||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ০৪||

দুলাভাইকে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করা চরম ভুল ছিল। অনামিকার বিশ্বাস আর সম্পর্কের সুযোগ নিয়েছে পরশ। প্রথম দিকে বেশ ভালোই কথা বলছিল কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল সে সুযোগ পেলে নানারকম বাজে কথা বলে। মজার ছলে অশ্লীল কথাবার্তা বলে যায়। যা অনামিকার কাছে ভালো শোনায় না। আফিয়া যেন এগুলো শোনেও না শোনার ভাব ধরে। অনামিকা কিছু বললে জবাবে একটা কথা বলে যে, “হেতে তোর লগে ঢং করে”

মা-বাবা না থাকলে সন্তান কতটা অসহায় হয়ে পড়ে তা পরপারে চলে যাওয়া মা-বাবা যদি কোনোদিন দেখত তাহলে হয়তো উপরওয়ালার সাথে লড়াই করতো এত তাড়াতাড়ি তাদের কেন নিয়ে গেলেন। পরশের সাথে প্রয়োজন ব্যতীত খুব একটা কথা হয় না অনামিকার। আজ ঘরে আসার পর ডাক পাঠিয়েছে। আফিয়া বসে শাক কাটছে। অনামিকা চুপচাপ পরশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কি যে বলবে কে জানে। চারদিকে শুধু নীরবতা৷

নীরবতার বরফ গলিয়ে পরশ বলল, “তোমার জন্য একটা পোলা দেখছি। রাজপুত্তুরের থেইক্যা কম না পোলায়। গঞ্জে তার দোকান আছে। তরিতরকারি ফলন কইরা বেচে আরকি। এইহানে বিয়া করলে সুখী হবা। সারাজীবন তো আর বসাই রাখন যাইব না।”

আসলেই সারাজীবন বসিয়ে রাখা যাবে না৷ আফিয়া শাক কাটা বন্ধ করে অনামিকার দিকে তাকিয়ে আছে। জবাবের অপেক্ষা যে করছে তা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। অনামিকা মনে মনে কথা আওড়াচ্ছে। মৃদু গলায় বলে দিল, “আমি এহন বিয়া-শাদী করুম না। আরো একটা বছর যাউক তারপর দেহেন।”

পরশ বেশ ভরকে গেল। ধমকের সুরে বলল, “তোমার মতিগতি আমার ভালা ঠেকতাছে না। মা-বাপ নাই দেইখ্যা দায় নিছি নাইলে কহনই ফিক্কা মারতাম। এই প্রস্তাব হাত থেইক্যা গেলে পরে এমন প্রস্তাব মিলাইয়া আইনো।”

বিড়বিড় করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় পরশ। যাওয়ার পথে বলে যায় সে আর কোনোদিন বিয়ের কথা বলবে না। পালিয়ে যাও না হয় যার যেভাবে খুশি থাক এতে তার কিছু আসে যায় না। সে যাওয়ার পর গুলবাহার বিবি চড়ে বসেন তাদের উপর। তার কথামতে, ছেলেটার জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছে ওরা। একজনকে বিয়ে করিয়ে এনেছিল আরেকজন না চাইতেই বোঝা হয়ে আসছে। অনামিকার গাল বেয়ে টপটপ করে চোখের পানি ঝড়ছে। আফিয়া যেখানে যেভাবে বসেছিল ঠিক সেভাবেই বসে আছে। না পারে বোনকে কিছু বলতে আর না পারে স্বামীকে কিছু বলতে। স্বামীকে কিছু বললে চুল ধরে বের করে দেবে আর মা-বাবা মরা বোনকে কীভাবে কিছু বলবে সে! তার দিকে তাকালেই তো মনটা শান্ত হয়ে আসে। রিনি দাদির সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে বসেছে।

“এ বুড়ি আমার মণিরে এইগুলা ক্যান বলিস! আরেকবার কিছু বলিলে একটা মাইর দিমু কিন্তু।” গুলবাহার বেগমের কথার সুর এখন অন্যদিকে পরিবর্তন হয়। তার নাতনিকে নাকি মা-বোন মিলে যাদু করে নিয়েছে। নিজের রক্ত হয়ে পরের রক্তের জন্য কথা বলে। রিনি দাদীকে এটা-সেটা ছুঁড়ে মারতে লাগে। আফিয়া ছুটে এসে তাকে বাঁধা দিয়ে ঘরে নিয়ে যায়। রিনি অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুরু করেছে। গ্রামের বাচ্চাদের সাথে থেকে শিখেছে সব। কিছুটা অবশ্য তার বাবা আর দাদীরর থেকেও শিখেছে। তাদা যখন আফিয়াকে বা অন্য কাউকে গালমন্দ করে সে সবকিছু পাশে বসে রপ্ত করে। অনেক বাজে শব্দ তার জানা আছে। তাদেরই নকশা কদমে হাঁটছে সে। বাচ্চারা এমনিতেও অনুকরণপ্রিয়। তারা যা দেখে তাই করে। যা শুনে তাই শিখে।

অনামিকার সাথে অপ্রত্যাশিত কিছু হলো না। এসব কথা যে তাকে শুনতে হবে সে জানতো। এর আগেও শুনেছে। নতুন কিছুই নয় এসব তার জন্য। সারা শরীর দুলে উঠে তার। কেউ যেন দম বন্ধ করে দিচ্ছে। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নিজের কামরায় চলে যায়। ভেতরটা হুঁ হুঁ করছে। চাপা নিশ্বাস ফেলে যেন কেউ না শুনতে পায়৷ আজ আর চোখের জল মুছে না সে৷ ঝরে পড়ুক যত পারে। থামানোরও বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। বিছানায় মাথাটা এলিয়ে দেয়৷ চোখে তন্দ্রাভাব। আশপাশের নিস্তব্ধতা তাকে আলিঙ্গন করে বরণ করে নিয়েছে।

৪.
অনামিকা মনে মনে ভয় পাচ্ছে। বাদল যদি তার টাকা মেরে দেয়। কই হাঁস খামারের কথা তো আজ তাকে কিছু বলল না। শত চেষ্টা করেও আফিয়ার সাথে কথাগুলো বলতে পারছে না। টাকাগুলো কী মার গেল! অদ্ভুত সব চিন্তা করতে করতে তাদের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছে যায়। যেখানে গ্রামে সবার সারি বাঁধা ঘর সেখানে তাদের একা একটা বাড়ি। তারা তাদের দাদার বাড়ি থেকে আলাদা ঘর বানিয়ে এসেছে এখানে। একদম রাস্তার সাথে লাগানো। চারদিকে টিনের বেড়া দেওয়া। ছোট্ট গেইটের পাশে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। ফুল ঝরে পড়ে মাটিতে যেন বাসর সাজায়। ফুলের বাসর।

“তোমার সাথে কিছু কথা আছিল।” চমকে উঠে পেছনে তাকায় অনামিকা। বাদল দাঁত বের করে হাসছে।

“হাসি বন্ধ করেন, বন্ধ করেন। খুবই বিশ্রি লাগে আপনারে হাসলে। আমার সামনে আসলে এমন দন্ত বাইর কইরা হাসবেন না।” বেশ অপমানির হয় বাদল। বন্ধুরা তো বলতো তার হাসি নাকি খুব সুন্দর। একদম আকাশে চমকানো বিজলিবাতির মতো। মেয়েদের সামনে গিয়ে একটা হাসি দিলেই পটে যাবে। কিন্তু ভার্সিটির কোনো মেয়েকে সে পটাতে পারেনি। দিয়া নামের মেয়েটাকে খুব ভালো লাগতো তার। প্রথম দিকে নিশ্চুপ দেখে যেত। কিন্তু যেদিন দিয়ার সামনে গিয়ে হাসিমুখে দাঁড়ালো তারপর থেকে মেয়েটা তাকে দেখলেই উলটো দিকে হাঁটে। আজ তাহলে কেউ তার মুখের উপর সত্যটা বলেই দিল। একবার আয়নায় দেখলে মন্দ হয় না। কখনো তো নিজে হেসে নিজেকে দেখেনি সে। সত্যিই কী খুব বিশ্রি লাগে! আর দাঁত বের করে না বাদল। কিন্তু জরুরি কথা বলতে হলে তো দাঁত বের করতেই হবে। এ যেন মহাবিপদ সংকেত। ঠোঁট দিয়ে দাঁতের পাটি লুকিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু অস্পষ্ট কথার কিছুই বুঝতে পারছে না অনামিকা।

বিরক্তি নিয়ে বলল, “না হাইসা, যা বলার বলেন।”

কিছুটা আস্বস্ত হয়। হাঁসের খামারের মেরামত কাজ শেষ। কাল বিকেলে বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসছে। অনামিকার ত্রিশ টাকা আর তার ত্রিশ টাকা দিয়ে প্রায় পঞ্চাশটা হাঁস কিনে আনছে। বাকি টাকা মেরামতের কাজে লাগিয়েছে আর খাবার এনেছে। অনামিকার আনন্দে উদ্ভাসিত মুখ। চোখজোড়াও এই আনন্দের সাক্ষী দিচ্ছে। শব্দরা যেন নিখোঁজ হয়ে গেছে। সে তার হাঁস দেখতে চায়। বাড়ির সামনে সরু পথ ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে ছোট্ট একটা দিঘি। পরির দিঘি বলা হয়। লোকমুখে শোনা যায় মাঝরাতে নাকি এখানে পরিরা নেমে আসে। গাছগাছালির বিশাল ছায়ায় আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে দিঘিটা। দিঘির পাশেই খামার। সারাদিন দিঘিতে হাঁস খেলা করবে।

আকাশটা আজ ফকফকা পরিষ্কার। কিছু সাদা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে মাথার উপর। এই মেঘে বৃষ্টি হয় না, কেবল আকাশের সাথে খেলা করে। মেঘগুলো ঠিক যেন হাওয়াই মিঠাই। হাত বাড়িয়ে যদি ছোঁয়া যেত তাহলে মেঘ খেয়ে দেখতো অনামিকা। মেঘের স্বাদ নিতে ইচ্ছে করে তার। শিলার হেঁচকা টানে সামনের দিকে তাকায় সে। তার দু’হাত ধরে হাঁটছে মিলন আর শিলা। বাদল তাদের সামনে হেঁটে যাচ্ছে। তারা তাকে অনুসরণ করছে। মিলন চুপচাপ স্বভাবের হলেও শিলা বেশ চটপটে স্বভাবের। অনামিকাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করে যাচ্ছে। এত প্রশ্নে হাঁপিয়ে উঠছে না সেও। একের পর এক জবাব দিয়ে যাচ্ছে।

#চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here