#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৫

আফীফের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পাইচারি করছে সেহেরিশ।দুপুরের পর আফীফের আর দেখা মিলেনি কোথায় আছে কে জানে।তখন পা’য়ে এমন ভাবে ছুরিটা কোপ পড়ছে ভাবতেই সেহেরিশের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।মানবিক কারনে হলেও আফীফকে এই মূহুর্তে একবার দেখা জরুরি।কিন্তু আফীফের দরজাটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া কোথায় আছে কোন খোঁজ পাচ্ছে না সেহেরিশ।বাড়ির কাউকে জিজ্ঞেস করতে গেলে এখন বিষয়টি কেমন যেন দেখায় তাই আফীফের রুমের সামনেই পায়চারি করছে সে।

কিছুক্ষণ পর আমানকে দেখে সেহেরিশ এক ছুটে তার কাছে যায়।
– আমান!আমান!
– হ্যা আপু বলো।
– তোমার ভাইয়া কই?আই মিন আফীফ।
– ভাইয়া তো মনে হয় ছাদে গেছে।
– আজ তো প্রচুর শীত,শৈত্যপ্রবাহ। এমন ঠান্ডায় ছাদে কি করছে?
– তা তো আমি জানি না আপু।ভাইয়া আমাকে বলেছিল তার জন্য কফি নিয়ে যেতে আর ছাদের দিকে যেন কেউ না আসে।ভাই একা থাকতে চায়।
– আমি গেলে কি কিছু হবে আমান?

সেহেরিশের ভীতু মুখখানা দেখে ঠোঁট চেপে হাসে আমান।
– কি বা হবে তুমি বলো?
– যদি ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় আমায়?তখন কি করবো?
– তবে আবার ভাইয়া তুলে নেবে সমস্যা নাই তুমি যাও বাকিটা তোমার দেওর সামলে নেবে?
– মানে?
– না না না না কিছু না কিছু না তুমি যাও আপু।সন্ধ্যা নেমে এসেছে।

সিড়ি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছাদে প্রবেশ করবে কি করবে না বলে দ্বিধা সংশয়ে ভুগছে সেহেরিশ।আড়াল থেকে আফীফের অস্তিত্বর দেখা মিললো না।সংশয়কে দূরে ঠেলে দ্রুত ছাদে প্রবেশ করে সে।চিলেকোঠার ঘরের দরজাটা ভিড়ানো দেখে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে আসে।

আফীফ পুরোনো একটি সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।পায়ের রক্তে ভিজে আছে ব্যান্ডেজটা।শার্টের হাতা ফোল্ড করে বাম হাত কপালের উপর ঠেকিয়ে রেখেছে।তাকে দেখে বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে সে কোন কারনে বেশ চিন্তিত।কিন্তু রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজ দেখে সেহেরিশের গা শিউরে উঠে।

– একি আপনি এখনো এই পা নিয়ে বসে আছেন?ডাক্তারের কাছে কে যাবে?

বেগবান গতিতে সেহেরিশের কথায় তড়াক করে তাকায় আফীফ।কপালে ছুঁয়ে থাকা চুল গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে।

– এখানে কেন এসেছো তুমি?
– আপনার পায়ের এই অবস্থা আর আপনি নরমাল ভাবে ব্যান্ডেজ করে বসে আছেন?আপনার কুইকলি স্টেচ করা প্রয়োজন।তা না হলে ইনফ্যাকশন হবে।
– হলে হবে আমার কোন সমস্যা নেই।
– আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি আপনি আমার উপর রেগে আছেন।বিশ্বাস করেন আমি জানতাম না ছুরিটা এইভাবে আপনার পায়ে লাগবে।
– ইট’স ওকে।সমস্যা নেই।

– তাহলে ডাক্তার দেখাচ্ছে না কেন?
– মাঝে মাঝে নিজের শরীরে আঘাত দিয়ে মনের চাপা রাগ মেটানো যায়।আর মনের চাপা রাগ কেটে গেলে প্রফুল্ল লাগে।যানো তো মেঘ কেটে গেলে আকাশটা কেমন পরিষ্কার শুভ্র লাগে!

আফীফের এমন উওরে ফস করে শ্বাস ছাড়লো সেহেরিশ।সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে আফীফ এখন তর্কে লেগেছে সহজে এই তর্ক ছাড়বেনা।

– আপনি উঠুন প্লিজ।ব্যান্ডেজ করা স্বত্তেও এখনো রক্ত ঝরছে।আম সরি আসলে বিষটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটে গেছে।

সেহেরিশের কথায় পাত্তা দিলো না আফীফ।বরং পায়ে থাকা ব্যান্ডেজটা সহসা খুলে ছুড়ে ফেলে দেয়।আফীফের রক্তাক্ত ক্ষত স্থান দেখে আর্তনাদ করে উঠে মেয়েটি।

– প্লিজ প্লিজ এমন করবেন না।দ্রুত পা ঢাকুন আমার রক্ত সহ্য হয় না মাথা ঘুরায় এক কথায় রক্তে আমার ফোবিয়া আছে প্লিজ আপনি এসব পাগলামি করবেন না।

সেহেরিশ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাগুলো শেষ করে।আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ হাসে।মনে মনে আফসোস সুরে বলে,
– এখনো তবে রক্ত ভয় পাও।

– মি.আফীফ আপনার সমস্যাটা কি বলবেন আমায়?কাটা পা নিয়ে এভাবে বসে থাকার মানে কি প্লিজ আপনি ডাক্তারের কাছে যান।

সেহেরিশের ধমকের সুরে কথায় সৎবিৎ ফিরে আফীফের।গায়ের চাদরটা ছাড়িয়ে নিয়ে আরাম করে গা এলিয়ে বসে।আফীফের এমন অঙ্গ ভঙ্গিতে বেশ রাগ লাগে সেহেরিশের।বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে আবারো বলে উঠে,
– ঠিক আছে আপনার যা ইচ্ছে আপনি করুন আমি মুনিফ ভাইকে ডাকছি তিনি আপনার জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করবেন।

সেহেরিশ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আফীফ দ্রুত উঠে দাঁড়ায় এবং তাকে হেচঁকা টান দিয়ে সোফায় ছুড়ে মারে।পকেট থেকে চাবি নিয়ে দরজায় দ্রুত তালা মেরে দেয়।আফীফের কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে যায় সেহেরিশ।এদিকে পায়ে চাপ লাগায় ব্যাথায় চোখ মুখ খিচে নেয় আফীফ।

– এইসবের মানে কি মি.আফীফ?
– কোন মানে নেই।
– তাহলে দরজা বন্ধ করলেন কেন?
আফীফ প্রত্যুত্তর করলো না।সেহেরিশের পাশে আবারো আয়েশ ভঙ্গিতে বসে যায়।কিন্তু পায়ের ব্যথায় মুষড়ে উঠছে সে।চোখে মুখে লালভাব ছড়িয়ে আছে।সেহেরিশ আহাম্মক বনে আফীফের দিকে তাকিয়ে আছে।আফীফ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে নেয়।

– জানো সেহেরিশ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে পায়ের ব্যাথায় পা নাড়াতেও পারছি না।
– আগেই বলেছিলাম এইসব নাটকের কোন মানে নেই ডাক্তারকে খবর দিন।সন্ধ্যা নেমে এসেছে আমার শীত করছে তাছাড়া রুমটাও অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে আমি বাইরে যাবো চাবি দিন।মুনিফ ভাইয়ে পাঠিয়ে দেবো।
– আমার কিন্তু খুব কষ্ট সেহেরিশ তুমি এমন না করলেও পারতে।

আফীফের ঠোঁট খিচে আসা কথায় সেহেরিশ ভয় পেয়ে যায়।আফীফের পায়ের দিকে তাকিয়ে আবারো ভয়ে কুঁকড়ে উঠে।

– প্লিজ আপনি চাবিটা দিন আপনার পায়ের অবস্থা মারাত্মক খারাপ।আমার উপরে রেগে আছেন আপনি তা আমি বুঝতে পারছি তাই বলে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না।

– আমি বাইরে যাবো তবে একটা শর্ত আছে।

সিরিয়াস মুডে আফীফের এমন কথা কিছুতেই সহ্য হয়নি সেহেরিশের।ধুপ করে মাথায় চেপে যাওয়া রাগটা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে তার।যার দরুনে আফীফের কলার টেনে ধরতেও দ্বিধা করে নি সে।

– তোর সমস্যা কি?পায়ের এমন বেহাল দশা করে আমার উপরে দোষ ফেলতে চাস?একা আছিস মেরে তক্তা করে দিতেও দু’বার ভাববো না।

– বাহ বাহ সাহস দেখি তাল গাছে উঠে গেছে।আমাকে তুই করে বলা হচ্ছে।এই মেয়ে এই আমাকে তুমি চিনো কলার ছাড়ো দ্রুত!

আফীফের ধমকে সেহেরিশের সৎবিৎ ফিরে আসে।তার আচরণে সে নিজেই লজ্জিত।হাটুতে হাত রেখে মাথা নুইয়ে বিড়বিড় করে আফীফকে বকতে থাকে।আফীফ তার মাথায় হাত রেখে রাগান্বিত স্বরে বলে,

– আমার একটা শর্ত আছে মিস সেহেরিশ তবেই আমার পায়ের আঘাতের বিষয়ে আপনাকে দোষ দেবো না আর আমি ডাক্তার দেখাবো।
– বলুন আপনার কি শর্ত?

– আমাকে আলিঙ্গন করে দুইটা শব্দ বলবেন।
– ছিহহহ এই ছিল আপনার মনে?আপনাকে আমি আলিঙ্গন করবো কোন দুঃখে?
– কেন কেইন, তুন্দ্রকে হুট হাট যে জড়িয়ে ধরো তখন বুঝি ছিহহ লাগেনা?
– ওরা আমার বন্ধু।বোকার মতো কথা বলবেন না।
– আমিও তোমার বন্ধু, বিশেষ বন্ধু। নাও জড়িয়ে ধরো।না হলে আজ পায়ের চিকিৎসা করাবো না।দায় তোমার আর আমার পরিবার আমার প্রতি ভিষণ ইউক এবার যদি আমার কিছু হয়ে যায় তুমি ফাসবে।

সেহেরিশ গোমড়া মুখে আফীফের দিকে তাকায় আফীফের তার দিকে তাকিয়ে আছে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে।
– আপনার শর্তটা চেঞ্জ করুন আফীফ দেওয়ান।এটা ছাড়া বাকি সব শর্ত মেনে নেবো।
– সত্যিত?
-পাক্কা সত্যি।
– ঠিক আছে।এবার থেকে আমার সব কথা শুনে চলবে যাও চাবিটা নিয়ে দরজা খুলো।

সেহেরিশ হাফ ছেড়ে বেঁচে যায়।আটকে আসা শ্বাসটা ছেড়ে চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই আবার হঠাৎ হেঁচকা টান খায়।তৎক্ষনাৎ আফীফ তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।আফীফের মুখে সেহেরিশের পড়ে থাকা চুল গুলোতে গাঢ় করে শ্বাস নেয়।কানের কাছে ফিসফিস করে আবেগী সুরে বলে

– মিস সেহেরিশ ইয়া তেবয়া লিউব্লিউ!
– এহহহ
– হ্যা।

—–

সকাল সাতটায় আফীফের নির্দেশে ঘুম ভাঙ্গে সেহেরিশের।আফীফের পরিবারের কিছু সংখ্যাক সদস্য ঘুম থেকে উঠে গেলেও সেহেরিশের পরিবারের কেউ এখনো উঠে নি।আর তাই সেই সুযোগটা কাজে লাগায় আফীফ।সেহেরিশ ফ্রেশ হয়ে আসলে তাকে পাঠিয়ে দেয় কিচেনে চা তৈরির জন্য কিন্তু বেচারি সেহেরিশ এই জীবনে প্রথম চা বানানোর উদ্দেশ্য রান্না ঘরে প্রবেশ করে।দরজায় মাথা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে সেহেরিশের কান্ড দেখছে আফীফ।

– আজকে সকালের চা টা কি আমি সত্যি পাবো নাকি না?
আফীফের কথায় আড় চোখে তাকায় সেহেরিশ।
– এত কথা বলছেন কেন?আপনি জানে না আমি চায়ের “চ” পারি না আর আপনি আমায় সাত সকালে চায়ের জন্য কিচেনে পাঠিয়ে দিলেন।অদ্ভুত লোক আপনি কোন জনমের শত্রু ছিলাম আপনার বলুন তো?
– কোন জনমের শক্র ছিলে জানি না তবে এই জনমের প্রিয়তমা হয়ে থেকো।

আফীফের ফিসফিসে কন্ঠের কথা সেহেরিশের কর্ণকুহরে পৌছালো না।

দুজনে দুইকাপ চা হাতে পুকুর পাড়ের সিড়িতে বসে।আফীফ নিরিবিলি সেহেরিশের তৈরি পানসে চা টা আনন্দের সাথে গিলছে কিন্তু সেহেরিশ একবার মুখ কুচকে চায়ের দিকে তাকায় অন্য বার আফীফের দিকে তাকায়।

– পুকুর পাড়ে শীত বেশি চলুন আমরা বাগানের দিকটায় যাই।
– চলো তবে।

সেহেরিশ এবং আফীফ দুজনে বাগানের দিকটায় কিছুক্ষণ আড্ডা দেয় হঠাৎ মাঝারি আকারের একটি ইটের টুকরো দেয়ালের বাইরে থেকে কেউ সেহেরিশের মাথায় ছুড়ে মারে।সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠে সেহেরিশ।কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত তার চোখ নাক ভাসিয়ে দিচ্ছে আর সেদিকে তাকিয়ে বিমূঢ় হয়ে যায় আফীফ।সেহেরিশের মাথাটা দ্রুত চেপে ধরতেই তার পায়ের সামনে একটি কাগজের দলা পড়ে।

আফীফ দ্রুত কাগজটি তুলে পড়া শুরু করে,

” খুব শীঘ্রই প্রিয় মানুষ হারানোর আর্তনাদে ছড়িয়ে যাবে বাতাসের বেগে!”

আফীফ চিঠিটার মানে বুঝতে পেরে দ্রুত সেহেরিশকে আঁকড়ে ধরে।এদিকে রক্তের ফোয়ারা দেখে সেন্সলেস হয়ে যায় সেহেরিশ।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here