভাইয়া বা আপুকে জিজ্ঞেস করলেই পেয়ে যাব রেওয়াজের ঠিকানা।
ভেবেছিলাম হয়তো সহজ হবে।কিন্তু নিয়তি তা মেনে নেয় নি।সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।কেই রেওয়াজের সন্ধান দেন নি।ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরছি গোধুলি লগ্নে ধাক্কা খেলাম এক ছেলের সাথে।যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছে করে সে আমার সাথে ধাক্কা লাগিয়েছে। কলার ধরে থাপ্পড় দিতে যাব তখনি চোখ আটকে গেল তারদিকে।ধীরে ধীরে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে হাত নেমে এল।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটা যে সেদিন রেওয়াজের সাথে ছিল আর কথায় কথায় তাকে তেল দিচ্ছিল।
আমি নিচু স্বরে বলে উঠলাম
-সরি দেখিনি আপনাকে। ভুল করে ধাক্কা লেগে গিয়েছিল।
-আচ্ছা সমস্যা নাই।
বলেই ছেলেটা সামনে পা বাড়াল।
আমি পেছন থেকে ডেকে উঠলাম
-এই যে শুনুন….
ছেলেটা পিছনে ফিরে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল
-বললাম তো ঠিক আছে। এখন আবার কি?
-রেওয়াজ কোথায়?
আমার প্রশ্ন শুনে সে যেন চমকে উঠল।কোন কথা না বলেই দ্রুত পদে হাটতে লাগল।
আমি দৌড়ে গিয়ে তার পথ আগলে দাড়ালাম।
-আমি জানি আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন।আমি কোন সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছিনা।ভালোভাবে বলুন রেওয়াজ কোথায়…..
আমার কথা শুনে ছেলেটা কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে থাকল।নীরবতা কাটিয়ে বলে উঠল
-আসুন আমার সাথে……..

#পার্ট_০৩

.
.
জীর্নতা যখন গ্রাস করে অস্তিত্ব তখন বিলীন হয়ে যায়।যে রেওয়াজ এর নাম ক্যাম্পাসের প্রতিটা মানুষের অন্তরে গেথে ছিল সে রেওয়াজের কথা ভাবতেও আজকে সবাই দ্বিধাবোধ করে।
ঠিক মাগরিবের আযানের সময়ে একটা পুরোনো বিল্ডিং এ গিয়ে পৌছালাম।পুরো বিল্ডিং জীন শীর্ন। যেকোন মুহুর্তেই যেন ধ্বসে পরবে।অন্য সময়ে হলে হয়তো এই জায়গায় আসতে আমি ১০০ বার ভাবতাম।কিন্তু রেওয়াজকে খুজে পাওয়ার ইচ্ছা আমার মধ্যে এমনভাবে গ্রাস করে বসেছে যে আমি জাহান্নামের দরজায়ও বিনা দ্বিধায় যেতে পারি।ছোট খাটো একটা রুমের সামনে গিয়ে দাড়ালাম আমরা।দরজা আধ খাওয়া ভাঙা।কালোমত ছেলেটা তিনবার নক করল দরজায়।ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। ছেলে টা আবার একই সময় ব্যবধানে দরজায় টোকা দিল। এবার যেন ভেতরে কেউ নড়ে উঠল।খুটখাট শব্দ শোনা যাচ্ছে।ছেলেটা আবার আগের মত তিনটা টোকা দিল। আচ্ছা এইটা কি কোন কোড ওয়ার্ড?
এখনো দরজা খুলছে না কেন?ভেতরে কে আছে?১৫ সেকেন্ড রুদ্ধ শ্বাসে কাটল।ঠিক তার পরেই আসল সেই মুহুর্ত।খুট করে শব্দ হয়ে দরজা খুলে গেল।
.
.
কথায় বলে চোখে দেখা সব কিছু সবসময় বাস্তব হয় না।আমিও খুব করে চাচ্ছি যেন আমার সামনের দৃশ্যটা যেন বাস্তব না হয়ে কল্পনা হয়।আমার সামনে রেওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে।চোখ দুটো কোটরে বসে গেছে,চোখের নিচে জমেছে অগনিত নির্ঘুম রাতের আধার।ঠোট দুটো সিগারেটের আগুনে জ্বলে কালো হয়ে গেছে। গাল দুটো যত্নের অভাবে মলিন।চুল উষ্কখুষ্ক। পরনে সেই প্রথম দিন দেখা সাদা পাঞ্জাবিটা।সিগারেটের উটকো গন্ধ নাকে আসতেই দেখি বাম হাতে একটা আধখাওয়া সিগারেট জ্বলছে।রেওয়াজ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হাতের সিগারেটটা নিঃশেষ হয়ে ওর হাত পুড়াচ্ছে।আমি টেনে নিয়ে ওর হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিলাম।রেওয়াজ কোন কথা না বলেই ভেতরে চলে গেল।আমি ওর পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম।
ভিতরে গিয়ে রেওয়াজ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল
– কি চাই?
-তুমি আমাকে চিনতে পারো নি?
রেওয়াজ কথার জবাব দিল না কোন৷শুধু চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে দাড়িয়ে রইল।আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-আমি ভার্সিটি ঘুরতে এসে গুন্ডাদের হাতে পরেছিলাম।তুমি আমাকে বাচিয়েছিলে। পুরো ভার্সিটি ঘুরিয়েছিলে।যাওয়ার সময় আমার কপালে চুমু একে বলেছিলে -“অপেক্ষা করব,অপেক্ষায় থেকো”।
রেওয়াজ আমি ৪ মাস ধরে প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহুর্ত তোমার অপেক্ষা করেছি।
রেওয়াজ অন্যদিকে সরে গিয়ে বলল
-কায়া তুমি ছোট বাচ্চা না। যথেষ্ট বড় হয়েছ৷ সিম্পল একটা প্রাঙ্ককে এত সিরিয়াস নেওয়ার মত বয়স নেই এখনো তোমার।বেটার হবে তুমি এখান থেকে চলে যাও।
-প্রাংক?!রেওয়াজ তোমার চোখের মায়া প্রাংক ছিল?আমার কপালে তোমার ঠোটের আলতো স্পর্শ প্রাংক ছিল?আমাকে ভালবাসার স্বপ্ন প্রাংক ছিল?রেওয়াজ তুমি তো আমাকেই প্রাংক বানিয়ে দিলে।
কথাগুলো বলেই কাদতে লাগলাম আমি।বুক ফেটে যাচ্ছে আমার।এতদিন থেকে যার স্বপ্নকে যত্ন করে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছি সে এক নিমিষেই সবকিছুকে মিথ্যা বানিয়ে দিল।
-কায়া অযথা সীন ক্রিয়েট করে কোন লাভ হবে না।আজকে তোমার ভার্সিটিতে প্রথম দিন৷ তোমার সামনে একটা সুন্দর ফিউচার পরে আছে।মরীচীকার পেছনে না ছুটে নিজের ভবিষ্যত সুন্দর কর।
-এটাই কি তোমার শেষ কথা?
রেওয়াজ একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল
-হ্যা৷
-তাহলে চোখ নিচু কেন তোমার? যদি এটাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত হয় তাহলে আমার চোখে চোখ রেখে বল। বল যে তুমি আমায় ভালোবাসো না।বল যে আমার জন্যে তুমি অপেক্ষা করনি।বল রেওয়াজ। নাহলে আমি এখান থেকে যাব না।
রেওয়াজ রেগে গিয়ে আমার দুবাহু চেপে ধরে বলল
-একবার কথা বললে কানে ঢোকে না? সিনেমার মত নাটক করে দেখাইতে হবে?আরেকবার যদি তোমাকে এইখানে দেখি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। যাও এখান থেকে।
বলেই রেওয়াজ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।টাল সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়লাম পাশের টেবিলের উপর। টেবিলের কোনা লেগে মাথা ফেটে গেছে।প্রচন্ড ঝিমঝিম করছে পুরো মাথা।
রেওয়াজ আরেক দফা চেচিয়ে উঠল
-আই রফিক ওকে এখানে কেন নিয়ে এসেছিস?নিয়ে যা ওকে এখান থেকে৷ আর কখনো যাতে ওকে আমি না দেখি এইখানে।
ছেলেটা মাথা নিচু করে কাচুমাচু করে উত্তর দিল
-জ্বি বস।
আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল
-আপা চলেন এইখান থাইক্কা।ওস্তাদের মন মেজাজ ভালো নাই। চলেন।
আমি ছলছল চোখে রেওয়াজের দিকে এক পলক তাকিয়ে বের হয়ে আসলাম।
.
.
সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল এক নিমিষেই।সব যেন ঝরের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।কি এমনটা হল যে রেওয়াজ এতটা বদলে গেছে?!ভার্সিটিতেও যায় না একা একা একটা রুমে চোরের মত লুকিয়ে আছে। ভার্সিটির কেউ রেওয়াজের নামটাও শুনতে নারাজ। কি এমন হল যে পুরো দুনিয়াই পাল্টে গেল!আমাকে যে করেই হোক জানতেই হবে।
রফিক আমাকে মেইন রোড পর্যন্ত পৌছে দিয়েছে।অটোতে উঠতে যাবে তখনি মাথা ঘুরিয়ে বললাম
-রফিক ভাইয়া রেওয়াজ…..
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই রফিক বলে উঠল
-আমি জানি আপা আপনি কি জিগাবার চান।কিন্তু আপা আমি কিছু কইতে পারুম না।ওস্তাদের নিষেধ আছে।আপনি সাবধানে বাড়ি যাইয়েন। আল্লাহ হাফেজ।
আমি কিছু বলার আগেই রফিক দ্রুত পায়ে হেটে ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
সব কিছুতেই একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।সবাই কিছুনা কিছু লুকাচ্ছে।রেওয়াজের সাথে এমন খারাপ কিছু হয়েছে যার ছায়া আমার উপর সে ফেলতে চাইছে না।কিন্তু সে জানে না আমি তাকে নিজের করে নিয়েছি এতে সে চাক বা নাই চাক।
.
.
বেশ কয়েকদিন কেটে গিয়েছে।ভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়ে গেছে পুরো দমে।ক্লাস এসাইনমেন্ট সব মিলিয়ে দম ফেলারও টাইম নেই। কিন্তু এর মাঝে আমি আমার খোজ বন্ধ রাখিনি৷আমি যতই খোজ করিনা কেন এমন কোন মানুষ নেই যে মুখ খুলতে রাজী হয়েছে।সবাই নাম শোনা মাত্রই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে। এখনো কোন খোজ পাইনি।এর মাঝে একবার রেওয়াজকে ক্যাম্পাসে দেখেছিলাম।চোখ মুখ বেধে এসেছিল।লোকের ভীড়ে ওকে কেউ চিনতে না পেলেও আমি ঠিকি চিনে নিয়েছিলাম।ওর দিকে এগিয়ে যাব তখনি ও ভীড়ে মিলিয়ে গেল।লাইব্রেরিতে বসে নোট করছি আর কথাগুলো ভাবছি।হঠাত করে একজন এসে আমার সামনের চেয়ারে বসল।আমি মাথা তুলে দেখি লাইব্রেরিয়ান আমার সামনে বসে আছেন।এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি।
উনাকে এভাবে তাকাতে দেখে বেশ অস্বস্তি লাগছে আমার। নিচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম
-কিছু বলবেন স্যার?
-তুমি কায়া না?
-জ্বি বলুন।
-শুনলাম তুমি নাকি কয়েকদিন থেকে রেওয়াজকে খুজছ।কোমড় বেধে লেগে পরেছ ওর কাছে পৌছানোর জন্যে।
আমি হালকা হেসে বললাম
-আমি ওর কাছে পৌছে গিয়েছি স্যার। আমি জানি রেওয়াজ কোথায় আছে কেমন আছে।
কথাটুকু বলেই আমি আবার বইএ মুখ গুজলাম।তখনি উনি আবার বলে ঊঠলেন
-তাতে কি আদৌ কোন লাভ হয়েছে?সে তোমাকে কখনোই মেনে নিবে না। শুধু তোমাকে কেন কাউকেই সে মানতে পারবেনা।যেকোন মেয়ের দিকে তাকানোই তার জন্য মৃত্যুর সমান।
-মানে?
আমার কথার জবাবে উনি শুধু মুচকি হাসলেন।কোন কিছুই না বলে উঠে চলে গেলেন বই ইস্যু করতে।
.
.
লাইব্রেরির তিনতলার গেটে দাঁড়িয়ে আছি আমি।লাইব্রেরিয়ান কাগজ পত্র গোছাচ্ছেন।পুরো লাইব্রেরী ফাকা।কেউ নেই আশেপাশে।এটাই মোক্ষম সুযোগ।উনার সাথে কথা বলার৷ উনি রেওয়াজের সম্পর্কে কিছু জানেন।আমাকে তা জানতে হবে।হয়তো ভিড়ের কারনে তখন তিনি কিছু বলেন না হয়তো বা ইচ্ছাকৃতভাবেই গোপন রেখেছেন।কারন যাই হোক না কেন আমাকে তা জানতেই হবে।ছোট একটা দম ফেলে লাইব্রেরীর ভিতরে পা বাড়ালাম।…..
চলবে
#Afrin_Inayat_Kaya

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here