অতঃপর মৃত্যু
মান্নাত মিম

|২|
“আমি আপনার মেয়ে সাশাকে কিনে নিতে চাই। মূল্যটা এখানে যথেষ্ট পরিমাণে রাখা আছে। দেখে নিন।”

টেবিলে ওপর পড়ে থাকা মোটা অংকের মুদ্রার থলেটার দিকে একবার তো এরভিনের দিকে একবার চোখ বুলাচ্ছে মদ্যপ সাশার পিতা জোসেফ। ভারি থলেটা দেখে জিহ্বায় লালা এসে পড়েছে, চোখের তারা জ্বলজ্বল করছে। এতেই বোঝা যায় যে, জোসেফ মেয়ে বিক্রি করতে রাজি।

“তোমাকে এরভিন কিনে নিয়েছে।”

খুব একটা অবাক হতে দেখা গেল না সাশাকে। তবে এমনটা আশা করেনি আবার নিরাশাজনক মন্তব্যও ছিল না তার। জোসেফ মেয়ের নিরবতাকে সম্মতি মেনে নিলেন আর পাঠিয়ে দিলেন এরভিনের সাথে।
______

গ্রাম থেকে বরফে আচ্ছাদিত পাহাড়াঞ্চলে ফিরে এলো এরভিন সাথে করে সাশাকে নিয়ে। ক্লান্তিতে বুঁদ হয়ে থাকা সাশার চোখ-মুখ ম্রিয়মাণ প্রায়। তার যে অভ্যাস নেই এত দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার, তাই এমন হালত।

“পরিষ্কার হয়ে ভেতরে যাও। বিশ্রাম নেও, ভালো লাগবে।”

মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করে ওঠে দাঁড়িয়ে পাত্র থেকে পানি দ্বারা পরিষ্কার হয়ে ভেতর রুমে প্রবেশের মাধ্যমে শয্যা গ্রহণ করল সাশা। আসলেই তার প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল। মাথা ঘোরা থেকে বমির প্রভাবে পেট পাক দিতে শুরু করলেও সে কোনোমতে তা চেপে রেখেছিল। এখন যদি একটু ঘুমিয়ে ভালো হয়।

এরভিন খুবই কম কথা বলে। তার ব্যক্তিত্বটা এমনই। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া গোমড়ামুখো বুড়ো যেন। তবে দায়িত্ববান খুব। যত্ন করা জানে নিজস্ব জিনিসের। গাঁ থেকে আসার সময় কয়েকটা মেষ নিয়ে এসেছিল। সেগুলো পালছে সে ও সাশা মিলে। সকালে ওঠে সাশা সেগুলো মাঠে চড়াতে যায়। আর এরভিন শিকার করার মাধ্যমে খাবার জোগাড়ের জন্য জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। দু’জনের দিনকাল চলছিল ভালোই। তবে এরভিন কথা কম বলত বলে মন খারাপ হতো সাশার। সে চাইত এরভিন এসে তাকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করুক, তার সাথে কিছুটা সময় কাটাক। সারাদিনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করুক। উঠোনের কোণের পাইন গাছের নিচে বসে আলাপে মাতুক দু’জনে। কিন্তু নাহ, এরভিন রাতে শুধু খাওয়ার সময় সাশার আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করার দশটার জায়গায় দুটোর উত্তর দেয়। আর নিজের যৌনতার তাগিদে যখন-তখন কাছে আসে, চাহিদা মিটিয়ে চলে যায়। এখানে এরভিনের চাহিদা কেবল প্রাধান্য পায়। সাশা আস্তেধীরে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় রত হলো। একপর্যায়ে এসে মানিয়েও নিলো। তবে সমুখের আগাম ঝড়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। ঝড়ের বিষয়ে যদিওবা জ্ঞাত ছিল সে। এখন এরভিনেরও বোধগম্য হলো, কেন সাশা তার সাথে এমন দূর্গম, বনজঙ্গলে আসতে রাজি হলো আর কেনই বা তার পিতা জোসেফ নিজের মেয়েকে বিক্রি করলেন।

এরভিনের সাথে আসা বাড়িতে সাশার কাটানো সময় গণনার হিসেব সমেত মাত্র সপ্তাহখানেক হলো। এরইমধ্যে সাশার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিষয়টা দূর্লভ ঠেকল এরভিনের কাছে। বুঝল বাচ্চাটা তার নয়। সাশাকে জিজ্ঞেস করবে কি, তার মুখের মেদুর ছায়াই বাতলে দিচ্ছে, অপরাধবোধের বিষয়টা। এরভিন রাগের মাথায় বাড়িতে ফিরল না দু’দিন প্রায়। সাশা কান্নায় ভেঙে পড়ে তার এমন খামোশ হওয়াটা। গ্রামে থাকাকালীন অনেকের সাথেই সাশার অন্তরঙ্গতা ছিল। এটা তাদের-ই বীর্যের ফসল। এরভিনের ওপর দায় চাপাতে চায় না সে। তবে এখান থেকে বিতাড়িত হয়ে গ্রামে গেলেও সকলে মন্দভাবে নিবে বিষয়টা। অগত্যা এরভিনের সাথে এখানে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল সে। এবং কি এবিষয়ে তার পিতা জোসেফ অবগত ছিলেন। সেটাও এরভিন ধরতে পেরেছে যে বুঝে গেল সাশা।

এরভিন এলো নিজের সময়মতো করে, মাথা ঠান্ডা হয়ে। চুপচাপ থাকাটা যেন আরো বেড় গেল তার। কথা তো বলতোই না, সাশা-ও ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করত না। ভয়টা আসলে কোথায় সেটা সাশা নিজেও জানে না। কারণ এরভিন এপর্যন্ত তার গায়ে হাত তুলেনি কখনো। এত বড়ো একটা কাণ্ড ঘটানোর পরেও না। লোকটার এই বিষয়টা সাশাকে মুগ্ধ করেছে। তবে প্রেমে পড়েনি, একটু একটু করে ভালোলাগা জন্মেছে মাত্র। কেননা ইদানীং লোকটা তার যত্ন নেওয়া যে শুরু করেছে। অন্যের সন্তানকে গর্ভধারণ করা সাশার সর্বোপরি খেয়াল রাখছে। বাড়ন্ত পেটের দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বলে এরভিন। মনে হয় তার বাচ্চা অনেক পছন্দ। ছয়মাসের বেলাতে সাশা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ল। রান্না-বান্নার কাজ আরো আগে থেকেই এরভিন করত। এবার যেন দায়িত্ব আরো তিনগুণ হারে বৃদ্ধি পেল। সাশা শয্যাশায়ী হলো। তাকে ধরে উঠিয়ে খাওয়ানো থেকে শুরু করে পরিষ্কার পর্যন্ত এরভিনকে করতে হয়। এত অসুস্থতা দেখে একবার গ্রাম থেকে ডাক্তার দেখাতে চাচ্ছিল সে কিন্তু সাশা মানা করে দেয়। এতদূরে যেখানে যাত্রা পথই দু’দিনের সেখানে সাশা বাড়িতে একা থাকবে কী করে? এই ভয়ে এরভিনকে যাওয়া থেকে আটকায়। এরভিনেরও আর যাওয়া হয় না। দেখতে দেখতে সাশার ডেলিভারির সময় এগিয়ে আসে। আর সাশা-ও তখনের সময়টাতে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিঃশ্বাসটা কেবল কোনোমতে টানে। জীর্ণশীর্ণ শরীর বিছানায় লেগে শুধু ফোলা পেট’টা চোখে পড়ে। চক্ষুযুগল কোটরের গর্তে ডুবন্ত প্রায়।

দিনের বেলার উজ্জ্বলতার মাঝেই তীব্র প্রসব বেদনায় ছটফট করছে সাশা। বাড়িতে তখন এরভিন ছিল না। এমনিতে সবসময় পাশে থাকে মেয়েটার তবে এবার ঘরে বিন্দুমাত্র খাবার না থাকায় বাইরে শিকারে বেরোয় সে। তদুপরি দ্রুতই ফেরে। ফিরে এসে দেখে ছটফট করতে থাকা সাশাকে।

“কী হয়েছে? এমন করছ কেন?”

ব্যস্ত, উদ্বিগ্ন ধরে আসা কাতর গলায় জিজ্ঞেস করে এরভিন সাশাকে। কিন্তু সাশার প্রচণ্ড ব্যথায় লাল হওয়া কান্না করা মুখশ্রী দেখে পরবর্তী আর প্রশ্ন মুখে জুটলো না। একসময় নিদারুণ চিৎকারে সাশা একটা মৃত পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। এবং নিজেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পৃথিবী ত্যাগ করে। হতবিহ্বল, বিস্মিত হওয়া এরভিন কেবল বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে দেখে। কেমন পাগল পাগল অনুভূত হচ্ছে তার। আশপাশ তাকায় মনে হয় সে যেন কিছু খুঁজছে। অথচ কিছুই খোঁজ করছে না সে। অযথাই তার এমন তাকানো।

বাড়ির আঙিনাতে মৃত সাশা ও পুত্র সন্তানকে মাটি চাপা দেয় এরভিন। বুক ভার হয়ে আছে তার। হয়তো বাচ্চাটা অন্যের তবুও তার এতদিনে অদ্ভুত এক মায়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল বাচ্চাটার প্রতি। হতে পারে স্বপ্নও বুনা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নে অদৃশ্য, মিথ্যে হয়ে গেল সবই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here