||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ১৯||
বাদল উন্মুক্ত শরীরে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়েছিল। আচমকা অনামিকা তার বুকের উপর ঝাপটে পড়ে। দু’হাতে খামচে ধরে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। বাদল দু’হাতে তার পিঠের উপর হাত রেখে বলল, “ওজন বাইড়া গেছে তোমার। এইভাবে শুইয়া থাকবা নাকি চাঁন মুখখানটাও দেখাইবা?”
ভেজা চুলগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে রয়েছে। মুখ তুলে বাদলের চোখের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে যায় মুখমণ্ডলের কোণায় কোণায়। পরিস্থিতি বুঝে উঠতে সময় লাগে খানিকটা। বাদল ভয় পাচ্ছে কেউ যদি তাদের এভাবে দেখে ফেলে তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কিন্তু প্রিয়তমার থেকে এমন ভালোবাসা খুব কম সময়েই পাওয়া যায়। হয়তো সেটা বিশেষ কোনো মুহূর্তে। আর আজ সেই বিশেষ দিন। সে বাধা দেয় না তাকে। আবেশে জড়িয়ে অনুভব করছে এই সুখ।
রেহানা অনামিকাকে দৌড়ে ঘরের ভেতর যেতে দেখে নিজের সন্দেহ দূর করতে পেছন পেছন ছুটে আসে।
বাদলের কানের কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে অনামিকা বলল, “এই কয়ডা মাস কত যন্ত্রণায় পুইড়া মরছি আর তুমি আইতাছ আমারে জানাইলাও না! এ কেমন কাম করলা বাদল মিয়া!”
তার কণ্ঠে অভিমানে ভরা অভিযোগ। কথা টেনে টেনে বলছে। বাদল তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
রেহানা দরজার ওপাশে এসে দাঁড়াতেই তাদেরকে এমন অবস্থায় দেখে। কোনো কিছু না বলে আড়াল থেকেই সরে যায়। মায়ের কামরায় গিয়ে দেখে তিনি শোকরানা নামাজ পড়তে বসেছেন। হয়তো ছেলে সুস্থ সবল ফিরে এসেছে বলে। আর বাবা বাড়িতে নেই, কেউ দেখার ভয় নেই তাহলে। তবে বাদলের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে তার। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আবার রান্নাঘরে ফিরে যায়।
বাদল অনামিকার চিবুকে হাত রেখে মুখ তুলে ধরে। চোখের উপর আলতো ঠোঁটের স্পর্শ করিয়ে বলল, “জানাই আসলে কী আমার পাগলীর এই অস্থির রুপডা দেখতে পারতাম? আমারে কাছে পাওনের লাইগা যে সে ব্যাকুল হইয়া আছে তা তো জানতেই পারতাম না।”
অনামিকা বাদলে দূরে ঠেলে দিয়ে উঠে বসে। বাদলও উঠে বসে তার কোমর ধরে কাছে টেনে নেয়। ভেজা চুলে মুখ গুঁজে গন্ধ চুরি করতে ডুব দেয়। শিউরে উঠে চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নেয় অনামিকা।
“দোহাই লাহে বাদল মিয়া, আমারে বউ কইরা নিয়া আসো। আমি আর এমনে থাকতে পারতাছি না।”, কণ্ঠস্বর কাঁপছে অনামিকার।
বাদল কানের নিচে মৃদুস্পর্শ করে ক্ষীণ গলায় বলল, “বিয়া কইরা যদি তোমারে এমনে আজীবনের লাইগা কাছে পাওন যায়, তাইলে তোমার কসম এই বাদল তোমারে সপ্তার মইধ্যেই বিয়া কইরা আনবো।”
“মামুউ”, বলে মিলন দৌড়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। অনামিকা এক ঝটকায় বাদলের থেকে সরে দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণে বাদলের চেহারা স্পষ্ট দেখছে সে। শরীরটা যেন নিস্তেজ হয়ে আসে তার। বুকটা ধুকপুক করছে। দরজার কপাটে হেলান দিয়ে ঘন নিশ্বাস ফেলছে। একদম ভয়ে পেয়ে গিয়েছিল। মিলন এভাবে দেখে ফেললে তার ছোট্ট মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়তো। নিজের উপরে রাগ উঠছে। কী করছিল সে এসব! আবেগের বশবর্তী হয়ে কতবড় ভুল করছে। বাদলের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রয়৷ ঠোঁট ভেঙে কান্না আসছে৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। তার চোখে তাকালে মায়াটা বেড়ে যায়। কেমন শুকিয়ে গিয়েছে কয়টা দিনে। ইচ্ছে করছে আঁচলে এখনই মুখটা মুছে দিতে। আরেকটু ভালোবাসার ছোঁয়ায় ক্লান্ত শরীরটাকে শান্ত করতে। কিন্তু না এখন এসবের সময় নয়।
“মিলন তো আইজকা পড়ব না, আমি যাই তাইলে।”, বলেই অনামিকা বেরিয়ে যেতে চায়।
বাদল ইতস্তত করে বলল, “আইচ্ছা যাও তাইলে। সন্ধ্যায় থাইকো ঘাট পাড়ে, দারুণ কিছু একটা দেখবা।”
তার কথার অর্থ কিছুটা ঝাপসা থেকে যায়। শুধু এটুকু বুঝে সন্ধ্যায় ঘাট পাড়ে দেখা করতে বলেছে।
২৩.
ভালোবাসার মানুষটাকে একটুখানি খুশি করতে হলে দামী কোনো উপহার নয় বরং সেই মানুষটার উপস্থিতিই যথেষ্ট, যদি সেটা সত্যিকারের ভালোবাসা হয়। আজ অনামিকার মনেও খুশির বন্যা। বাদলকে দেখেই সে তার সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার পেয়ে গেছে।
সেই সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছে এখনো বাদল আসেনি। এদিকে আজকে ঘোর অন্ধকার। সীমাহীন অন্ধকারে ঢাকা দূরের দিগন্ত। আকাশের বুকে চাঁদের বসবাস নেই। তবে কী তাদের অভিমান চলছে! হবে হয়তো৷ মাঝেমধ্যে দুই একটা তারা দেখা যাচ্ছে। রাতে বৃষ্টি হতে পারে।
হঠাৎ করে অনামিকার মুখ কেউ চেপে ধরে। চিৎকার করছে কিন্তু এই চিৎকার হাতের নিচে চাপা পড়ে যায়। পেছন দিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে প্রাণপণে পা ধাপড়াচ্ছে মাটিতে। টানতে টানতে খড়ের ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বুকে খামচে ধরে সর্বস্ব শক্তি দিয়ে কিন্তু একজন পুরুষের শক্তির সাথে পেরে উঠে না। শাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলে। অনামিকা বুঝতে পারে তার সাথে খারাপ কিছু হতে চলেছে। হঠাৎ করে নিজেকে হালকা অনুভব হচ্ছে। মুখের উপর থেকে হাতটা সরে যায়। উঠে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সেই মানুষটা নেই। মাটিতে বসে মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে কান্না করছে। কে তার সাথে এমন করলো! মাথাটা একদম ফাঁকা হয়ে আসে। ছেঁড়া শাড়ি সামলে বাড়ির দিকে ছুঁটে যায়। বাড়ির পথে আসতেই পরশের সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। পরশ তার দিকে লাইট মেরে আৎকে উঠে। হাতে-মুখে ক্ষত চিহ্ন। ব্লাউজের হাত ছেঁড়া, শতচ্ছিন্ন শাড়ি, এলোমেলো চুল! দ্রুত তার কাছে ছুঁটে যায়।
বাহু ধরে উৎকণ্ঠা গলায় শুধায়, “অনু! কী হুইছে তোর? এই অবস্থা কে করছে?”
অনামিকা কিছু না বলেই পরশের বুকে মাথা দিয়ে কান্না করে দেয়। পরশ তাকে কোলে করে ঘরের দরজার এসে একনাগাড়ে আফিয়া ডেকে যাচ্ছে। আফিয়া মাত্র এশার নামাজের সালাম ফিরিয়েছে। পরশের এত ব্যস্ত কণ্ঠে নামাজের পাটি ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলে আর্তনাদ করে উঠে।
“ও আল্লাহ! কী হইছে আমার অনুর! ও রিনির বাপ, কী হইছে? কে ওর ক্ষতি করছে?”, আফিয়া কান্নার সাথে হাজারটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
গুলবাহার বিবি এই মুহূর্তেও অনামিকাকে গালমন্দ করে যাচ্ছেন, “ওমন বেশরম, বেলইজ্জা মাইয়া হইলে তো এমন হইবোই। কত কইরা কইলাম বিয়াডা কইরা লা। আইজ বুঝলা তো ঠ্যালা? আমার কতা তো হুনে না কেউ। এহন বুঝ! মাইয়া মাইনষের এত পাখির লাহান পাংখা গজাইতে নাই।”
পরশ অনামিকাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ভয়ে আর কান্নায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মায়ের এসব কথায় সে ধমকে উঠে, “আম্মা এই সময় মুখটা বন্ধ রাখো।”
ক্ষণকাল থেমে আফিয়াকে বলল, “জলদি পানি নিয়া আয়। মুখে ছিঁটা দে।”
রিনি দৌড়ে পানির জগ নিয়ে আসে। এমন চিৎকার, চেঁচামেচি শুনে সোনিয়া ছুটে আসে তাদের ঘরে। অনামিকার এমন অবস্থা দেখে বুক কেঁপে উঠে তার। পরশ তাকে জিজ্ঞেস করে সে কোথায় গিয়েছিল। সন্ধ্যায় যাওয়ার সময় তাকে বলে গিয়ছিল বাদলের সাথে দেখা করত্ব যাচ্ছে। সবার প্রশ্নে মিথ্যা বলতে পারে না সে। সত্যটা বলে দেয়। পরশ হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সোনিয়ার বড় ভাইও তার পেছন পেছন যায়। এখনো অনামিকার জ্ঞান ফিরেনি। পানি ছিঁটা দিচ্ছে মুখে। পাশে বসে বাতাস করছে রিনি। আফিয়া কপাল চাপড়ে কান্না করছে।
সোনিয়ার ভাই পরশকে জিজ্ঞেস করে, “কই যাবি পরশ? ওই বাদইল্যারে খুন কইরা নদীতে ভাসাই দিলেই তো কাম তামাম।”
পরশ হাঁটতে হাঁটতে বলল, “ওইসব খুনখারাবি কইরা আর হাতে পাপ নিবার চাই না। থানায় যাই। শালারে পুলিশে ধরামু, জেলের ভাত খাওয়ামু।”
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা