#অপরাজিতা

তিশা শাড়িটা কাঁধে ফেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। গাঢ় সবুজ সিল্কের শাড়িটা তার ভারী পছন্দ হয়েছে।
কিন্ত এটা তার নয় নুপুরের জন্য কেনা হয়েছে। আজ নুপুরকে দেখতে আসবে। এই শাড়ি পড়ে সে ওদের সামনে যাবে।
ফর্সা সুন্দর নুপুরকে সবুজে খুব মানাবে। কিন্ত এই নিয়ে নুপুরের কোন আগ্রহ নেই। এটাই কি স্বাভাবিক। বিয়ের সময় মেয়েদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো কি খুব জটিল হয়ে যায়।

এমন সময় নুপুরের মা সালমা বেগম রুমে ঢুকে পড়ে। তিশা মাকে দেখে চট করে শাড়িখানা সরিয়ে ফেলে।

: কি রে নুপুর কই?

: মনে হয় ছাদে।

; মনে হয় কি, তুই জানিস না?

তিশা বোকার মত চেয়ে থাকে। উত্তরের অপেক্ষা না করে সালমা চলে যায়। তার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে চেয়ে দ্রুত শাড়িটা ভাঁজ করে ফেলে।

সিড়িতে শব্দ হচ্ছে। স্যান্ডেলের শব্দ। সালমা বেগম ধুপধাপ শব্দে এমন উপরে নিচে উঠানামা করে। প্রায় যায় উপরে। আজ বরং বেশী। সকাল থেকে এই পর্যন্ত পাঁচ সাতবার গিয়েছে। কারন বিয়ের সব আয়োজন আজ দোতলায় চাচার বাসায় হচ্ছে। এতে নুপুরের আপত্তি ছিল। কিন্ত তার চাচা আদিলের কথাই শেষ কথা।
দেখাদেখির পর্বটা সালমা বেগমও চেয়েছে খুব সাদামাটা হোক। কিন্ত আদিল আয়োজন বড় করে ফেলেছে।
দোতলায় তার ফ্ল্যাটে বিশ পচিশজনের খাবার দাবাড়ের ব্যবস্থা হয়েছে। এই উপলক্ষে ঘরবাড়ি সাফ করা শেষ। সিঁড়ি ধোয়া মোছা ফুলের টব দিয়ে ডেকোরেশন করল।

এটা নুপুরদের দাদাবাড়ি। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে ওদের দাদা কল্যানপুরে জমি কিনে বাড়িটা করেছিলেন। তখন জমিজমা ছিল সস্তা। চাইলেই পাওয়া যেতো। ত্রিশ বছরের সেই পুরানো তিনতলা বাড়ির নিচতলায় ওরা থাকে। নিচতলা খুব স্যাঁতসেঁতে আর ভ্যাপসা। দোতলায় চাচা আদিল চাচী সিলভিয়া আর মেয়ে রাইমা থাকে। রাইমা তিশা একই বয়সের। তিনতলায় ভাড়া দেয়া। আদিল বিদ্যুৎ অফিসে চাকরী করে। ভালো ইনকাম তার। বউ মেয়ে নিয়ে ভালো আছে। কিন্ত শফিক নুপুরের বাবা চাকরী হারানো বেকার মানুষ। বছর পাঁচ হয় সব খুইয়ে ঘরে এসে বসেছে। ধারদেনা করে ছোট একটা দোকান চালায়। সংসারের খরচ কোনমতে চলে এতে।

দরজায় কড়া নাড়ছে সালমা । রাইমার আওয়াজ পেলো তিশা। কেমন একটা ভাব নিয়ে কথা বলে মেয়েটা । নিচতলা থেকে সব শোনা যায়।
তিশার মন খারাপ হয় রাইমাদের টাকা আছে তাই কেমন অহংকার নিয়ে চলে। চাচীও কেমন কেমন জানি। ভিন্ন কেবল চাচা। আদিল চাচা আসলেই ভালো মানুষ।
নইলে বিয়ের পুরো আয়োজন তার বাসায় করতো না।
এসব চাচী পছন্দ করছে না সেটা রাইমার কথা শুনলেই বোঝা যায়।
দশ মিনিট পর সালমা বেগম দোতলা থেকে নেমে আসে।

আজ নুপুর ক্লাসে যায়নি। মন খারাপ করে আছে। যদিও তা বুঝতে দেয়নি কাউকে। সকালের নাশতার পর মুখ ভার করে ঘোরাঘুরি করেছে। এরপর দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে গেছে। ছাদে গেছে এটা তিশা জানে।
মাকে দেখে তিশা।আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে। ঠিক তখন নুপুর ঘরে ঢুকে। তার চোখমুখ শুকনো। দুপুরেও তেমন কিছু খায়নি।
সালমা উদ্বিগ্ন হয়নি এতে। মেয়ের এমন আচরন তার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্ত মুখে কিছু বলেনি।
হাসি হাসি ভাব নিয়ে নুপুরের হাতখানা টেনে ধরে।

: কিরে কই ছিলি এতক্ষণ?

: ছাদে।

: দুপুরে একটু ঘুমালেও পারতি। চেহারায় ফ্রেশ ভাবটা থাকত।

নুপুর রাগ করল না। কিন্ত কোন জবাবও দিলো না। বিয়েটা তার ইচ্ছায় হচ্ছে না। তাই সবাই তাকে আজ একটু বাড়তি খাতির করবে। সে মাত্র অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ে। এই মুহুর্তে তার বিয়ের ইচ্ছেটা ছিল না। তবে পছন্দের কেউ যে আছে সেটাও নয়। তবে রিহান তার পিছু পিছু ঘুরে। দু একবার বলেও ফেলেছে তাকে পছন্দের কথা। নুপুর পাত্তা দেয়নি। রিহান পয়সাওয়ালা পরিবারের ছেলে। দামী গাড়ি দিয়ে ভার্সিটিতে আসে যায়। দামী পোশাক পড়ে। মেয়েদের ছোটখাট একটা দল আছে যারা রিহানকে নিয়ে গবেষনা করে।
নুপুর সব দেখে। কিন্ত এড়িয়ে চলে।

নুপুর মাকে এড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সালমা বেগম ছুটে এসে কপাল ছুঁয়ে দেখে।

: কিরে শুয়ে পড়লি যে?

: আহা, মা কি এত প্রশ্ন করছো।

সালমা বেগম স্বাভাবিক ভাবেই মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। নুপুর পাশ ফিরেই আছে।

: ঠিক আছে একটু ঘুমা। তারপর উঠে হাতমুখ ধুয়ে একটু রেডী হবি। শাড়ি পড়তে না পারলে তোর চাচীকে বলিস।

: ঠিক আছে।

তিশা ড্যাবড্যাব চোখে মা বোনকে দেখছে। তার মন খারাপ হচ্ছে। নুপুর চলে গেলে তার খুব একা লাগবে।

সন্ধ্যের দিকে তিনটি গাড়ি এসে ওদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। আদিল সবাইকে হাসিমুখে দোতলায় বসিয়ে নিচতলায় ছুটে আসে। শফিককে সাথে নিয়ে উপরে যায়।

নুপুর আয়নার সামনে বসে আছে। শাড়ির পিন করা হয়নি। চুলও খোলা। চাচাী সিলভিয়া লাল টকটকে কাতান পড়েছে। পার্লার থেকেও সাজ করেছে। কখন এতসব করল। নুপুর তাকে এক ঝলক দেখে হাসি থামাতে পারল না। কি অদ্ভুত মানুষের চিন্তাভাবনা। কেউ আছে নিজেকে নিয়ে আর কেউ থাকে সবার জন্য।
এক সংসারে এমন অসংখ্য মানুষের সমাহার।

চাচী নুপুরের শাড়ি পিন করতে করতেই সালমা চলে আসে। এক গাল হেসে সিলভিয়া নুপুরকে গুছিয়ে দিচ্ছে।
কিন্ত নুপুর কেমন শক্ত কাঠ হয়ে আছে। তার চোখে আনন্দ খুশীর চিহ্ন নাই। সালমা বেগমের বুকে একটা মোচড় লাগে।
এত বড় খুশীর খবরে মেয়েটা এতটা নিস্প্রভ কেন। কত বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছে। ছেলের বাবা বড় সরকারী চাকুরে। মা ভার্সিটির প্রফেসর। ছেলেটাও কম্পিউটার সায়েন্স থেকে পড়েছে। ভালো চাকরী করছে।
নুপুরের এমন ঘরে বিয়ে হলে সুখের কমতি থাকবে না।

: ভাবী তুমি ভালো একটা শাড়ি পরো, কি পড়ছো এটা?
সালমা হেসে ফেলে।

: এটাই ঠিক আছে।
সিলভিয়া চুল ঠিক করে আবার লিপস্টিক লাগাল। লাল রঙা লিপস্টিকে তাকে জোকারের মত লাগছে।

ড্রইরুমের সবগুলো সোফায় লোকজন বসা। নুপুর বসেছে মাঝখানে। সিলভিয়া নুপুরকে এক হাতে ধরে রেখেছে। ছেলের মা উঠে এসে নুপুরের পাশে বসলেন। ভদ্রমহিলা অতিশয় সাধারন বেশভুষা।
নুপুর আড়চোখে কয়েকবার ভদ্রমহিলাকে দেখল। চশমা পড়া চোখগুলো কেমন অহমিকায় ঠাসা। পয়সাওয়ালা হলেও অহংবোধের ছাপ পরিস্কার।

আদিল একে একে সবার সাথে শফিককে পরিচয় করিয়ে দিলো। আদিল বিয়েটার মাধ্যম হয়ে কাজ করছে। ছেলের বাবা কেতাদুরস্ত। পরিপাটি পোশাক গায়ে।
নুপুরের হঠাৎ কেমন অস্বস্তি লাগল। এত এত লোকের মাঝে সেই মানুষটিকে চোখে পড়ছে না কেন।
পরিচয় পর্ব শেষে ছেলের বাবা বলে উঠল।

: আমার ছেলে রিফাত। সে আমার একমাত্র ছেলে। খুব মেধাবী। ও কম্পিউটার সায়েন্স থেকে স্কলার রেজাল্ট করে একটা জবে আছে। ওর সম্পর্কে সবই আপনারা জেনেছেন। তবে একটা বিষয় একটু খোলাখুলি বলে নিলেই ভালো হয়।

ভদ্রলোক এটুকু বলে থামল। আদিল কেমন উশখুশ করছে। শফিকও বুঝল না বিষয়টা কি। সালমা বেগম এক কোনায় চুপচাপ বসে আছে। উপস্থিত সবার মাঝে একটা গুঞ্জন। সবাই কেমন নিচু স্বরে একে অন্যের সাথে কথা বলে যাচ্ছে।

নুপুরের মুখ কালো হয়ে গেছে। পাশে বসা চাচীকে আস্তে করে জিজ্ঞাস করে বসল।

: চাচী ছেলে কোনটা?
সিলভিয়া ফিসফাস করে কথা বলছে।
: তুই কি ছেলের ছবি দেখিস নাই?
নুপুর না করতেই সিলভিয়া চোখের ইশারায় সামনে প্যান্ট শার্ট টাই পড়া ছেলেটিকে দেখিয়ে দেয়।

: ওই যে আকাশী শার্ট গায়ে।

নুপুর চোখ তুলে তাকাতেই দেখে ছেলেটি মাথা নিচু করে বসে আছে। খুব অন্যমনস্ক। লম্বা গড়ন। কিন্ত অনেকক্ষণ পরও ছেলেটা একমনে ওভাবে বসে রইল।
নুপুর তার চাচীকে খোচা মেরে বলল।

: চাচী ছেলেটা কি বোবা?

সিলভিয়া চমকে উঠে এই কথায়। নুপুরের হাতটা সে ছেড়ে দেয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নুপুর ছেলেটাকে আরেকবার দেখল।

বিঃদ্র- জীবন থেকে নেয়া ছোট ছোট কথাগুলো গল্প হয়ে যায়। প্রিয় পাঠকদের জন্য আবারও লিখলাম তেমন একটা গল্প। ভালো লাগলে পরের পর্ব লিখতে পারি।

….. তামান্না হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here