“অদ্ভুত মুগ্ধতা ”
৮ম পর্ব
মিশু মনি

.
মিশু হাসি মুখে মর্ম’র সামনে এসে দাঁড়াল।ওর ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।ঢাকার হাইওয়েতে রাত্রিবেলা বাইকে ঘুরার মজাটাই অন্যরকম। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল রাতে বাইকে করে ঘুরতে যাওয়ার।কিন্তু কখনো সুযোগ হয়ে উঠেনি।আজ সেই সুযোগ টা পেয়ে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইলো না মিশু।

মর্ম বাইক স্টার্ট করে দিয়ে বলল,উঠে পড়ুন ম্যাডাম।

মিশু বাইকের পিছনে উঠে বসতে বসতে বলল,কত জোড়ে চালান আপনি?
– যত জোড়ে চালালে পিছনে বসা মেয়েটি যদি ধরে না রাখে তাহলে সে বাইক থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
– ওরে বাবা তাই নাকি! তাহলে তো বেশ থ্রিল হবে মনে হচ্ছে।
– হা হা,থ্রিল হবে কেন?
– আমার রাত্রিবেলা বাইকে ঘুরার খুব শখ।আচ্ছা রেস্টুরেন্ট কতদূর এখান থেকে?
– খুব বেশি সময় লাগবে না।
– তাহলে আস্তে আস্তে চালাবেন।
– কেন?
– আমি চাইনা জার্নিটা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাক।

মর্ম মুচকি হাসল।মনে মনে ভাবল,মেয়েটার দারুণ শখ আছে দেখছি।অবশ্য আমার ও রাত্রিবেলা বাইকে চেপে ঘুরে বেড়াতে বেশ লাগে।তাহলে ওকে এখন থেকে যেভাবে পারি,পটিয়ে ফেলতে হবে।অন্তত একটা রাতে বাইক নিয়ে লম্বা জার্নি করে আসলে আজীবন মনে থাকবে।এমনি তে তো সারাক্ষণ ফিল্ম নিয়েই পড়ে থাকি।জীবন টাকে নিজের মত উপভোগ করার সময় পাইনি কখনো!

মর্ম খুব ধীরে ধীরে বাইক চালাচ্ছে।মিশু চুপ করে আছে দেখে ও জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম তো মিশু তাইনা?
– হ্যা।আই এম মিশু,মিশু এখনো শিশু।ইউ লাইক দিছু?
– হা হা হা।
– আমি লাইক দিতে বললাম আর আপনি হাহা রিয়্যাক্ট দিলেন কেন?
– তুমি খুব মজা করে কথা বলো তাই হাসি পায়।

বলেই মর্ম হাসল।মিশু অবাক হয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছে।রাতে চেনা শহর টাকেও অচেনা মনে হয়।অনেক ভালো লাগা কাজ করছে।দিন দিন এ শহর টা অনেক উন্নত হয়ে যাচ্ছে।একটা সময় হয়ত নিজের শহর টাকে আর চেনাই যাবে না! চারিদিকে কত আলো জ্বলছে!

মিশু মর্মকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা আলোতে তো সবকিছু ই দেখা যায় তাইনা?
– হ্যা।আলোয় পৃথিবীর সবকিছু দেখা যায়।
– আলোতে শুধুমাত্র একটা জিনিস দেখা যায় না।বলুন তো সেটা কি?
মর্ম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। আলোতে তো সবই দেখা যায়।তাহলে কি এমন জিনিস আছে যা আলোয় দেখা যাবে না? সত্যি কি সেরকম কিছু আদৌ আছে জগতে?
মিশু বলল,আলোতে একটা জিনিস দেখা যায় না।সেটা হচ্ছে অন্ধকার! আলো জ্বালিয়ে সবই খুঁজলে পেয়ে যাবেন কিন্তু আলোর মাঝে কখনো অন্ধকার দেখা যায় না।আলো জ্বাললেই অন্ধকার শেষ।

মর্ম অবাক হয়ে বলল,আরে বাহ! দারুণ ধাধা তো।আলোতে অন্ধকার দেখা যায় না।ভালো যুক্তি দেখিয়েছ।
– এবার বলুন তো,অন্ধকারে কি দেখা যায়?
– অন্ধকারে কিছুই দেখা যায়না।অন্ধকার মানেই তো কালো কুচকুচে আধার।
– উহু।অন্ধকারেও একটা জিনিশ দেখা যায়,সেটা হচ্ছে ভুত।
– হা হা হা।এত উদ্ভট সব কথা বার্তা কি করে বলো তুমি!

মিশু খিলখিল করে হাসছে।সেই চেনা ঝুনঝুনির বাজনার মত হাসি।মর্ম যতই মেয়েটাকে দেখছে ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।এমন সুন্দর করে কথা বলে যে,ইচ্ছে করে আরেকবার কথা বলি!

একটা ফুচকার দোকানের সামনে এসে বাইক দাড় করাল। মিশু অবাক হয়ে বলল,এখানে ডিনার করবো নাকি?
মর্ম হেসে বলল,ফুচকার দোকানে কেউ ডিনার করে বুঝি?
– তাহলে এখানে থামলেন কেন?
– নামো,ফুচকা খাবো।

মিশু লাফ দিয়ে নামল বাইক থেকে।মর্ম ছেলেটা তো খুব ভালো! ফুচকা খেতে কার না ভালো লাগে! তাও আবার এই রাত্রিবেলা! উফফ কি যে ভালো লাগছে!
মিশু ফুচকার প্লেট হাতে নিয়েই খেতে আরম্ভ করেছে।মর্ম তাকিয়ে দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে।ও মিশুকে খুশি করার জন্যই এখানে বাইক দাড় করিয়েছে।।মেয়েটা কিভাবে পুরো ফুচকা মুখে পুরে দেয় তাই দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল।মিশু খুব দ্রুত গপগপ করে এক প্লেট ফুচকা খাওয়া শেষ করলো।

মর্ম জিজ্ঞেস করলো আরো খাবে কিনা।মিশু জবাব দিলো, এর বেশি খেলে ডিনারে খাবো কি?
এমন জবাব মুখের উপর দিয়ে দেবে এটা মর্ম ভাবেনি।ও হেসে নিজের প্লেটের ফুচকা তাড়াতাড়ি শেষ করে বাইক স্টার্ট দিলো।

সাফায়েত উল্লাহ সাহেব রেস্টুরেন্ট এ বসে আশেপাশে তাকাচ্ছেন।অনেক্ষণ হয়ে গেলো এখনো মর্ম আসেনি।কি জানি মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হলো! ভাবতে ভাবতে মৈত্রীর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। চোখ চোখ পড়তেই উনি ফিক করে হেসে ফেললেন।

মৈত্রীর ও হাসি পেলো।কাউকে হাসতে দেখলে নিজের ও হাসি পেয়ে যায়।ওদের দুজনের হাসি দেখে খুজিন্তা শব্দ করে হেসে উঠল।বাকি তিন জন অবাক হয়ে এদের দিকে তাকাল।তারপর হঠাৎ তারাও হেসে উঠল।আশেপাশের টেবিলের লোকজন অবাক হয়ে দেখছে এদের টেবিলের দিকে।এনারা এভাবে হাসছেন কেন? খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে সকলকে।কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার পুরো রেস্টুরেন্ট সুদ্ধ সকল লোকজন হাসতে শুরু করে দিলো।একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে আর হাসছে।কেউই জানেনা তারা কেন হাসছে! অথচ সবাই একসাথে হেসে চলেছে।ভারী অদ্ভুত ব্যাপার!

হোটেলের কর্মচারীরা হা করে দেখছে কাস্টমার দেরকে।প্রত্যেক টেবিলেই যেন হাসি খেতে দেয়া হয়েছে।সবাই কি সুন্দর করে হাসি খাচ্ছে আর হাসছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীতে হাসির চেয়ে সুন্দর জিনিস আর কিছুই নেই।হাসলে কত সুন্দর দেখায় মানুষ কে!
এমন সময় মর্ম ও মিশু এসে ভিতরে প্রবেশ করলো। সকলকে একসাথে হাসতে দেখে ওরা হতভম্ব! কিন্তু এমন সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখা যায়না বলে ওদের বিস্ময়ের শেষ নেই! ওরাও হাসতে হাসতে এসে মৈত্রীর পাশের চেয়ারে বসলো। লোকজন এখন ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

মর্ম জিজ্ঞেস করলো, সবাই হাসছ কেন?

সাফায়েত উল্লাহ সাহেব বললেন, তুই ও হাস।
মিশু বলল,উনি তো হাস নন।উনি হচ্ছেন গরু।
সকলে আবারো হেসে উঠল।তারপর আস্তে আস্তে হাসির রেশ টা কমে আসতে আসতে হাসির শব্দ থেমে গেলো। কিন্তু তবুও অনেকে মুচকি মুচকি হাসছেন!
মর্ম ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,আব্বু বলোনা কি হয়েছে?
– হাসি একটা ছোঁয়াচে রোগ সেটাই প্রমাণ করছিলাম।
– প্রমাণ তো হয়েই গেলো। তোমার হাসি দেখে হোটেল সুদ্ধ সবাই হাসছে দেখলাম।
– আমার আর মৈত্রীর হাসি দিয়ে শুরু হয়েছে খেলাটা।কিন্তু এর মূল উৎস হচ্ছিস তুই আর মিশু।
মিশু ও মর্ম একে অপরের দিকে তাকাল।তারপর অবাক হয়ে বলল,আমরা!
– হ্যা।তোদের দুজনের কথা ভাবতে গিয়ে মৈত্রীর সাথে চোখাচোখি হল।অমনি হাসি পেয়ে গেলো।

মর্ম ও মিশু এখনো অবাক হয়ে চেয়ে আছে।ওরা কিছু বুঝতে পারছে না।বাকিরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।তাদের ও বিষয় টা বোধগম্য হয়নি।কিন্তু খুজিন্তা শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।শ্বশুর মশাই কি ভাবছেন এটা ও বুঝতে পেরেছে।ব্যাপার টা বোঝামাত্রই খুজিন্তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।এখন সাফায়েত উল্লাহ সাহেব ও খুজিন্তা একই জিনিস নিয়ে ভাবছে।কিন্তু বাকিরা কেউ এটা কল্পনাও করেনি।


এরপর খাবারের অর্ডার দেয়া দেয়া হল।তানিন সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিল কে কি খাবে? কেউ কিছু বলার আগেই মিশু বলেছে,হাসের গোশত।
ওর কথা শুনে মর্ম মুখ টিপে হাসল।মৈত্রী বলল,এখানে হাসের গোশত পাওয়া যায় না।বিরিয়ানি আর কাবাব চাইতে পারো।
– হাসের কাবাব পাওয়া যায় না?

মর্ম খোঁচা মেরে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।মাথা নিচু করে হাসতে লাগলো।সাফায়েত উল্লাহ সাহেব হেসে বললেন, তিন্নি।আমি আগামীকাল দুই জোড়া হাস কিনে আনবো। তুমি খুব আয়েশ করে হাসের কাবাব বানিয়ো তো।

মৈত্রী মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,তোমাকে আরেক দিন হাসের গোশতের তরকারী খাওয়াবো।এখানে গরু,খাসি আর মুরগি পাবে?
– সবই আছে তাহলে হাস কি দোষ করেছিল? হাসের গোশত কেন রাখেনা?
মর্ম খোঁচা মেরে বলল,এরা হাসের বদলে ব্যাঙ এর গোশত রাখে।ব্যাঙ হলে চলবে?

সবাই মুখ টিপে হাসতে লাগলেন।তানিন একবার মিশুর দিকে তাকাচ্ছে,একবার মর্ম’র দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার তাকাচ্ছে মৈত্রীর দিকে।বেশ মজা লাগছে।
মিশু হঠাৎ মৈত্রীর দিকে তাকাল।তাকিয়েই রইলো অনেক্ষণ।মৈত্রী কিভাবে যেন চেয়ে আছে! ও চোখে কত মায়া! ছেলেদের চোখ ও এত মায়াবী হয়? ও একবার সাফায়েত উল্লাহ সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো ওনার চোখ ও মায়াবী কিনা।হ্যা,ওনার চোখেও অসম্ভব মায়া!

এরপর খাবার চলে আসলো। খুজিন্তা এর আগে কখনো এত বড় হোটেলে খায়নি।বিরিয়ানির প্লেট দেখেই ও লাফিয়ে উঠে বলল,এত সুন্দর পরিবেশন! আমার মাটন বিরিয়ানি খুব ভালো লাগে।
কথাটা বলামাত্র সকলে ওর দিকে একবার তাকাল।কেউ কিছু বলল না কিন্তু খুজিন্তা খুব লজ্জা পেয়ে গেলো।ও নিজেও ভাবেনি এভাবে হঠাৎ লাফিয়ে উঠবে।
তানিন ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,আব্বু।তোমার ছেলেরা কত সুন্দর দেখেছ? দুই ছেলে কোথ থেকে যেন ভিন গ্রহের দুটা মেয়ে নিয়ে এসেছে।ওরা আসার পর থেকেই আমাদের কত আনন্দ হচ্ছে তাইনা আব্বু?

– হ্যা।আনন্দে তোর মা একেবারে নায়িকা ময়ূরীর মত মোটা হয়ে যাচ্ছে।
বলেই উনি স্ত্রী’র দিকে তাকালেন।তিন্নি রাগে ফুঁসছে,এক্ষুনি ঝগড়া বাধিয়ে দিবে নির্ঘাত।
সাফায়েত উল্লাহ সাহেব বললেন, তিন্নি,এটা রেস্টুরেন্ট।

ওনার কথা শুনে আবারো হাসি পেয়ে গেলো সবার।এরপর অনেক হাসাহাসি ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আড্ডা চলল।দেশের অবস্থা থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ ফুটবল পর্যন্ত সবই আড্ডায় উঠে আসলো।একেকজনের মন্তব্য গুলোও ছিল অসাধারণ।কিন্তু মিশু বরাবর ই হাস্যকর মন্তব্য করে বসে।ও যা ই বলে,তাতেই সবার হাসি পেয়ে যায়।খুজিন্তার মন্তব্য ছিল এক কথায় বর্ণনাতীত! সাফায়েত উল্লাহ সাহেব ও তার স্ত্রী খুব খুশি হলেন।অনেক দিন পর এত আনন্দ করা গেলো, মন খুলে হাসা হলো।
আড্ডা যেন শেষ হতেই চায়না।কিন্তু রেস্টুরেন্ট এ তো আর সারা রাত জেগে বসে গল্প করা যায় না।বাসায় গিয়ে অনেক আড্ডা দেয়া যাবে।কেউই তো আর হারিয়ে যাচ্ছে না।তবুও আড্ডা ছেড়ে কারো উঠতে ইচ্ছে হলোনা।অনিচ্ছাসত্ত্বেও সকলে উঠে পড়লেন।ওনাদের গাড়ি ছেড়ে দেয়া মাত্রই মর্ম মিশুকে বাইকে তুলে বাইক ছেড়ে দিলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here