#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২১

অন্ধকার একটি কক্ষে দীর্ঘ কয়েক বছর বন্দি সে।দূর থেকে গানের আওয়াজে চাতক পাখির মতো চারিদিকে চোখ বুলায়।কান খাড়া করে বেশ কয়েকটি মেয়ে ছেলের জোরে জোরে কথা বলার শব্দে আবারো বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে বসে।তখনি দরজা খোলার শব্দে আবারো উঠে দাঁড়ায় সে।
তার সামনে মধ্যে বয়স্ক একজন ব্যাক্তি খাওয়ারের থালা এগিয়ে দিয়ে বলে,
– খাইয়া লও রাত বহুত হইছে।খাওন দিতে ভুইলা গেসিলাম।মেলা কাম দেওয়ান বাইত।
লোকটির কথায় ব্যাক্তিটির ঠোঁটের কোনে হাসির আভাস পাওয়া যায়।মনের সংশয় মেটাতে দ্রুত প্রশ্ন করে সে,
– আফীফের কি বিয়ে নাকি আজ?
– খুশি হইয়া লাভ নাই আজ আফীফ ভাইজানের বিয়া না।
– তবে! তবে এত গান বাজনা হই হুল্লোড় কিসের?
– বছরের শেষ বিদায় দেওয়ার লাইগা এত আয়োজন৷আমি যাই গা কাম আছে বহুত।

লোকটি আবারো নিজ গন্তব্য ফিরে যায়।অবরুদ্ধ ব্যাক্তিটি খাওয়ারের থালাটা হাতে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে থাকে।
____

গত কয়েক বছরে এই দেওয়ান মঞ্জিলে এত জোরে গান বাজনা হই হুল্লোড় দেখা যায় নি।সবাই আফীফের ভয়ে তটস্থ থাকতো।নিয়ম করে চলাফেরা ছিল তাদের সকলের অভ্যাস। কিন্তু আজ সবটা পালটে গেছে দেওয়ান মঞ্জিলে।সেহেরিশ, তুন্দ্র, কেইন পালটেছে আজ সেই নিয়ম।গানের তালে তালে ছাদে সবাই মিলে নেচে গেয়ে মাতিয়ে তুলছে।আফীফ দূরে চেয়ারে বসে সেহেরিশের কান্ড দেখছে।নাচের তালে তালে হুট হাট আছাড় খেয়ে তুন্দ্র কিংবা কেইনের সাথে ধাক্কা লাগছে।আবার সামী, আমান, মৌয়ের হাত ধরে নেচে যাচ্ছে।কে বলবে এই ছেলে মেয়েগুলো এতটা চলোর্মি। সব সময় তো আফীফের সামনে ভদ্র চুপচাপ থাকে।

খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে যায়।ক্লান্ত শরীরটা আফীফ বিছানায় এলিয়ে গাঢ় করে শ্বাস ছাড়লো।আজ সেহেরিশকে ভালোভাবে গানের মাধ্যেমে শায়েস্তা করেছে তাতে বেশ খুশি আফীফ।

রাত প্রায় শেষ হতে চললো আড্ডা মাস্তি শেষে সেহেরিশ রুমের দরজা খুলতেই হাতে টান পড়ায় সহসা ঘুরে তাকায়।কেইনকে দেখে কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ধমকের সুরে বলে,
– সমস্যা কি?এইভাবে টান দিলি কেন?
– বলেছিনা সারপ্রাইজ আছে।
– কি সারপ্রাইজ?
– আয় আমাদের রুমে।

সেহেরিশ বিরক্ত মুখ নিয়ে কেইনের পিছু পিছু তাদের রুমে যায়।দরজা খুলতেই চাপা আর্তনাদ করে উঠে সেহেরিশ।এক দৌড়ে রুমে ঢুকে ঝাপিয়ে বসে যায় বিছানার উপর।টেবিলের সামনে সাজিয়ে রাখা ওয়াইন,হুইস্কির বোতলের দিকে তাকিয়ে সেহেরিশ আবারো লাফিয়ে উঠে।

– তোরা কোথায় পেলি এইসব?
– সারপ্রাইজ টা কেমন ছিল?
– পুরাই জোশ। আগে বল কোথায় পেলি?পাপা দেখলে কিন্তু মেরেই ফেলবে আমায়।
– ঢাকায় গেলাম যে আসার সময় নিয়ে এসেছি।চাপ নিস না।দুই প্যাগ নিয়ে রুমে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাবি।হুট হাট এক দুইবার মাতাল না হলে চলে না।

তুন্দ্রের কথায় ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো সেহেরিশ।তিনজনে তিনটে গ্লাস তুলে নিয়ে ‘চিয়ার্স’ বলে আরো একবার আড্ডায় মেতে উঠলো।

ঘুমের ঘোরে চোখটা লেগে আসছিল আফীফের তৎক্ষনাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজে দরজা খোলার উদ্দেশ্য বিছানা থেকে নেমে যায়।কে এসেছে এই মূহুর্তে? দাদাজান নয়তো নাকি বাবা?
ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে সামনে সেহেরিশকে দেখেই চমকে যায়।

– কী সমস্যা?এত রাতে আমার রুমে কী?
– উহহহহ একটু আদর করে কথা বললে কি হয়?

সেহেরিশের ঠোঁট উলটে কথায় আফীফের মনে সন্দেহের বাতি জ্বলে যায়।ভ্রু কুচকে সেহেরিশের দিকে এগিয়ে আসতেই উটকো গন্ধ নাকে লাগে।
– তুমি ড্রিংস করেছো?
আফীফের ঝাঝালো কন্ঠে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে উঠে সেহেরিশ।নিরিবিলি পরিবেশে সেহেরিশের ফ্যাচফ্যাচে কান্নার আওয়াজ সবার কানে যাবে বলে আফীফ দ্রুত সেহেরিসের মুখ চেপে ধরে।
– চুপ, বাড়ির সবাই জেগে যাবে।তোমার রুমে চলো।

আফীফ নিজের রুমের দরজাটা ভিড়ে সেহেরিশকে নিয়ে দ্রুত তার রুমে চলে যায়।সেহেরিশের রুমের দরজাটা বন্ধ করে আফীফ তাকে ছিটকে দূরে সরিয়ে দেয়।
– এই বাড়িতে মদ আনার সাহস কার হলো?
আফীফের ধমকে কেঁপে উঠে সেহেরিশ।আমতা আমতা করে বলে,
– ত-তুন্দ্র,কেইন।
– তোমাদের আমি এই বাড়িতে হইহুল্লোড় করতে দিয়েছি মানে এই না যে যা ইচ্ছা তাই করবে।মদ আনার মতো সাহস করে তোমরা মোটেও ভালো করো নি।
সেহেরিশ প্রত্যুত্ত করলো না।ঠোঁট উলটে তাকিয়ে রইলো আফীফের দিকে।
– চুপচাপ ঘুমিয়ে যাও আমি আমার রুমে গেলাম।
আফীফ যেতে নিলেই সেহেরিশ আবারো তাকে টেনে ধরে।
– না না না আমি একা থাকবো না আমাকে নিয়ে যাও। আমি একা থাকবো না।
– আরে আজব এমন নাটক করার মানে কি?

আফীফ রাগের মাথায় আবারো সেহেরিশকে ধমক দেয়।যার দরুনে দু পা পিছিয়ে যায় সেহেরিশ।তার চোখের কোনে চিকচিক করছে নোনা জল।আফীফ তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়।সেহেরিশ যে এখন সজ্ঞানে নেই তা বুঝতে পেরে তার মাঝে অনুতপ্তের আভাস দেখা যায়।
– সেহেরিশ তুমি ঘুমিয়ে যাও আমি বরং যাই।
– না আমায় ছেড়ে যেওনা।

আফীফ ঘুরে তাকায়।গাঢ় করে শ্বাস ছেড়ে হতাশার দৃষ্টিতে তাকায় সেহেরিশের দিকে।সহসা সেহেরিশ আফীফের পায়ের উপর নিজের পা রাখে।দু পা উচু করে আফীফের গলা জড়িয়ে ধরে কিঞ্চিৎ হাসে।
– করছো কি তুমি?
– কই কি করলাম?
– আমার পায়ের উপর কি তোমার?
– আমায় ভালোবাসো না?

আফীফ থেমে যায়।সেহেরিশের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার মুখমন্ডলে ফু দিয়ে বলে,
– তুমি কি জানো মাতাল অবস্থায় মানুষের পেট থেকে সত্যি কথা বেরিয়ে যায়।
– উহু, আমি কি বলছি ভালোবাসো আমায়?
– অনেকটা!কিন্তু তুমি না আমায় ভালোবাসো আর না আমায় তোমায় ভালোবাসতে দাও।কি করি আমি বলতো?
– জানি না।
– তবে জানবে কে?আমায় ভালোবাসো তাকিয়া?

সেহেরিশ উত্তর দিলো না।বরং আফীফের গালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তার কান্ডে বাকরুদ্ধ আফীফ।
– কি করছো তুমি?যখন সজ্ঞানে ফিরবে তখন কিন্তু আফসোস হবে তোমার কাজের জন্য।
– তাতে কি? চলোনা আমরা বিয়ে করি।
এমন কথায় আফীফ চমকে যায়।এক গাল হাসি দিয়ে বলে,
– আরে বাহ, প্রেম করতে চায় না যে জন।সে জন এসেছে আমাকে বিয়ে করতে।সূর্য আজ কোন দিকে উঠলো।
– এমন করছো কেন?বলনো না ভালোবাসি।
– ভালোবাসি, ভালোবাসি,ভালোবাসি।আর কতবার বললে বিশ্বাস করবে তুমি?

সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।হেলেদুলে হেটে নিজের ফোন নিয়ে গান চালিয়ে দিলো।তার কান্ডে আফীফের মাথায় হাত।
– সমস্যা কি তোমার।এখন আবার গান চালালে কেন?
– একটু নাচবো তোমার সাথে।
– উফফ কি সব বায়না তোমার। আমি নাচতে পারিনা।
– আমি নাচবো মানে নাচবো।

সেহেরিশ আফীফের হাত টেনে নাচতে শুরু করে।বেচারা আফীফ উপায় না পেয়ে সেহেরিশের সাথে হেলে দুলে নাচতে থাকে।হুট করেই সেহেরিশ সবচেয়ে অবাক কান্ড করে বসে।আবারো আফীফের পায়ে পা রেখে তার ডান গালে জোরে কামড় বসায়।কামড়টা এতটাই জোরে লাগে যে আফীফ সহ্য না করতে পেরে চিৎকার দিয়ে উঠে।

– পাগল হয়ে গেলে নাকি তুমি?
– তুই হাসবি না তোকে হাসতে দেখলে আমার রাগ লাগে।
– তাই বলে তুমি এইভাবে কামড় বসাবে।দেখো রক্ত!
সেহেরিশ হুট করেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে।আফীফ সেহেরিশের কান্ডে হাসবে নাকি কাদবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।ভোরের পাখি ডাকার কিচিরমিচির শব্দ ধীরে ধীরে বাড়ছে।বাড়ির সবাই জেগে যাবে সেই চিন্তা এক মূহুর্তেই আফীফের মাথায় ভর করেছে।দ্রুত সেহেরিশকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয়।
– প্লিজ ঘুমিয়ে যাও।যদি বাড়ির সকলে তোমার কান্ড দেখে তবে আজ আর রক্ষে থাকবেনা।
– না আমি একা ঘুমাবো না তোমার সাথে ঘুমাবো।
– উফফ কি যন্ত্রণায় পড়লাম আমি।তুমি ঘুমাবে নাকি আবার আমি সেই গান গাইবো?
– তোমার গান আমি শুনতে চাইনা বিশ্রি লোক।
– তাহলে ঘুমিয়ে যাও।

সেহেরিশ হেলেদুলে আবারো সটান হয়ে শুয়ে যায়।আফীফ তার দিকে এগিয়ে এসে ভালোভাবে গায়ে কম্বোল জড়িয়ে দেয়।
– হেই গুডনাইট কিসি দাও আমাকে।
– এখন কি গুড নাইট নাকি গুড মর্নিং?আমি নিজেও কনফিউজড।
সেহেরিশ ঠোঁট বাকিয়ে শুয়ে পড়ে।আফীফ তার চুল গুলো কানের গুজে দিয়ে কপালে গাঢ় করে চুমু খায়।

– কেন বার বার মায়ায় জড়াও?এতটা মায়ায় জড়িয়ো না যতটা মায়ায় জড়ালে তোমাকে ছাড়া আমি অপূর্ণ থেকে যাবো।

সকালে নাস্তার টেবিলে বাড়ির সবাই উপস্থিত থাকলেও উপস্থিত নেই কেইন, তুন্দ্রএবং সেহেরিশ।আফীফের ডান গালে ব্যান্ডেজ দেখে বাড়ির সবাই উদ্‌বেগ।
– কিরে আফীফ তোর গালে কি হয়েছে?
– তেমন কিছু না দাদাজান।
– তেমন কিছু না মানে?গালে কি হয়েছে সেটা বল।
– উফফ এত প্রশ্ন কিসের।

আফীফের হঠাৎ রাগে আহনাফ দেওয়ান ভড়কে যান।আফীফের গালের দিকে সবার আড় চোখে তাকানো দেখে আফীফ দ্রুত খাওয়ার শেষ করে উঠে যায়।দোতালায় নিজের রুমের দিকে যেতে নিলেই আচমকা সেহেরিশসের সাথে ধাক্কা খায়।
– আহ
– এই মেয়ে চোখ কি বেগে রেখে হাটো?
– আরে আজব আপনি আচমকা এসে ধাক্কা দিয়ে আপনি নিজেই বাজে ব্যবহার করছেন।
আফীফ থেমে যায়।ভালোভাবে সেহেরিশের দিকে চোখ বুলিয়ে গমগম সুরে বলে,
– মাথা কি ভার লাগছে?
– তা লাগছে।আপনি জানলেন কি করে?
– কিছু না।
– এই আপনার গালে কি হয়েছে?
– কেন তোমার মনে নেই?
– কী মনে থাকবে?
– কাল রাতের কথা।
– কাল রাতে কি হয়েছে?
– আমাকে লাভ বাইট দিয়েছো তার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি।
– আল্লাহ!কি বলছেন এইসব?
– আরে সব ভুলে গেলে।কত কিছু হয়েছে তুমি সব ভুলে গেছো যাক ভালোই হলো।তুন্দ্র আর কেইনের সাথে ড্রিংস করে আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই করেছো।
– কি করেছি আমি?
– ওই যে… থাক বলবো না।
– আরে বলুন প্লিজ। আরে কোথায় যাচ্ছেন?

আফীফ দ্রুত নিজের রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।এদিকে সেহেরিশ তার রুমের দরজায় করাঘাত করে যাচ্ছে।
– এই যে বলুন প্লিজ কি হয়েছিল কাল।

আফীফ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাল ছুঁয়ে হাসতে থাকে।
– নিলাম প্রতিশোধ।এবার কাল রাতে আর কি কি হয়েছে উলটা পালটা সব ভাবতে থাকো।আমি বরং বিনোদন উপভোগ করি।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here