||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ১৮||
সোনিয়া নিষ্প্রাণ হয়ে বিছানায় শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। অনামিকা পাশে এসে বসে। আর্তনাদে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সোনিয়ার নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। কোনো কথা বলে না। গতকাল তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হয়েছে। কিছুদিন আগে তার স্বামী এসে হাত-পা ধরে মাফ চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অনামিকা অনেক বুঝিয়েছিল না যাওয়ার জন্য। এই লোক কোনোদিন ভালো হবে না। যে মানুষ একবার মারতে সাহস পেয়ে সে বারবার মারতে পারে। কিন্তু সে শুনেনি তার কথা। ভেবেছিল আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে দোষের কী! কোন মেয়ে চায় স্বামী সংসার ছেড়ে বাপের বাড়ি বসে থাকতে! বাপের বাড়ি তো বিয়ের আগ পর্যন্ত আপন, বিয়ের পর ওই স্বামীর ঘরটাই নিজের ঘর করে নিতে হয়। কিন্তু সোনিয়ার কপালপোড়া! শান্তি হয়নি সংসারে। এক মাসের মধ্যে তাকে আবার মারধর করেছে। কান দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এক কানে কম শুনতে পাচ্ছে। এই কানের সমস্যা হয়তো তার সারাজীবন লেগে থাকবে।
অনামিকা ঘরে আসতেই আফিয়া তার কাছে যায়। সে তার কামরায় আসলেই আজকাল ভয় লাগে। বিয়ের কথা ছাড়া আর যেন কোনো কথা নেই তাদের কাছে। আজও সেই একই কথা জুড়ে বসেছে আফিয়া।
“তোর বয়স হইতাছে। পরে কী আর এমন ভালো প্রস্তাব পামু? আইজ আব্বা-আম্মা বাঁইচা থাকলে তুই এমন করতে পারতি?”, বলতে বলতে কান্না করে দেয় আফিয়া।
বোনের চোখের জল দেখতে তার যে খুব ভালো লাগছে বিষয়টা তেমন নয়। কিন্তু সে এই বিয়ে কিছুতেই করতে পারবে না। বাদলকে ছাড়া কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
অনামিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আপা, তোর স্বামী আমারে বিয়া এইহান থেইকা সরাইতে চায়, আমিও বিয়াতে রাজী।”
কথাটা শুনেই আফিয়ার চোখেমুখে আনন্দ ফুটে ওঠে। তবে তারপরের কথা শুনে কালো মেঘ এসে ভর করে।
“কিন্তু, তার পছন্দ করা পাত্রের লগে না, আমার পছন্দের পাত্রের লগে বিয়া করুম। আর সেই পাত্র হইলো বাদল মিয়া। বাদল মিয়া গেরামে আসলে তোমরা বিয়ার ব্যবস্থা কইরা নিও।”
এত যন্ত্রণা সইতে না পেরে বাদলের কথা বলেই দেয়। ভাবে না যে এর পরে কী হতে পারে। সেদিনই রাতেই পরশ রেগেমেগে আফিয়াকে এক তালাক দিয়ে বসে। স্বামীর মুখে তালাক শুনেই যে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পুরো বাড়ির লোক দৌড়ে আসে। পরশ তাকে তার বোনকে নিয়ে এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে বলে।
এক সপ্তাহ সোনিয়াদের ঘরে থাকে সে। প্রতিবেলা পরশের চোখের আড়ালে এসে রান্না করে দিয়ে যেত। গুলবাহার বিবি যতই মুখে আজেবাজে কথা বলেন না কেন মন থেকে তিনি কখনোই ছেলের সংসার ভেঙে যাক এটা চান না। আফিয়ার মতো ছেলের বউ ভাগ্য করেই পেয়েছেন তা মনেপ্রাণে মানেন। পরশকে বুঝিয়ে হুজুর এনে আবার তাদের মধ্যে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয়।
আফিয়া এই ঘরে ফিরে আসলেও অনামিকা আসতে চায় না। পরশের ভিন্ন রূপ দেখ যায় তখন। সে নিজে যায় অনামিকার কাছে মাফ চাইতে। এতটা অবাক অনামিকা কখনোই হয়নি। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অনামিকার সামনে খাটের উপর বসে। আফিয়া দরজার কোণে দাঁড়িয়ে আছে। রিনি তার আঁচল ধরে রেখেছে।
পরশ তাকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “ঘরে চল অনু। তুই যা চাস তাই হইবো। আমি নিজে বাদল মিয়ার লগে কথা কমু। তার বাপেরে প্রস্তাব দিয়া পাঠাইতে কমু। তোর পছন্দেই বিয়া হইবো। এহন তো খুশি?”
অনামিকা একটা শব্দও বলে না। নিঃশব্দে কেবল আফিয়ার দিকে এক পলক তাকায়। নিজের জন্য না হোক মায়ের সমান বোনের কথা ভেবে সে ঘরে চলে আসে। কিন্তু পরশ হুট করে এত পরিবর্তন কীভাবে হলো এটাই খটকা লাগছে তার কাছে। পরে আবার ভাবলো মানুষ মাত্রই তো পরিবর্তনশীল। হয়তো সে তার নিজের ভুলটা বুঝতে পারছে৷ এসব নিয়ে সে আর ভাবে না।
২২.
দেখতে দেখতে আরো বেশ কিছুদিন কেটে যায়। অবশেষে ৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন জেনারেল এরশাদ। ছাত্র আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে৷ বাদলের এখন গ্রামে ফেরার পালা। বড় সাহেবের সাথে আরেকবার দেখা করতে যায়। তিনি আগের চাকরিটা তাকে আবার করার জন্য বলেন৷
প্রতিত্তোরে সে জানায়, “বিয়া কইরা একেবারে বউ নিয়া শহরে চইলা আসুম বড় ভাই। তহন চাকরিতে আবার যোগদান করুম।”
বাদলের কথায় তিনি খুশি হয়ে যান। এক কাপ চা খেয়ে বিদায় নেয় সে তাঁর থেকে। মার্কেটে যায় কাপড় কিনতে। অনেক শাড়ি দেখার পর একটা শাড়িতে এসে তার চোখ আটকে যায়। লাল পাড়ের মিহি শাড়ি। সাদা জমিনের উপর উপর কালো সুতোর কাজ করা। শাড়িটা কিনে নেয় অনামিকার জন্য। সাথে রেশমি চুড়ি আর একজোড়া নুপুর। মায়ের জন্য শীতের শাল, বাবার জন্য পাঞ্জাবি, বোনের জন্য শাড়ি, আর মিলনের জন্য শার্ট নেয়। নিজের জন্য কী নেবে ভাবতে ভাবতে একজোড়া চপ্পল ছাড়া কিছুই নেওয়া হয় না। কিছু খাবার জিনিস কিনে নেয়। পরদিন সকাল বেলা রওয়ানা দেয়। ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। বাড়িতে জানায়নি সে যে ফিরে যাচ্ছে। তাকে দেখে সবাই কেমন চমকে উঠবে সেটাই ভাবছে।
বিকেলের দিকে বাদল বাড়িতে এসে পৌঁছায়। মিলন পথে বসে খেলছিল। তাকে দেখামাত্রই কাছে ছুটে যায়। একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বাড়ির ভেতর দৌড়ে আসে। মায়ের কাছে এসে চেঁচিয়ে বলল, “আম্মা, নানী, মামু আইছে মামু।”
রেহানা বসে মায়ের মাথা দেখে দিচ্ছিল। রুজিনা বানু নাতির কথা শুনে উঠে দাঁড়ান। ছেলেকে দেখে তার চোখ ছলছল হয়ে আসে। এতদিন পর দেখছেন তাকে। কাছে এসে গা, মাথায় দু’হাত বুলিয়ে ঘরে নেন। রেহানা ঠান্ডা পানি নিয়ে আসে ভাইয়ের জন্য।
“কতডা শুকাই গেছস রে বাবা! ওইহানে খাইতে পারোস নাই তাই না? চুল-দাড়ি কামাস নাই ক্যান?”, বলতে বলতে চোখ মুছেন রুজিনা বানু।
মায়ের কথায় স্পষ্ট যত্ন আর চিন্তা খুঁজে পাচ্ছে। বাদলকে কিছু বলতে না দিয়ে রেহানা বলল, “হ, বুইড়া বেডা লাগতেছে এক্কেরে, আমি তো চিনতেই পারি নাই তোরে!”
বাদল সংক্ষেপে বলল, “তোমরা কী খালি এইসবই বলবা? আমারে একটু কিছু খাওয়াবা না?”
রেহানা একগাল হেসে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়৷ সন্দেশ করবে। তখন বাড়িতে পা রাখে অনামিকা। সন্দেশের কী সুন্দর ঘ্রাণ ভেসে আসছে। বাড়িতে কী কোনো মেহমান আসলো নাকি ভাবছে। মিলন মায়ের পাশে বসেছিল। অনামিকাকে দেখে দৌড়ে এসে বলে, “আফামনি, মামু আইছে আমার আইজকা পড়ুম না।”
কথাটা শুনেই শরীর দুলে ওঠে, বুকের কম্পন বেড়ে যায়। আসলেই কী বাদল এসেছে! চোখের কোণে জল এসে জমে। হৃদপিণ্ড যেন গলায় এসে আটকেছে। সন্ধানী দৃষ্টি দুয়ারে গিয়ে ঠেকে। গুটিগুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। বারবার দোয়া পড়ছে ভেতরে গিয়ে যেন বাদলকে দেখতে পায় সে।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা