#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৪
ডিসেম্বরের শেষ সাপ্তাহ।চারিদিকে শীতের প্রবলতা বেড়েছে।গ্রামের মানুষগুলোর জন জীবন নির্জিত অবস্থা।সেদিনের পর কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন।আফীফ সম্পূর্ণ পালটে গেছে।তার মাঝে দেখা দিয়েছে গুরুগম্ভীর ভাব।সেহেরিশের সাথেও সামনা-সামনি কথা হয় না বেশ কয়েকদিন।অবশ্য সেহেরিশ নিজেই আফীফের সামনে ধরা দেয় না।নিজেকে পালিয়ে বেঁচেই সুখ পায় সে।গত কয়েকদিন আগের আফীফের সাথে বর্তমান সময়ের আফীফের কোন মিল পায় না সে।এ যেন আট বছর আগের গুরুগম্ভীর স্বার্থপর আফীফ।তার প্রতি আফীফের কেয়ারিং গুলো আরো ভয়ের সঞ্চার করছে।ঠিক আট বছর আগেও আফীফ তাকে আগলে আগলে রাখতো।তাই এই ছেলের কাছ থেকে যতটা সম্ভব পালিয়ে বাচঁতে হবে।
কফির মগ হাতে নিয়ে ছাদে পাইচারি করছে আফীফ।ব্লাক হাউজের ছাদে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে ঠিকি সেহেরিশকে দেখতে পাচ্ছে সে।তুন্দ্র, কেইন,মৌ,সামী সবাই মিলে গোল মিটিংয়ে বসেছে।হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় জ্যাকেটের পকেট থেকে আফীফ দ্রুত ফোন বের করে,
– হ্যা জিউ বলো,
– কেমন আছো?কোন খবর নেই তোমার।তাকিয়াকে পেয়ে বুঝি ভুলে গেছো আমায়?
– না ভুলি নি।তবে সমস্যায় আছি।বাড়িতে যে সাম্প্রতিক একটা তুফান বয়ে গেছে তুমি তো জানো না।সেহেরিশকে নিয়ে আমায় হুমকি বার্তা পাঠানো হয়েছে!
– মানে কি?কী বলছো এইসব।সেহেরিশের কিছু হয় নি তো?
– না সে ঠিক আছে।তবে কেউ বা কারা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে সেহেরিশ আমার দূর্বলতা।তাই তাকে দিয়েই তীর ছুড়েছে।
– তোমার এইসব শত্রু,যুদ্ধ,হামলা যাই হোক।আমার জানার দরকার নেই তবে সেহেরিশের যেন কিছু না হয় মাথায় রাখবে।সেহেরিশের সকল তথ্য টাইম টু টাইম আমি তোমায় দিয়েছি।একমাত্র তোমার ভালোর জন্য তোমার সুস্থতার জন্য এখন তোমার স্বার্থ উদ্ধারে মেয়েটির যেন কোন ক্ষতি না হয়।
– হুম,মাথায় আছে আমার।চলো রাখছি পরে কথা হবে।
– গুড বায়।
মতাব্বরের ছেলে রমিজ মিয়ার অপেক্ষায় দীর্ঘ দিন থাকার পরেও সৌদি থেকে তার আসার কোন নাম গন্ধ নেই।বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে খুরশীদকে।আদৌ কি তিনি জমি পাবেন?এদিকে আর কত দিন পড়ে থাকবে এই বাড়িতে।দেওয়ান বাড়ির লোক তাদের আপন হিসেবে গ্রহণ করলেও লোক লজ্জার ভয় আছে।তাই খুরশীদ সিধান্ত নিয়েছেন কাল পরসূর মধ্যেই ঢাকায় ফিরে যাবেন।
– কেমন কাটছে দিন খুরশীদ সাহেব?
আহনাফ দেওয়ানের প্রশ্নে ঈষৎ হাসেন খুরশীদ।গলাটা ঝেরে কেশে সন্তর্পণে বলেন,
– ভাবছি অনেকদিন হয়ে গেছে এবার আমাদের ফেরা উচিত।আমাদের বরং এবার যাওয়ার অনুমতিটা দিয়ে দিন আপনি।
– যাবেন মানে?কোথায় যাবেন?
– ঢাকায় ফিরতে চাইছি আমরা।এইভাবে আর কতদিন থাকবো এখানে?আপনাদের বাড়তি ঝামেলা হিসেবে পড়ে আছি।
– ছি! এইসব বলে আমায় লজ্জায় ফেলবেন না আপনি।আমি ভালো করেই জানি আপনারা আরো বেশ কিছু মাস বাংলাদেশে থাকবেন বাংলাদেশে যতদিন আছেন ততদিন এখানেই থাকবেন।ঢাকা যান সিলেট যান যেখানেই যান আপনার নির্দিষ্ট বাসস্তান হবে এই দেওয়ান মঞ্জিল।
– মাফ করবে আমায়!আপনাদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ আমি এবার আমার ফেরা দরকার।
খুরশীদ আনওয়ারের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আহনাফ।তিনি ভালো করেই যানেন আফীফ জানতে পারলে বেশ রেগে যাবে তাই খুরশীদ আনওয়ারের উদ্দেশ্য অনুনয় সুরে কিছু বলার আগেই আফীফের আগমন লক্ষ্য করা যায়।
– শুভ সকাল আঙ্কেল।শুভ সকাল দাদাজনা।
– তোমার আঙ্কেল কি বলছে যানো তুমি?সে নাকি চলে যেতে চাইছে এখানে তার কাছে বেশি দিন থাকতে অস্বস্তি লাগছে।
আহনাফ দেওয়ানের কথায় চোখ বন্ধ করে নিলো আফীফ।গাঢ় করে শ্বাস টেনে গমগম সুরে বলেন,
– আজকের মতো শেষ বার বলছি আপনাদের এখানেই থাকতে হবে।যদি কোন দিক দিয়ে কারো ব্যবহারে মনে কষ্ট পান তবে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।আপনাদের সুবিধার জন্য সকল ব্যবস্থা করা হবে তবুও এখানে থাকতে হবে।
আফীফের গমগম সুরের কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান খুরশীদ।
____
দুপুরের খাওয়ার বাড়ির সকলেই শেষ করে যে যার কাজে চলে গেলেও সেহেরিশ ঘুমিয়ে থাকার কারনে আজ দেরিতে খেতে বসেছে।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো সামনে আফীফকে দেখে।বাইরের কাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে আফীফ তার বরাবর চেয়ারটায় খেতে বসে।তারপর থেকেই সেহেরিশের দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সামনে বসে থাকা গুরু গম্ভীর মানুষটার দিকে তাকিয়ে কয়েকটা ঢোক গিললো সেহেরিশ।এই মানুষটাকে দেখলে কেন যে তার ভয়ে আত্না কেঁপে উঠে কে জানে?হয়তো অতীতের ভয়,নয় তো বা মনের ভ্রম!লোকটার ভাব গম্ভীর দেখে সেহেরিশের হাত কাঁপতে থাকার কারনে, হাতে থাকা কাটা চামচটা প্লেটের সাথে ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। এমন শব্দে সেহেরিশ নিজেও ভড়কে যায়।আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না পেয়ে দ্রুত খাওয়ার থালাটা রেখে উঠে যায় কিচেনের দিকে।
এই মূহুর্তে এখানে থাকা বিপদজনক।শুধু বিপদজনক নয় মহা বিপদজনক।
বেসিনের পানিতে হাত ধৌত করার সময় সে অনুভব করে তার গলায় ঘাড়ে কারো উত্তপ্ত শ্বাস-প্রশ্বাস আছড়ে পড়ছে।হঠাৎ সেহেরিশের অনুভূতি গুলো জেনো ভাঁতা হয়ে গেছে।ডানে-বামে না তাকিয়ে দ্রুত পেছনে ঘুরতেই আফীফকে তার সামনে দেখতে পায়।ছেলেটি একদম তার সামনে কিঞ্চিৎ দূরত্বে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে।
– খাওয়ার নষ্ট করে চলে এলে কেন?
আফীফের গুরুগম্ভীর ধারালো তীক্ষ্ম কন্ঠে হুশ ফিরে তার।
– আমার খিদে ছিল না!
সেহেরিশ দ্রুত তার চোখ নামিয়ে নেয়। হঠাৎ করেই সে অনুভব করে তার গালে ঠান্ডা ধারালো কিছুর আঁচড়।চমকে তাকাতেই আফীফের হাতে একটি ছুরি দেখতে পায়।যে টি আফীফ সেহেরিশের গালে স্লাইড করছে।
– কী করছেন কি আপনি?
– কৃষকের কষ্টের পরিশ্রমের খাদ্য নষ্ট আমি মোটেও পছন্দ করি না সেহেরিশ আনওয়ার।আমার নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাধ্যে কারো নেই।এই বাড়িতে এক চিমটে অন্ন ও এঁটো হয় না সেখানে তুমি অর্ধ-থালা ভাত… থাক,আজকের জন্য মাফ!কিন্তু আগামী দিন গুলোতে আর নয়।
সেহেরিশ মাথা নুইয়ে নেয়।কিছুক্ষণেই তার কপালে ঘামের রেশ দেখতে পাওয়া গেছে।সেদিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।হাতে থাকা ছুরিটি আলতো করে সেহেরিশের গলায় চেপে ধরে।মেয়েটি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে চমকে তাকালে,আফীফ আরেকটু ঝুঁকে বলে,
– রমণীর ভয়ার্ত চোখে এ’কোন জাদু আছে, যে সমীপে টানছে আমায়?ভয় পাচ্ছো কেন?আমি তো জলজ্যান্ত মানুষ!কখনো বকেছি তোমায়?রাগ দেখিয়েছি?তবে ভয় কিসের?
সেহেরিশ মূঢ়তা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কী বলবে সে?কী করবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
আফীফ তার হাতের ছুরিটা আরেকটু জোরে ধরতেই সেহেরিশ চোখ বন্ধ করে নেয়।ভয়ে কাঁপাকাঁপা দুই হাতে আফীফের হাতটা ছিটকে সরিয়ে দেয়।তৎক্ষণাৎ ধারালো ছুরিটি হাত ফসকে আফীফের পায়ে পড়ে যার ফলে পায়ের পাতার উপর কোপের মতো ছুরিটি দাঁড়িয়ে যায়।লাহমায় রক্তে আফীফের পা ভেসে যায়।সেদিকে তাকিয়ে চাপা আর্তনাদ করে উঠে সেহেরিশ।
ভয়ে তার দু-চোখের পানি টলমল করছে।কিছু বলতে গিয়েও বার বার থেমে যাচ্ছে।
– খুন! খুন করতে চাইছো আমায় সেহেরিশ?খুনের শাস্তি কী জানো?মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।সাদৃশ্য খুন আমায় তুমি না করলেও অদৃশ্য খুন তুমি করেছো।তাই তো তোমার যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থায় আছি।উহু’হ,ভয় পেয়ো না আমার শাস্তিটা ভিন্ন মাত্রার। অন্তরিন,অন্তরিন…..
থাক বাকিটা পরে জানতে পারবে।
আফীফ সেহেরিশের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে।তার নাক এবং ঘামাক্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
– বাঙালিরা কি যেন বলে?নাক ঘামালে বর বেশি ভালোবাসে,বেশি আদর করে?তোমার নাক তো দেখি নোনা সমুদ্র হয়ে গেছে।বরের এত আদর, ভালোবাসা সহ্য হবে তো তোমার?
আফীফের ঠোঁট কাটা কথায় সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।লাহমায় কিছু বলতে নিলেই আফীফ খুড়ে খুড়ে সেখান থেকে চলে যায়।সেহেরিশ লজ্জায় মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো।এই মানুষটাকে সে বুঝে না।কেমন কেমন কুটিলতা তার মাঝে।
—
লজ্জায় আড়ষ্টতায় সেহেরিশকে মুড়িয়ে দিয়েছে আজ।আফীফের ব্যবহার তবে সত্যি পাল্টেছে।আগের মতো হাসে না আগের মতো ভয় দেখায় না কেমন যেন কথার মারপ্যাঁচে বার বার ফেলছে তাকে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বার বার মাথায় ঘুরছে তার।মারুফার রুমে বসে চিন্তায় মগ্ন সে।
– কি রে সেহেরিশ তোর চোখ মুখ এমন লাগছে কেন?
– কেমন ফুফি?
– তুই কী কোন বিষয়ে ভয় পেয়েছিস?তোকে আতংক গ্রস্ত দেখাচ্ছে।
সেহেরিশ থামে চুপচাপ মারুফার কোলে সটান করে শুয়ে তার দু হাত টেনে নেয়।
– ফুফি আফীফ কেমন যেন হয়ে গেছে।
– কেমন?
– ঠিক আগের মতো।এক চোখে রাগ অন্য চোখে ভালোবাসা,যত্ন।
– এইসব তোর মনের ভ্রম। যত তাড়াতাড়ি এই বাড়ি থেকে যেতে পারবো তত তাড়াতাড়ি মুক্তি।
– হুম তাই যেন হয়!
#চলবে…