#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_৬
#এম_এ_নিশী
একজন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী যার আচরণে সর্বদা কঠোরতা দৃশ্যমান। সবকিছু হিসেব কষে চলা যার ধাত। জটিল কেসে মস্তিষ্ক ডুবিয়ে আর আসামিদের দৌড় করিয়ে রাখা যার প্রিয় কাজ, উপরন্তু যাকে বরাবরই সকলে ভয় করে চলেছে। সেই মানুষ ‘খন্দকার ইফাদ আহমেদ’ কে নাকানি চুবানি খাইয়ে চলেছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের এক পুঁচকে মেয়ে। ব্যাপারটা হাস্যকর হিসেবে দেখবে নাকি কঠোরতার সাথে? দ্বিধাদ্বন্দে ভোগার মতোই বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। তবে এবার বুঝি এই মানুষটির প্রতি ওই পুঁচকে মেয়ের একটু দয়া হলো। খুব বেশি দৌড় করালোনা। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলতে মুহুর্তেই চোখে ভেসে ওঠে সেই চঞ্চলা, দুরন্ত কিশোরী যার পদযুগল যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহরের এই দূষিত রাস্তায়।
মেলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপসী। কিছু একটা খুঁজে চলেছে। ইফাদ তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। রাগ সংবরণ জরুরি হয়ে পড়েছে তার। পরপর কয়েকবার শ্বাস নিয়ে ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করলো সে। তারপর দ্রুত এগিয়ে গেলো।
–তোমাকে আমি কোথাও একটা দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলাম?
রূপসী চমকে উঠে। কখন তার পাশে এসে ইফাদ দাড়িয়েছে খেয়াল করেনি। সে ওই আতশবাজি ফাটানোর উৎস খুঁজতে এসেছিলো। এতোটাই মনোযোগ ছিল সেদিকে যে ইফাদ যে তাকে দাঁড়াতে বলে গাড়ি আনতে গিয়েছিলো সেটাই ভুলে বসেছে। শুকনো ঢোক গিলে একটু হাসার চেষ্টা করলো সে। আমতা আমতা করে বললো,
–আ-আ-আমি ওইগুলান দেখতে…
হুট করেই রূপসীর হাতের দিকে নজর যেতেই ভ্রু কুঁচকে ওঠে ইফাদের।
–তোমার হাওয়ায় মিঠাই তো প্রায় হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার পথে। খেয়েছো বলে তো মনে হয় না।
এতোক্ষণে যেন রূপসীর হুশ ফিরলো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে তার টুকটুকি ফুল বেশিরভাগটাই গায়েব। সে তো খেতেও পারেনি ভালো করেনি। ইফাদ ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে, মেয়েটি চোখগুলো প্রথমে গোল গোল করে তাকায়, তারপর কপাল কুঁচকে কিছু ভাবে, হুট করে ঠোঁট উল্টে আসে। অতঃপর ইফাদকে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়। ইফাদকে যেন আজ কেউ বাঁশের কঞ্চি দিয়ে যত্ন করে পেছনপানে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ওইতো, সে স্পষ্ট সপাংসপাং আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। এই পুঁচকে মেয়ে তাকে আজ কোন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে এই ব্যপারে সে আর এক বিন্দুও ভাবতে।চায় না।
–আমার টুকটুকি ফুউউউউললল।
রূপসীর কান্নার আওয়াজ তীব্র হতেই ইফাদ বিব্রতকর দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। না জানি তাকে বখাটে ভেবে আজ পাবলিক প্লেসে মার না খেতে হয়। সে তড়িৎ গতিতে রূপসীকে কান্না থামাতে বলে ছুটে যায় হাওয়ায় মিঠাই বিক্রেতার কাছে। আরো একটি মিঠাই এনে রূপসীর হাতে দিতেই সে চুপ করে যায়। আশেপাশের সকলের তীর্যক দৃষ্টি তাকে ভয়াবহ অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এবার সে রূপসীকে কিছু না বলেই গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রূপসী এগিয়ে এসে গাড়িতে উঠতেই ইফাদ যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি ছুটানোর ব্যবস্থা করে। রূপসী মনে মনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মূলত সে ইফাদের রাগ থেকে বাঁচতে চাইছিলো। হাওয়ায় মিঠাই এর জন্য কান্না! সে তো একটি অযুহাত ছিলো মাত্র। তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের ঘূর্ণিঝড় হতে বাঁচার অযুহাত।
______________
আধাপাকা ইটের রাস্তার ধার ঘেঁষে এক গোডাউন ঘর। সেমিপাকা ঘরটির উপরে টিনের ছাউনি। আশেপাশে বাড়িঘর খুব একটা নেই। নিস্তব্ধ পরিবেশ। গোডাউন ঘরের ভিতরে হাতল ভাঙা একটি কাঠের চেয়ারে এক পা তুলে বসে আরাম করে সিগারেট ফুঁকছে মনসুর আলী। তার সামনে মাদুর বিছানো মেঝেতে বসে রয়েছে কাশেমসহ আরো তিনজন। সকলের মুখেই ভয়ের ছাপ। মনছুর আলী সময় নিয়ে সিগারেট খাওয়া শেষ করল। শেষ অংশটুকু চেয়ারের আরেক হাতলে পিষে আগুন নিভিয়ে তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কাশেমের দিকে তাকিয়ে বলে,
–আইজ আমার দুবাই যাওনের কথা আছিলো। মাইয়াগো লইয়্যা। কামডা কি ঠিক হইলো?
–গুরু আমরা তো কইবার পারতাম না ওই ম্যাজিস্টেরেট আইসা পড়বো।
মনছুর আলী প্রচন্ড ক্ষেপে যান। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে সজোরে লাথি মেরে ফেলে দেয় চেয়ারটি। তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে,
–তাইলে তোরা জানোস কি? তোগো মতো আকাইম্মা রাইখা আমার লাভ কী? যেই কোটি টেহার লোকসান আইজ হইলো হেইডার হিসাব বড় বসরে কেমনে দিমু ক?
কাশেম আলী সহ বাকি সবাই ভিষণ চিন্তায় ডুবে যায়। এই বড় বসকে তারা কোনোদিন দেখেনি। এই মানুষটার আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কি না তাও জানে না তারা। এমনকি কোনো পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট কেউই তার সম্পর্কে অবগত নয়। তবে আজ পর্যন্ত মনছুর আলীকে তারা গুরু মেনে সব কাজ করলেও উদ্দেশ্য থাকে বড় বসের সন্তুষ্টি।
_____________
রূপসীদের গ্রামের মাথায় গাড়ি ঢুকতেই রূপসী থামতে বলে। ইফাদ গাড়ি থামিয়ে ঘুরে তাকাতেই রূপসী বলে উঠে,
–এই রাস্তা ম্যালা ছোডো। আপনের এত্তো বড় গাড়িখান ঢুকবো না ম্যাজিস্ট্রেট স্যার। আমারে এইহানে নামায় দ্যান। আমি চইলা যামু।
–বেশ গাড়ি আমি এখানেই রাখছি। তবে তোমাকে তোমার বাড়ি অবধিই দিয়ে আসবো আমি।
ইফাদ গাড়ি থেকে নেমে রূপসীর দরজা খুলে দেয়। রূপসীও নেমে আসে। গাড়ি লক করে এসে রূপসীর সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকে সে। আবছা অন্ধকারে ঢাকা গ্রাম্য রাস্তায় এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে ইফাদের। এভাবে নিশুতি রাতে গ্রামীন রাস্তায় চলাচলের অভিজ্ঞতা হয়নি কখনোই। অবশ্য তার মন্দ লাগছে না। রূপসী বেশ লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। বোঝায় যাচ্ছে তার চেনা পরিচিত রাস্তা। তবে ইফাদের একটু অসুবিধাই হচ্ছে বৈকি। বেশ খানিকটা পথ হেঁটে অবশেষে রূপসীর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো দুজন। বাড়ির উঠোনে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো দেখে রূপসী অবাক হয়ে যায়। তাদের গ্রামে হাতে গোনা কয়েকজনের বাড়িতেই বিদ্যুৎ রয়েছে। যাদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো। কিন্তু রূপসীদের তো বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিলো না। তবে উঠোনে বাতি এলো কিভাবে? তবে কি তার বাবা লাগিয়েছে? দুটো দিন তো হলো সে ছিলো না। এই দুদিনই যেন তাদের বাড়ির আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। মূল ফটকের কাছে এগোতেই ইফাদ ডেকে ওঠে,
–রূপসী!
রূপসী পিছন ফিরে তাকায়।
–তুমি তো বাড়িতে এসেই পড়েছো। তবে তুমি যাও। আমাকে এখনি আবার শহরের দিকে ফিরতে হবে।
–এ কি কথা কন ম্যাজিস্ট্রেট স্যার। একবার আমাগো বাড়িত আসবেন না। একটু পানি তো খাইয়া যান।
–তা সম্ভব নয় রূপসী। তুমি যে বলেছো এর জন্য ধন্যবাদ। আমাকে কাল সকালেই অফিসে উপস্থিত থাকতে হবে। এটা জরুরী। তাই এখন না বেরোলে বেশ দেরি হয়ে যাবে। ভালো থেকো। আসি তাহলে।
–চইলা যাবেন? আইচ্ছা।
রূপসীর মনটা কেন জানি খারাপ খারাপ করছে। সে ইফাদকে বিদায় জানালো। ইফাদও বেশ তাড়া নিয়েই চলে গেলো। রূপসী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ইফাদের যাওয়ার পানে যতক্ষণ না ইফাদ অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই রূপসী খেয়াল করে মুরগীর খোঁয়াড় ফাঁকা। ছাগল গুলোও খুপরি ঘরটাতে নেই। রান্নাঘরের দরজা পুরোটাই খোলা। অথচ তার মা রাতে রান্নাঘরের দরজা ভালোভাবে লাগিয়ে যান। এসব দেখতে দেখতে যখন সে সদর দরজার দিকে আসে সেদিকে তাকিয়েই যেন মুহূর্তেই তার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। দরজায় তালা ঝোলানো। তার জানা মতে কাছে পিঠে তাদের এমন কোনো আত্মীয় স্বজন নেই যাদের বাড়িতে তারা যেতে পারেন। বহুদূরে তার এক খালার বাড়ি রয়েছে তবে তারা তো শহরে থাকে। গ্রামে খুব একটা আসে না বললেই চলে। তাহলে তার বাবা মা কোথায় গেলো? এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে?
গভীর রাত। জনমানবের কোনো শব্দ নেই হয়তো সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। আশপাশ থেকে ঝিঁঝিঁ ডাকার শব্দ আসছে। দূরে কোথাও খেঁকশিয়াল ডাকছে। রূপসীর ভিষণ ভয় হতে শুরু করে। সে মূল ফটকের কাছে এসে এদিক ওদিক তাকায়। নাহ! কাওকে দেখা যাচ্ছে না। রূপসীর কান্না পায়। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। হঠাৎ একটা পায়ের শব্দ শুনে তটস্থ হয়ে দাঁড়ায়। শব্দ অনুসরণ করে তাকাতেই দেখতে পায় দূর থেকে কেউ একজন টলমল পায়ে হেঁটে আসছে। অন্ধকারে মুখ চেনার উপায় নেই। হয়তো পরিচিত কেউ হতে পারে ভেবে রূপসী দাঁড়িয়ে তার আসার অপেক্ষা করতে থাকে। যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়। তার মা-বাবার খবর পাওয়া যায়। মানুষটি রূপসীর কাছাকাছি আসতেই তার আশার বাতি দপ করে নিভে গিয়ে একরাশ ভয়ের অনুভূতি সৃষ্টি করে। কারণ সেই মানুষটি ছিলো তাদের গ্রামের মাতব্বর কুদ্দুস মিঞার একমাত্র ছেলে দিদার। গ্রামের সবচেয়ে নষ্ট ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছেলে। তার কুনজর থেকে বাঁচতে পারেনি গ্রামের একটি মেয়েও। এমনকি রূপসীও নয়। দিদারকে দেখে রূপসী ধীর পায়ে পিছনে ফিরে আসে। দিদার যেন কোনোভাবেই তাকে দেখতে না পায়। ফটকের পাশে গাঢ় অন্ধকারে নিজেকে আড়ালে করার চেষ্টা করে। এই মুহুর্তে এর বেশি পিছতে গেলে দিদারের নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রূপসী নিজের সমস্ত নড়াচড়া বন্ধ করে নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। দিদার টলতে টলতে রূপসীদের বাড়ির ফটকের কাছে এসে পড়ে। গুনগুন করে গান গায়ছে সে। একবার রূপসীদের উঠোনের দিকে তাকায়। রূপসীর আত্মা যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। দু হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সে। যদি দিদার আরেকটু সরে আসে তবেই রূপসীকে দেখতে পেয়ে যাবে। কয়েক সেকেন্ড দিদার উঠোনের দিকে তাকিয়ে পুনরায় টলতে টলতে এগিয়ে যায়। রূপসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজার কাছে থাকা ছোটো বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে। তার শরীর চলছে না আর। এতো কঠিন পরিস্থিতি পার করে এসেও সে বাবা মায়ের কাছে পৌঁছাতে পারলো না এখনো। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। ভিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। এক হাতে সে জল মুছতেই কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পায়। হৃৎপিণ্ড ধরাস করে লাফিয়ে উঠে তার। সারা শরীর শিরশির করে ওঠে। ভয়ে পাথর হয়ে যায় সে। কোনোরকমে খাপছাড়া ভাবে উচ্চারণ করে,
–দি-দি-দার, দিদার ভাইইই……
চলবে…..