গল্পঃ হৃদয়ের বন্ধন।
পর্বঃ ১৮।
লেখাঃ #মেহের।

তবে জেসিকা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সবাই যা চায় তাই হবে।
জেসিকা আর ওদের কাছে জোর করে এ বাড়িতে থাকবে চায়বে না।
দরকার হলে ওঁর যেদিকে দু’চোখ যায় সে দিকে চলে যাবে।
তবুও এখানে থেকে আর কোন অশান্তির সৃষ্টি করবে না।
মারুফকে মুক্ত করে দিবে এই জং ধরা বন্ধন থেকে।

এদিকে মারুফ কাপড় চোপড় নিয়ে গোসল করতে চলে গেল।
মারুফ ওয়াশরুমে গিয়ে দেয়ালে জোরে ঘুষি মারে।
তাতে ওঁর হাতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয়।
কিন্তু এ ব্যথার থেকেও মারুফের মনে মধ্যে আরও বেশি ব্যথা হচ্ছে।
মারুফ মনে মনে বলল, জেসিকা তোমার সহ্য শক্তি দেখে আমি তোমার উপরে ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম এবং মনে মনে তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম ।
আর সেই তুমি কিনা এত সহজে আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে দিলে।

যেই আমি কখনো কোন নারীকে আঘাত করেনি ।
সেই আমিই আজ তোমার কর্মকাণ্ড দেখে তোমাকে আঘাত করতে বাধ্য হয়েছি ।

আমার পরিবারের প্রতি তোমার করা খারাপ ব্যাবহারেই বাধ্য করছে আমাকে তোমার গায়ে হাত তুলতে।

জেসিকা তুমি এই আমাকে মানুষ থেকে কি বানিয়ে দিলে!
এসব ভাবতে ভাবতে মারুফের চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু বেয়ে পড়ল।
ওভাবেই কিছুক্ষণ ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে থাকলো।

এরপর মারুফ গোসল করে বের হয়ে আসল।

এদিকে সবাই যে যার ঘরে চলে গেছে।
মায়া বেগম ভেবেছে ছেলের যেহেতু বৌকে আঘাত করেছে তাই ওয়াশরুমে থেকে বের হলেই হয়তো জেসিকার অবস্থা দেখে নিজেই মলম মালিশ করে দিবে বৌকে।
কারণ তার ছেলে এ পর্যন্ত কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলেনি সেখানে আজকে বিনা কারণে জেসিকে এভাবে আঘাত করেছে।
নিশ্চই এ নিয়ে নিজের ভিতরে অনুশোচনায় দগ্ধ হবে।
তাই বৌয়ের সেবা যত্ন করলে তা কিছুটা লাঘব হবে।
এসব চিন্তা করে মারুফের মা
সেজন্য জেসিকার রুমে থেকে চলে এসেছে।

কিন্তু সে আশায় শেকড়ে বালি ।

কারণ মারুফ ওয়াশরুমে থেকে বের হয়ে জেসিকার দিকে ফিরেও তাকায়নি।
মারুফ রুমে থেকে বাহিরে আসলে আলো তাকে খাবার বেরে দিয়ে খেতে অনুরোধ করে।
মারুফ আলোর অনুরোধ ফেলতে পারেনি।
তাই অল্প কিছু খেয়ে ওঁর চাচ্চুর জন্য খাবার নিয়ে গেছে।

মারুফ যাওয়ার পরে মায়া বেগম জেসিকার রুমে এসে দেখে জেসিকা ব্যথায় ছটফট করছে।
আর ঘোরের মধ্যে ওঁর মা’কে ডাকছে।
মায়া বেগমের খারাপ লাগছে মেয়েটার জন্য।
জেসিকার আঘাতের জায়গা পরিস্কার করতে ও মলম দিতে জেসিকাকে একপাশ করে শুয়ে দিল।

পরিষ্কার করতে জামা উপরে উঠিয়ে মায়া বেগম আঁতকে উঠলেন!
তার ছেলে এটা কী করেছে? এমন করে কেউ কোন মানুষকে আঘাত করে তা মায়া বেগমের জানা ছিল না।
ইস্ ব্যথায় মেয়েটার কত না কষ্ট পাচ্ছে।
এসব ভেবে মায়া বেগম জেসিকার শরীরে আলতো করে মলম দেওয়া শুরু করে।

তাতে জেসিকা কেঁপে কেঁপে উঠছে আর চিৎকার করছে।
জেসিকা এই মুহূর্তে হালকা ছোঁয়াও সহ্য করতে পারছে না।
তাই বারবার চিৎকার দিয়ে উঠছে।

মায়া বেগম জেসিকার শরীর পরিষ্কার করে মলম দিয়ে জ্বর ও ব্যথার ওষুধ দিলেন।
এবং কোমলকে ডেকে জেসিকার সাথে থাকতে বললেন।

তিনদিন পর।

দুইদিন পরেই চাঁদনী বানুর জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু তার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে কারো সাথেই কথা বলতে পারেনি।
গতকাল রাতে থেকে চাঁদনী বানুর শরীর অনেকটাই ভালো ।
তাই সে কোনভাবেই হসপিটালে থাকতে রাজি হচ্ছে না।

মারুফ দাদুর সাথে না পেরে ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওঁর দাদুকে বলেছে আগামী কালেই তাকে বাসায় নিয়ে যাবে।
এর আগে নেওয়া সম্ভব নয়।

চাঁদনী বানু মারুফের সাথে কথায় না পেরে মন খারাপ করে বসে আছে।
মারুফ তাকে কোন মতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওঁর চাচ্চুকে দাদুর কাছে হসপিটালে রেখেই মারুফ এরপর ৎদোকানে চলে গেছে।

চাঁদনী বানুর জ্ঞান ফিরেছে যেদিন তার পরের দিনই বাসার সবাই হসপিটালে এসে তাকে দেখে গেছে।
শুধু আলো আসেনি মায়া বেগম আলোকে বাসার ও জেসিকার খেয়াল রাখতে রেখে এসেছিল।

কারণ এই কয়দিন জেসিকা অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল।
জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে থাকতো ।
একটু হুস আসলেই বমি করে রুম ভাসিয়ে দিতো।
জান নিয়ে টানাটানি অবস্থা ছিল।
সেদিন জেসিকা ঘোরের মধ্যে মা মা ডাকাতে মায়া বেগম জেসিকার মাকে খবর পাঠায়।

জেসিকার মা এখানে এসে মেয়ের এই অবস্থা দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে।
তার স্বামী এবং মেয়ের জামাই তার মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিলো কিভাবে তাই ভাবতে পারেন না।
তাই রাগ করে মেয়ের এই অবস্থার খবর জেসিকার বাবাকে দেয়নি।

বিশেষ করে মারুফের আঘাতগুলো ছিলো চোখে পড়ার মতো।
সেসব কথাও বলেনি।

সেদিন থেকেই জেসিকার মা মেয়ের কাছেই আছে।
অবশ্য এখানে আসার পরে থেকে দোলা এবং আলো তাকে নানাভাবে হয়রানি ও অপমান করছে।
তবুও মেয়ের দিকে তাকিয়ে পড়ে আছেন।
জেসিকার মা মনে মনে ঠিক করেছে মেয়েটা একটু সুস্থ্য হলেই মেয়েকে নিয়ে চলে যাবেন এখানে থেকে।

এদিকে মারুফ এই কয়দিন বলতে গেলে একটুও সময় পাচ্ছেনা ।
শুধু দিনে একবার বাসায় এসে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করেই হসপিটালে চলে আসতো।
ঐ দিনের পরে জেসিকার মুখ মারুফের দেখাই হয়নি ।
কারণ সব সময় জেসিকার কাছে তার মা বসে থাকতেন।
ওকে দেখেও জেসিকার মা মেয়ের কাছেই বসে থাকতো একটুও সরে থাকত না ।
যদি তার মেয়েকে আবার মারে সেজন্য।
এ কদিনে না সে মারুফকে সাথে কথা বলেছে আর না মারুফ বলেছে।

মারুফ ওদের রুমে থেকে কাপড় চোপড় নিয়ে অন্যরুমে যেয়ে গোসল করত।
শাশুড়ি সামনে তো গোসল করে বের হতে পারবে না তাই।
আর রাতে হসপিটালে থাকাতে শাশুড়ির সাথেও তেমন একটা দেখা হতো না।
এদিকে জেসিকার অবস্থা বেশি খারাপ হওয়াতে রাতে জেসিকার কাছে জেসিকার মা থাকতো।
এভাবেই চলছিল এই কদিন।

পরেরদিন পর সকালে।

চাঁদনী বানুকে বাসায় দিয়ে মারুফ দোকানে গেছে।
দোকানে এসেই প্রথমে শ্বশুরকে ফোন দিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় আসতে বলেছে জরুরী ভিত্তিতে।

অন্যদিকে জেসিকা আজকে কিছুটা সুস্থ্য হয়েছে।
তবে এখনও পুরোপুরি সুস্থ্য হয়নি।
একা একা দাঁড়িয়ে থাকতেও পারেনা।
জেসিকার মার এখন মনে হচ্ছে তার মেয়ে প্রথমে যেমন রাগী ছিলো ।
এখনো তেমন থাকলে তাকে কেউই এইভাবে আঘাত করতে পারত না।
মেয়েটা নরম ভদ্র হয়ে এসেছে এজন্য সবাই ওঁর জানের পিছনেই হাত ধুয়ে পড়েছে।

আজকে সন্ধ্যায় মারুফ ও ওঁর চাচ্চু যলদি বাসায় এসে পড়ল‌।

ওদেরকে সন্ধ্যায় বাসায় আসাতে দেখে মায়া বেগম বললেন , কিরে আজ এত তাড়াতাড়ি বাসায় দোকানে কোন সমস্যা হয়নি তো আবার?

মারুফ ওঁর মা’কে বলল,মা জেসিকার বাবাকে বাসায় আসতে বলেছি।
তাই যলদি এসেছি,
এবং তিনি আসলে তার মেয়েকে তার কাছে দিয়ে আমি এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে চায়।
ওঁর মত মেয়ের আমাদের বাসায় জায়গা নেই।

এ কথা শুনে মায়া বেগম বললেন, মারুফ মেয়েটা এখনও অনেক অসুস্থ্য প্রথমে তো ওকে সুস্থ্য হতে দিবি নাকি!
আর তোর দাদু যদি এসব শুনে আরও অসুস্থ্য হয়ে যায় তখন কী করবি?

মা তুমি ওকে চেন না সব ওঁর অভিনয়।
আর দাদু এ কথা শুনে বরং খুশিই হবে।
মা’কে এ কথা বলে মারুফ ফ্রেস হতে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে জেসিকার বাবা আসলে কোমল তাকে সামনের রুমে বসতে দিয়ে সবাইকে ডাকতে গিয়েছে।

জেসিকার বাবা বসার পরেই একে একে সবাই এই রুমে আসে।

সবাইকে আসতে দেখে উকিল সাহেব বিচক্ষণ মানুষ তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না আজকে তার মেয়েকে একবারেই নিয়ে যেতেই তাকে জরুরী ভিত্তিতে আসতে বলেছে মারুফ।
এদিকে মারুফ ওঁর দাদুকে কোলে করে নিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দেয়।
তার একটু পরেই জেসিকাকে তার মা নিয়ে এসে মেয়েকে বসিয়ে জরিয়ে ধরে রাখছে।

নাহলে মেয়েটা তার পরেই যেত।
উকিল সাহেব মেয়ের এই অবস্থা দেখে চমকে উঠে।
তার এতো আদরের মেয়েটার এই কি হাল হয়েছে।
সে এমন পাষাণের মত মেয়েকে মারল কি করে।
আর এ কদিনে জেসিকার মা তো একবারও বলেনি মেয়েটার এমন খারাপ অবস্থা।
নাহ্ মেয়েটাকে আজকে বাসায় নেওয়ার পর ভালো মত ডাক্তার দেখাতে হবে।
জেসিকার বাবা যখন মেয়েকে নিয়ে এসব ভাবছিল সে সময়ে
মারুফের কথায় জেসিকার বাবার ধ্যান ভাঙল।

আমি আপনার মেয়ের সাথে আর এক মুহুর্তও থাকতে চায় না।
আপনি ওকে নিয়ে যান।
আগামী সপ্তাহে তালাকের কাগজ সাইন করে আপনার বাসায় পাঠিয়ে দিব।
মারুফ এতক্ষণ ধরে একরুমে বসে থেকে একবারও জেসিকার দিকে তাকায়নি।

মারুফের এসব কথা শুনে জেসিকার মা বললেন, আপনাদের বিচার শেষ হয়েছে না আরও বাকি আছে।
যদি আরও বাকি থাকে তো তাড়াতাড়ি শেষ করেন কারণ এখানে থেকে যত তাড়াতাড়ি যাব ততই আমার মেয়ের জন্য মঙ্গল।

এ কথা শুনে দোলা বলে,হ্যাঁ তবে উল্টোটা ।
মানে এই অলক্ষী অপয়া মেয়ে এই বাড়িতে থেকে বের হলেই আমাদের বাড়িতে আবার শান্তি ফিরে আসবে।

জেসিকা সবার কথা শুনছে তবে আজকে কারো কথা খারাপ লাগছে না।
কারণ সেও এই বাড়িতে আর থাকতে চায় না।
তবে বাবার বাড়িতেও ফিরতে চায় না।
তাই ভেবেছে মাকে বলবে তাকে জয়ার বাসায় দিয়ে আসতে।
জয়া নিশ্চিয় এই বিপদে তাকে তাড়িয়ে দিবে না।
জেসিকা যখন এসব ভাবছিল সে সময়ে মারুফের চাচ্চু জেসিকার বাবাকে বলল, আপনাদের ভাগ্যে ভালো মায়ের ঝাল খাবারে সমস্যা আছে জানা সত্ত্বেও এই মেয়ে খাবারের মধ্যে ঝাল দিয়ে আমার মাকে খুন করতে চেয়েছে এটা জেনেও আপনার মেয়েকে এখনো আমরা পুলিশে দেয়নি।

জেসিকার বাবা এ কথা শুনে বলল, ছোট ভাই এজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।

চাঁদনী বানু এতক্ষণে বুঝতে পারছে আজকে বিচার শুরু হয়েছে কি নিয়ে।
সে ভেবেছিল জেসিকা বুঝি আবারো কিছু করেছে।
সেও এতদিন চাচ্ছিল জেসিকা এই বাড়িতে থেকে চলে যাক।
কিন্তু এইখানে তো এই মেয়ে যে অপরাধ করেনি তার শাস্তি পাচ্ছে।
এটা তো ঠিক নয়।
আর চাঁদনী বানুর এখন মনে হচ্ছে আলোর থেকে জেসিকা শতগুণ ভালো।
জেসিকাকে এই কদিনে চাঁদনী বানু যে কষ্টটাই না দিয়েছিলো তবু তার সাথে এই মেয়ে সামন্য বেয়াদবিও করেনি।
ওঁর জায়গায় আলো থাকলে চাঁদনী বানু মরে ভূত হয়ে যেত।

সে যখন এসব ভাবছিল সেই সময়ে জেসিকার বাবা বলল,আমার মেয়ের হয়ে ছোট বড় সবার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি ওঁর কাজের জন্য আমি খুবই লজ্জিত।
আর দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের এখন বের হলেই ভালো হবে।
এই কথা বলেই জেসিকার মাকে উদ্দেশ্য করে জেসিকার বাবা মেয়েকে নিয়ে বের হতে বলল ।

এ কথা শুনে চাঁদনী বানু বলল, খবর ধার আমার বাড়ির বৌকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে খবর আছে।
সবাই কান খুলে শুনে রাখ,জেসিকা কোথাও যাবে না।

একথা শুনে সবাই চমকে উঠে কিন্তু এ কথায় জেসিকার কোন হেলদোল নেই।
সে এখানে থাকা বা যাওয়া নিয়ে কিছু ভাবতে চায় না।

মারুফ তার দাদুর কথা শুনে চমকে বলল, দাদু এই খুনিকে তুমি সুযোগ দিতে পারো আমি না।
তাই প্লিজ ওকে থাকতে বলো না।
আর তুমি জানো এই মেয়ে তুমি হসপিটালে থাকা কালীন সময়ে চাচী ও মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করেছে।
এমনকি জেসিকার বাবা ও মাও বাসায় এসে তাদের অপমান করেছে।
একথা শুনে মায়া বেগম বললেন, কবে কখন জেসিকা খারাপ আচরণ করেছে আমি তো দেখেনি উল্টো তোর চাচী তো আম্মার খারাপ অবস্থা দেখে ওঁর গায়ে হাত তুলছে।

আর আলো এবং দোলায় তো তোর শ্বশুর ও শাশুড়িকে অপমান করেছে।
সেজন্য রাগে ক্ষোভে জেসিকার বাবা মেয়েকে মেরে আধমরা করে রেখে গিয়েছিল।
শুন মারুফ না জেনে কারো নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া উচিত নয়।

মারুফ এ কথা শুনে জমে গেছে মানে তার শ্বশুর জেসিকা কে মেরে আধমরা অবস্থা করেছে আর সে জানতেও পারল না।
কিন্তু তাকে আলো যেসব কথা বলল তাহলে কি সব মিথ্যা!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here