#অনুরক্তির_অনুভূতি
#আফসানা_মিমি
|৫ম পর্ব |
সন্ধ্যা নামতেই পথেঘাটে কর্মজীবী মানুষদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। অফিস শেষে বাড়ি যাওয়ার তাগিদে কেউ ছুটে চলে তো কেউ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভাজা পুরি বিক্রি করে।
অন্তরে রাগ পুষে রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটছি। দুই হাতে বাজার প্রতিবেশীদের। কাজের মাহিলা সাজিয়ে দিয়েছে একদিনের মধ্যে। ধুপধাপ পা ফেলে হাঁটছি। অনুভব করছি কেউ অনুসরণ করছে আমায়। টেলিভিশনে ইংলিশ ভূতের সিনেমাতে যেমন ভয়ে ভয়ে নায়িকা পিছনে তাকায় আমিও সেভাবেই তাকাচ্ছি পর পর।
দুরুদ দোয়া পড়ছি। মনে মনে আল্লাহকে স্বরণ করছি। ভূত হোক বা মানুষ দূর হয়ে যাক। জাম্বুর জন্য নতুন ফিতা কিনেছি। শক্ত হাতে নিলাম। আল্লাহর নিম নিয়ে পিছনে অনুসারীকে আঘাত করে বসলাম। ” আমার মাথা!” বলে পুরুষ কণ্ঠস্বরে চিৎকার কর্ণধারে আসলো। সাহস করে পিছনে ফিরলাম। মূর্ছা গেলাম। চিনি পানি চেয়ে খাওয়া প্রতিবেশী। মাথায় হাত, মুখশ্রীতে ব্যাথার চিন্হ। পাত্তা দিলাম না। আপনমনে এগিয়ে আসলাম।
” আমাকে আহত করে কোথায় যাচ্ছেন গুন্ডি প্রতিবেশী? এসেছিলাম আপনাকে সাহায্য করতে।”
তেড়ে আসলাম আকিলের কাছে। আঙুল তুলে শাসিয়ে আসলাম।
” একদম সাহায্য করতে আসবেন না। জান নিয়ে নিবো। একা চলার অভ্যাস আসে। আপনাদের ছেলেদের প্রয়োজন নেই।”
” আকিল শা’লা ব’ল’দ!”
স্তম্ভিত ফিরে আসলো। কর্ণধারে আসলো শত্রুর স্বর। কপাল কুঁচকে নিলাম। কোকাকোলা পান করে বোতল ছুঁড়ে মারল আমার দিকে। তীর্যক চাহনি। ঘায়েল হবে যে কেউ। চোখ ফিরিয়ে নিলাম। রাস্তায় ঝামেলা করতে চাই না। কাছাকাছি এষে দাঁড়ালো প্রিয়ম। হাতের বন্ধনীতে সময় পরোখ করে বলল,
” আকিল বোকা। ভুল মানুষের দিকে হাত বাড়ায় শুধু। এই মেয়ের সাথে মিষ্টি ভাষায় না, তেতো ভাষায় কথা বলা উচিত। ”
” অনুসরণ করছেন? লজ্জা করে না?”
” না, ছেলেদের লজ্জা পেতে নেই। লজ্জা নারীদের ভূষণ।”
রিফাত এগিয়ে আসলো। অভিভাবকের ন্যায় বলল,
” ছাড় প্রিয়ম! মেয়েটার পিছু না পড়ে নিজের কাজ কর।”
” এসেছিলাম নিজের কাছে। রাস্তায় অসহায় মেয়েকে দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু হলো কী! দাপটে পা মাটিতে ফেলে না একদম।”
” আর আমাকে যে আঘাত করলো?”
আকিলের মাথায় হাত। প্রিয়মের রক্তিম দৃষ্টি আমার উপর। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” আধা ঘন্টার মধ্যে নাস্তা পাঠাবে রুমে।”
চলে গেলো সকলে। মাথা ঠান্ডা করলাম। বাকিটা পথ ভাবনায় বিভোর ছিলাম।
———–
ওড়না কোমড়ে গুঁজে রুম মুছার কাজ করছে রত্না। জাম্বুর মুখে বালতির লোহার অংশ। মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে আছি। পাঁচ মিনিট হয়েছে বাসায় এসেছি। দুই বাদরকে বাসায় রেখে যাওয়ার পরিণাম এত ভয়াবহ জানলে জাম্বুকে সাথে নিয়ে যেতাম।
” তোদের দুই বাদরকে বলেছিলাম বাড়ির খেয়াল রাখতে। নোংরা করতে না।”
” দুই বাদর কাকে বললি। আমাকে আর জাম্বুকে? জাম্বু তো কুকুর! কুকুরের সাথে বাদর যোগ করলে হবে বাদর কুকুর। আর তুই হচ্ছিস মালিক।”
অতিষ্ঠ হলাম। টেবিলের উপর রাখা খাবারের প্যাকেট দেখে বাঁকা হাসলাম। জাম্বুর জন্য পাউরুটি, রত্নার জন্য বিস্কুটের প্যাকেট রেখে তৈরী হলাম।
ছুটির দিনে ব্যাচেলরদের বিশেষ কোনো কাজ থাকে না। আড্ডা দেয়া, গান শোনা, ঘোরাফেরা করা এসব করে সময় কাটে। আকিল কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছে, রিফাত হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত, শুধুমাত্র কাজ নেই প্রিয়মের। ইদানীং ধুমপান করার প্রচেষ্টায় প্রিয়ম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
পরপর কলিং বেলের আওয়াজে প্রিয়মের ধ্যান ভাঙ্গে। দুই বন্ধুকে ডাক দিয়ে দাও কোন সাড়া না পেয়ে নিজেই এগিয়ে গেল দরজা খুলে দিতে।
সেজেগুজে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির প্রতিবেশী। দুধে আলতা গায়ের রং লাল পোশাকটা যেন খুব মানিয়েছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো প্রিয়ম। চলে গেলো ভেতরে। মগ্ন হল নিজ কাজে।
চারপাশে নজর ঘুরালাম। হাতের নাস্তা টেবিলের উপর রেখে হাক ছাড়লাম,
” কইগো প্রতিবেশীরা! নাস্তা নাস্তা নাস্তা বলতো আমাকে অপমান করা হয়েছিল। এখন নাস্তা খাবে কে?”
রিফাতের কর্ণধারে আরাতের কথা পৌঁছায়। ঘর থেকে উঁকি দিলে আরাতের হাস্যজ্বল চেহারা ভেসে উঠে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিফাত বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরে গান শোনায় মগ্ন থাকা আকিলের মাথায় আঘাত করে কান থেকে হেডফোন নিয়ে নেয়।
” আমার সুখ সহ্য হয়না তর! প্রতিবেশীর কু’ত্তা’য় কামড়াইছে নাকি? ডাকছিস কেন? ছুটির দিনেও শান্তি নাই।”
রিফাত রেগে গেলো। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
” মুখের ভাষা সংযত করা বা’ল।”
” তোর মুখের ভাষা মনে হয় অনেক ভালো!”
রিফাত চুপ। পরাজয় মেনে নিলো। ঘর থেকে বের হয়ে আকিলকেও টেনে আনলো।
খাবার টেবিলে এসে সকলের চোখ ছানাবড়া। আকিল মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। আছে রিফাতের চোখ বড় হয়ে আছে। চেয়ারে বসে ভদ্র সমাজের দুই প্রতিবেশীকে অবলোকন করছি। আর একজন বাকি আছে, তার ভাব ভঙ্গি কেমন হবে অপেক্ষা করছি। চলে এলো তৃতীয় প্রতিবেশী। টেবিলের ওপর রাখা শুকনো রুটি কলা দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো। দৃষ্টিপাত করল আমার দিকে। মুখে বাঁকা হাসি রেখে টেনে বসে রইলাম।
” ফাজলামি করার জায়গা পাও না? আমাদের পথের লোক মনে হয়?”
মনে আনন্দের বন্যা বইছে। আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছে।
” অসহায় ব্যক্তির নিকটে যা আছে তা দিয়েই তো আহারের আয়োজন করতে হবে তাই না?”
ভ্রু যুগল কুঁচকে আসলো প্রিয়মের। আমার কথা উপলব্ধি করতে পেরে রেগে গেলো। ভাবছি এই বুঝি পরাজয় গ্রহণ করল। কিন্তু না উল্টো মানিব্যাগ বের করে বাঁকা হাসলো।
” তুমি চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায় মিস গুন্ডি।”
একশত টাকার নোট টেবিলের উপর রাখলো। কলা ছিলে মুখে পুরে বলল, রাতের রান্না করে যাও গুন্ডি। আজ চিংড়ি রান্না হবে। রান্নাঘরে সব আছে।” চলে গেলো প্রিয়ম। হেরে গেলাম এবারও। ফ্রিতে বিনোদন নেওয়া দুই প্রতিবেশী সিনেমা দেখতে দেখতে নাস্তা করা সম্পূর্ণ।
” কলা মিষ্টি ছিলো, প্রতিবেশী।”
এমনিতেই রাগে আগুন তার উপর ঘি। চিনি পানি চাওয়া প্রতিবেশীর কথায় অগ্নিরুপ ধারণ করলাম। দাঁতে দাঁত চেপে প্রত্যুওর করলাম,
” জাম্বুর খাবার সব সময় মিষ্টি দেখেই কিনি।”
চলে আসলাম রান্নাঘরে। পেছন থেকে ওয়াক ওয়াক করে বমি করার আওয়াজ শুনতে পেলাম।
” ওরে রিফাইত্তা, শেষ পর্যন্ত কু’ত্তা’র খাওন! এই ছিলো আমাদের কপালে!”
————-
সময় এবং শ্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। কেটে গেছে অনেকদিন। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছেই। জাম্বুকে নিয়ে বের হয়েছি। উদ্দেশ্য রেল স্টেশন। মা আসছে গ্রাম থেকে। বাস যাত্রা করতে পারেন না। প্রায় চার মাস পর মা আসছে। পৃথিবীতে মা আর জাম্বু ছাড়া কেউ নেই।
” খবরদার জাম্বু, মা আসলে আমার আগে ঝাপটে ধরবি না। আমার আদর কমে যাবে।”
প্ল্যাটফর্মে বসে ট্রেনের অপেক্ষা করছি। জাম্ব পাশে বসা। আদৌও আমার কথা কানে পৌঁছেছে কি না সন্দেহ। সে ব্যস্ত আশপাশ দেখতে।
” কিরে জাম্বুরা, আজ কাকে কামড়াতে এলি?”
ক্যা ক্যা আওয়াজ করে আড়ালে চলে গেলো জাম্বু। টনক নড়ে আমার। পরিচিত কন্ঠস্বর। বিরক্তির রেখা ফুটে উঠে অনিমেষে। পাশের প্রতিবেশীর এখানে কী কাজ? তার না অফিস আছে! সকালে পিঠা বানিয়ে এসেছি তো।
ফিরে তাকালাম। ফর্মাল পরিপাটি পোশাক। অফিসে যাচ্ছে হয়তো। আটকে গেছে আমাদের দেখে।
” অনুসরণ করছেন আবারও!”
” আপনজনকে অনুসরণ করা যায়। তুমি কি আমার আপনজন?”
” আপনার কাজ নেই?”
” কাজ কাজের জায়গায়, আপনজন আপনজনের জায়গায়।”
ফোঁস করে উঠলাম। মানুষটার ত্যাড়াবাঁকা কথা ছাড়া কথা নেই যেন। জন্মের সময় মুখে মধু উঠেছিল কি! সন্দেহ। মনোযোগ দিলাম না আর, লোকটাকে ভাবনার ইচ্ছে নাই।
ট্রেন এসেছে প্ল্যাটফর্মে। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। মাকে দেখার তৃষ্ণা জেগেছে খুব। অদূরে মায়ের দেখা মিলল। হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন। জাম্বুর গলার ফিতা শক্ত করে ধরলাম। এক পা দুই পা আগালাম। পাশ দিয়ে প্রিয়মকে এগিয়ে যেতে দেখলাম। মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল প্রিয়ম। বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। তারা কি পূর্ব পরিচিত?
” কেমন আছিস আরু?”
অন্তর কাঁপছে ভয়ে। সন্দিহান দৃষ্টিপাত করলাম প্রিয়মের পানে। বাঁকা হাসি মুখে। যেন কোন বিষয় গোপন রেখে জয়ী হয়েছে।
” ভালো।”
” তোরা যে একসাথে থাকিস আগে বললি না তো! ভাইজান না জানালে জানতামই না। তোদের রাগ অভিমান শেষ বুঝি?”
থমকে গেলাম। চমকে তাকালাম মায়ের দিকে। অভিমান, অভিযোগ কার উপর করব? জাম্বুর দিকে তাকালাম। তাঁর দৃষ্টিও সন্দিহান। চোখে চোখে বলছে যেন” কামড়ে দেই আবার?”
ইশারায় না করলাম। চুপ থাকতে বললাম। বাসায় গিয়ে আলোচনা হবে।
——–
সোফার উপর আরাম করে বসে আছে প্রিয়ম। যেন শাহজাদা। মাকে দেখে ভাব যেন বেড়ে গেলো তার। একের পর এক আদেশ দিচ্ছেন আমাকে।
” আরু, পানি এনে দাও তো!”
এনে দিলাম পানি। ঢকঢক করে পান করে মুখশ্রী বাঁকা করে বলল,
” শুধু পানি? খাবারের কিছু নিয়ে আসো?”
” পারব না।”
পা নেমে বসলেন। গা ঝেড়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” চাচী, আরুর একটা ভিডিও আছে আমার কাছে।”
চোখ বড়ো হয়ে আসলো আমার। ইশারায় না করছি প্রিয়মকে। লোকটা এত খারাপ কেন?
” কি ভিডিও?”
মায়ের মুখ থেকে কথা টেনে বললাম,
” পিঠা বানিয়েছি। আনছি মেহমানের জন্য।”
মা হাসিমুখে প্রত্যুওর করলেন,
” মেহমান কি বলছিস রে! হবু বর বল! যার সাথে তোর আংটি বদল হয়েছে!”
চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসলো সব। মস্তিষ্কে আটকে গেছে কথাটা। ভারসাম্যহীন হয়ে গেলাম। ঢলে পড়লাম। বলিষ্ঠ কারোর বুকের উপর মাথা ঠেকালাম।
তাড়াতাড়ি সব হয়ে গেলো তাই না!
চলবে…..