#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৬
ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আড্ডায় মেতে আছে চার বন্ধু।ধৌয়া উঠা গরম গরম কফির মগে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে সেহেরিশ।তার পাশেই বসে আছে জুহি।সেহেরিশের বেস্ট ফ্রেন্ড জুহি।গত সাত বছর থেকে তাদের সম্পর্ক।জুহির বাড়ি বাংলাদেশে।সেহেরিশের মুখোমুখি কেইন এবং তুন্দ্র।তুন্দ্র একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ছেলে তার বাড়ি ইন্ডিয়ায়।ইতালি শহরে চাচার সঙ্গেই তার বসবাস। সেহেরিশের সাথে বেশ কয়েক বছর থেকেই পরিচিত।নিরবতা ছেদ করে কথা তুললো কেইন,
– সেহেরিশ আজ তো আমাদের এক্সাম শেষ তোমার গুড নিউজটা দিয়ে দাও সবাইকে।
– ইয়াহ!আমরা এবার লং ট্যুরে যাবো ফ্রেন্ড উইথ ফ্যামিলি।
সেহেরিশের কথা শেষ করতেই জুহি আড় চোখে তাকায় তার দিকে।
– আমরা ট্যুরে যাবো এটা নতুন কী?এটা নিয়ে আলোচনা করার কিচ্ছু নেই বরং শপিং করতে নেমে পড়ি এটাই ভালো।
জুহির কথা তাল মেলালো তুন্দ্র,
– ইয়েস,জুহি ঠিক বলেছে।
– শপিং তো আমরা করবোই আচ্ছা যাই হোক।মেন্টালি প্রিপেইড থাক এটাই বড় কথা।
সেহেরিশ কথা শেষ করে উঠতে নিলেই তার ফোন বেজে উঠে।হাতে মোবাইল নিয়ে চেক করতেই খুরশীদের নাম্বার দেখে চোখে মুখে হাসির ঝলক ভেসে উঠে,
– হ্যা পাপা বলো,
– তুমি কোথায় মামনি?
– ভার্সিটিতেই আছি।
– তোমার বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে চলে আসো।বাকি কথা পরেই হবে।
– ওকে পাপা।
সেহেরিশ ব্যাগ পত্র গুছিয়ে দ্রুত সবাইকে তার সাথে যেতে বললো।বাকিরাও দ্বিমত পোষণ না করেই সেহেরিশের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো।
তুন্দ্র,কেইন,জুহি সেহেরিশদের বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই মারুফার সাথে হাসি আড্ডায় মেতে উঠলো।মারুফার জীবনে ভাই ভাবী আর ভাই’ঝি ছাড়া কেউ নেই।স্বামী মারা গেলেন বেশ কয়েক বছর আছে।অন্যদিকে সেহেরিশের বন্ধুগুলো যেন তাদের পরিবারের আরেক দল সদস্য তাই প্রতিটা ইভেন্টে তুন্দ্র, কেইন,জুহি এই বাড়িতে হাজির হয়ে যায়।মারুফার সাথেও তাদের বেশ ভালো বন্ধুত্ব।
– ফুপ্পি আমাদের জন্য কী সারপ্রাইজ আছে বলনা?
কেইনের কথায় সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো মারুফার দিকে।মারুফা কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন সেহেরিশের মা ফাহমিদা।
– তোমাদের পাশাপাশি সেহেরিশের জন্য ও বিষয়টি সারপ্রাইজ তাই আগে তার পাপা আসুক তবেই বলবো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয় খুরশীদ আনোয়ার।মেয়ের মাথাটা বুকে জড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– বলতো কী সারপ্রাইজ আছে তোমাদের জন্য?
– আঙ্কেল আমরা যেহেতু ঘুরতে যাবো নিশ্চই ভালো কোন জায়গায় যাবো?
কেইনের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলেন মুরশীদ।
– আমরা বাংলাদেশে যাচ্ছি!
মুরশীদের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে সেহেরিশ। তার অবস্থা বুঝতে পেরে দ্রুত তার হাত চেপে ধরে মারুফা।
– বাংলাদেশ!বাংলাদেশ কেন বাবা?বাংলাদেশে কেন যেতে হবে আমাদের?এই ছাড়া কি আর কোন প্লেস নেই?
– আজব! তুমি এত রাগ দেখাচ্ছো কেন?ভুলে যেওনা তোমার জন্মস্থান বাংলাদেশেই।আগামী মাসে তোমার ফুফা এবং দাদা-দাদীর মৃত্যু বার্ষিক।গত কয়েকবছর আমাদের বিডিতে যাওয়া হয় নি এখন যেহেতু তুমি ফ্রি আছো তবে যেতে সমস্যা কোথায়?
– বাবা আমার শেষ কথা আমি যাবো না ,মানে যাবো না। নো নেভার।
সেহেরিশ রাগ দেখে মারুফা চোখ ইশারা দেন।তাতে আরো রেগে যায় সেহেরিশ,
– ফুফু তুমি জানতে বাবা-মা বিডিতে যাওয়ার প্লানিং করছে?তুমি জানো না আমি বিডিতে যেতে চাই না।তবে কেন নিষিধ করো নি তাদের?
সেহেরিশের রাগ দেখে বন্ধুরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে।শান্ত মেজাজের সেহেরিশের এমন রাগ আগে কখনো দেখেনি তারা।বাংলাদেশ নিয়ে রেগে যাওয়ার কোন কারন বুঝতে পারলো না তারা।মুরশীদ মেয়ের উগ্রতা দেখে রেগে যান আর তা বুঝতে পেরে ফাহমিদা সেহেরিশের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকায়।
– সমস্যা কি তোর সেহেরিশ?বিডিতে গেলে কি সমস্যা হবে তোর?
– আমি যাবো না মানে যাবো না।তোমাদের যেতে ইচ্ছা তো যাও।আমি একাই থাকবো বাড়িতে।
সেহেরিশের এমন হঠকারিতা দেখে দ্রুত নিচে নেমে আসে তার একমাত্র ভাই সামী।
– আপু তুমি রেগে গেলে কেন?
পনেরো বছরের দুরন্ত ছেলে সামী।সামী সেহেরিশের একমাত্র ছোট ভাই।বোনের এমন রাগ দেখে কিছুতেই কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলো না।
– সামী তোমায় বলেছিনা বড়রা কথা বললে তুমি তার মাঝে আসবে না।তবে কেন এলে?
মুরশীদের কথায় মাথা নামিয়ে চলে যায় সামী।
সেহেরিশ তার বাবার রাগ বুঝতে পেরে নিজেকে ধাতস্ত করে নেয়।
– লিসেন পাপা আমি যাবো না তোমাদের ইচ্ছে হলে তোমরা যাও।কিন্তু আমি না।
সেহেরিশ নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।রাগে তার সারা শরীর কাপছে।আবার সেই অনন্তপুর আবার সেই চন্দনপুরের স্মৃতি তাকে মুষড়ে দিচ্ছে।মাত্র দশটা দিনের দেখায় একটা মানুষের সাথে, সারাজীবন যে তাকে ভুক্তে করতে হবে কে জানতো?
এতক্ষণ হাতে ধরে রাখা আপেলটি ঝুড়িতে রেখে সোফায় বসে পড়লো কেইন।
– হোয়াটি’স দ্যা রিজন ফর সেহেরিশ এংরি?
কেইনের প্রশ্নে তার পাশে বসে যায় জুহি।গালের নিচে হাত দিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
– আই ডোন্ট নো কেইন।
খুরশীদ লজ্জিত ভাব নিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্য বলে,
– সেহেরিশের আচরণে তোমরা কিছু মনে করো না।তোমরা কী বিডিতে যেতে চাও?
– ইয়েস আই ওয়ান্ট টু গো আঙ্কেল।
কেইনের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলেন খুরশীদ।বাকি সবাই যাওয়ার জন্য মত পোষণ করলে ফাহমিদা আর খুরশীদ তাদের তৈরি থাকতে বলেন।এদিকে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন মারুফা।
—
বাড়ির সব কিছু আবারো তকতকে ঝকঝকে করতে উঠে পড়ে লাগলো আফীফ।সেই ভোর থেকেই বাড়ির বাগান,ছাদ পুরো ঘরটাই আবারো নতুন করে সাজানো হয়েছে।আফীফের রুমের পাশের সেই গোপন কক্ষটাকে আবারো অন্যভাবে সাজানো হয়েছে।বর্তমানে এটি গোপন কক্ষ নেই বললেই চলে,তবে সবার চক্ষু আড়ালে গোপনীয়তা এখনো বজায় আছে।চারিদিকে ফুল,পুতুল,তারা,ঝার বাতি,পেইনটিং, সাদা রঙের পর্দায় সাজানো পুরো কক্ষটি দেখলে যে কারো তাক লেগে যাবে।
পুরো দেওয়ান মঞ্জিল জুড়ে এমন নিটোল রুম শুধু মাত্র দুটি আছে একটি আফীফের রুম এবং অন্যটি আফীফের গোপন কক্ষ।আফীফ সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই মর্জিনাকে চোখে পরে,
– মর্জিনা খালা আপনাকে বলেছিলাম মায়ের কাছে যেতে এখানে কী আপনার?
– বড় আম্মা পাঠাইছে তোমার কাছে।আম্মার কি যানি কথা আছে।
-ঠিক আছে দাদীজানকে বলে দাও আমি আসছি।
আফীফ সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে নিজের রুমে যায়।গায়ে থাকা ধূলো জমা শাটটা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়।আলমারি থেকে অন্য একটি শার্ট নিয়ে গায়ে জড়াতেই দেয়ালের দিকে লক্ষ্য যায়।সেহেরিসের হাস্যউজ্জ্বল ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে যেন সৎবিৎ হারিয়ে ফেলে আফীফ।ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ছবিগুলোতে হাত বুলায়।
– আমার ছোট্ট তাকিয়া এখন তুমি সেহেরিশ!আমি অধীর আগ্রহে, তোমায় কখন এই দেওয়ান মঞ্জিলে আবারো স্বাগতম করবো।যত রাগ আছে সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসো।আর বন্ধী করবো না আর বকবো না।তবুও ফিরে এসো…তুমি জানো গত আট বছর আমার কি অবস্থায় পার হয়েছে?উহুহ যানো না।তোমার উপর রাগ দেখিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়েছি।দিনের পর দিনে ওষুয় সেবনে আমি যে মৃত্যুর পথ যাত্রী হয়ে গেছিলাম তা কি তুমি জানো?উহু’হ যানো না।তবে যানবে ধীরে ধীরে আগের মতো তাড়াহুড়ো নয়।একটু সবুর করো।
সেহেরিশের ছবিতে হাত বুলিয়ে আফীফ সেখান থেকে চলে যায়।খুব শীঘ্রই তার জীবনে নতুন দিনের সূচনা হবে।
—
গভীর রাতে মনমরা হয়ে বসে আছে সেহেরিশ।তার সব সুখ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।ফুল গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ে কানে গুজে গালে হাত দিয়ে চিন্তায় মগ্ন সে।তখনি তার রুমে প্রবেশ করেন মারুফা।
– তুমি কেন আমার ঘরে এসেছো ফুফু?
– রেগে যাচ্ছিস কেন তুই?
– তুমি জানো আমি ফিরতে চাই না বিডিতে তবে কেন পাপার সাথে তালে মেলালে?
– তোকে কিছু কথা বলি শোন!আমরা ঢাকায় যাবো সেখানে হোটেল বুক করে কয়েকদিন থেকে অনন্তপুরে যাবো।তোর ফুফা দাদাভাই দাদীর কবর জিয়ারত করে আবার ফিরে আসবো। এতে চন্দনপুরের ভয় আসছে কেন?আর আট বছর আগের ঘটনা আট বছর পর ফিরে আসবে না।গিয়ে দেখ গ্রামের জমিদারের নাতি এতদিন বিয়ে শাদী করে সংসার সামলাচ্ছে।এটাও তো হতে পারে চন্দনপুরের সেই জমিদারের সব রাজস্ব হারিয়ে ফেলেছে।তুই চিন্তা নিচ্ছিস কেন?তাকিয়া নামের কোন মেয়ের কথা হয়তো বা তাদের মনেও নেই।সব ভুলে গেছে।এই আট বছরে তুই পাল্টেছিস তোর জীবন পাল্টেছে ঠিক তাদেরো।তাই তোর ভালোর জন্য বলছি ভাইজানের মনে কষ্ট না দিয়ে বিডিতে চল।
– যদি আবারো ফিরে আসে আফীফ দেওয়ান?আর আমায় বন্ধী করে নেয় গোপন কক্ষে?
– দূর বোকা মেয়ে!তখন তুই ছিলি একা এখন তোর সাথে আমরা আছি।সেদিন যদি পারভিন না থাকতো তবে যে কি হতো?আমি হয় তো তোকে ফিরেই পেতাম না।টাকা কি না করতে পারে।টাকার লোভে দেওয়ান বংশের সাথে পাল্লা দিয়ে পারভিন তোকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।টাকাই সব!
– তার মানে তুমি বলতে চাইছো আমি যাবো?
– কেন নয়?তোর সাথে কেইন,জুহি,তুন্দ্র যাবে তবে তুই কেন যাবি না?
– ঠিক আছে আমি পাপার সাথে কথা বলে নেবো।
– তাহলে আমাদের লং ট্যুর বিডি?
– ইয়েস!
সেহেরিশ হাসি মুখে সবটা সমাধান করলেও মনের ভেতরটায় জমে থাকা ভয় টা এখনো কাটে নি।
#চলবে…