||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ১৭||
বাদলের নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। ভাষণ আর স্লোগান দিতে দিতে গলা একদম ফ্যাসফ্যাসে হয়ে গেছে৷ একফোঁটা চা খাওয়ারও সুযোগ হয়ে উঠছে না। চব্বিশটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে গড়ে উঠেছে “সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য।”
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠনের মাধ্যমে ছাত্র সংগঠনের সকল শক্তি একই জায়গায় মিলিত হয়। এছাড়া আরও কিছু শক্তিশালী বামধারার ছাত্র সংগঠন যথেষ্ট পরিমাণে সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এর আন্দোলনের সাথে দেশের জনগণ সম্পৃক্ত হয়। এক সময় তা গণ আন্দোলন থেকে গণ অভ্যুত্থানে রুপ নেয়।
অনামিকা মিলনকে পড়াতে এসে জানতে পারে বাদলের চিঠি এসেছে। তখনই সে মিলনকে সাথে নিয়ে ডাকঘর চলে যায়। নিজের নামের চিঠিখানা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে। এখন পড়বে না সে। বাড়িতে গিয়ে রাতে পড়বে। ব্লাউজের ভেতরে লুকিয়ে রাখে। আজ সে কী পড়াচ্ছে না পড়াচ্ছে কোনো খেয়াল নেই। কখন সন্ধ্যা নামবে আর কখন চিঠিটা পড়বে সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। আর অপেক্ষা সইতে পারে না সে। বেলা থাকতেই মিলনকে ছুটি দিয়ে বাড়িতে চলে আসে। নিজের ঘরে গিয়ে দুয়ারে খিল দেয়। খোলা জানালার কাছে গিয়ে বসে চিঠিটা বের করে। তড়িঘড়ি করে খাম ছিঁড়ে ফেলে। চিঠি খুলে কতক্ষণ চোখ বুলায়৷ এতেই যেন অশান্ত মনে শান্তি পাচ্ছে। পড়তে শুরু করে।
তৃণলতা,
কেমন আছ তুমি? জানি ভালো নাই। সারাক্ষণ হয়তো আমারে ভাইবা কান্দো। এই যে চিঠিটা পইড়াও কান্তেছ তাই না? কানবা না, কান্দিলে যে তোমার ঘাসফড়িং কষ্টে ছটফট করে। শোন, আমি ঠিকঠাক মতো পৌঁছাইছি। আমারে নিয়া কোনো চিন্তা করবা না। এইহানে অনেক ব্যস্ততায় আছি। নিয়মমতো খাওয়া দাওয়া করতেছি। তুমি নিজের খেয়াল রাখবা। আমারে এই ঠিকানায় চিঠি লিখবা। হোস্টেলের টেলিফোন নম্বর দিয়া দিলাম। কোনোদিন গঞ্জে গিয়া টেলিফোন করতে পারলে করিও। দেশের হাল ভালা না। এই শাসক দেশটারে গিইল্যা খাইতেছে। দোয়া কইরো খুব তাড়াতাড়ি যাতে আমরা সফলতা পাইয়া যাই, তাইলে তোমার কাছে উইড়া চইলা আসুম। চিঠির উত্তর লিইখো আমারে। আজ এইখানে শেষ করতেছি। ভালো থাইকো। আরেকটা কথা, যত্ন নিও গোলাপের পাপড়িগুলার। আমি আইসা ওইহানে বিচরণ করুম আবার। তহন মধু মিশাই দিও। খুব বেশি ভালোবাসি তোমারে।
তোমার ঘাসফড়িং,
বাদল
রাঙা মুখ, চোখে জল, ঠোঁটে হাসির সব মিলিয়ে এক অপূর্ব মিশ্রণ। এই ছেলে এভাবে কেন লিখলো চিঠিতে। একদম লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ফেলেছে। এসবের আবার উত্তর চাচ্ছে। অনামিকা চিঠি ভাঁজ করে বুকের সাথে চেপে ধরে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে তার বাদলের ছোঁয়া। চোখের সামনে সেদিনের মুহূর্তটা ভেসে আসে। শিউরে উঠে তার শরীর। বাদলকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্খা আরো বেড়ে যায়। দূরত্ব শুধু কষ্টের নয়, মধুরও বটে। এই অপেক্ষা করতে বেশ ভালো লাগছে। বাদল ফিরে আসলেই বিয়ে করে নেবে তারা। আর দুরত্বের পীড়া সহ্য করতে পারবে না সে।
জামাল বাদলের কামরায় পানি নিয়ে এসে ঢুকে। ভার্সিটিতে জামাল বাদলের সব থেকে কাছের ছোট ভাই। একই কামরায় থাকে তারা। আন্দোলনে বাদল যতটা কষ্ট করছে তার পেছনে জামালও সে পরিমাণ কষ্ট করছে। তাল মিলিয়ে দু’জনে জয় ছিনিয়ে আনতে আন্দোলন করে যাচ্ছে।
“কীরে কু আছিলি এতক্ষণ?” উপন্যাসের বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করে বাদল।
পানির জগ মাটিতে রেখে জামাল বলল, “ভাইজান, বাড়ি থেইক্যা টেলিফোন আসছিল। কথা কইতে গেছিলাম। আব্বায় ছোডো বইনডার বিয়া ঠিক করছে। আমারে যাইতে কইতেছে। কও দেহি এই সময় কী যাইতে পারুম আমি?”
বাদল বইটার একটা পৃষ্ঠার কোণা ভেঙে দাগ দিয়ে বন্ধ করে এক সাইডে রেখে দেয়। জামাল তার সম্মুখে এসে বসে। জামালের দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্যান যাওয়া যাইবো না? বইনের বিয়া কবে?”
“১৫ই অক্টোবর ভাইজান।”
“তুই ওতো চিন্তা করিস না। বইনের বিয়ায় যাবি৷ এইহানে সব আমি সামলাই নিমু।”
“কিন্তু ভাইজান,” জামাল আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। বাদল তাকে থামিয়ে দেয়।
কিছু টাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। ছোট ভাইয়ের বোনের বিয়ে কিছু না দিলে কেমন দেখায়! বড় সাহেবের কাছে গেলে তার টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাদল এর আগে ঢাকায় থাকতে একটা প্রকাশনিতে সম্পাদকের কাজ করতো। তার লেখা কবিতার বইও বের হয়েছে কয়েকটি। ওখানের প্রকাশকের কাছে কিছু পাওনা আছে তার। ওইটা হলেই ছোট বোনের জন্য একটা শাড়ি কিনে দিতে পারবে। তাছাড়া অনামিকার জন্যেও একটা টুকটুকে লাল শাড়ি কিনে নিয়ে যাবে। টাকার তো দরকার আছেই। কাল একবাত সময় করে দেখা করে নেবে বড় সাহেবের সাথে।
বড় সাহেবের সাথে দেখা করতেই কাজ হয়ে যায়। খুব ভালো মানুষ না হলেও অতোটা খারাপ না মানুষটা। আসার সময় জামালের বোনের জন্য একটা শাড়ি কিনে নিয়ে আসে। অনামিকার জন্য যাওয়ার কিনবে। পরিবারের জন্যেও আরো অনেক কিছু কিনতে হবে।
২১.
আজ ১০ই অক্টোবর ১৯৯০ সাল, বেলা এগারোটা বাজে সকলে দলবেঁধে রাজপথে নেমে আসে। আন্দোলনের মাত্রা বেড়েছে। হঠাৎ করে কে যেন পুলিশের দিকে ইট ছুঁড়ে মারে। সাথে সাথে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেঁধে যায়। পুলিশ আর ছাত্র-জনতার মধ্যে তুমুল ঝগড়া। পুলিশ লাঠি চার্জ দিয়ে দেয়। বাদলের কপালে লাঠির আঘাতে রক্ত ঝরছে। বেশ কিছু ছাত্র আহত হয়েছে। একদল তাদেরকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। হঠাৎ করে শুরু হয় গুলাগুলি। পুলিশের একটা গুলি একজন ছাত্রের বুক ঝাঁজরা করে দেয়। সে আর কেউ নয় জামাল। বাদলকে বাঁচাতে জামাল নিজের বুক পেঁতে দেয় বন্দুকের গুলির সামনে। মুহূর্তে থমকে যায় সবকিছু। বাদল তাকে কোলে নিয়ে দৌড়াচ্ছে হাসপাতালের দিকে। তার পেছনে অগণিত ছাত্র-জনতা। রক্তে রঞ্জিত রাজপথ। পথেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে জামাল। বাদলের চোখ জলে ভিজে একাকার। চিৎকার করে কান্না করে দেয়৷ রাগে পুলিশের দিকে তেড়ে যায়। অনেকজন তাকে চেপে ধরে আটকায়।
বোনের বিয়েটা আর দেখা হলো না জামালের। কত স্বপ্ন ছিল তার। সব যেন এক মুহূর্তে ধুলোয় মিশে গেল। চারিদিকে প্রিয় ভাই হারানোর হাহাকার শুনছে। তার পরিবারকে কী জবাব দেবে বাদল কিছুই জানে না।
জামালের মৃত লাশকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে তৎকালীন ক্রিয়াশীল সকল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত হয়। শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয় তাকে। বাড়িতে তার মা-বাবার কাছে খবর পাঠানো হয় তাদের ছেলে শহীদ হয়েছে। জামালের বাবা তার লাশ এসে নিয়ে যান। ছোট বোনের বিয়ের জন্য কেনা শাড়িটা বাদল তার বাবার হাতে ধরিয়ে দেয়।
যে বাড়িতে বিয়ের বাদ্য বাজার কথা সে বাড়িতে আজ স্বজন হারানোর করুণ সুর। মায়ের আর্তচিৎকারে কেঁপে উঠছে বাড়ি। প্রলাপ করছেন কিছুক্ষণ পরপর। বোনের চোখে বাধাহীন জল গড়িয়ে পড়ছে। হুজুর ও গ্রামের মুরব্বির সাথে বড় ভাই নিজ হাতে ছোট ভাইয়ের লাশ ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে। যে ছেলে বাবার লাশ কাঁধে নিয়ে কবরে শোয়ানোর কথা সেই বাবা আজ ছেলের লাশ নিয়ে শুইয়ে আসলেন। যে যাওয়ার সে চলেই যায়। রেখে যায় কেবল কিছু স্মৃতি। স্মৃতিতেও একটা সময় ধুলো জমে যায়।
জামালের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে আসে। অবশেষে সব কয়টি ছাত্র সংগঠনের মিলিত শক্তির আন্দোলনের কাছে সেনাবাহিনী সমর্থিত জেনারেল এরশাদ টিকতে পারে না। দীর্ঘ নয় বছর পরিচালিত আন্দোলনের অবশেষে সমাপ্তি ঘটে। সেই গণ অভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ ৪ঠা ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
পরশ আজ আফিয়াকে ডেকে বলে, “দেখ, কয়টা মাস তো চইলা গেল। তুই এবার অনামিকারে একটু বোঝা। আমি আর ওর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারুম না। ওই প্রস্তাবডা এহনো আছে। কইলেই হেতেরা দৌড়াই আসবো। এমন ভালা প্রস্তাব কিন্তু খুঁইজা পাবি না।”
আফিয়া কেবল নিশ্চুপ শুনে যায়। অনামিকার হাবভাব তার কাছে ইদানীং ভালো ঠেকছে না। প্রায়ই তাকে দেখা যায় একা একা বসে হাসতে। কিছু জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দেয় না। কীভাবে কথাটা তুলবে ভেবে পাচ্ছে না। বাবা-মা হারা বোনটাকে জোর করতেও পারে না সে। কষ্ট পেয়ে যাবেই বা কার কাছে। সে ছাড়া তার যে আর কেউ নেই।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা