অতঃপর মিঠিকথা ৫-৮
শপিং ব্যাগটা খুলে মিঠি এত অবাক হলো বলার মতো না।
এই বাবল ওড়ানো তার এত প্রিয়, কেউ তাকে এটা এপ্রিশিয়েট করেনি কখনো। সবসময় বলে এসেছে, তুই কি পোলাপান নাকি, ন্যাকামি, ঢং!
অথচ রেজা!
এভাবে কেউ মিঠিকে নিয়ে ভাবেনি।
আচ্ছা রেজা কি করে জানলো যে মিঠি বাবল ওড়ায়! তার মানে সেদিন ছাদে গিয়েছিলো রেজা।
মিঠির খুব ভালো লাগলো, কোথাও একটা লজ্জা মেশানো ভালো লাগা।
একটা অদ্ভুত আবেশে মনটা ছেয়ে রইলো।
মিঠি ভাবত, যাকে বিয়ে করবে সে যেন এমন হয়, তার হাত ধরে নিশ্চিন্তে হাঁটা যায় মাইলের পর মাইল।
রিক্সায় হুড ফেলে ঝুম বৃষ্টিতে ভেজা যায় অসংখ্যবার।
রেজা কি তেমন একটা মানুষ?
এমন একটা মানুষকে বিয়ে করা যেতেই পারে।
রেজা অসম্ভব বুদ্ধিমান এবং মিঠিকে পছন্দ করে সেটা সে নিজেই বলেছে।
মিঠি বোতল গুলো যত্ন করে ড্রয়ারে রেখে দিলো।
রেখে দিলো টকটকে লাল গোলাপটাও, একটা গ্লাসে পানিতে ভিজিয়ে।
কাল মাকে কিছু একটা বলতে হবে, পজেটিভ।
রাতে ছাড়া ছাড়া ঘুম হলো মিঠির।
কি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন।। মিঠি লাল শাড়ি পরে একা একা হাঁটছে।। রেজা কি সামনে, বুঝতে পারছে না।
মিঠি হেঁটে গিয়েও রেজাকে ধরতে পারলো না।
★★★
রেজা সকাল থেকেই একটু ব্যস্ত ছিল।
দশটার দিকে একটা ফোন এসেছিলো।
একটু ফ্রি হয়ে রেজা ফোন ব্যাক করলো।
-হ্যালো কে বলছেন?
-আপনি মি. রেজা? আমি রেদোয়ান!
-রেদোয়ান কে?
-মিঠির বয়ফ্রেন্ড!
রেজা একটু চমকালো, সে ভাবেনি মিঠির সত্যি সম্পর্ক আছে।
ভেবেছে মিথ্যে বলছে মিঠি।
-জি বলুন?
-বুঝতেই পারছেন কেন ফোন করেছি।
-হু,
– আপনি মিঠিকে বিয়ে করার কথা ভাববেন না, আমার সাথে ওর গভীর সম্পর্ক, আমার সাথে ও রুমডেটও করেছে।
রেজার কেমন একটা বোধ হলো।
মিঠির বিষয়ে এমন কথা শুনতে ভালো লাগছে না।
অ্যাফেয়ার থাকলেও মিঠিকে এমন মনে হয়নি, কেন মনে হলো না?
রেজার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রশংসা করে সবাই, সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান।
-সেটা আপনাদের ব্যক্তিগত বিষয়, আমাকে কেন বলছেন?
-কারন আপনি মিঠিকে বিয়ে করতে চাইছেন।
মিঠি বলতে পারছিলো না। তাই আমি বললাম।
-ওহ আচ্ছা, ওকে, আমি দেখছি কি করা যায়।
-ভালো থাকবেন, আপনার জন্য অনেক ভালো মেয়ে পাবেন।
বাই।
রেজা ফোনটা রাখলো।
রুমডেট বিষয়টা আজকালকার ছেলেমেয়েরা করে, কিন্তু বিষয়টা নোংরা, ভীষণ নোংরা লাগে, হয়ত এখনো অনেকটা ব্যাকডেটেড মানসিকতার রেজা।
মিঠির বিষয়ে এই কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না।
ওর মধ্যে একটা সরলতা, দস্যিপণা আছে।
রুমডেটফেট করার কথা না ওর।
তাহলে এমন উদাসী হয়ে বাবল ওড়াতে পারতো না।
ওই দৃষ্টিতে কোন খারাপ কিছু থাকতে পারেনা।
মনটাও অদ্ভুত, মিঠি ছাড়া কি অন্য কোন মেয়ে নেই!
যাই হোক, মেয়েটা ওকে বিয়ে করতে চায় না।
সত্যি হোক মিথ্যে হোক এই নোংরা একটা কথা রেজার কাছে পৌছেছে তাই।
আচ্ছা, তাহলে তাই হোক।
রেজা মাকে ফোন করে দিয়ে মিঠির বিষয়ে আর কথা বলতে না করে দিলো।
রেজার সাথে কথা শেষ করে মুচকি হাসলো রেদোয়ান সাজিদ!
এই কথা শোনার পরে কোন ছেলে বিয়ে করতে দুবার ভাববে।
কিন্তু মিঠি জানতে পারলে খুব রাগ করবে।
তাই ওকে না জানিয়েই ইপার কাছ থেকে রেজার নম্বর নিয়ে সাজিদ ফোনটা করেছে।
রেদোয়ান নাম বললে হুট করে কেউ চিনবেও না।
মিঠি পরদিন রাতে মাকে জানাতে গেলো তার বিয়েতে আপত্তি নেই।
কিন্তু অবাক হয়ে শুনলো, রেজা এই মুহুর্তে বিয়ে করবে না জানিয়েছে।
মানে একরকম না করে দিয়েছে।
মিঠির একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো।
পরে নিজেকে সামলে নিলো!
সে তো এখনি বিয়ে করতে চায়নি।
যেটা হয়েছে, এটা একটা ছোট্ট ঘটনা।
জীবনে এমন হাজার হাজার ঘটনা রোজ ঘটে। তবুও ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করল মিঠির।
★★★
এরপর কেটে গেলো চারটি বছর।
উনিশের মিঠি তেইশ পার করা তরুনী এখন! অনেকটা ম্যাচিউরড, বুদ্ধিমতি, দায়িত্ব নিতে শিখেছে, গ্রাজুয়েশন শেষ।
ফোর্থ ইয়ার থেকেই চাকরি করছে একটা টুরিজম কোম্পানিতে।।
শুধু কোথাও একটা রেজা থেকে গেছে মনের মধ্যে।
কখনো খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেনি মিঠি, যতবার বাবল ওড়াতে গিয়েছে, মনে হয়েছে রেজা কোথাও দাঁড়িয়ে আছে।
সেই টকটকে লাল ফুলটা ঝরে যেতে দুদিনের বেশি সময় লাগেনি।
মিঠি পাপড়ি গুলো একটা বাক্সবন্দি করে রেখেছে।
জমা থাক কিছু প্রথম অনুভূতি একটা কাঠের বাক্সে।
রেজারও কি এমন কিছু হলো? কিছু অনুভূতি জমা থেকে গেলো মিঠির বাক্সে?
কে জানে?
৫
“দেখা হলো বছর চারেক পর”।
সাতাশ বছরের রেজা ত্রিশ পার করে ফেলেছে।
গত চার বছরে রেজা বিয়ে করেনি। প্রথম দুবছর বলেছে আমার একটু সময় প্রয়োজন। পরের যে মেয়েই দেখেছে, তার মধ্যে মিঠির ছায়া খুঁজে গেছে, না পেয়ে হতাশ হয়েছে।
জীবন থেমে থাকেনা।
তবে মাসছয়েক আগে পরিবারের পছন্দে মৌরিনের সাথে আংটিবদল হয়েছে রেজার।
মৌরিন ভালো মেয়ে, স্মার্ট, সুন্দরী।
একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে।
রেজার সাথে টুকটাক কথা হলেও এখনো ফর্মাল সম্পর্ক।
আংটি বদল হলেও প্রোগ্রাম একটা হবে বলে আকদ হয়নি এখনো।
শায়লা আন্টির ছেলে ইহানের জন্মদিন ছিলো।এমনিতে খুব একটা আসা হয়না ফ্যামিলি গোট টুগেদার এ।
আজকে আসতেই হলো।
শায়লা আন্টি একটু বড় করেই আয়োজন করেছে।
মিঠিদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রেজার একটু কেমন যেন লাগলো।
মিঠি কেমন আছে?
বিয়ে হয়ে গেছে এখন?
বাসায়ই আছে?
যাই হোক এসব কথা ভাবা অর্থহীন। রেজা শায়লা আন্টির বাসায় ঢুকলো।
আধঘন্টা পরে মিঠি ঢুকলো, একটা সবুজ আর হলুদ মেশালের মনিপুরি শাড়ি পড়ে আছে।
রেজার চোখ আটকে গেলো তবে মিঠি রেজাকে দেখেনি।
না, মিঠির বিয়ে হয়নি।
বাংলাদেশের বিবাহিতা মেয়েদের স্বর্ণবন্ধনী দেখে বিবাহিতা বা অবিবাহিতা চিহ্নিত করা যায় খুব সহজে।
মিঠির কানে কি দুল আছে দেখা যাচ্ছে না, গলায় সবুজ স্টোনের লকেটটা চিকচিক করছে।
অনাবৃত হাতে চুড়ি নেই, সবুজ পাথরের ব্রেসলেট।
ছিমছাম সাজ। কোন কিছুর আধিক্য নেই
চুলগুলো কাঁধ ছাড়িয়েছে, তবে অতোটা লম্বা নয়।
দুধে আলতা গায়ের রঙ আগের চাইতে আরো উজ্জ্বল লাগছে।
আগে একটা কিশোরী ভাব ছিলো, এখন পরিণত তরুনী রীতিমতো।
রেজার মনে হলো, ও যতবার দেখবে মিঠিকে, ততোবারই প্রেমে পড়বে। ঠিক এমনটাই রেজা চেয়েছে সবসময়।
বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো।
চার বছর আগে মিঠির বিষয়ে শোনা কথা বিশ্বাস করে নয়, বরং অভিমান থেকে না করে দিয়েছিলো।
মিঠি তাকে পছন্দ করেনি।
রেজার মনে হলো, মিঠির সাথে একটু কথা বলতেই হবে।
যেভাবেই হোক।
সুযোগ খুঁজলে সুযোগ পাওয়া যায় তবে রেজার খুঁজতে হলো না।
মেনুতে ছিল বিফ বিরিয়ানি। রেজা গরুর মাংস খায় না।
এত মানুষের মাঝে হাতে হাতে প্লেট দেওয়া। শায়লা আন্টি ব্যস্ত, তাকে ভীড়ে দেখতে পেলো না রেজা।
তবে মিঠি সামনে এসে পড়লো।
-এই যে মিঠি, একটু হেল্প করতে হবে!
মিঠি একটু চমকে তাকলো পেছনে, রেজা!
রেজা এখানে?
হু আসতেই পারে, শায়লা আন্টির রিলেটিভ তো!
ওনার তো এনগেজমেন্ট হয়েছে, আন্টি বলেছিলো, মিঠির মনে একটু ধাক্কা লাগেনি তা নয়, কিন্তু ও হেসে ঢেকে ফেললো ওর অনুভূতি।
-জি বলুন?
– এই প্লেট টা রেখে এসো প্লিজ!
-সে কি, আপনি খাবেন না?
-আমি বিফ খাই না!
-ওহ আচ্ছা, আমি চিকেন এনে দিচ্ছি।
-নাহ, এখন খাবো না কিছু, তুমি কোল্ড ড্রিংস থাকলে নিয়ে
আসতে পারো।
সাদাটা। কোক নয়।
-আচ্ছা, বলে মিঠি প্লেট নিয়ে চলে গেলো।
রেজার মনে হলো মিঠি আর আসবে না।
মিনিট দশেক পরে মিঠি এলো।
হাতে কোন্ড ড্রিংকসের গ্লাস, আরেক হাতে একটা প্লেটে কেক।
রেজাকে দিলো, রেজা শুধু ড্রিংকস টা নিয়ে বললো, আমি এত ক্রিমওয়ালা পেস্ট্রিও খাইনা।
মিঠি হেসে বললো, আপনি তো মুরব্বিদের মতো কথা বলছেন।
রেজা হেসে বললো, এটা রাখো এখানে।চলো বারান্দায় দাঁড়াই একটু।
আচ্ছা চলুন!
তুমি খেয়েছো?
আমি এই সন্ধ্যায় খাবো না।রাতে এসে খেয়ে যাবো।
হুম, এসময় আসলে ভারী মেনু হয়েছে। কি করছো এখন?
গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম, ছোটখাটো একটা জবে আছি।
আচ্ছা, রেজা অফিসের নামটা জেনে নিলো। কাওরানবাজারে মিঠির অফিস।
রেজা ভাবলো, মিঠির ছেলেমানুষি ভাবটা নেই এখন, কিন্তু আগের চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী ছিমছাম এখন।
রেজার সাথে বিয়ে হলে মিঠির এই বড় হয়ে ওঠা রেজা দেখতে পারতো, সাথে দুষ্টুমি মাখা সময়গুলো জমা হতো!
মিঠি রেজাকে আড়চোখে দেখলো একবার। রেজা কিছুটা ভারী হয়েছে, আগের চাইতে অনেক ম্যানলি লাগছে।
হয়তো বয়সের সাথে সাথে এই ম্যাচিউরড ভাবটা চলে আসে সবার মধ্যে। একটু বেশি কালো হয়েছে কি?
এভাবে দেখা ঠিক না। কল্পনার মানুষটা ছায়া ছায়া, তেমনি থাক না।
রেজা জিজ্ঞেস করলো, বাবল ওড়াও এখনো? ছাদে বসে?
মিঠি হেসে বললো সময় পাইনা। তারপর জিজ্ঞেস করল,
আচ্ছা আপনি নিশ্চয়ই দেখেছিলেন আমাকে বাবল ওড়াতে তাই না?
মিঠি এই কথাটা বলে একটু লজ্জা পেলো সেই গিফটের কথা ভেবে।
রেজার চোখ এড়ালো না।
রেজা বুঝতে পারলো সেই শপিং ব্যাগের কথা মিঠি মনে রেখেছে।
ও উত্তর দিলো না।জিজ্ঞেস করলো,বিয়ে কবে করছো?
তোমার বন্ধু জব পেয়েছে?
কোন বন্ধু?
ওই যে রেদোয়ান?
রেদোয়ান!! আচ্ছা সাজিদ, হুম ও কি একটা কোম্পানিতে ঢুকেছে কয়েকদিন আগে।
কথা হয়নি বেশ কিছুদিন আগে।
রেদোয়ান নাম বলেছিলো আপনাকে?
ওকে তো আমরা সাজিদ ডাকি, আপনার মনেও আছে!
হুম, ওকেই বিয়ে করছো?
কেন! সাজিদকে কেন বিয়ে করবো? সেরকম কিছু বলেছে কি?
ওর সাথে না তোমার একটা সম্পর্ক ছিলো!
মিঠি অবাক হয়ে, বললো কে বলেছে বলেন তো?সাজিদ?
হু,
আচ্ছা, না, আসলে ও আমাকে পছন্দ করতো, আমি কখনো ভাবিনি ওকে নিয়ে, ওর অ্যাফেয়ার হয়েছ আমাদের জুনিয়র এক মেয়ের সাথে।যা হয় আর কি, অ্যাফেয়ার হলে বন্ধুমহল থেকে
একটু আলাদা হয়ে যায়।
ওহ আচ্ছা।
সাজিদ কবে বললো আপনাকে?
ওইসময় বলেছিলো, চার বছর আগে!
মিঠি মনে মনে ভাবলো এটা কি তবে রেজার না করে দেওয়ার কারণ ছিলো! থাক, এসব ভেবে লাভ নেই, রেজা চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে গেছে তখনি।যেটা মনে আছে, সেটার গুরুত্ব খুব কম।রেজা অন্য কারো
ফিয়াসে এখন।
মিঠি এখনো বুঝতেই পারেনি রেজার জায়গাটা ওর কাছে ঠিক কোথায়। কখনো অন্য কারো কথা ভাবতেই পারেনি মিঠি। নিজের সাথেই লুকোচুরি খেলা চলেছে।
রেজা বললো, মিঠি আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
হুম, শায়লা আন্টি বলেছিলো কিছুদিন আগে। আপনার কিন্তু বেশ দেরি হলো, আমাদের বিয়ের কথা যখন হয়েছিল, তখন মনে হয়েছিল আপনার খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে, বলে মিঠি হাসলো!
রেজা বললো, কেন দেরি হয়েছে জানো?আমার সামনে তোমার পরে যে মেয়েই এসেছে আমি সবার মধ্যে মিঠিকে খুঁজেছি! পাইনি!
মিঠি অবাক হয়ে গেলো, রেজা এমন একটা কথা কিভাবে বললো! মাথা নিচু করে ফেললো।
রেজা বললো, সেসব পুরোনো কথা থাক, তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউরড বলেই বললাম, আবেগে ভাসার বয়স হয়তো দাঁড়িয়ে নেই। তোমার ফোন নম্বর দাও তো, মাঝে মাঝে ফোন করলে আশা করি বিরক্ত হবে না!
মিঠি ফোন নম্বর দিলো, রেজা বললো ফোন করছি, সেভ করে রাখো। চলো এখন ভেতরে যাই।
মিঠি বললো, আগে আপনি ঢুকে যান।আমি একটু পরে আসছি।
রেজা বুঝতে পারলো, ওদের একসাথে হয়ত ভালো দেখাবে না সবার কাছে।
ইশ মিঠি, কেন সেই ছেলেমানুষিটা করলে, নাহলে তুমি শুধু আমার হতে, শুধুই আমার।
এ কোন অচেনা অনুভূতি! মৌরিনের জন্য তো এমন লাগে না কখনো!
মিঠি থেকে দূরে পালাতে হবে।অনেক দূরে।
(চলবে)
শানজানা আলম
#অতঃপর_মিঠিকথা-৭
রেজার ফোন বেজে গেলো কয়েকবার।
রেজা ওয়াশরুমে ছিলো, ফিরে দেখলো মৌরিন ফোন করেছিলো।
রেজার কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না।
কেন যেন মনে হচ্ছে মিঠির সাথে নতুন করে একটা সেতু তৈরি হয়েছে। মৌরিনকে আউট সাইডার মনে হচ্ছে।
কী ভীষণ ভয়ানক কথা।
রেজা ফোন করলো মৌরিনকে-
– মৌরিন বলো?
-কোথায় ছিলে? বাসায় ফেরোনি?
– বারোটা বাজে, আমি এত সময় বাইরে কাজ ছাড়া থাকি না,
আজ যে কাজ নেই সেটাও তুমি জানো।
– এই সাধারণ কথাটা এত ঘুরিয়ে বলছো কেন!
-সরি, উল্টোপাল্টা প্রশ্ন আমি নিতে পারি না।
-রেজা উল্টোপাল্টা আমি কিছু বলিনি, আমি তোমার হবু ওয়াইফ, আমি জানতে চাইতে পারিনা?
রেজা কথা বললো না।
মৌরিন বললো, সরি, আচ্ছা আন্টি গতকাল বলেছিল।আজ কি একটা পার্টি আছে, আমাকে যাওয়ার কথা, তুমি তো কিছু বললে না?
ওহ, মা মৌরিন কে বলেছে, রেজা ইচ্ছে করেই বলেনি, মিঠিদের বাড়িতে যাবে, তাই।
রেজা বললো এখনো বিয়ে হয়নি আমাদের, মা যাই বলুক, আকদের আগে ফ্যামিলি প্রোগ্রামে তোমার যাওয়াটা ভাল দেখায় না।
ওহ, আচ্ছা, রেজা অনেক ব্যাকডেটেড এখনো।
মৌরিন একটা কথা বলতে চাইছে, সেটা কি বলা ঠিক হবে?
বুঝতে পারছে না।
রেজা একটা কথা বলতে চাই, আমার ফ্রেন্ডরা সবাই কক্সবাজার যাবে ঠিক করেছে।
তোমাকেও যেতে বলছে, নেক্সট উইকে দুদিন ছুটি আছে, আমরা তো নিজেরা কোন সময়ই পেলাম না নিজেদের জানার।
রেজা বললো, আমার সময় হবে না মৌরিন।তুমি যাও।
আমি গেলে তোমার সমস্যা নেই?
না, সমস্যা থাকবে কেন?
আমার ছেলে ফ্রেন্ডরাও আছে কিন্তু।
তো কি হয়েছে?
তুমি তো টিনএজার না, এডাল্ট।
নিজের কেয়ার নিজে করতে পারবে। আর নিজে কিছু করলেও আমি বলার কেউ না।
এই মাত্র রেজাকে ব্যাকডেটেড মনে হয়েছে, এখন মুক্ত মনের মনে হচ্ছে, ছেলেটাকে বুঝতে পারছে না।তবে আন্তরিকতা খুব কম, ইয়েস নো দিয়েই কথা সারতে চায়। মৌরিন মনে মনে ভাবলো।
আচ্ছা মৌরিন আমি ফোন রাখছি, ঘুম পাচ্ছে। মৌরিনকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা রেখে দিলো রেজা।
ঘুম পাচ্ছে না মিঠিকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে।এত রাতে, কি না কি মনে করবে, থাক!
মিনিট পনেরো এপাশ ওপাশ করে রেজা টেক্সট করে ফেললো-
ঘুমিয়েছো?
না, পাঁচ মিনিট পরে টেক্সট রিপ্লাই চলে এলো!
তারপর মিঠিই ফোন করলো।
হ্যালো, আপনি টেক্সট করেছেন??
এত রাতে?
আসলে সত্যি কোন কারণ নেই, এমনিই করেছি।
ঘুমাচ্ছ না কেন?
মুভি দেখছিলাম।
এত রাত জেগে?
এটা খুব বেশি রাত না ঢাকা শহরে।
হু সেটাও ঠিক, আমি রাত জাগি না বেশি।
আপনি খুব নিয়ম মেনে চলেন দেখছি।
হুম, গত বছর একটু অসুস্থ হয়েছিলাম।
তখন ডক্টর সাজেস্ট করলো রুটিনে চলে আসতে।
আমি একমাত্র ছেলে, বাবা মায়ের জন্য হলেও সুস্থ থাকা দরকার।
হুম, বুঝতে পারছি! তাহলে আর জাগবেন না, অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে।
হুম। একটু চুপ করে থেকে রেজা বলেই ফেললো, মিঠি, আমাকে অপছন্দ করার কারণটা জানতে পারি?
মিটি অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
তারপর একটু ভেবে বললো, আসলে আমি তখন বিয়ে করতে চাইনি। আমার বোনেরা সবাই বিয়ে করে গৃহিণী হয়ে গেছে, আমি একটু দাঁড়াতে চেয়েছিলাম।
তারপরেও মায়ের কথায় যখন মত জানাতে গেলাম, তখন আপনার দিক থেকে না হয়ে গেছে।
তাই আর কথা আগায় নি!
এখন বিয়ের কথা ভাবছো না?
আসলে এসব অনেক কথা, কিছু ফ্যামিলির ভেতরের কথাও আছে। পরে কখনো বলব।
এখন এসব বলতে ভালো লাগছে না।
পরে কখনো বলবে, মানে আরো কথা হবে মিঠির সাথে।
মিঠি, তুমি কেন যে আমার সবটা জুড়ে বসে আছো আমি জানি না, এটা বলতে ইচ্ছে করলেও রেজা বললো না।
ফোন রাখলো দুজনেই।
রেজার ঘুম আসছে না।
মিঠি ভেতরটা এলোমেলো করে দিলো, কেন এমন হচ্ছে।
মৌরিন তো খারাপ মেয়ে না।যথেষ্ট ভালো, কেন মিঠির জায়গায় আসতে পারছে না।
চোখ বন্ধ করলেই রেজা সেই দৃশ্যটা দেখতে পায়, কিছুটা ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশনের মতো, সাদা স্কার্ট পরা মিঠি আকাশে ভাসমান বল ফু দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে।
রেজা চোখ বন্ধ করেই ভাবলো, আই লাভ ইউ, মিঠি।
তুমি জানবে না কখনো।
সহজ সমীকরণটা অনেক কঠিন হয়ে গেছে, তুমি কি কখনো জানতে বা বুঝতে পারবে?
#অতঃপর_মিঠিকথা-৮
মিঠির ফুপু আরেফা বেগম। স্কুল জীবন থেকেই একটু বেপরোয়া ছিলেন।
সরকারি কর্মকর্তা বাবার মেয়ে হয়েও পালিয়ে বিয়ে করেছেন পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী ছেলেকে।
সম্পত্তি তার অভাব নেই কিন্তু মিঠিদের ধানমন্ডির এই বাড়ির জায়গার দাবি ছাড়তে পারেন না।
আর এখানে তারও অংশ আছে, মিঠির বাবা মা বার বার বুঝ দিয়েছেন, মিঠির বিয়ের পরে ডেভেলপারকে দিয়ে দিবেন, তারপর ফ্ল্যাটের ভাগ নিবেন।
কিন্তু তিনি এবার অধৈর্য্য। তার উপর তার ভাসুরের ছেলে, আকাশ বকস, তার সাথে মিঠির বিয়ে দিতে চান বহুদিন। মিঠি সুন্দরী, এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে।
মিঠির মা সারাক্ষণ চিন্তা করেন এ বিষয়ে।
আরেফা সকাল থেকে মিঠির বাবার ঘরে বসে আছে।
ভাইজান, আপনে তো গুরুত্ব দেতেছেন না।
আকাশ কি খারাপ পোলা নাকি, চাইরটা রেস্টুরেন্ট আছে, তার মধ্যে একটা আবার ভাইরাল, দুনিয়ার মানুষ কাচ্চি খাইতে অর দোকানে যায়।
কি যে বলো আরেফা, আকাশের সাথে মিঠি যায় নাকি, মিঠি পড়াশোনা করছে, ওর জন্য একটা চাকরিজীবী ছেলে খুঁজি।
আকাশের জন্য আরো ভালো মেয়ে পাবি তো, তোদের এলাকায়।
এই কালচারে মিঠি মিশতে পারবে না।
কইলাম পারবে, আমি পারছি না।
আপনে তো বোঝেন না, আপনের দুই বড়লোক জামাই আপনের খোঁজ নেয়, নেয় না, কালে ভাদ্রে দাওয়াত দেন, আইসা খাইয়া দৌড়।
বাবু এখনো ছোট, আপনের আকাশের মত পোলা দরকার একটা, সারাদিন আব্বা আব্বা করবো।
আকাশগো বাড়িটা বিশাল।
বিয়ার পরে দুইটা রুমে আপনেরা যাইয়া থাকবেন।
বাড়ির কাজ চলতে থাকবো, আপনের দেখাও লাগবে না, আকাশ দেখবো!
মিঠির মা ভাইবোনের মাঝে কথা বলেন না। কি যে আছে মিঠির কপালে, মেয়েটা একটা বিয়েতেও রাজি হলো না।
এখন কি আকাশের সাথে বিয়ে দিতে হবে!
আকাশকে তিনি চেনেন, আদব কায়দা ভালো, কিন্তু পড়াশোনা ওই টেনেটুনে আইএ পাশ।
বি গ্রেড পেয়েছে, তাতেই তার বাপ ঘোড়ার গাড়ি করে মিছিল করছে।
ছেলেটা বখে যায়নি, ব্যবসা বানিজ্য ভালোই করছে, মিঠি কি রাজি হবে, মিঠির সাথে যায় না কোন ভাবেই!
আহারে, কি সুন্দর মিঠির মুখটা, তিনি মনে মনে ভয় পেলেন, মায়ের নজর না লাগে যেন!
★★★
মিঠির ঘুম ভাঙলো আটটার দিকে।
আজ কি একটা ছুটি আছে, অফিস নেই।
এমনিতে সাড়ে সাতটার মধ্যেই বের হয়ো যেতে হয়।
ফোন চেক করে রাতে রেজার করা টেক্সটটা চোখে পড়লো।
মিঠি রেজাকে এড়াতে পারছে না।
চারবছর আগের বাক্সবন্দী ইচ্ছেটা কেন নাড়া দিয়ে উঠছে।
রেজার বাগদত্তা আরেকটা মেয়ে এখন।
রেজাকে এভয়েড করতেই হবে, যেভাবেই হোক।
ফোনটা নামিয়ে রাখতেই রেজার ফোন।
কাল সন্ধ্যায় রেজার সাথে দেখা হলো, তারপর থেকে এটুকু সময় রেজা জুড়ে থাকছে, সন্ধ্যা, রাত এখন সকাল।
-গুডমর্নিং মিঠি, ঘুম হয়েছে?
-গুডমর্নিং, আপনার অফিস নেই আজ?
-আছে, কিন্তু বন্ধ তো, একটু পরে যাবো, তোমার ছুটি না আজ?
-হুম
-কি প্ল্যান তোমার আজকে?
-কোন প্ল্যান নেই, বাড়িতেই আছি, নিজের কিছু কাজ আছে, সেগুলো সারতে হবে।
-দুপুরের পরে আমি ফ্রি, বের হবে?
-নাহ, আজ বাসায়ই থাকি, ছুটিছাটা কম আমার। বের হওয়ার প্ল্যান করলে কাজ হবে না।
-তো কি আর করা, আমি কাজ শেষ করে ফোন করবো আরেকবার।
দেখো, তখন যদি মন চায়, এসো।
-আচ্ছা।
ফোন রেখে মিঠি রান্নাঘরে দেখলো ফুপুআম্মা এসেছেন।
ফুপু আম্মা কি চায় সেটা সে জানে।
আকাশ ভাইয়ের সাথে মিঠির বিয়ে দিতে চায়।
মিঠি প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও এখন আর হাসে না।
ফুপু আম্মা দিনকে দিন বেশি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে।
মিঠি শুনলো বিকেলে আকাশ আসবে, ফুপু আম্মাকে নিতে।
আসলে সবই ত্যানাপ্যাচানো কাহিনী, আসলেই ফুপু আম্মা বলবে, মিঠি যা তো, আকাশকে নিয়ে কফি খেয়ে আয়!
মিঠি আগে একবার গিয়েছে, অত্যন্ত বিরক্তিকর।
উফ, রঙচঙে শার্ট গায়ে দিয়ে, কানে গলায় সোনার রিং আর চেইন, চোখে অদ্ভুদ কালা চশমা, পুরো জোকার সেজে থাকে, এটা নাকি তাদের মান ইজ্জত বাড়ায়!
মিঠি রুমে এসে রেজাকে ফোন ব্যাক করলো।রেজা পিক করলো না।
মিনিট পনেরো পরে রেজা ফোন করলো মিঠিকে।
-মিঠি, বলো….
-আপনি কখন ফ্রি হবেন?
-একটার পরে, তুমি আসবে?
-কোথায় বলুন?
-তুমি ধানমন্ডি সাতাশের দিকে চলে আসো, আমি ওর আশেপাশেই থাকবো, মিট করে ঠিক করবো কোথায় বসা যায়, ওকে?
-আচ্ছা ঠিক আছে।
রেজার অদ্ভুত ভালো লাগছে। মিঠি আসতে চাইছে, সত্যিই!
মৌরিন?
থাক, ওর কথা পরে ভেবে দেখা যাবে।
মনের উপর কারো হাত নেই।
মিঠির সাথে রেজার কোন অদৃশ্য বন্ধন আছে, নয়তো এতদিন পরে হুট করে দেখা হয়ে, সম্পর্কটা এত স্বাভাবিক হয়ে যেতো না।
-এটা আমি কি করছি, রেজার সাথে দেখা করা কি ঠিক হচ্ছে, রেজা অন্য একজনের এখন!
ধূর, একদম মধ্যবিত্ত মানসিকতা, রেজার সাথে দেখা হলেই বা কি, রেজা কি বন্ধু হতে পারেনা।
দেখা হওয়া মানেই কি অন্যকিছু নাকি!
কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট, রেজা তাকে অন্যচোখেই দেখে, এই দৃষ্টি মেয়েরা বুঝতে পারে।
মিঠির যুক্তিসংগত ভাবে, রেজাকে এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ।
সেটা পারছে না কেন?
সব কিছু মানুষের হাতে থাকে না কেন!!
কেন মানুষটা মনটা ইচ্ছে গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না!
এসব ভেবে লাভ নেই!
মিঠি আলমারি থেকে ছাইরঙা হাফসিল্ক শাড়িটা বের করলো, পড়া হয়নি এখনো।
আজই পড়ে ফেলা যাক তবে।
(চলবে)
শানজানা আলম