||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ০৫||

কিছু মানুষের মুখে নিজের নাম শুনলে ভেতর থেকে কেমন একটা ভালো লাগা কাজ করে। বাদলের ভালো লাগার সাথে এখন বেশ আনন্দও লাগছে। মনোরম পরিবেশে সতেজ হয়ে এসেছে হৃদয়।

“আর কদদূর হাঁটতে হইবো বাদল মিয়া?” অনামিকার কণ্ঠে প্রথম তার নাম। কিন্তু মেয়েটা চাইলে তাকে ভাই ডাকতে পারতো। একটুও সম্মান দিয়ে কথা বলল না। নামের সাথে মিয়া লাগিয়ে দিল। যদিও তার নামের শেষে শেখ লাগানো। দিঘির সামনে আসতেই শিলা আর মিলন তার হাত ছেড়ে দৌড়ে ঘাটে গিয়ে পা ভেজায়। পানি দিয়ে খেলছে। একে অপরের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। খিলখিল করে হাসছে। হাসির প্রতিধ্বনি তুলছে। হাঁসগুলো দিঘির পাড়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তাদেরকে দেখা মাত্র ছুটে যায় পানিতে। হরেক রঙের হাঁস দেখে অনামিকার মন যতটা খুশি হওয়ার ততটা হয় না। এখানে সংখ্যানুপাতিক হাঁস কম লাগছে। বাদলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “এইহানে তো হাঁস কম লাগতাছে।”

“আসলে হইছে কী, হাঁস খালি আপনের টেকায় আনছি। আমি টেকার জোগাড় করবার পারি নাই।”

অনামিকার চোখ-মুখ রক্ত বর্ণ। এখনই বাদলকে খেয়ে ফেলবে। ভ্রুজোড়া ঈষৎ কুঁচকে এলো তার। নাক ফুলিয়ে তার দিকে তেড়ে আসে। উচ্চস্বরে বলল, “আপনে মিয়া যদি ফকিন্নি হইয়া থাকেন তাইলে আমারে আগে আশ্বাস ক্যান দিলেন? আমার টেহায় কারবার কইরা লাভ খাইবেন বইসা বইসা। আপনে দেহি বেজায় খারাপ মানুষ!”

অনামিকার গালে চিকচিক করছে এক টুকরো রোদ। মেয়েটা কী মুখে তেল মাখে নাকি! মিটমিটিয়ে হাসছে বাদল। রাগটা জায়েজ। তার আগেই বলা উচিত ছিল কিন্তু সে তো কোনো লাভ খেতে চায় না। একটা মানুষকে স্বাবলম্বী করতে চায় কেবল। নিজের পকেট ফাঁকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আবার সে শুরু করবে কারবার! শব্দ করে হেসে দেয় সে। শিলা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাদল তাকে সংক্ষেপে বোঝায় যে সে এখান থেকে এক টাকাও লাভ নেবে না। যতদিন বাড়িতে আছে ততদিন কেবল দেখাশোনা করবে এগুলোর। আর সে না থাকলেও হেলাল সবকিছু দেখবে। কিছুটা স্বস্থি ফিরে পায়। কিছুক্ষণ আগেও একটা পাতা নড়ছিল না৷ এখন মৃদু বাতাস বইছে। দিঘির পাড়ে বসে পড়ে অনামিকা। কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ায় বাদল। সে ভাবল একবার তাকে বসার কথা বলবে কিন্তু কেন জানি বলতে পারলো না৷ নিজেই নিজেকে শাসালো, “থাইমা যা অনু, পুরুষ মানুষরে এত দরদ দেহাইতে নাই। পরে নিজেরই বেসামাল হইতে হইব।”

রক্তিম সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। রোদের ত্যাজ কমেছে খানিকটা। অনামিকা হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। নিজের বাম হাতের উপর মাথা রেখে পলকহীন তাকিয়ে আছে দিঘির জলে। বাদলের চোখ তার উপর এসে ঠেকেছে। কিছুটা দূরত্ব রেখে সেও বসে পড়ে। হাঁসগুলো কি সুন্দর গোসল করছে পুকুরে৷ মাঝেমধ্যে একটা হাঁস আরেকটার উপর উঠে একদম পানিতে ঢুবিয়ে দিচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ পর ভেসে উঠছে। এই খেলাটাও দেখতে মন্দ লাগছে না। দু’চোখ অনেক ক্লান্ত। তন্দ্রাভাব চলে এসেছে। এখানে আর থাকলে ঘুমই চলে আসবে।

পরশ সারাদিনে বাড়িতে পা রাখেনি। গুলবাহার বিবি আফিয়াকে বকতে বকতে মুখে ভাত পুরে দিচ্ছেন। তার খাওয়ার কোনো নিয়মনীতি নেই। সকালের খাবার সাতটায়, বিকেলের খাবার পাঁচটায় আবার রাতের খাবার আটটা বাজার আগে খেয়েই ঘুম। তার নাক ডাকার শব্দ বাহির থেকেও শোনা যায়। মোটাতাজা শরীর নিয়ে নড়তে সমস্যা হয়। চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুম দেন সারারাত। একপাশ হয়ে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারেন না তিনি। সন্ধ্যা নেমে আসছে৷ অনামিকার এখন বাড়ি ফিরতে হবে। বাদল তাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চায় কিন্তু সে রাজী হয় না। গ্রামের মানুষ কথা রটাতে সময় নেবে না। এখানে কেউ যদি কোনো উপযুক্ত মেয়েকে কোনো যুবকের সাথে কথা বলতে দেখে তাহলেই বলবে, “ওইতো লাগাই দিছে পিরীতি।”

সাথে আরো দু’চারটে অশ্রাব্য কথা তো আছেই। মানুষ আবার এসব না দেখেই বিশ্বাস করে নেবে৷ একজন যদি দেখে কথা বলছে, অপরজনের কাছে গিয়ে লাগাবে হাসাহাসি করতে দেখছে। এই কথাই আরেকজনের কাছে ঘুরে হয়ে যাবে হাত ধরেছে। কথা গোল হয়ে ঘুরতে থাকে কিন্তু তিল থেকে তাল হয়ে যায়৷

৬.
রিনিকে কোলে নিয়ে পড়া বোঝাচ্ছে অনামিকা। পাশের একটা স্কুলে যায় সে। আফিয়া রান্নার কাজে ব্যস্ত। বাহির থেকে পরশের গলা শোনা যায়। সোনিয়ার বাবা মতিন মিয়ার কণ্ঠও ভেসে আসে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল উঠানে পাটি বিছিয়ে কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছে তারা। চারদিকে রুপালী চাঁদের ঝলমলে আলো। জোৎস্নার বন্যা বইছে। আফিয়া তবুও রিনিকে দিয়ে হারিকেনে আলো জ্বেলে পাঠিয়ে দেয়৷ মুহূর্তেই চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়ে। এঘর ওঘর থেকে বাচ্চা, ছেলে, পুরুষ সবাই একে একে বেড়িয়ে আড্ডার আসরে বসে। আফিয়া গরম গরম চাল ভেজে পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে তেলে ভেজে মেখে একটা বোলে করে দিয়ে যায়। কথার সাথে সাথে একেকজন মুঠোভরে ভাজা চাল খাচ্ছে। চাল ভাজার স্বাদের কাছে দামী খাবারের স্বাদও হার মানায়। অনামিকাকে এক বাটিতে অল্প কয়টা চাল ভাজা দিতে যায় আফিয়া।

“বুবু, তুই কী আমার উপরে রাগ কইরা আছত? ঠিকমতো কথা বলিস না।” ম্লানমুখে বলল অনামিকা।

আফিয়া তার পাশে বসে মুখটা তুলে ধরে বলল, “তুই হইছিস আমার একটা মাত্র বইন। আম্মায় তোরে যতখান আদর করতো আমি ততখান করতে পারি না জানি। তয়, কমও করি না। রিনিরে যতখান আদর করি তোরেও ততখান করি মনে রাহিস। আর তোর যহন মন হইব শাদি করবি। আমি তোরে কহনো কিস্যু বলুম না।”

অনামিকা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। পৃথিবীতে একজন মানুষ অন্তত তাকে বোঝে। এই মানুষটা যতদিন তাকে ভালোবাসবে তার বেঁচে থাকার একটা কারণ হলেও থাকবে। পৃথিবীর বুকে যেদিন তাকে ভালোবাসার শেষ মানুষটাও থাকবে না সেদিন সে চিরবিদায় নেবে। দীর্ঘজীবন বাঁচতে হবে এমন কোনো কথা নেই, তৃপ্তি নিয়ে কিছুকাল বেঁচে থাকলেও সেটা শান্তির। সে কিছুকাল তৃপ্তি নিয়ে বাঁচতে চায়। জানে না কখন তার হৃদয় তৃপ্ত হবে!

বাদল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁত বের করে হেসে নিজেকে দেখছে। আসলেই হাসিটা বিশ্রি। এজন্যই কোনো মেয়ে পটাতে পারেনি সে। অথচ তার হারামি বন্ধুগুলো তাকে সবসময় বলতো, “মেয়ে দেখলেই হাসবি। দেখবি কেমনে পইট্যা যায় নিজেও টের পাইবি না।” সে আসলেই টের পায়নি। যে মেয়েগুলোকে সে হেসে হেসে প্রেমের প্রস্তাব দিত পরের দিন থেকে তারা তাকে দেখলেই কেন পেছনে পালাতো। আজ তার কাছে বিষয়টা খুব স্পষ্ট। অনামিকা যদি মুখের উপর সত্যটা না বলতো তাহলে হয়তো আজীবন এভবেই কেবলাহাসি দিয়েই যেত। টেবিলের সামনের জানালা খুলে দিয়েছে। হারিকেনের টিমটিমে আলো বাড়িয়ে দিয়ে ডায়রি খুলে। কবিতা লেখার বেশ নেশা তার। খুব করে মন চাচ্ছে একটা কবিতা লিখতে৷ আজ তার কবিতার বিষয়বস্তু “অনামিকা”।

এমন শ্রাবণও দিনে
হেরেছিল মোর প্রাণ কাহার টানে।
অম্বরও পানে
নিহারিল আঁখিদুটি আনমনে।
মেঘেদের সনে
একেলা মন মেতেছিল কথোপকথনে।
রিমঝিমঝিম গানে
যুগল ময়ূর নেচেছিল কুঞ্জবনে।
বৃষ্টি স্নানে
ভিজে চিত্ত যেথা অশ্রু তব নয়নে।
বেলার ফুরাবার ক্ষণে
এসেছিলে তুমি প্রেয় মম আমন্ত্রণে।
হৃদয়ের অন্তিম কম্পনে
জাগ্রত চক্ষুদ্বয় বন্ধ হইল চিরবিদায়ের নিমন্ত্রণে।
ওপারের টানে
বিচ্ছেদ ঘটিয়া গেল ধরাধমের সনে।
স্ব-আসনে
খুলিয়া দুয়ার বসিয়া আছেন মন মহাজনে!

কবিতার নাম দিল “শ্রাবণও দিনে” কিন্তু কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেল, এখন কী শ্রাবণ মাস! সে জানে না। কিন্তু যে তার মন কেড়েছে সেই মানুষটা অনামিকা। আজ শ্রাবণ হোক বা না হোক, আজ তার প্রেম দিবস। সে চতুর্থ বারের মতো প্রেমে পড়েছে। যতবারই সে প্রেমে পড়েছে মনে হয়েছে এটাই তার প্রথম প্রেম। সদ্য প্রেমে পড়লে মনটা উড়ুউড়ু করে। এখন তার মনটাও ডানা মেলেছে। কে বলেছে প্রেম একবারই হয়? প্রেম বারবার হয়৷ যতবারই হয় ততবারই নতুন স্বাদ নিয়ে আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। বাদল যদি তার প্রেমে সফল হয় তবে এটা তার প্রথম প্রেম হবে। আবার হতে পারেই এটাই শেষ প্রেম।

#চলবে…
-বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here