#অন্তরিণ_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৮

বাড়ির লিভিং রুমে বসে আছে সেহেরিশের পরিবারের সদস্যরা।তাদের মধ্যমণি হয়ে আছেন আহনাফ দেওয়ান।সবাই উৎসুক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে তার দিকে।সেহেরিশ মারুফার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।বর্তমানে শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে তবুও এমন শীতে ঘামছে সেহেরিশ।তার চিন্তাররাজ্যে বার বার ভর করছে আফীফ দেওয়ান।সেই আট বছর আগেও ছিল এমন ডিসেম্বর মাস।বাংলাদেশ তখন প্রচন্ড কুয়াশায় ঢাকা।শীতের প্রকটে নিমজ্জিত জনজীবন।সেই পূবাহ্ণে আফীফের সাথে দেখা তার। সেদিন আফীফের থেকে মুক্তি চাইতে কত ছলা কলা কৌশল এটেঁছিল আর আজ সে নিজেই আফীফের দরবারে হাজির।

– আপনাদের সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি।মতাব্বরের ছেলে রমিজ মিয়া খুব একটা সুবিধার নয়।তবে আমাদের দেওয়ান বংশের সাথে কোন দিন বেয়াদবি কিংবা চালাকি করতে যায়নি।আমরা যখন যা বলেছি সে করেছে।আজ যেহেতু সৌদি চলে গেছেন সে হিসেবে আমার হাত ফাঁকা।এখন এই মূহুর্তে কোন সিধান্ত আমি নিতে পারবো না।

আহনাফ দেওয়ানের কথায় চিন্তায় মুখ ভার হয়ে গেলো খুরশীদের।
– তবুও আপনি আপনার চেষ্টার ত্রুটি রাখবেন না দয়া করে।আমি অনেক দূর থেকে এসেছি।আগামী সাপ্তাহ আমার আব্বা আম্মার মৃত্যু বার্ষিক আমি চাইছি এবারের আয়োজনটা বড় করে করা হবে।কিন্তু জমির সমস্যা নিয়ে আমার মনটাই নড়ে গেলো।
– আপনি যে সিধান্তে দেশে এসেছেন সেই সিধান্ত বজায় রাখুন।রমিজ সৌদি থেকে ফিরে আসলেই আমরা আলোচনায় বসবো।তাছাড়া এইসব ঝামেলার কাজ আমার নাতি দেখা শোনা করে।আমার তো বয়স হয়েছে এত কিছুর দখল সামলানোর সময় আমার নয়।
– আপনার নাতি?

-আফীফ দেওয়ান!আমার বড় ছেলের, বড় পুত্র।
আফীফের কথা শুনতেই নড়েচড়ে বসে মারুফা এবং সেহেরিশ।সেহেরিশের শঙ্কিত মুখ দেখে ইশারায় চুপ থাকতে বলেন মারুফা।

– যাই হোক খুরশীদ সাহেব আমাকে এখন উঠতে হবে!
আহনাফ দেওয়ানের কথা বিচলিত হয়ে যান খুরশীদ।
– কিন্তু আমাদের তো কথা শেষ হয় নি।
– একটু পর গ্রামের সার্লিশে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে।তাই এখন আর আপনার সাথে আলোচনা করতে পারছিনা আমি দুঃখিত।
– ঠিক আছে আপনার সাথে আমার পরে কথা হবে।আজ তবে আমরা আসি।
– এ কি আজ চলে যাবেন?দেওয়ান পরিবারের নিয়ম তো নেই মেহমান আপ্যায়ন ছাড়া বিদায় নেবে।আপনাদের আজ রাত এখানেই থাকতে হবে।বাইরে প্রচন্ড কুয়াশা।এমন শীতের মাঝে মোটেও এত দূর যাওয়া উচিত নয়।আপনারা আজ থেকে যান।

– না না তা হয় না আমরা অলরেডি হোটেল বুকিং করে ফেলেছি।
– আপনাদের ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি নেই?
– না আমার যা ছিল সব অনন্তপুরেই কিন্তু আজ সেই জমিও আমি হারাতে বসেছি।
– তবে বেশ আজ থেকে আপনারা এখানেই থাকবেন হোটেল বুকিং ক্যান্সেল করুন।আমার শেষ কথা এর পর আপনার আপত্তি থাকলেও আমার কিছু করার নেই। আপনার জন্য এখানে থেকে যাওয়াটাই ভালো হবে।

আহনাফ দেওয়ানের কথায় খলবলিয়ে উঠে সেহেরিশ।তাকে দাঁড়াতে দেখে বাদ বাকি সবাই দাঁড়িয়ে যায়।আহনাফ দেওয়ানের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে জবাব দেয়,
– আ…আমরা গ্রামের পরিবেশের সাথে মানিয়ে উঠতে পারবো না। আমরা বরং ঢাকায় ফিরে যেতে চাইছি।
আহনাফ আপাদমস্তক সেহেরিশকে দেখে নিলেন।তার কথায় লীন হেসে তীক্ষ্ণ কন্ঠে জবাব দেয়,

– এই বাড়ি দেখে আশা করি এতক্ষণে বুঝে ফেলেছো কোন কিছুর কমতি নেই।ত্রুটিহীন বাড়িটাকে আরো নিটোল ভাবে সাজিয়েছে আমার দাদুভাই।তাছাড়া শহরে অনেক থেকেছো এবার না হয় গ্রামের হাওয়া গায়ে লাগাও।তা খুরশীদ আনওয়ার আপনি আপনার পরিবার স্বজন নিয়ে আজ থেকে এই বাড়িতেই থাকুন।
– আমার মেয়েটা যখন চাইছে না তখন আপনাদের আর কষ্ট দেবো না।আমরা আজ রাতের বেক করবো

খুরশীদ আনওয়ারের কথা শেষ হতেই সমীরণে ভেসে আসে এক গম্ভীর কণ্ঠ,
– আমার দাদাজানের কথা কেউ কখনো অমান্য করেনি আশা করি আপনিও করবেন না।

আফীফের কন্ঠে সহসা সবাই চকিতে তাকায়।
– আসসালামু আলাইকুম আমি আফীফ দেওয়ান। দাদাজান নিশ্চই আমার পরিচয়টা এতক্ষণে দিয়ে দিয়েছে।
– ওয়া আলাইকুমস সালাম।হ্যা তোমায় চিনতে পেরেছি।

আফীফ আর খুরশীদ সমান তালে কথা বলে যাচ্ছে, এদিকে সেহেরিশ অবাক হয়ে আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে আফীফের দিকে।আগের আফীফের উগ্রতার মাঝে বর্তমান আফীফের কোন মিল নেই।নির্মল,সচ্ছল চেহারার কথা বার্তায় মার্জিত।কে বলবে এই লোকটা উগ্র!রাগী!স্বার্থপর।
দ্রুত গায়ে থাকা হুড়ির টুপিটা এঁটো সেঁটো করে মাথায় জড়িয়ে নেয় সেহেরিশ।আফীফ যেন সহযে তার চেহারা চিনতে না পারে।

– আঙ্কেল আপনারা কোন চিন্তা করবেন না।আপনাদের জন্য পার্ফেক্ট থাকার জন্য রুম দেওয়া হবে।হোটেলের বুকিং ক্যান্সেল আমি করছি।আপনারা শুধু আমাদের অনুরোধ টুকু রাখুন

আফীফের সরলতা,ভদ্রতা দেখে ফাহমিদা সহসা সম্মোতি জানান।আর তার সম্মোতি পেয়ে সবাই হা তে হা মেলালেও একমাত্র মারুফা আর সেহেরিশ কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। তবুও সকলের চোখে সন্দেহের বাতি জ্বলার আগেই সেহেরিশ এবং মারুফা রাজি হয়ে যায়।
—-

খুরশীদ-ফাহমিদার জন্য নিচের তলার রুম ঠিক করা হয়েছে।
কেইন-তুন্দ্র,মারুফা-সামী,তাদের জন্য দোতলার বাম দিকের রুম দেওয়া হয়েছে।একমাত্র সেহেরিশের জন্য দোতলার ডানের রুমটি দেওয়া হলো।সবার থেকে বিচ্ছিন্ন রুমটি সেহেরিশের হওয়ায় তার ভীষণ রাগ লাগলো কিন্তু ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাগারাগি না করে নিজের রুমে গিয়ে ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে দেয়।দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আবার চোখ খুলতেই একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে রুমের চারিপাশ।অদ্ভুত সুন্দর ডেকোরেশন পুরো রুম জুড়ে।কেউ দেখে বলবে এই গ্রামে এত সুন্দর রুমের ব্যবস্থা।সেহেরিশ পীল পীল পায়ে এগিয়ে যায় রুমের দিকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ধপ করে বসে যায় বিছানার উপর।

হাজারটা চিন্তার পাসরা রেখে সেহেরিশের মাথায় হুট করেই প্রশ্ন আসে আফীফ কী তাকে চিনতে পারেনি?সবার সাথে কথা বলার সময় আফীফ তার দিকে একটি বারেও তাকায় নি।তবে কি ফুফির কথাই ঠিক!আফীফ সব ভুলে গেছে।হয়তো বা ভুলেই গেছে জমিদারের নাতি হাজারটা কাজ তার ঘাড়ের উপর।তাতে এই সামান্য মেয়েটির কথা মাথায় রাখবে কী করে?

—-
রাতের ডিনার টেবিলে সেহেরিশের পরিবারের সকল সদস্য সহ আফীফ আহনাফ দেওয়ান বসেন।বাড়ির মহিলা সদস্যরা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত।একে একে সেহেরিশের পরিবারের সঙ্গে সবার পরিচয় পর্ব শেষ।সেহেরিশ ঘুরে ঘুরে সব মহিলাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।আফীফের মা সেঁজুতি তাকে চিনতে পারছে না।বাড়ির কাজের মেয়ে মর্জিনা আফীফের দাদীজান আমেনা এবং আহনাফ দেওয়ান তাকে চিনতে পারলো না।সব কিছু কেমন যেন অদ্ভুত হয়ে গেছে।কি করে সম্ভব মাত্র আট বছরে একটি মেয়েকে ভুলে যাওয়া। সেহেরিশতো তাদের ভুলতে পারেনি।

– আপনার নাম কি মিস?
মুনিফের কন্ঠে সৎবিৎ ফিরে আসে সেহেরিশের।
– স..সেহেরিশ!
– ওহ সামীর বোন আপনি।আপনার ভাই তো ভীষণ চটপটে তবে আপনি এমন শান্ত কেন?আসার পর থেকেই দেখছি কেমন যেন চিন্তিত?
সেহেরিশ কিছু বলার আগেই কেইন হড়বড়িয়ে কথা শুরু করে দেয়,
– হেই ব্রো সেহেরিশ মোটেও চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে নয়।সে কথা বলতে নিলেই দশজনের কথা একজনেই বলে দেয়।

কেইনের কথা শুনে সকলেই মৃদু হাসে।সকলের কাছে ডিনার টেবিলে করা আলোচনা স্বাভাবিক লাগলেও। পরিবেশটার সাথে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছেনা সেহেরিশ।আফীফের দিকে যতবার নজর গেছে ততবার তার শ্বাস আটকে আসার উপক্রম হয়েছে।সব কি তিক্ত অসহ্য লাগছে তাই বাড়ির সবার খাওয়ার মাঝেই সেহেরিশ দাড়িয়ে যায়,

– আমার খাওয়া শেষ মাম্মি আমি ঘরে যাই।
– কি বলিস তোর ভাত এখনো প্লেটে সম্পূর্ণটাই রয়ে গেছে।
– আমার ইচ্ছে করছে না। আমি গেলাম।
সেহেরিশ যেতে নিলেই আফীফের মা সেঁজুতি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফীফ চোখ ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলেন।সেহেরিশের অর্ধ খাওয়া থালাটার দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আফীফের।

তুন্দ্র এবং কেইন রাতে একসাথে আড্ডা দিতে বাড়ির স্টাডি রুমটি খুজে নেয়।সেখানে বসে কিছু দলিল দেখছিল আফীফ তাদের দেখে রুমের ভেতরে আসতে ইশারা করে,

– তুন্দ্র কেইন আপনারা ভেতরেই আসতে পারেন।
– থ্যাংস ব্রো।আপনার স্টাডি রুমের বইয়ের কালেশন তো প্রচুর।
– জি, আপনারা চাইলে নিয়ে পড়তে পারেন।
– অবশ্যই আমি যতদিন এখানে থাকবো অর্ধেক বই শেষ করার প্লানিং নিয়েই থাকবো।

তুন্দ্রের কথায় মৃদ্যু হাসে আফীফ।তুন্দ্র চেয়ার থেকে উঠে প্রতিটি আলমারিতে বইয়ের কালেকশন দেখতে থাকে।এদিকে কেইন তুন্দ্রের ক্যামেরায় সেহেরিশের ছবিগুলো মন দিয়ে দেখছে।হঠাৎ একটি ছবিতে চোখে আটকে যায় কেইনের তুন্দ্রের দিকে তাকিয়ে উৎসাহ নিয়ে বলে,

– হেই তুন্দ্র গায়ে ফুল পড়া ছবিটায় সেহেরিশকে পুরো প্রিন্সেস লাগছে।
– আমি আগেই বলেছিলাম এই ছবিটা বেস্ট ছিল।
– হাহ!
কেইনের কথায় আড় চোখে তাকায় আফীফ।স্বাভাবিক ভাবে সেহেরিশের বন্ধু হিসেবে কেইনকে সম্মোহন করলেও এই মূহুর্তে তাদের সর্ম্পকটা বড্ড জটিল লাগছে আফীফের কাছে।তাই কেইনের মনের ভাব জানার জন্য আফীফ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কেইনকে প্রশ্ন করে,

– আপনারা কি শুধু তিন জন ফ্রেন্ড?
– নো,আমরা চারজন।জুহি আসতে পারেনি তার বাবা অসুস্থ।তাই আমরা নিজেরাই চলে এলাম।
– ওহ!আপনার ফ্রেন্ড সেহেরিশ কেমন যেন অদ্ভুত! আসার পর থেকেই লক্ষ্য করছি।
– না সে ঠিকি ছিল তবে বিডিতে যেদিন আসার সিধান্ত হয় সেদিন থেকে সে অন্যরকম বিহেব করছে।যানি না কেন।

কেইনের আফসোস ভঙ্গির কথা শুনে কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।আফীফের দিকে সহসা দৃষ্টি রেখে কেইন ফিসফিস করে বলে,
– হেই ব্রো ইউ আর লুকিং সো কিউট।গার্লফ্রেন্ড আছে তোমার?
– নো!
– পছন্দের কেউ?
-ইয়েস!
– ওয়াও কে সেই লাকি গার্ল?
– অন্যদিন বলবো।তোমার কেউ আছে নাকি কেইন?
– ইয়েস।মাই ক্রাশ,মাই হার্ট,মাই অনলি ওয়ান ফেইরি সেহেরিশ।
সেহেরিশের নামটা শুনতেই আফীফের মুখের রং পাল্টে যায়।হাতে থাকা দলিল গুলো ফাইলে গুছিয়ে রেখে কেইনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাটা শুরু করে।এই রাতে কি হবে কে জানে?

শব্দহীন পায়ে দোতলার ডানের সেহেরিশের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অজ্ঞাতে এক ব্যক্তি।গায়ে থাকা হুড়ির জ্যাকেটির পকেট থেকে হাত মোজা নিয়ে দ্রুত দুই হাতে পরে নেয়।দরজার নব ঘুরাতেই সহসা দরজাটি খুলে যায়।ঘোর অন্ধকার মিশ্রিত রুমটার দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে লোকটি।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here