অতিথি
পর্ব:১৯ – (শিক্ষনীয় পর্ব)
লেখা: মিশু মনি
.
মিশু ঘুমিয়ে আছে।
চোখ মেলে তাকিয়েই দেখে কাজী মৈত্রী তার সামনে দারিয়ে!
মৈত্রি বলল,মিশু ওঠো।আর কত ঘুমাবে? সেই কখন এসেছি আমি।
মিশু তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে বিছানা থেকে পড়ে গেল।
মৈত্রি বুঝতে পারল মেয়েটার মনের অবস্থা ভালো নেই,চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে,চুল গুলো এলোমেলো।খুব আঘাত পেয়েছে মেয়েটা।
মিশু উঠে বলল,কখন এসেছেন?
– অনেক্ষন হলো।
– এত কষ্ট করে আসার কি দরকার ছিল?
– কষ্ট হয়নি,প্লেনে এসেছি।তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো তো। অনেক কথা আছে।
.
মিশু ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,খেয়েছেন আপনি?
– হ্যা।তুমি রেডি হও,কোথাও ঘুরে আসলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।
– যেতে ইচ্ছে করছে না।
– মিশু,আর কেউ না বুঝুক,মৈত্রী তোমাকে বুঝে।অনেক কথা আছে।বের হয়ে আসো।
.
মিশু মৈত্রিকে খুব বিশ্বাস করে,আর অনেক পছন্দ ও করে।মৈত্রীর কথা ফেলতে পারল না।তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে এসে বলল,চলুন।
– কোথায় যাবো বলোতো?
– ঘাঘট সেনানিবাস। নদী আছে।যাবেন?
– আচ্ছা চলো।
.
মিশু ও মৈত্রি নদীর ধারে ঘাসের উপরে এসে বসলো। খুব মিষ্টি হাওয়া বইছে।জায়গা টা অনেক সুন্দর! মন ভালো হয়ে যায় দেখলে।
মৈত্রি বলল,এটা ঘাঘট নদী?
– হ্যা।থ্যাংকস কাজী সাহেব।এখানে এসে প্রান ভরে নিশ্বাস নিতে পারছি।
– হুম,কেমন আছো?
মিশু অবাক হয়ে বলল,আমাকে কেউ কখনো জিজ্ঞেস করেনা তুমি কেমন আছো?
– সে জন্যই আমি জিজ্ঞেস করলাম। কেমন আছো মিশু?
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,খারাপ না।
– আমি বুঝি তোমায়।ফোনে বললে কিছুই হবেনা ভেবে নিজেই চলে আসলাম। তোমার মনটা ভেঙে চুরে যাচ্ছে,এই অবস্থায় মানসিক শক্তি জাগিয়ে তোলার জন্য কাউকে প্রয়োজন।
মিশু মাথা নিচু করে চেয়ে আছে পানির দিকে।
মৈত্রী বলতে আরম্ভ করলো,তোমার বয়স সতের,এই বয়সে একটা মেয়ের মাঝে যত টা পরিপক্কতা চলে আসে,তোমার মাঝে সেটা আসেনি।তুমি এখনো অবুঝ।কিন্তু মিশু,বড় হচ্ছ যখন, তখন সবকিছু জানা এবং বোঝা তোমার দরকার।
মিশু একদৃস্টে পানির দিকে চেয়ে আছে।
মৈত্রী বলল,তুমি অনেক আঘাত পেয়েছ মর্ম’র আচরনে,আমি জানি।কিন্তু আমি মনে করি এই আঘাত পাওয়া টা তোমার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল।কারণ, মানুষ বই পড়ে কিংবা কারও মুখে শুনে যত টা শেখে,তার চেয়ে বেশি শিখতে পারে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে।তুমি এত টাই কষ্ট পেয়েছ যে,ঢাকা থেকে একা বাসায় চলে এসেছ।এটা নেগেটিভ দিক,কিন্তু এই ঘটনার পসিটিভ দিক টা তুমি ভেবে দেখো তো। কি শিখলে তুমি এটা থেকে?
মিশুর মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।বড় কঠিন প্রশ্ন!
মিশু কিছুক্ষণ ভেবে বলল,আমি ছেলেদের সাথে যেভাবে কথা বলি,মিশি সেটা ঠিক না।আমি বড় হচ্ছি,তাই ছেলেদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলা উচিৎ। আর কাউকে অন্ধ বিশ্বাস করা ঠিক না।সুযোগ পেলে শিয়াল ও বাঘের মত হিংস্র হয়ে উঠতে পারে।
মৈত্রী বলল,কতকিছু শিখে ফেলেছ এটা থেকে।অথচ সামান্য একটা ঘটনা।যেখানে তোমার মত অসংখ্য মেয়ে দিনের পর দিন বয়ফ্রেন্ড এর সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়াচ্ছে। আর তুমি সামান্য একটা ঘটনা তেই আঘাত পেয়ে কতকিছু শিখে ফেলেছ।তাহলে বলোতো,এই ঘটনা টার প্রয়োজন ছিল কি না?
মিশু মাথা নিচু করে বলল,আমার জন্য এর দরকার ছিল।এখন থেকে সাবধানে সবার সাথে মিশবো।
– গুড।এই না হলে মিশু,কত সহজেই সবকিছু বুঝতে পারে।তাহলে এবার বলোতো,তুমি যে একা একা ঢাকা থেকে এসেছ,এটা কি ঠিক হয়েছে?
– না।
– কেন ঠিক হয়নি?
– আমার বড় বিপদ ঘটতে পারত।
– আরে বাহ,মিশুর কত বুদ্ধি! বিপদ ঘটলে কি করতে তুমি?
মিশু কিছুক্ষণ ভেবে কেঁদে ফেললো, কিচ্ছু করতে পারতাম না।সত্যিই আমার একা একা ফেরা টা ভুল হয়ে গেছে।
– এই ভুল থেকে কি শিক্ষা পেলে?
মিশু বলল,রিস্ক নিয়ে কোথাও যাবো না।একা একা কোথাও চলে যাওয়া ঠিক না।মেয়েদের জন্য বড় বিপদ হতে পারে।
মৈত্রী হেসে বলল,এ জন্যই তোমাকে খুব ভালো লাগে আমার।অনেক বুদ্ধিমতী তুমি।কিন্তু মিশু,বুদ্ধি গুলাকে তো সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করতে হবে।এই যে তুমি নুহাশ পল্লী তে তীব্র’র সাথে নির্জনে বসে গল্প করেছ।যদি তীব্র খারাপ ছেলে হত,সেখানে তো তোমার বিপদ হতে পারত।এখন একটু ভেবে বলোতো এই কথা টা আমি কেন বললাম?
মিশু ভেবে বলল,আমি সবসময় ই পরিচিত, অপরিচিত সবার সাথেই ফ্রি ভাবে মিশি।কিন্তু তাদের মধ্যে খারাপ মানুষ ও থাকতে পারে।আমার এভাবে মেশা টা ঠিক না।
– হুম।ঠিক বুঝেছ।তুমি মানুষের সাথে অবশ্যই মিশবে,কিন্তু সাবধানে।সাথে যেন কেউ থাকে।একা একা অপরিচিত কারও সাথে আডডা দেয়ার সাহস কি করে পাও?
– হ্যা।এখন বুঝেছি।মিশুর আর ভুল হবেনা।
– এবার আসি আরেক কথায়।ফেসবুকে সব ছেলের মেসেজ রিপ্লে করেছ তুমি।প্রতিদিন ই যদি অসংখ্য ছেলের সাথে চ্যাট করো,তাহলে তোমার মানসিকতা কোনদিকে যেতে পারে একবার ভাবো?
মিশু ভেবে বলল,এটা আমি বুঝতে পারছি না।আপনি বলুন।
মৈত্রি বলল,সৌজন্যতার খাতিরে দু একটা কথা বলা যেতেই পারে।কিন্তু তুমি যদি সবার সাথেই বেশ আডডা জমাও,ব্যাপার টা ভালো হবেনা।কারন একটা সময় আসবে,যখন তুমি খুব বিরক্ত হয়ে পড়বে।আর তোমার আব্বু যদি জানতে পারেন তুমি এত মানুষ দের সাথে আডডা দিয়ে সময় নষ্ট করো,তাহলে তো তিনি কষ্ট পাবেন।
– হ্যা।আর এতে অনেক সময় ও ব্যয় হবে।ঠিক না?
– হুম।তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে মিশু।শুধু মাত্র অবুঝ হওয়ার কারনে অনেকেই তোমায় খারাপ ভাবতে পারে।তুমি যেটা না বুঝে করছ,সেটা অন্যের চোখে খারাপ হতে পারে।যেমন, আমার আব্বুর সামনে অনায়াসে বিয়ের কথা বলেছ।একটা মেয়ের এইভাবে ব্যক্তিগত কথা অন্যের কাছে বলা ঠিক না।আমার আব্বু কিছু মনে করেনি।কিন্তু অন্যকেউ হলে নিশ্চয় ই তোমাকে বেহায়া মেয়ে বলত।যেকোনো কথা বলার আগে ভেবে বলবা।লিমিটেশন বজায় রেখে চলবা।মনে যা আসে,তা বলা পাগল দের কাজ।একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ সবসময় ভেবে কথা বলেন।
মিশু চুপ করে শুনছে আর ভাবছে কথাগুলি অনেক ভালো। আমার মাঝে এত কমতি ছিল,আমি কখনো বুঝিনি।
মৈত্রী বলল,নিজের সম্মান কিসে বাড়বে, সেটা ভেবে কাজ করবা।এমন কিছু বলা বা করা থেকে বিরত থাকবা,যেটা করলে নিম্ন মানসিকতার পরিচয় দেয়া হয়।বুঝেছ কি বলছি?
– বড় কঠিন সব কথা।কিন্তু সুন্দর!
– বাস্তবতা অনেক কঠিন মিশু।এবার অন্য কথায় আসি।বড় হচ্ছ,ভালবাসা কি বুঝো?
মিশু উত্তর দিলো,ভালোলাগা থেকে ভালবাসা।
– ভালোলাগা আর ভালোবাসা আলাদা জিনিস।ভালবাসা মানে বিশ্বাস, পাশে থাকা,অনুপ্রেরণা, আরও অনেক কিছুর সমন্বয়। কিন্তু আজকাল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রেম করছে।আমি মনে করি,একজন মানুষের যতদিন মনের দিক থেকে পুর্নতা আসবে না, ততদিন তার রিলেশনে জরানো উচিৎ নয়।কারন একটা অল্পবয়স্ক মেয়ে বা ছেলের বিয়ে হলে সে হিমশিম খেয়ে যায়।তেমনি অল্পবয়সে রিলেশনে জড়ালে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হতে পারে।ভুলভাল মানুষের সাথে জীবন জড়িয়ে ফেললে ধোকা তো খেতেই হবে।কাজেই মনের পুর্নতা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবা।যেদিন আবেগ কমে যাবে,যেদিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখবা সেদিন প্রেম করবা।তার আগে নয়।ভুল মানুষকে বেছে নিলে আজীবন পস্তাতে হবে।আর কারও সাথে গভীর বন্ধুত্ব করোনা,কারন ছেলে আর মেতের বন্ধুত্ব মানেই প্রেম হয়ে যাবে।আগে নিজেকে গড়ে তোলো,তারপর এসব।
মিশু মাথা নেড়ে বলল,ঠিক আছে।আপনি অনেক ভালো কাজী সাহেব। আমি এসব বুঝতাম না।
– সে জন্যই এসেছি মিশু।নিজেকে গড়ে তুলতে অবিরাম চেষ্টা করো।পৃথিবী তে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের বড় অভাব।যোগ্য মানুষ হতে না পারলে জীবন টাই তো বৃথা।
মিশু বলল,আমি মানুষ হবো।মানুষের মত মানুষ। আর কোনো ভুল করবো না।ভেবে চিন্তে কাজ করবো।
– হুম,পড়াশুনার কি অবস্থা?
– পনেরোষোলো দিন থেকে পড়তে বসিনা।
– তুমি না ডাক্তার হবা? এভাবে পড়লে কি হবে?
– এখন তো পড়ার চাপ কম।
– এখন ই পড়ার সময়।সিলেবাস টা সম্পুর্ন করার চেষ্টা করো।সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর থেকেই মেডিকেলে ভর্তির জন্য বই পড়া শুরু করবা।তাহলে পরবর্তিতে পরিশ্রম কম হবে।আর প্রস্তুতি যত ভালো হবে,আত্মবিশ্বাস তত বেশি থাকবে।নিজেকে গড়ে তুলতেই সময় ব্যয় করো।অযথা কাজকর্ম বাদ দাও আজ থেকে।
মিশু অনেক্ষন আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর বলল,আপনি এসে অনেক ভালো হলো আমার জন্য।আমি খুব গ্লানিতে ভেঙে পরেছিলাম, মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আপনার সাথে মন খুলে কথা বলে খুব ভালো লাগছে।
– হুম।আমি তোমার কষ্ট টা সহ্য করতে পারিনা।আর আমি চাই,তুমি অনেক বড় হও।
মিশু হেসে বলল,আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করতে ইচ্ছে করছে।আমার ভুল গুলা ধরিয়ে দিলেন। সঠিক পথ দেখিয়ে দিলেন। আপনি আমার গুরু।
– হা হা হা।
মিশু ও হেসে উঠল। এখন খুব ভালো লাগছে মিশুর।জীবন টা সুন্দর কিছু স্বপ্ন দিয়ে সাজাতে ইচ্ছে করছে।
মিশু বলল,ইচ্ছে করছে এখুনি গল্প লিখে ফেলি।আমার এই গুরু অতিথি কে নিয়ে।
– লিখে ফেলো, আমি পড়ব।
– আচ্ছা।
.
অনেকক্ষন গল্প করে গোধুলি বিকেল টা কাটিয়ে দিয়ে সন্ধায় ওরা বাসায় ফিরলো।
খাওয়াদাওয়া করে রাতের বাসেই মৈত্রী ঢাকায় ফিরে গেল।
.
মৈত্রীর প্রতি টা বাক্যই মিশুর জীবনে অভাবনীয় পরিবর্তন এনে দিলো।
মিশু পড়াশুনায় অনেক মনোযোগী হয়ে উঠল।
দুষ্টু মেয়েটার সকল চঞ্চলতা এখন পড়াশুনা আর নিজেকে গড়ে তুলার জন্য।মিশুকে যে মানুষ হতে হবে।পৃথিবীতে এখন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের বড় ই অভাব।
( চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here