||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ১৬||
“তুই শরীর বেইচ্যা দিলেও আমি তোরে মাফ করুম কিন্তু অন্তর বেইচ্যা দিলে খুন কইরা ফালামু অনামিকা।”
আরো কয়েকটা নীরব মুহূর্ত। অনামিকা নীরবতা গুড়িয়ে বলল, “এই অনামিকারে খুন করনের আগে নিজেই জিন্দা লাশ হইয়া যাইবা বাদল মিয়া।”
ছলছল নয়ন জোড়ার বাঁধ ভেঙে অশ্রু ঝরছে। প্রিয় মানুষটা দূরে যাওয়ার ক্ষণ চলেই এলো। একে অপরের সাথে জড়িয়ে থাকে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে এই সময়টা৷ নির্লিপ্ত প্রশান্তির কোলে আত্মসমাহিত। নিরবচ্ছিন্ন আলিঙ্গনে নির্বাক প্রবাহে কেটে যায় ক্ষণকাল।
দু’হাতে অনামিকার মুখটা বুক থেকে তুলে ধরে বলল, “হুনো, হাঁসগুলার দায়িত্ব হেলালরে দিয়া গেলাম। তোমার কিস্যু করতে হইবো না। তুমি ওইদিকে একলা যাইও না। যদিও যাইতে হয় তাইলে আপারে সাথে নিয়া যাইও।”
“ভয় পাইতাছ মিয়া?”, বলে পরিমিত হাসে৷
হাসি কিছুক্ষণ পর শব্দ ছড়ায়। মিহি হাসির শব্দ। এই প্রথম তার প্রিয়তমার হাসির শব্দ শুনতে পায়। কখনো এত প্রাণখোলা হাসি দেখেনি। আচমকা হাসি থামিয়ে বাদলের দিকে তাকায়। বাদলও তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের মণিজোড়া নিষ্পলক। কিছু একটা চেয়েও যেন পাওয়া হচ্ছে না৷ ভয় অথবা সংকোচ কাজ করছে। বুকের কাঁপন বলে দিচ্ছে চাওয়াটাকে মনের গভীরে চেপে না রাখতে। অনামিকার ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে। চোখজোড়া সরু হয়ে এলো। হাতজোড়া কোলের উপর গুটিয়ে রেখে বসে রইল। ধুকপুক করছে বুক। বাদল তার দিকে এগিয়ে আসে। কাছে থেকে আরো কাছে। চোখ বন্ধ হয়। গতকাল সন্ধ্যায় য্ব চুম্বন দিতে বাঁধা দিয়েছিল, আজ তার জন্য নিজে প্রস্তুত হয়ে এসেছে। অন্তত এই স্মৃতিটুকু বুকে লালন করে কাটিয়ে দিতে পারবে অগণিত বছর। একজোড়া শুষ্ক ঠোঁট আরেকজোড়া ঠোঁটের উষ্ণতায় সিক্ত হচ্ছে। বুকের সমতলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। সময় এখানে থমকে গেলেই ভালো হতো। কিন্তু না, দূরত্ব না এলে যে প্রেমের স্বাদ পরিপূর্ণ হয় না। বিষাদ প্রেমে পূর্ণতা দিয়ে ভালোবাসার অতল গহ্বরে এক অনন্য সুখের নগর গড়ে তুলে। যেখানে মাঝেমধ্যে দুঃখ এসে কড়া নাড়ে। দুয়ার খুলে কখনো তাকে বরণ করে নেওয়া হয়, কখনোবা সুখের তালা ঝুলিয়ে দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়।
হেলাল হাঁক ছেড়ে বলল, “দেরি হইয়া যাইতাছে বাদল। পরে বাস পামু না।”
কী এক তন্ময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল দু’জনে। মুগ্ধতার মোহজাল ভেঙে যায় হেলালের ডাকে। নড়েচড়ে বসে তারা। অনামিকার মুখটা রাঙা হয়ে আসে। দৃষ্টি তুলে তাকানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারছে না। দ্রুত নিশ্বাস ফেলছে।
অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত সময়টা এসে যায়। বাদল অনামিকার একটা হাত ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। গালে হাত রেখে বলে, “নিজের খেয়াল রাইখো। আমারে চিঠি লিইখো।”
“আমার ঘাসফড়িং এর খেয়াল রাইখো বাদল মিয়া। সহিসালামতে তারে ফিরায়া আমার কাছে নিয়া আসবা।” বাদলের গালে সে নিজের একটা হাত রেখে বলল।
নিশ্বাস যেন আটকে আসছে। বুকটা ভীষণ ভারী। এলোমেলো হয়ে এসেছে সকল অনুভূতি। শব্দরা গুমোট বেঁধেছে। কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে, ধীরে ধীরে হাতটা ছেড়ে কদম বাড়ায় সরু পথে।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই অনামিকা দ্রুত পায়ে এসে বলল, “ঠিকমতো খাইও, নিজের খেয়াল রাইখো।”
“আচ্ছা তুমিও।”
আরো কিছুদূর যেতেই আবার বলল, “বেশি রাইত বাইরে থাইকো না।”
“ঠিকাছে, তুমি বাড়ি যাও এহন।” বাদল থেমে পেছনে তাকিয়ে বলল।
অনামিকা পেছন পেছন আরো খানিকপথ এসে বলল জোর গলায় বলল, “চিঠি লিখতে ভুইলা না যেন।”
“সপ্তায় একদিন পাঠামু, তুমি উত্তর দিও।”
এই কথাটাই শেষ কথা ছিল। দেখতে দেখতে বাদল তার চোখের আড়াল হয়ে যায়। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এসেছে। সেখানেই চিৎকার করে কান্না জুড়ে বসে। এ যেন কারো বিয়োগের কান্না। ভেতরের কষ্ট কণ্ঠনালী ঠেলে বেরিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে তা নীরবতায় রূপ নেয়। সূর্য উঁকি দিয়ে আলো ছড়িয়েছে চার দিকে। বাড়িতে এসে ঘরের ভেতর ঢুকে চুপচাপ বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। কতক্ষণ যে কান্না করেছে তার কোনো হিসাব নেই। বালিশ ভিজে একাকার।
বিছানা ছেড়ে আজ অনেক দেরিতে উঠে সে। বেলা দশটা বাজে তখন। সকালের খাবার খাওয়া শেষ সবার। কয়লা হাতে নিয়ে পুকুরের দিকে রওয়ানা হয়। পুকুরে কাকে যেন দেখতে পাচ্ছে। খুব পরিচিত জন। কাছে যেতেই পরিষ্কার দেখতে পায় সোনিয়াকে। সারামুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার সইকে। এতদিনের জমানো কথা সব আজ গড়গড় করে বলে দেবে। কিন্তু সোনিয়ার কোনো সাড়াশব্দ পেল না। বাহু ধরে নিজের দিকে ফেরাতেই কলিজাটা ধক করে উঠে। আর্তনাদ করে উঠলো সে। তার মুখে গলায় কালো কালো দাগ।
“এইগুলা কী রে! কিয়ের দাগ?”, সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আরে এইগুলান কিস্যু না। আমার কথা ছাড়, তোর কথা কো। কেমন আছিস? বাদল ভাই কেমন আছে?” সোনিয়া কণ্ঠ টেনে টেনে বলল।
কথা আড়াল করার চেষ্টা করছে যে স্পষ্ট বুঝতে পারে অনামিকা। এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন করে তাকে খারাপ পরিস্থিতিতে ফেলতে চায় না। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ কাছের মানুষজন কখনো কথা বুকে চেপে রাখতে পারে না৷ কখনো না কখনো তা বেরিয়ে আসে। যখন তার মন চাইবে তখন সে নিজেই সব বলবে। ততদিন না হয় নিজের আগ্রহ চেপে রাখল।
অনামিকাকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না। দু’দিনের মাথায় সোনিয়া জানায় তার স্বামী তাকে যখন-তখন মারধর করে। কোনো কথার উঁচুনিচু হলেই মারে। এবার আর সইতে না পেরে বড় ভাইকে জানায়৷ সে গিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। হয়তো আর ফিরে যাবে না ওখানে। সুখ পাখিটা তার খাঁচায় ধরা দিল না। অনামিকা এবারও তাকে কোনো সান্ত্বনা দিতে পারে না। বাদলের থেকে তার আর সান্ত্বনা বাণী শেখা হলো না। চিঠিতে লিখে দেবে, তাকে যেন কিছু সান্ত্বনা বাণী লিখে পাঠায়।
২০.
দূরত্বের যন্ত্রণা বিচ্ছেদের বেদনার থেকেও পীড়াদায়ক। এক একটা দিন এক একটা বছরের ন্যায় কাটে। চোখের নিচের গভীর গর্তে কালি পড়া একেকটা নির্ঘুম রাতের সাক্ষী হয়ে রয়।
বাদল শহরে পাড়ি জমিয়েছে আজ সাতদিন হয়ে গেল। এখনো তার চিঠি আসেনি। এর মধ্যে দুইদিন ডাকঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে অনামিকা। পিয়নকে বলেছে তার নামে চিঠি আসলে যেন বাড়িতে না নিয়ে যায়। সে এসে নিয়ে যাবে। পরশ দেখলে তাকে সমস্যায় পড়তে হবে। বাড়িতে খবর নিয়ে জানতে পারে সেখানেও চিঠি দেয়নি। হয়তো আসতে দেরি করছে। সে কেন যে তার ঠিকানাটা রাখল না। নাহলে প্রতিদিন একটা করে চিঠি লিখে পাঠাতো তাকে।
এখানে বাদল আসার দুইদিন পর চিঠি লিখে পাঠিয়েছে গ্রামে। একটা চিঠি মা-বোনকে আরেকটা তার তৃণলতা অনামিকাকে। এখনো চিঠির জবাব পায়নি। ওদিকে চিঠি পৌঁছাতে দেরি করছে। সে আসার পর থেকে আন্দোলন আরো জোড়ালো রুপ ধারণ করেছে। সে তাদের দলনেতা৷ নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আন্দোলনকে। জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরো বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা এসে যোগ দিয়ে বাদলের সাথে পরিকল্পনা করে। রাস্তার প্রথম সারিতে তাদের দেখা যায়।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা