#অনুরক্তির_অনুভূতি
#আফসানা_মিমি
|২য় পর্ব |
বেলা ফুরিয়ে এসেছে। গগনে মেঘ জমেছে। পুরো পৃথিবী আঁধারে ঢাকা। যে কোন সময় অঝোর ধারায় বর্ষণ হতে পারে। দিবস যেন মুহূর্তেই রজনী রুপ ধারণ করেছে।
তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করছি জাম্বুর দিকে। কিছুক্ষণ পর পর ক্যা ক্যা আওয়াজ করছে সে। যেন আমায় বলছে, “আমি আমার মনিবের আদেশ পালন করেছি মাত্র, তুমি এভাবে চেয়ে আছো কেন হে!” বর্তমানে অবস্থান করছি হাসপাতালে। বারান্দায় অপেক্ষা করছি যুবকটির। ভয়ে নয়তো গ্লানিতে অজ্ঞান হওয়ার আসল কারণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি না।
” আপনার স্বামী তো মারাত্মক লোক? দেখুন কীভাবে খামচে ধরেছে আমাকে! ইনজেকশন পুশ করতে দিচ্ছে না। আপনি ভিতরে আসুন। চড়,থাপ্পড়, খামচি, কামড় বরং আপনিই সহ্য করুন।”
হাসপাতালের সুন্দরী ডাক্তার। রোগীদের দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে মাথা ধরেছে তাইতো ভুল সম্বোধন করছে। বিনয়ী হয়ে প্রত্যুওরে বললাম,
” আপনার ভুল হচ্ছে। আমার স্বামী সাহসী হবে, ঐ ছেলের মত ভীতু না যে কুকুরের কামড় খেয়ে চিৎপটাং হবে। উনাকে চিনি না।”
উপলব্ধি করলাম সুন্দরী ডাক্তার অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করে আছে। সেদিকে আর ঘাটলাম না। জাম্বুর দিকে তাকিয়ে আদেশের স্বরে বললাম,
” এখানেই বসে থাকবি, নড়াচড়া করলে খাসির পায়খানার হালুয়া রেঁধে খাওয়াব।”
অতঃপর ভিতরে পারবেশ করলাম।
” পার্থিব জীবনে মায়া কিছুক্ষণের জন্য, এসে আবার চলে যাবে আজীবনের জন্য। তখন চিনবে না তাঁকে যাকে ভেবেছিলে আপনজন কখনও। এটাই নিয়ম, এভাবেই একা চলবে সর্বদা তুমিও।”
কুকুর কামড়েছে ইনজেকশন পুশ করতেই হবে। নয়তো ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। চেয়ারে মাথা এলিয়ে বসে আছে যুবকেটি, যার নাম অজানা। চিৎকার করছে এতক্ষণ ছোট বাচ্চাদের মতো। বলছে, যত খাওয়ার ঔষধ আছে প্রেস্ক্রিপশন করে দিন। ইনজেকশন পুশ করতে দিচ্ছি না।”
গভীর ভাবনায় বিভোর আমি। অন্তরে অনুতপ্তের চিন্হ এঁকেছে। অন্যায় হয়েছে প্রতিদান তো দিতেই হবে। যুবকের নিকট এসে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে বললাম,
” ইনজেকশন না নিলে পেটে কুকুরের ছা হবে। পাগল হয়ে যাবেন তারপর আমার জাম্বুর মতো ঘেউঘেউ আওয়াজ করবেন।”
” পাগল নাকি! আমাকে বাচ্চা মনে হচ্ছে? ফালতু কথা না বলে বিদায় হও আমার কাছ থেকে।”
পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মানবের সাথে কথা বলছি। জঘন্য মেজাজে ভরপুর। নিজের ভুলের অনুতাপে জ্বলছি নয়তো এই মানবকে শায়েস্তা করা আমার দুই মিনিটের ব্যপার। অগ্নি দৃষ্টিপাত করে ডাক্তারের দিকে মনোনিবেশ করলাম। ইশারায় বাহিরে আসার অনুরোধ করলাম।
” ইনজেকশন রেডি করুন। আমি পাঁচ ছয়জন লোককে পাঠাচ্ছি। ধরে বেঁধে পুশ করে দিবেন। আর অজ্ঞান হয়েছিল কেন, বলবেন?”
” কুকুরে ফোবিয়া আছে উনার। কুকুর সহ্য করতে পারেন না সেই জায়গায় কামড় খেয়েছে। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।”
খুব করে দোয়া করছি এই যুবকটার সামনে যেন আর না পড়ি। তৃতীয়বারের মত দেখা হলে, চির শত্রুর খেতাব লাভ করবে যুবকটি।
আকাশ পরিষ্কার। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝড়ছে। আবহাওয়া ঠান্ডা। প্রেমিক যুগলরা হাতে হাত রেখে রাস্তা পাড় হচ্ছে। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি প্রিয় বান্ধবী রত্নার। জাম্বুকে রেখেছিলাম যার কাছে। বাজার করা হলো না বান্ধবীকে নিয়ে বাসায় যাবো। নতুন ছেলেদের মতলব ভালো ঠেকছে না। মা আসার আগ পর্যন্ত রত্নাকে নিজের কাছে রেখে দিবো।
” কি রে বিদেশিনী! তোর তো বিদেশ থাকার কথা ছিলো। এখানে কী?”
রিকশা ডেকে উঠে বসলাম সাথে রত্নাও। জাম্বুকে কোলে বসালাম। অনামিকা আঙ্গুলে আংটির দিকে দৃষ্টিপাত করে প্রত্যুওর করলাম,
” বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি। যেতে পারিনি। পরের বার সুযোগ পেলেই পাড়াপাড় হবো। কোন অতীতের গ্লানি আঁকড়ে ধরে রাখব না।”
” অতীত কেন মনে করিস আরাত! খুলে ফেল আংটি, ভেঙ্গে ফেল সব নামহীন সম্পর্ক।”
” সম্ভব না। বাঁধা পড়েছি। আমার অস্তিত্ব মিশে আছে কারোর জীবনে। হোক নামহীন তবুও অপেক্ষা করতে ক্ষতি কী।”
———-
একশত দুই ডিগ্রি জ্বর শরীরে। চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সোফায় বসে লেবুর শরবত পান করছে প্রিয়ম। ভয়ে কাবু দুই বন্ধু। কিছুক্ষণ পর পর ঘর থেকে উঁকি দিচ্ছে। ঠাওর করতে পেরে প্রিয়ম উঁচু আওয়াজে ডেকে উঠলো, ” উঁকি ঝুঁকি না মেরে কাছে বসে দেখে যা, নয়তো তোরা শান্তি পাবি না।”
এগিয়ে আসলো বন্ধুগন। ললাটে হাত রেখে তাপমাত্রা পরিমাপ করে নিলো। শান্ত হয়ে বসলো দুই বন্ধু। পেটের মধ্যে যেন কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। অবশেষে আকিল মুখ খুলল,
” কুত্তার পাছায় লাঠি ভাঙ্গতে তোকে কে বলেছিল?”
” কুত্তা না ঐটা কুকুর হবে।”
” তুই চুপ থাক কুকরের দোস্ত।”
রিফাত ফোঁস করে হেসে উঠে। প্রিয়মের শীতল উওর,
” বৃদ্ধ মহিলাকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। কুকুর এসে কামড়ে ধরেছে। আমি ঐ মেয়েকে ছাড়ব না। যেখানেই পাবো কবর দিয়ে আসবো। সাত সাতটা ইনজেকশন পুশ করতে হয়েছে ঐ মেয়েটার জন্য।”
ফোন বাজছে অনবরত। প্রিয়মের সেদিকে খেয়াল নেই। আরাতকে বকে যাচ্ছে। রিফাতের কথায় প্রিয়ম শান্ত হয়। বাবা নামটা ফোনের পর্দায় ভেসে উঠেছে। শান্ত হলো মন মুখে উঠে আসে মিষ্টি হাসি। ফোন কানে নিয়ে চলে যায় অপরপাশে।
আকিল চলে যায় রান্না ঘরে। কফির পিপাসা পেয়েছে।কিন্তু কফি তো শেষ। বাড়ি ছাড়ার ঝামেলায় কিনা হয়নি। কিছুক্ষণ ভেবে বারান্দায় উঁকি দিয়ে প্রিয়মের অবস্থান দেখে নিলো। চলে গেল প্রতিবেশীর ঘরের সামনে।
———-
তুমি চাঁদের জোছনা নও।
ফুলের উপমা নও
নও কোন পাহাড়ি ঝড়না
আয় না আ আ আ আ
তুমি হৃদয়ের আয়না
খাটে বসে গলা ফাটিয়ে গান গাইছে রত্না। রান্না ঘরে পাস্তা রান্না করছি। সকালের নাস্তা করতে হবে তো! দুপুরে কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো। মা আসার আগ পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে। রত্নার উপর চরম রাগ হচ্ছে। গলা ফাটিয়ে মেয়েটা গান গাইছে। গানের তালে জাম্বু দাঁড়িয়ে ঘুরঘুর করে ঘুরছে ঘেউঘেউ করে আওয়াজ করছে। যেন রত্নার তালের সাথে তাল মিলিয়ে গান গাইছে। এই নির্মম অত্যাচার সহ্য করার মতো না। এই মেয়ে যদি আর কিছুক্ষণ আমার বাড়িতে থাকে তাহলে আমি পাগল হয়ে যাবো।
” আল্লাহর ওয়াস্তে তুই চুপ থাকবি রত্না! তোর কণ্ঠস্বর শুনে রাস্তার কুকুর সব দৌঁড়ে চলে আসবে।”
কুকুরের কথা বলাতে জাম্বু মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জাম্বুকে সবকিছু বলা যাবে রাস্তার কুকুর মুখে বলা যাবে না। এটা নিষিদ্ধ, জাম্বু পছন্দ করেনা। যে বলবে তার দিকে তেড়ে যাবে। এটা আমার শিক্ষা না পাড়া-প্রতিবেশীদের শিক্ষা। ওই যে কুকুর দেখলে কুত্তা কুত্তা বলে ডাকে যেই প্রতিবিশী তাদের।
” তোর মত নিরামিষ মেয়ের জীবনে আমিষ ছড়াতে যেন কেউ আসে খুব করে দোয়া করছি। তোর মনে তো কোনো রঙ ঢঙ নেই। এক আমি চাইছি ঘরটাকে সতেজ রাখতে তাও করতে পারছিনা তোর জন্য।”
” আমার জীবনে যে আসার সে এমনিতেই চলে আসবে। তোকে ভাবতে হবেনা নে পাস্তা খা, উদ্ধার কর আমাকে।”
” পালাতে চাইছিলি যার কারণে সে যদি কোনদিন তোর সামনে ফিরে আসে আর চিনতে পারে। ততদিনে তোদের ভাব আদান-প্রদান হয়ে গিয়েছে। তখন তুই কি করবি?”
রত্না মেয়েটা চঞ্চল। কখন কি বলে নিজেও বুঝতে পারে না। যদি বুঝতে পারত তাহলে হয়তো এসব কথা বলতো না। পাস্তার বাটি একটা এগিয়ে দিলাম। জাম্বুকেও দিলাম। জাম্বু হামলে পড়লো পাস্তার উপর। রত্নার কথার প্রতুত্তরে বললাম,
” সে সামনে আসলে ধরা দেবো না। অন্য ছেলেকে ধরে বিয়ে করে নেবো। তখন বুঝবে এই আরাত কি জিনিস!”
রত্না আমি হেসে উঠলাম। কলিং বেলের আওয়াজে এগিয়ে গেলাম। প্রতিবেশী এসেছে। গতকালের মত দাঁত বের করে হাসছে। আমার পিছু জাম্বু এসে হাজির। ঘেউঘেউ করে কি যেন বলতে চাইছে প্রতিবেশীকে।
” কফি হবে আপু?”
প্রতিবেশীদের কাজই কি চেয়ে খাওয়া? গতকাল এসেছে ঝাড়ু নিতে আজ এসেছে কফি নিতে। ভ্রু যুগল কুঁচকে আসলো আমার। হাত থেকে কাঁচের কৌটা নিয়ে চলে গেলাম রান্নাঘরে। কফি এনে হাতে দিলাম। চলে যাওয়ার আগে প্রতিবেশী আবারও দাঁত বের করে হেসে বলল,
” আপনি খুব ভালো আপু। কিন্তু আপনার অবস্থা দেখে আফসোস হচ্ছে। রুপবতীর সাথে যদি বলতে পারতেন তাহলে আমার সাথে সাথে আমার নিরামিষ বন্ধুও আপনার জন্য পাগল হয়ে যেত।”
কি বলে প্রতিবেশী। আমি বোবা? কোন দিক দিয়ে? সহ্য হলো না কথা বলার উদ্যোগ নিতেই প্রতিবেশী পাড়াপাড় হয়ে গেল।
” কে এসেছিল?”
রত্নার প্রশ্নে মাথায় খোঁপা করতে করতে উওর দিলাম,
“পাশের প্রতিবেশীর। তিন চারজন ছেলে উঠেছে। সাবধান ঐদিকে যাবি না।”
———
মধ্যাহ্নের সময়। রোদ উঠেছে প্রচুর। ছাদের নিচে ফ্ল্যাট হওয়াতে সুবিধা পেয়েছি। তখন তখন চলে যাই ছাদে।
ছাদে কাপড় শুকানোর রশি বাধা মোট সাতটা তার মধ্যে আমার তিনটা রশি। ছাদে উঠে আমার চোখ ছানাবড়া। তিনটা রশি ভরা ছেলেদের কাপড়ে। ছোট প্যান্ট থেকে ধরে বড় প্যান্ট সব মেলে রেখেছে রশিতে। ছোট প্যান্ট দেখে আমার গা গুলিয়ে আসে। আমার যত্নে বাঁধা রশিতে ছেলেদের কাপড়। মানা যাচ্ছে না। ছাদের একপাশে কাঠ রাখা ছিলো। এক হাতে নাক টিপে কাপড় সরিয়ে নিচ্ছে তখনই কারোর স্বর কানে আসে,
” ডিটার্জেন্ট দিয়ে ধৌত করা কাপড়গুলো। সুগন্ধি মাখা আছে তাতে। এমনভাবে ধরার কি আছে?”
পিছনে ফিরে তাকালাম। তৃতীয়বার সাক্ষাৎ হলো যুবকটির সাথে। তারমানে এই যুবক আমার প্রতিবেশী? শেষে কী না প্রতিবেশী শত্রু হয়ে গেল!
চলবে…….