অতঃপর মৃত্যু
মান্নাত মিম

|৩|
বন্য প্রাণীর মতো গর্জে ওঠা কণ্ঠ এরভিনের। সেই কণ্ঠের সাথে তার হাতে শিকার করা বন্দুক তাক করা সাশার পিতা জোসেফের দিকে।

“তুমি জানতে, সাশার অসুস্থতার কথা। তারপরও এমন একটা অসুস্থ মেয়েকে আমার কাছে বিক্রি করলে। আমার অর্থ ফেরত চাই আমি। নাহলে…!”

জোসেফের বুঝতে আর বাকি রইল না নাহলের পরের বাক্য কী হতে পারে। তিনি এরভিনকে আরকিছু বোঝ দেওয়ার মতো বাক্য খুঁজে পেলেন না। কারণ তিনি-ও জানতেন সাশার বিষয়। অগত্যা খানিক সময় ভাবলেন, অতঃপর একটা উপায় বের করলেন তোখড় শয়তানি মাথা থেকে। ভেতরের রুমে গেলেন আর নিয়ে এলেন সেই জিনিসটা। এরভিনকে একটু অবাক হতে দেখা গেল। অবাকান্বিত ও প্রশ্নবোধক চোখে জোসেফের দিকে তাকায়। জোসেফ তখন উত্তরে বললেন,

“আমার কাছে অর্থকড়ি নেই। তবে সে আছে। তাকে এখনো কেউ স্পর্শ করেনি। একদমই নতুন ও আনকোরা।”

জোসেফ মেয়েটার দু’বাহু আঁকড়ে ধরে এরভিনকে প্রদর্শন করায়। সেনোলিয়া জোসেফের ছোটো মেয়ে। সে বুঝতে পারছে না তার সাথে হচ্ছেটা কী? হতবাকতার সাথে পিটপিটানো চোখ ঘুরিয়ে দেখছে এরভিন নামক লোকটাকে। জোসেফ তার বাহু ধরে পিছনে থাকায়, নাহলে সে জিজ্ঞেস করতে সমুখের লোকটাকে কেন তাকে প্রদর্শন করানো হচ্ছে? কিন্তু উত্তর পরবর্তী কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডে পেয়ে যায়।

“দ্বিতীয়বার তোমাকে বিশ্বাস করব কীভাবে? আমি দেখে নিতে চাই।”

“আচ্ছা, তাহলে তুমি দেখেই নেও।”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে দৃঢ়তা তবে নির্লিপ্ত গলায় জোসেফ কথাটা বললেন। এরভিন তার রাজি হওয়া দেখে সেনোলিয়াকে নিয়ে অন্দরে যায়। সম্পূর্ণ পোশাক নিরাবরণের মাধ্যমে সেনোলিয়ার সমস্ত শরীর পর্যবেক্ষণে নির্ণয় করে জোসেফের কথার সত্যতাকে সঠিক রূপে। মেয়েটাকে কেউই এপর্যন্ত ছোঁয়নি।

“ওঠে পড়। পোশাক পরে তৈরি হয়ে নে, যা।”

পোশাক ছুঁড়ে মারে আড়ষ্ট হওয়া সেনোলিয়ার শরীরে। মেয়েটার হাত-পা অবশীভাব ধারণ করে রয়েছে বিধায় এরভিনকে বাঁধা দিতে অক্ষম হয়েছিল। সেই ভাবমূর্তি এখনো বজায় রয়েছে। পোশাক পরিধান করে একই অবস্থায় বসে সে। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই রুমে প্রবেশ করলেন জোসেফ। গিয়ে মেয়ের পাশে বসলেন।

“তোমার বোন মারা গেছে।”

এটুকু বলেই চুপ রয়ে গেলেন। শ্বাস টেনে হাতে থাকা বিষাক্ত পাতার থলে সেনোলিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

“যদি এরভিনের সাথে থাকতে না পারো এগুলো খেয়ে মরে যেও।”

পিতা পাষণ্ড জোসেফের এমনতর কথা সেনোলিয়ার দম ধরে থাকা নিশ্বাসে বিষাক্ত বায়ু ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিষে ভরা পাতাগুলোর প্রয়োজন পড়েনি, পিতার কথাতেই মৃত্যু কামনা যেন।
______

যাত্রা পথে গাছের শিকড়-বাকড়ের সাথে পা ভেজে কয়েকবার পড়ে গিয়েছিল সেনোলিয়ার। বরফের মাঝেও পা ডেবে গিয়েছিল। তাকে প্রতিবারই এরভিন এসে উদ্ধার করেছে। রাতের সময়ে বাড়ি ফেরা হলো তাদের। পাহাড়চূড়ায় চন্দ্রলোকের জ্যোৎস্নার আলোর খেলা দেখে সেনোলিয়ার মনের ক্লেশ কিছুটা দূর হলো। সেনোলিয়া সেখানেই হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। এরভিনের কাঁধে তাদের দু’জনের ব্যাগ। সারারাস্তায় সেনোলিয়ার ব্যাগ সে বহন করে এসেছে। কাঁধ থেকে মাটিতে ফেলল ব্যাগ দু’টো। কয়েক মিনিট ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল জ্যোৎস্নার আলোতে স্নান করা সেনোলিয়ার কিশোরীর আদলে গড়া শ্রান্ত হওয়া লতানো দেহখানি। ফিরে ভেতরে চলে গেল। বাইরে তখনো মাটিতে শুয়ে নিজস্ব ভাবনায় বিভোর সেনোলিয়া।

এরভিনের বাড়িতে আসা সেনোলিয়ার চার-পাঁচ দিন কাটল। একমুহূর্তেও এরভিনের সাথে কথা বলল না সে। এরভিন আগ বাড়িয়ে কথা বলুক কিংবা প্রশ্ন করুক না কেন, সেনোলিয়ার জবাব কেবল নিরুত্তর আসে। এরভিন-ও তাকে যথেষ্ট সময় দিলো। কিন্তু ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে বাধ্য হলো সে। একসাথে থাকে দু’জন অথচ কথার জবাবটুকু পর্যন্ত দেয় না মেয়েটা। কতক্ষণ আর এভাবে থাকা যায়? তাই জোর করে মিলিত হলো সেনোলিয়ার সাথে এরভিন। সেনোলিয়া নিয়তির কাছে হেরে পরাস্ত স্বীকার করে নিলো। তবে আগের থেকে আরো চুপচাপ হয়ে গেল, শান্ত ঢেউয়ের মতো। ঢেউ কেবল অশান্ত, উচ্ছাসিত দেখতেই ভালো লাগে। তেমনই কিশোরী সেনোলিয়ার মাঝে গাম্ভীর্যের ভাব প্রকাশে সেই উচ্ছাসের তারতম্যের ব্যাঘাত যা এরভিনের মনঃপূত হলো না। তবে সে রোজ নিয়ম করে সেনোলিয়ার কাছে যাওয়াও ছাড়ল না। এমনই সময় করে সেনোলিয়া অনুধাবন করল নিজের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিষয়টা। এরভিনের কাছ থেকে চেপে গেল। তবে এক ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিলো। সে কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছে না এরভিনের সাথে। রোজকার সঙ্গমরত সময়টা তাকে পীড়া দেয়। শারীরিকভাবে নাহলেও মানসিক ভাবে পীড়াটা তার মনমস্তিষ্ককে বিষাক্ত করে তুলছে প্রতিনিয়ত। পিতা জোসেফের দেওয়া বিষ পাতাগুলো পাথর দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করল। এরভিনের মতো পাষণ্ড, নিষ্ঠুর, বর্বর খুনির সন্তান জঠরে ধারণ করতেও তার ঘৃণা হচ্ছে। যে কি না তার প্রাণপ্রিয় মা’য়ের মতো বোনের হত্যা করেছে সাথে তার সন্তানকেও। কয়েকদিন আগেই পাইন গাছের নিচে বসে ছিল সেনোলিয়া। নিজের সামনেই মাটি ঢিবির মতো উঁচু হওয়া দেখে যা বোঝার বুঝে গেল। এখানেই তার বোনকে মাটি চাপা দিয়েছে শয়তান এরভিন। তবে সেটার পাশে আরেকটা ছোটো কবর দেখে কান্নায় মেতে ওঠে তার মনের ভেতরকার কষ্টরা। ভেবে নেয়, সন্তান চায়নি বলে মেরে দিয়েছে এরভিন। হয়তো তার বোন সাশা সন্তানটি রাখতে চেয়েছিল তাই তাকেও মেরে ফেলেছে। তাহলে এখন তার মতো শয়তানের সন্তানকে পৃথিবীর আলো বাতাস দেখার কোন প্রয়োজন নেই। মনে মনে পুরোনো দিনের ভাবনা ভেবে প্রস্তুতি নেই খাবারের সাথে বিষ মেশানোর। কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় অন্যকিছুই লিখে রেখেছিলেন সেনোলিয়ার ভাগ্যে। বিপত্তি ঘটে খাবারে বিষ মেশানোর সময়। খাবারের গন্ধে বমি পেয়ে যায়। খুব জোর চেষ্টা চালায় ধরে রাখার জন্য। কিন্তু বিধিবাম! এরভিনের সামনেই বমি করে ঢলে পড়ে। আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়।

“তুই আমার বাচ্চার মা হতে চলেছিস। জানিস?”

হুঁশ ফেরার পরেই এরভিনের এমনতর কথায় সেনোলিয়া দিনের আকাশে চাঁদ, তারা দেখতে লাগল। তবে একদিক ভালো হয়েছে, এরভিন বুঝেনি যে সেনোলিয়া আগে থেকেই অবগত সেই বিষয়ে। সেটা ভেবেই এই প্রথমবার মুখ নিঃসৃত হলো সেনোলিয়ার শব্দবাক্যরা।

“ন…না, জানি না আমি।”

কয়েক পল কেটে যাওয়ার পর এরভিন আস্তে করে নিজের হাত সেনোলিয়ার উদরে রাখে। তা দেখে কিছু বলল না সেনোলিয়া। চুপচাপ দেখে এরভিন কী করতে চায়।

“এখন থেকে নিজের খেয়াল রাখবি। কোনকিছুর দরকার হলে আমাকে বলবি। এখানে না থাকলে আমি গাঁ থেকে এনে দেব।”

এরভিনের কথা শুনে সেনোলিয়া মনে মনে বলে, তোর মৃত্যু চাই শয়তান এরভিন।
_____

সত্যি সত্যিই মৃত্যু কামনা মঞ্জুর হয়েছিল। কিন্তু কামনার চেয়ে মৃত্যুর পরওয়ানা জারি করে সেনোলিয়া স্বীয় হাতে। যে বিষ পাতার গুঁড়ো নিজের জন্য তৈরি করেছিল, সেটা একটু একটু করে এরভিনের খাবারের সাথে মিশিয়ে দিতে লাগল। এতে এরভিন ধীরে ধীরে নিজের শারীরিক শক্তি হারাতে লাগল। বুঝতে পারল, শারীরিকভাবে সে দূর্বল হয়ে পড়ছে। রাতে সেনোলিয়ার সাথে মিলিত হতেও পারছে না দূর্বলতা তাকে এতটাই কাবু করে ফেলেছে। সাথে জ্বর, ঠান্ডা, কাশি নতুনভাবে গ্রাস করছে যেন। কিন্তু সেনোলিয়ার যে এতে হাত রয়েছে বিন্দুমাত্র ধরতে পারল না। এরইমধ্যে সেনোলিয়া একদিন পালানোর চেষ্টা করে। তখন এরভিন শিকারে বেরিয়েছিল। সেই সুযোগই কাজে লাগায়। তবে মাঝপথে এরভিনের শিকার ধরার জন্য রাখা ফাঁদে আঁটকে পড়ে সেনোলিয়া। লোহার তৈরি সেটা। বড়ো বড়ো সূচালো কাঁটা দিয়ে তার পা আঁকড়ে রক্ত বের করে দিচ্ছে। অনেক চেষ্টা চালিয়েও সেনোলিয়া সেটা থেকে রেহায় পেল না। একপর্যায়ে সেখানেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারালো সাথে সন্তান-ও।

এরভিন শূন্য বাড়িতে সেনোলিয়াকে না পেয়ে খুঁজতে আরম্ভ করে। চিৎকার করে এদিক-সেদিক তার নাম ধরে ডাকে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পায় না। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পেলেও নিজের সন্তান হারানোর কষ্টে জর্জরিত হয়। রক্তাক্ত সেনোলিয়াকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। তাকে পরিষ্কার করে পোশাক পরিবর্তন করিয়ে দেয়। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পা’য়ের ক্ষত সারানোর জন্য চিকিৎসা দিতে থাকে। ব্যথায় সেনোলিয়ার জ্বর এসে পড়ে। পা’য়ের কারণে সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে-বসে কাটাতে হয়। তবুও এরভিন তার সকল কাজ নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব নিয়ে করে। এভাবেই দেখাশোনার মাধ্যমে সেনোলিয়ার খেয়াল রাখতে শুরু করে। এরভিনের নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধের যত্নআত্তির কারণে সেনোলিয়া সুস্থ হয়ে ওঠে। তবুও কোনপ্রকার কথাবার্তা করে না এরভিনের সাথে। এত বড়ো কাণ্ড করার পরেও চুপচাপ থাকে। তা দেখে একদিন এরভিন তাকে ডেকে বলল,

“আমার সাথে থাকার ইচ্ছে নেই। যার কারণে এভাবে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছিল।”

সেনোলিয়া চুপ করে থাকে। নিরুত্তেজ, নিরুত্তর সেনোলিয়ার এমনতর ভাবে চুপ থাকাকে সম্মতি ভেবে নিয়ে এরভিন গম্ভীর গলায় বলল,

“চলে যেতে পারিস। ছেড়ে দিলাম তোকে।”

এই কথায় সেনোলিয়া বিস্মিত হয়ে তাকায় এরভিনের পানে। সেনোলিয়ার ঠোঁটের কোণে দেখা যায় মৃদু হাসি। যেটা এই প্রথম এরভিন দেখতে পায়। কারো মুক্তির সাধ এতোই মিষ্টি!

সেনোলিয়ার চলে যাওয়া আজ দিন তিনেক হলো। একা একাই চলে গেছে সে। সেনোলিয়া কিছুটা হলেও এরভিনের মনে দাগ কেটেছিল। যা এখন শূন্য বাড়িতে এরভিনের একাকীত্বের ভারে বুঝতে পারে। কিন্তু তার করারও কিছু ছিল না। মেয়েটা তার সাথে মানিয়ে নিতে চাইছিল’ই না। তাই মুক্তির সাধ দিলো তাকে। বাইরে থেকে ফিরে এসে খাবারের তাকে মসলা খোঁজার সময় অচেনা এক পাত্র এরভিনের হাত লেগে পড়ে ভেঙে যায়। তার ভেতর থেকে পাতার গুঁড়ি বেরিয়ে আসে। ভ্রু কুঁচকে থাকে এমন আজব জিনিস দেখে। হাত দিয়ে তুলে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে আসল বিষয়টা ধরতে পারে। তবে বুঝতে পেরেও সময় হাতে ছিল না। কারণ বিষের প্রভাব তার শরীরে আগেই ঘটেছে। এখন কেবল মৃত্যুর দিনগোণা বাকি।
_____

সময় গড়ায় আস্তে আস্তে এরভিনের শরীর ভেঙে পড়া শুরু করেছে। উপরন্তু ক’দিন ধরে সে শিকার করার মতো অবস্থায় ছিল না বিধায় শারীরিক দূর্বলতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। হাঁটতে চলতেও অসুবিধা, সারাক্ষণ বিছানাতেই লেপটে থাকে। মাঝে কয়েকদিন কাশির সাথে রক্তবমি হয়েছিল। তবে এখন সব সহ্য হয়ে গেছে। কেননা এখন যে প্রচুর নিদ্রা তাকে ঝেঁকে ধরেছে। প্রচণ্ড ঘুম ধরেছে, এতোদিনকার নির্ঘুম এখন শান্তির ঘুমে পরিবর্তন হবে… অতঃপর মৃত্যু।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here