“অদ্ভুত মুগ্ধতা ”
৬ষ্ঠ পর্ব
মিশু মনি
.
বাসর ঘরের সাজসজ্জা দেখে অভিভূত হয়ে গেলো খুজিন্তা! এত দ্রুত এমন চমৎকার ভাবে ঘরটা সাজিয়ে ফেলেছে! ও এগিয়ে এসে ফুলে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো।
এমন সময় মাত্রার মা এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, আসবো ভেতরে?
খুজিন্তা চমকে তাকাল।উনি আমাদের গুরুজন। অথচ ভেতরে আসতে অনুমতি চাইছেন।এত সুন্দর একটা পরিবারের বউ হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হতে লাগলো খুজিন্তার।
বলল,হ্যা আসুন।
– ঘর পছন্দ হয়েছে তো মামনি?
– হ্যা খুব পছন্দ হয়েছে।
– আমাকে বুঝি পছন্দ হয়নি?
খুজিন্তা হতবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলল,আপনাকে তো সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে।
– তাহলে আমাকে মা বলে ডাকছ না কেন?
এমন প্রশ্ন কখনো কারো কাছ থেকে শোনেনি খুজিন্তা।নিজের মা ছাড়া অন্য কাউকে মা বলে ডাকেও নি।কিন্তু মাত্রার মা মানে তো তারও মা।শ্বাশুরি কে মা বলে ডাকতেই হয়।তবুও কেন ওর একবার ও মা ডাকার কথা মনে পড়েনি? খুজিন্তা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
মা ওর হাত ধরে বললেন, এই মিষ্টি মেয়েটা আমার,এত লজ্জা পাচ্ছো কেন? আমাকে মা বলে ডাকতে আপত্তি আছে তোমার?
– হ্যা আছে।
মা অবাক হয়ে তাকালেন। এতো ভালবেসে মেয়েটার মুখ থেকে মা ডাক শুনতে চাইছেন আর মেয়েটার আপত্তি আছে! মুহুর্তেই মনটা খারাপ হতে শুরু করলো মায়ের।
খুজিন্তা বলল,সবাই তো আপনাকে আম্মু বলে ডাকে।আমিও আপনাকে আম্মু বলে ডাকি?
এবার মা চোখ তুলে তাকালেন খুজিন্তার দিকে।তারপর ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,লক্ষী মেয়েটা আমার।তোর আমাকে যা মন চায়,তাই বলে ডাকবি।আম্মু,মা,মম,মামনি,আব্বু, ড্যাড.. যা খুশি।
খুজিন্তাও ওনার বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইল।মনেহচ্ছে নিজের মাকে পেয়েছে ও।আনন্দে কান্না পেয়ে যাচ্ছে ওর।
মা খুজিন্তার মুখটা ধরে বললেন,আমার ঘরে এসো।
তারপর নিজের ঘরে এসে আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে খুজিন্তার হাতে দিয়ে বললেন,এটা পড়ো।
– আম্মু আমিতো শাড়ি পড়তে পারিনা।
মা হেসে বললেন, আমিই পড়িয়ে দিচ্ছি।
এরপর অনেক যত্নে খুজিন্তাকে শাড়ি পড়িয়ে দিলেন মা।হাতে চুড়ি পড়িয়ে দিলেন।চোখে কাজল আর কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ লাগিয়ে দিলেন।
বাহ! খুব সুন্দর দেখাচ্ছে নতুন বউটাকে! মা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন খুজিন্তার দিকে!
বাড়ির সবাইকে ডেকে এনে দেখালেন শাড়িতে তার মেয়েকে কত সুন্দর দেখাচ্ছে! শুধু মৈত্রী এলোনা।সে ঘরে শুয়ে শুয়ে মিশুর সাথে ফোনে কথা বলছে।বাকিরা সবাই এসে খুজিন্তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো! সবার প্রশংসা শুনে লজ্জায় নীল হয়ে উঠল খুজিন্তা!
★
মিশু অনেক্ষণ ধরে হেসেই চলেছে।মৈত্রী ফোনটা কানে ধরেই আছে।নিঃশব্দে শুনছে ওর হাসির শব্দ।মেয়েটা এত মিষ্টি করে হাসে কেন? ওর হাসির শব্দ শুনলে বুকটা ফাকা ফাকা লাগে।
মিশু হাসি থামিয়ে বলল,এই যে ডাক্তার মশাই একটা প্রশ্ন করি?
– হ্যা করো।
– আপনি তো ডাক্তার।সবকিছু ই জানেন।তাহলে বলুন তো মানুষের চুলে টাক পড়ে কিন্তু দাড়িতে টাক পড়েনা কেন?
মৈত্রী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,শুধু আজগুবি প্রশ্ন তোমার তাইনা?
– এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলনা।আমার যা জানতে ইচ্ছে হয় আমি তাই ই প্রশ্ন করি।এটা আজগুবি হলেও কিচ্ছুই করার নেই।
– হুম,আমি ডাক্তার ঠিকই কিন্তু সবজান্তা নই।তাছাড়া আমিতো পাগলের ডাক্তার।
– হা হা হা।পাগলের ডাক্তার হয়ে লাভ কি বলুন তো? দুনিয়ায় সবাই যদি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হয়,তবে কোনো বিচিত্রতা কি থাকবে? দু একটা পাগল থাকলে দোষ কি তাতে?
মৈত্রী অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে।দারুণ একটা কথা বলেছে মিশু।দুনিয়ায় সবাই সুস্থ, সুন্দর হয়ে গেলে এত বিচিত্রতা তো থাকবে না।সবাইকেই একরকম লাগবে।কিছু অস্বাভাবিক মানুষ থাকলেও কোনো ক্ষতি তো নেই।যেমন, মিশু একটু পাগল পাগল স্বভাবের।ওর এই পাগলামি গুলোর জন্যই ওকে সবার থেকে আলাদা মনে হয়।ও যদি গম্ভীর টাইপের ম্যাডাম হয়ে হাটাহাটি করে,ওকে মোটেও মানাবে না।ও যেমন আছে,তাতেই ওকে ভালো মানিয়েছে।তাহলে ওর চিকিৎসা করার দরকার কি? আর এরকম মিষ্টি একটা মেয়ের চিকিৎসা করার প্রয়োজন ই বা কি?
মিশু বলল,আপনি চুপ করে গেলেন কেন? উত্তর টা জানা নাই তাই তো?
– উহু না।
– আচ্ছা।পরে উত্তর টা খুঁজে বের করে বলবেন কেমন? এবার বলুন তো,কাঁদলে চোখ দিয়ে পানি বের হয় কেন? এটা খুবই সোজা।এই প্রশ্নটা বাদ।আপনি বলুন,ঝাল তরকারি খেলে নাকে সর্দি চলে আসে কেন?
মৈত্রী হেসে উঠল। এই মেয়েটার যতসব আজগুবি কথাবার্তা! ঝাল তরকারি খেলে নাকে পানি চলে আসে কেন এটা আবার কেমন প্রশ্ন!
মিশু রেগে বলল,ধেৎ। আপনি কোনোকিছুরই উত্তর জানেন না।আপনার সাথে আর কথাই বলবো না আমি।
বলেই কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। মৈত্রী শব্দ করে হাসতে লাগলো।এর উত্তর টা ওর জানা ছিল।কিন্তু বলার ই তো সুযোগ দিলো না মেয়েটা।এত চঞ্চল আর অভিমানী যে কিছুতেই কথা শুনতে চায়না!
♦
খুজিন্তা বাসর ঘরের বিছানায় পা তুলে বসে আছে।মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে ওর।নিজেকে মনেহচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে।সুখের যেন কোনো সীমা নেই।সীমাহীন সুখে ছেয়ে আছে মনটা!
এমন সময় মাত্রা দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল।এক ছুটে এসে বিছানার উপর লাফিয়ে উঠে ডান্স শুরু করে দিলো।খুজিন্তা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।
মাত্রা বলল,ও আমার রসিয়া বন্ধুরে.. তুমি কেন কোমরের বিছা হইলা না?
বলেই খুজিন্তাকে জড়িয়ে ধরল।খুজিন্তা হাসতে হাসতে বলল,পাগল হয়ে গেলে নাকি?
– Excuse me,wanna love you,love you..
– ইস হয়েছে।এত ফুর্তি ভালো না।
– ফুর্তি হবেনা? কথা নেই বার্তা নেই,হুট করেই বিয়ে করে বাসায় আনলাম। আব্বু আম্মুও প্রশ্ন নেই,আগ্রহ নেই,হুট করেই ওয়েডিং প্রোগ্রাম ও ঠিক করে ফেললো। আবার শ্বশুর শ্বাশুরিকেও দাওয়াত করে এসেছে।কি দারুণ! কি আনন্দ!
খুজিন্তা ও বিস্মিত চোখে চেয়ে থেকে বলল,সত্যিই! খুব সুখ সুখ লাগছে।
দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক ভাবে! মনেহচ্ছে স্বর্গীয় সুখ ধরায় নেমে এসেছে।এভাবেই কেটে যাক হাজার বছর!
★
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মর্ম বাইরে এসে দাঁড়াল।বারান্দা থেকে দেখল,বাগানে মাত্রা ও খুজিন্তা হাটছে আর গল্প করছে।দুজনের মুখ হাসি হাসি।ওদের দেখেই সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে।তাহলে ওরা নিশ্চয় ই আরো অনেক সুখে আছে!
ভাবতে ভাবতে বাইরে বেরিয়ে আসল মর্ম।মাত্রা ওকে দেখে বলল,গুড মর্নিং ভাইয়া।
– গুড মর্নিং।কি অবস্থা?
– ফাটাফাটি অবস্থা রে ভাইয়া।ঘর টা এত সুন্দর করে সাজিয়েছিস, তোকে আমার ঘারে করে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করছে।
– থাক আর ঘাড়ে করে নিয়ে ঘুরতে হবেনা।
– ভাইয়া,বিয়ে খুব ইন্টারেস্টিং একটা জিনিস। বিয়ে না করলে বুঝবি না।আমার মনেহচ্ছে আরো আগে বিয়ে করিনি কেন?
– হা হা,সব মেয়ে তো খুজিন্তা নয় রে।বউ যত ভালো হয়,বর তত সুখী হয়।
কথাটা শুনে খুজিন্তা লজ্জা পেলো। সবাই ওর এত প্রশংসা করছে কেন ও বুঝতে পারছে না।
মাত্রা হেসে বলল,আর বলিস না ভাইয়া।খুজিন্তা গর্বে ফুলে ঢোল হয়ে যাবে।
মর্ম হাসতে হাসতে চলে গেলো।
খুজিন্তা ও মাত্রা এবার খুনসুটি ঝগড়ায় মেতে উঠল।
♦
সাফায়েত উল্লাহ সাহেব চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবছেন,অতিথি দের কবে দাওয়াত করা যায়? বাড়িটা মানুষে গিজগিজ করবে,হাসাহাসি,হৈ হুল্লোর হবে,তবেই তো বিয়ে বাড়ি মনে হবে।কিন্তু এখনো তো বিয়ের ৯ দিন বাকি।পাচদিন আগে আত্মীয় স্বজন রা আসলেই ভালো হবে।তিন্নি আবার বেশি চিল্লাচিল্লি পছন্দ করেনা।হাতের সব কাজগুলো আজই সেরে ফেলতে হবে।বিকেলে মিশু আসবে,তখন ওর সাথে এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে।মেয়েটাকে বেশ ভালোই বুদ্ধিমতী মনেহয়।
আজ রাতে আবার বাইরে ডিনার করতে যেতে হবে।তাহলে আগামীকাল সকালে সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং করা যায়।সেখানে বসে কাজের আলোচনা করা হবে,আর সকল কে কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হবে।সবাই নিজ দায়িত্বের কাজটা ভালোভাবে করতে পারলে,বিয়েটা অনেক সুন্দর হবে আশা করা যায়।অনেক দিন পর একটা বিয়ের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।আসন্ন আনন্দের মুহুর্তগুলোর কথা ভেবে উত্তেজনা বেড়ে গেলো কাজী সাফায়েত উল্লাহ সাহেবের!
চলবে….