||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ০৩||
১৮+সতর্কীকরণ
চোখের ভাষা অনেকেই বুঝতে পারে কিন্তু চোখের জলের ভাষা ক’জন বুঝে? এখন অনামিকার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটা খুব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে তার চোখে। সে তার চোখের ভাষা নয়, এই জলের ভাষা বুঝতে চায়। আর্তনাদে কেঁপে উঠে বুকজোড়া। নিজেও জানে না হৃদয়ে এই আঘাত কেন পাচ্ছে সে।
“এই হরিণীটানা চক্ষুতে বন্যা ক্যান! এইডা তো মানায় না!” বাদলের কথায় অদ্ভুত সুর শোনাল। এই সুর যেন অনামিকার বুকের আড়পার করে দেয়। একদিনও হয়নি সে লোকটাকে চিনেছে অথচ কী সুন্দর তাকে বুঝে গেল! বাদল তার মাথার উপর ছাতা ধরে। বৃষ্টি যেন তাকে না ছুঁতে পারে। ক্ষীণ গলায় তার এখানে আসার কারণ স্পষ্ট করে বলল, “আমি একখান প্রস্তাব নিয়া আসছিলাম। আশা করি ফিরায়া দিবেন না।”
কথার ভাবখানা ঠিক সাহেবদের মতো। শিক্ষিত মানুষরা বোধহয় এমনই, মেপে মেপে কথা বলে। বাদল জানায়, সে নতুন একটা ব্যবসা করতে চাচ্ছে যার যোগ্য সহযোগী এই এলাকায় কেউ নেই। অনামিকার সাহায্য সে তার ব্যবসাতে চায়। দু’জনে মিলে প্রথম অবস্থাতে অল্প টাকার হাঁস কিনবে। খামারের জায়গা আছে বাদলের। অনামিকার কিছু করতে হবে না কেবল প্রতিদিন একবেলা এসে দেখবে খাওয়াবে আর সন্ধ্যেবেলা হাঁস ঘরে তুলতে সাহায্য করবে। লাভের দুই অংশ করে দু’জনে ভাগ করে নেবে। আর একফাঁকে তার বোন রেহানার ছেলেমেয়ে দুইটাকেও পড়াতে হবে। এটার জন্য আলাদা করে মাস শেষে পঞ্চাশ টাকা বেতন দেবে৷ চোখের সমুদ্রে যে দুঃখের জল গিলে ফেলেছিল সেটা সুখের জল রুপে নিজের অজান্তেই ছেড়ে দেয়। সে কেবল শুনেছিল মানুষের জীবনে একটা পথ বন্ধ হয়ে গেলে উপরওয়ালা আরো দশটা পথ খুলে দেন। আজ যেন নিজেই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হয়ে রইল। কখন, কীভাবে, কার মাধ্যমে উপরওয়ালা সাহায্য পাঠান কেউ জানে না। অনামিকা একটুও আঁচ করতে পারেনি যে, ক্ষণেক্ষণে অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া জীবনে অকস্মাৎ আলোর রেখা উজ্জীবিত হবে। পড়ানোর বেতন নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তার। প্রতি মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে বেতন দিয়ে দেবে সে নিজেই। আর ব্যবসার লাভের টাকা তারা সময়মতো হিসেব করে বুঝে নেবে। অনামিকা আগপাছ কিছু না ভেবে আজকের পাওয়া বেতনের পঞ্চাশ টাকা বাদলের হাতে তুলে দেয়। দশ টাকা সে নিজের কাছে রাখে। এছাড়া তার এই মুহূর্তে সাধ্য নেই। বাদলের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। সে যা চেয়েছিল তা যে এত সহজে পেয়ে যাবে কল্পনা করতে পারেনি। অনামিকার মনে কিছুটা ভয়, কিছুটা আনন্দ মিলে অদ্ভুত অনুভূতি খেলে যাচ্ছে৷ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আগেই সে বাড়িতে সবকিছু শোনাবে না। সফল হওয়ার পর তবেই জানাবে।
বাদলকে ম্লানমুখে শুধালো, “আমার একখান কথা আছে, এই কারবারের কথা এহন জানি কেউ না জানে।”
তার কথার উদ্দেশ্য বাদল কিছুটা আঁচ করতে পারে। গ্রামের লোকে যদি জানে দুইজন ছেলেমেয়ে মিলে ব্যবসা করছে তাহলে এমনিতেই নানা কথা বলবে। তার চেয়ে এখন কিছু না বলাই ভালো। সে কেবল মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে নীরব সায় দেয়৷ অনামিকা চলে যাচ্ছিল। বাদল তাকে পেছন থেকে ডেকে হাতের মধ্যে ছাতাটা ধরিয়ে দেয়। কিছুটা লজ্জাবোধ করলো সে। চুপচাপ কেবল বাড়ির দিকে পা বাড়ায়৷ সে আনমনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির সুধা পান করে।
৩.
আফিয়া পরশের পা টিপে দিচ্ছে। প্রতি রাতে এই এক কাজ করতে হয়। পা না টিপলে পরশের ঘুমই আসে না। আজ তার মাথা কিছুটা খারাপ আছে। কিন্তু এই মাথা খারাপের কারণ আফিয়া জানে না। কপালের উপর এক হাত রেখে চোখ বন্ধ করে আছে পরশ। কেমন বিরক্তি নিয়ে আফিয়ার হাত লাথি দিয়ে সরিয়ে দেয়৷ এটা নতুন কিছু নয়। এমন কত লাথি খেয়েছে সে হিসাব অগণিত। স্বামীরা মারবে আর স্ত্রীরা সহ্য করবে এটাই শেখানো হয়েছে তাকে। বাড়িতে থাকতে মা শিখিয়েছিল, এখানে আসার পর শাশুড়ি শিখিয়েছেন। গুলবাহার বিবি প্রায়শই বলেন, “জামাই বউরে তো মারবো, কাটবো, সোহাগও করবো। এইডাই তো তাগো বেডাগিরি৷ নাইলে আবার কিয়ের পুরুষ! খালি একখান নুনু থাকলেই পুরুষ হওন যায় না। কর্মে দেহাইতে হয়।”
আফিয়াও বুঝে গেছে স্বামীসঙ্গ কেবল রাতের অন্ধকারে খাটের মধ্যেই, জীবনের সুখে, দুঃখে পাওয়া তো দুর্লভ ভীষণ! তাদের যখন ক্ষুধা লাগে তখন শকুনের মতো ছিঁড়েখুঁড়ে খায় তারপর… বস্তু হিসেবে ফেলে যায়৷ শত ব্যথা পেলেও চোখে পড়ে না। বরং সুযোগে আরো আঘাত করে। তাদের মতে, মেয়েলোকের সব সহনীয়৷ আসলেই সব সহনীয়!
গুলবাহার বিবি সংসারের টানাপোড়েনের কথা বারবার শুনিয়ে অনামিকার কাছে টাকা চাচ্ছেন। সে কোনো উপায় না দেখে বলেছে এই মাসের বেতন সে একটা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। অনেক বড় তুফান গিয়েছে সারাদিন তার উপর দিয়ে। গুলবাহার বিবি তাকে ব্যাঙ্গ করে নানা কথা শুনিয়ে শান্ত হলেও কিছুক্ষণ পর পর কটু কথার ঢেউ তুলেন। কতকিছু করেছেন তার পেছনে এসব কথার হিসেব খুলে বসেন। বেলা চারটায় অনামিকা ছাতা হাতে বাদলদের বাড়ি আসে পড়ানোর জন্য। আজ বৃষ্টি নেই কিন্তু আকাশে রোদের প্রকোপ বেশি। এই রোদে পুড়ে আসার থেকে ছাতা নিয়ে আসাই তার কাছে ভালো মনে হয়েছে। রেহানার শাড়িটা ভালো করে শুকিয়ে ভাঁজ করে এনেছে। আজকে নিজের শাড়িটা নিতে হবে। তার বাইরে পরার কেবল তিনটা মাত্র শাড়ি। বাড়িতে তো জোড়াতালি দিয়ে পরে নেয়। কিন্তু কোথাও গেলে একটা ভালো শাড়ি ছাড়া যেতে পারে না। বাড়ির উঠানে আসতেই খবর পায় রেহানার স্বামী এসেছে। তার বড় মেয়ে শিলা দৌড়ে এসে পটপট করে কথাটা তাকে জানিয়ে আবার দৌড়ে ঘরে ঢুকে। বাবা আব্দুল হকের হাত ধরে টেনে তার নতুন আপামনির সাথে সাক্ষাৎ করাতে নিয়ে আসে। ভদ্রলোক বেশ নম্রতা সহকারে কথা বললেন। ছেলেমেয়ের পড়ার প্রতি খেয়াল রাখার কথা বললেন তাকে।
অনামিকা পাশের রুমে বসে পড়াচ্ছিল। রেহানা আর তার স্বামীর কিছু কথোপকথন তার কানে আসছে। শিলা খুব বাচাল স্বভাবের। পড়াশোনা বাদ দিয়ে তার বাবার ইতিহাস খুলে বসেছে। গঞ্জের বড় মহাজন তার আব্দুল হক। প্রথম একবছর কোনোরকম চললেও শিলার দাদীর সাথে রেহানার সংসার জীবন ভালো কাটছিল না। এজন্য আব্দুল হক নিজেই তাদের এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। প্রতি মাসে তিনি এখানে আসেন। কখনো না আসতে পারলে মিজানের দোকানে টেলিফোন করেন। নিজের মায়ের মন যতদিন ঠিক করতে পারছে না ততদিন তিনি তাদেরকে নেবেন না সেখানে। মাকেও ফেলতে চান না নিজের স্ত্রী সন্তানকেও না। স্ত্রীর প্রতি তার মায়ের ব্যবহারের জন্য চাইলেই আলাদা হয়ে যেতে পারতেন কিন্তু পরে খেয়াল কে রাখবে এই কথা ভেবেই আলাদা হননি। লোকে নানারকম কথাও শোনাবে। কোনো সুযোগ দিতে চান না তিনি।
বাদল গ্রাম ঘুরতে বের হয়েছিল। হেলালের সাথে বাজারটাও ঘুরে এসেছে। মিজানের দোকানে বসে খানিকটা আড্ডার আসরও জমিয়ে দিয়েছিল। হেলাল আর মিজান তার ছোট বেলার বন্ধু। আরো অনেক বন্ধুই আছে যাদের সাথে আজ তার দেখা হয়েছে। কিন্তু হেলাল তাদের সবার মধ্যে কাছের। ঘরে ঢুকে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে রেহানাকে ডেকে পেছনের বারান্দায় যায়। শার্ট হাতে নিয়ে রশিতে রাখতে যেতেই সামনের জানালার ওপর পাশে অনামিকাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে রয়। শার্ট একদিকে সরিয়ে কয়েক মুহূর্ত নীরব তাকিয়ে থাকে। অনামিকা একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। প্রথম দৃষ্টিই তার বুকের উপর গিয়ে পড়ে। কয়েকটা ছোট ছোট লোম উঁকি দিচ্ছে ধবধবে সাদা বুকের মধ্যিখানে। লজ্জায় তার গাল রক্তিম হয়ে গেছে। গ্রামে যদিও পুরুষদের খালি গায়ে থাকাটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয় তবুও কেন জানি বাদলকে এভাবে দেখে সে কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায়। বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করে।
#চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা