হৃদমোহিনী
পর্ব ৬
মিশু মনি
.
৭.
মেঘালয় সরে যেতেই মিশু গিয়ে বস্তার উপর শুয়ে পড়লো। শুয়ে শুয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে লাগলো। ট্রাকের দুলুনির সাথে সাথে চাঁদ টাও দুলছে সেরকম মনেহচ্ছে। শিরশিরে বাতাসে হিম হয়ে যাচ্ছে শরীর। মেঘালয় নিজের গায়ের কোটটা খুলে মিশুর দিকে এগিয়ে দিলো।

মিশু অবাক হয়ে বললো, “থ্যাংকস। কিন্তু এটার দরকার নেই। আমার সেরকম শীত করছে না।”
-“শীত না করলেও কোটটা পড়ে নাও। নয়ত ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
-“উহু, লাগবে না। আমার গায়ে চাদর আছে।”

মেঘালয় বললো, এই পাতলা চাদরে শীত কমবে না ম্যাম। আপনি কোটটা পড়ুন আর চাদরটা মাথার উপর বেধে ফেলুন। কানে বাতাস লাগাবেন না। ঠাণ্ডা লেগে গেলে আগামীকাল রাতে আর নদীতে ভেসে জোৎস্না বিলাস করতে পারবেন না। বুঝেছেন?”

মিশু মুচকি হেসে জবাব দিলো, “বুঝেছি। আপনার শীত লাগবে না?”
-“আমার শীত সয়ে যাওয়ার অভ্যেস আছে।”

কথাটা বলে মেঘালয় গা থেকে কোটটা খুলে দিলো মিশুকে। মিশু কোটটা পড়ে মাথার উপর চাদর ঢেকে নিলো। কেবলই মনে হতে লাগলো একটা অন্যরকম স্পর্শের সন্ধান পেয়েছে সে। মেঘালয়ের কোটটা গায়ে জড়ানোর পর তার উষ্ণতা ছড়িয়ে যাচ্ছে শরীরে। মিষ্টি সুগন্ধ এই কোট টায়, মিশু বারবার ঘ্রাণ নিতে লাগলো সেটার।

মেঘালয় বস্তার উপর দুইপা তুলে বসলো। বললো, “বাসায় কথা বলবে না?”
-“এত রাতে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করবো না। বাসায় জানে আমি বান্ধবীর বাসায় আছি। বান্ধবীর বাসা থেকে ঢাকায় এসেছিলাম। বাড়ি গেলে ওরা ভাব্বে বান্ধবীর বাড়ি থেকেই ফিরলাম।”
-“বাহ! কি ট্যালেন্ট। মেয়েদের এই একটা স্বভাব, সবসময় বয় ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় বান্ধবীর বাড়ির নাম করে যায়।”

মিশু হেসে ফেললো কথাটা শুনে। বললো, “আমি কক্ষনো মিথ্যে বলিনি আম্মু আব্বুকে। এবার ই প্রথম। তন্ময়ের জন্য মিথ্যে বলে বাসা থেকে বের হতে হয়েছে। ঢাকা যাবো বললে কখনোই যেতে দিতো না আমাকে।”
-“হুম সেটা তো বুঝেছি। এই ট্রাকটা হচ্ছে তোমার বান্ধবীর বাড়ি আর আমি হচ্ছি তোমার বান্ধবী।”

মিশু হো হো করে হেসে উঠলো। মেঘালয় বেশ মজার কথা বলতে জানে। লোকটা সবকিছুতেই সেরা। এমন একজন মানুষ দেখলে ইচ্ছে করে… কি যে ইচ্ছে করে সেটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু কিছু একটা ইচ্ছে করে,খুব ইচ্ছে করে।

মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কেমন লাগছে এই বান্ধবী’র বাড়িটাকে?”
-“অসাধারণ। অন্যরকম একটা বাড়ি আমার বান্ধবীর। এইযে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখতে পারছি সেটা কি কম কথা? তবে সবচেয়ে ইউনিক হচ্ছে আমার বান্ধবীটা।”

মেঘালয় শব্দ করে হেসে উঠলো। মিশু তাকালো ওর দিকে। হেডলাইটের হলুদ আলোয় একটা হলুদাভ আভা চলে এসেছে ওনার চেহারায়। ফর্সা গাল হলুদাভ হয়ে দারুণ হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। চুলগুলো উড়ছে বাতাসে, চোখদুটো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এটা রূপকথার রাজ্যের কোনো রাজকুমার নয়তো?

মিশুকে অবাক করে দিয়ে মেঘালয় গান গাইতে আরম্ভ করলো,
“যখন নিঝুম রাতে সবকিছু চুপ,
নিষ্প্রাণ নগরীতে ঝিঝিরাও ঘুম..
আমি চাঁদের আলো হয়ে তোমার কালো ঘরে,
জেগে রই সারানিশি..
এতটা ভালোবাসি.. এতটা ভালোবাসি… ”

মিশু মোটামুটি ধরণের মুগ্ধ হলো গান শুনে। মধ্যরাতের জোৎস্নায় ভিজতে ভিজতে এই গানটা শুনতে বেশ লাগলো। আরো শুনতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু লোকটা কি যেন ভেবে রাস্তার দিকে চেয়ে আছে, গান গাইছে গুনগুন করে।

মিশু বললো, “একটু জোরে গাইতে পারেন না? আমার ভালো লাগছে শুনতে।”

মেঘালয় আবারো গাইতে আরম্ভ করলো,
“রাত আমার শরীরে, আনাচেকানাচে ঘোরে
খুঁজে চলে ঘুমের গান,জোৎস্না চাদরে ঘুমের ভান..
ঘুম আসেনা দুচোখে,জোনাকিরা যায় ডেকে,
ওদের হাসির শব্দে আমার চোখ লুকোনোর অভিমান…
গল্প দাও,রাত্রি তুমি কিছু গল্প দাও..
ঘুম আজ মৃত্যু নাও,সকাল নতুন জন্ম দাও।
বন্ধু হও, রাত্রি তুমি আমার বন্ধু হও..
চোখের পাতায় আঙুল ছোঁয়াও, জন্মের আগে জন্ম হও..
রাত আমার শরীরে…”

মিশু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে মেঘালয় নামক মানুষটার মুখের দিকে। খুব সুন্দর করে গান গাইছেন উনি। ওনার ঠোঁটের কাঁপুনি দেখে আরো তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এরকম নির্লজ্জভাবে তো আর তাকিয়ে থাকা যায়না।
মিশু খেয়াল করে দেখলো মেঘালয় একটু একটু কাঁপছে। শীত করছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু ওনাকে বললে তো চাদর বা কোট কোনোটাই নিতে রাজি হবেন না। মিশু কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলো। তারপর বললো, “চাদরটা নিয়ে গায়ে দিবেন প্লিজ?”
-“না না, তোমার ঠাণ্ডা লাগবে।”
-“লাগবে না। এই একটা কোটই যথেষ্ট। আপনি চাদরটা নেবেন? নিন না।”

মেঘালয় কিছুতেই নেবে না চাদর। একটা মেয়ের কাছ থেকে শীতের পোষাক চেয়ে নেয়ার মাঝে কোনো সার্থকতা আছে নাকি? লজ্জা করবে ভীষণ। যতক্ষণ ঠাণ্ডা সহ্য করা যায় করবে, তারপর যদি অবস্থা বেগতিক হয় তখন ভেবে দেখা যাবে।

মেঘালয় বললো, “পিছনে কয়েকটা খালি বস্তা রাখা আছে। ঠাণ্ডা লাগলে বস্তা গায়ে দিবো।”
-“হা হা হা। বস্তা গায়ে দিবেন? কি ভয়ংকর সুন্দর লাগবে আপনাকে!”
-“বস্তা গায়ে দিলে ভয়ংকর সুন্দর লাগবে? তুমি মেয়েটা ভারি দুষ্টু আছো।”

মিশু হেসে উঠলো আবারো। ট্রাকটা যতই শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে,শীত তত বেড়ে যাচ্ছে। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেও যাওয়া যেতো কিন্তু ওখানে বসলে কোনো থ্রিলই নেয়া যেতো না। জোৎস্না উপভোগ করার জন্যই ট্রাকের উপরে ওঠা। ভোরের দিকে ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায় এখন বেশ শীত লাগছে। কুয়াশাও যেমন পড়েছে,বাতাসের জোরও সেরকম। কতক্ষণ কুলোনো যায়? মেঘালয়ের ঠাণ্ডা লেগে গেলে ব্যাপারটা কেমন হবে? কিন্তু লোকটা তো কিছুতেই চাদর নিচ্ছেনা। কি উপায় এখন? একটু ভেবেচিন্তে মিশু বললো, “একটা কথা বলি?”
-“হুম বলো।”

মিশু আমতা আমতা করে লাজুক স্বরে বললো, “আমার চাদরের ভেতরে আসতে আপনার কি সমস্যা হবে?”

মেঘালয় চমকালো। কখনো কোনো মেয়ের সাথে এক চাদরে শরীর মুড়িয়ে বসে থাকা হয়নি। মায়ের কোলে মাথা রেখে অনেক ঘুমিয়েছে কিন্তু একই চাদরে একটা মেয়ের সাথে বসা থাকা, ভাবলেই কেমন শিহরণ জাগে। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে ওঠে। হার্টের বিট বেড়ে যেতে থাকে।

মিশু বললো, “একটা চাদর গায়ে মুড়িয়ে দুজনে বসে থাকলে দুজনেরই ঠাণ্ডা কম লাগবে। আপনার আপত্তি না থাকলে এটা করতে পারেন। আর নয়ত চাদরটা নিন।”

মেঘালয় চুপ মেরে রইলো। চাদর কিছুতেই নেবেনা। এটা ওকে দিয়ে কক্ষনো হবেনা। আর একই চাদরে বসে থাকাটাও সংকোচ জনক ব্যাপার। মেঘালয় যখন নিশ্চুপ হয়ে এসব ভাবছে, মিশু কাছে এসে মেঘালয়ের শরীরের সাথে লেগে গেলো একেবারে। তারপর চাদরটা দুজনের গায়ের উপর মুড়িয়ে নিলো। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো মেঘালয়। কুয়াশা পড়ছে টুপটুপ করে। একটা চাদরে দুজনে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা, উত্তেজিত হয়ে পড়ছে সে। একদিকে বাতাসে হিম হয়ে আসছে শরীরটা। চাদরটা ফেলে দিতেও পারছে না, মিশু একহাতে শক্ত করে চাদর চেপে ধরে রেখেছে। গায়ে মুড়িয়ে নিয়েছে ভালোমতো।

মেঘালয় কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো, “শাহজাদপুর চলে এসেছি। সকাল হতে হতেই রংপুর পৌছে যাবো।”
-“ভালোই হবে। রাতে নদীতে ভেসে জোৎস্না দেখার পর পরেরদিন সকালে আমি বাসায় চলে যাবো।”
-“বেশ। তবে আর কখনো বাবা মাকে মিথ্যে বলে কোথাও যেওনা। একটা বিপদ ঘটে গেলে ওনারা কোথায় তোমাকে খুঁজত বলো?”
-“আর কখনো যাবো না। যাওয়ার প্রয়োজন ও পড়বে না।”

ঠাণ্ডা বাতাসে মিশু মেঘালয়ের আরো কাছে সরে এলো। মেঘালয়ের উষ্ণ শরীরের সাথে বাহু লেগে আরামবোধ হচ্ছে। মেঘালয় একটু নড়াচড়াও করছে না। এরকম পরিস্থিতিতে জীবনে প্রথমবার পড়েছে সে। সংকোচ লাগছে, লজ্জাও লাগছে। নিশ্চুপ হয়ে ঠায় বসে রইলো।

গাড়ি একবার জোরে ব্রেক কষতেই মিশু পিছনে বস্তার উপর ধপ করে পড়ে গেলো। একই চাদরে থাকায় আর চাদরের মাথাটা মিশুর হাতের মুঠোয় থাকার দরুন মেঘালয় ও পিছনে মিশুর গায়ের উপর এসে পড়লো। মিশু চোখ মেলে ওর মুখের সামনে মেঘালয়ের মুখটা দেখতে পেয়ে কেঁপে উঠলো একবার। তারপর চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে ওর। মেঘালয় এরকম পরিস্থিতিতে পড়ে অপ্রস্তুত বোধ করছে ভীষণ। মিশু চাদর দুজনের গায়ে পেঁচিয়ে চাদরের মাথাটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে রেখেছে। কাজেই চাইলেও মেঘালয় উঠতে পারছে না। কিরকম সংকোচজনক একটা ব্যাপার। ট্রাক দুলছে, মেঘালয়ের বুকের নিচে চাপা পড়ে গেছে মিশু। প্রশস্ত শরীরের নিচে চাপা পড়ে পুঁচকে মেয়েটার না দম বন্ধ হয়ে যায় আবার।

মেঘালয় হাত দিয়ে চাদরটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। মিশু চোখ মেলে তাকালো এবার। মুখের উপর মেঘালয়ের গরম নিশ্বাস পড়ছে। চোখ মেলতেই হলুদাভ চেহারাটা দেখে আরেকবার কেঁপে উঠলো। এতটা হ্যান্ডসাম ও কেউ হয়! মাথা খারাপ করা হ্যান্ডসাম ছেলেটা। কি পরিমাণ স্মার্ট, দেখলে হা করে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। প্রশস্ত কপালের উপর সিল্কি চুলগুলো উড়ছে, ইচ্ছে করছে….

মিশু মুখটা কাচুমাচু করে ফেললো। গোল হয়ে ‘o’ এর মত হয়ে গেলো মুখটা। মেঘালয়ের শরীরের গন্ধটা দারুণ, স্বর্গীয় একটা সুবাস মিশে আছে শরীরে। ওনাকে দেখলে যেকোনো মেয়ে একবার তাকাবে। মেয়েদেরকে পাগল করার মত সবগুলো গুণ ওনার আছে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে এসবই ভাবছে মিশু। মেঘালয় বলল, “চাদরটা ছাড়ো।”

মিশু লজ্জা পেয়ে চোখ বুজে ফেললো। হাতের বাধন আলগা করে দিয়ে ছেড়ে দিলো চাদরটা। মেঘালয় টানাটানি করে চাদর থেকে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করলো। তবুও পারলো না। দুটো প্যাঁচ দিয়ে গায়ে মুড়িয়ে নিয়েছে, একটা দিক মিশুর গায়ের নিচে। টানাটানি করেও কোনো লাভ হচ্ছেনা। মিশু চোখ বন্ধ করেই আছে। মেঘালয় ওর মুখের দিকে তাকালো।

কয়েক মুহুর্ত পর চোখ মেললো মিশু। এবার আবিষ্কার করলো মেঘালয়ের তীক্ষ্ণ মায়াবী দৃষ্টি। বিপজ্জনক রকমের চোখ দুটো চেয়ে আছে ওর দিকে। চোখাচোখি হয়ে গেলো খুব কাছ থেকে। বুকের ভেতর জোরে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। হার্ট আবার যেন ফেটে না যায়। সিনেমায় সাধারণত এমন হয়,নায়ক নায়িকা এরকমভাবে একে অপরের দিকে হা করে চেয়ে থাকে। তারপর দুজনেই মুচকি হেসে সরি বলে,মন দেওয়ানেওয়া হয়, তারপর প্রণয়, তারপর ছবি শেষ। এখানে তো তেমন হবেনা কখনো, ওটা সিনেমা বলেই সম্ভব হয়। বাস্তবে কক্ষনো এমন হয়না। ফিক করে হেসে ফেললো মিশু।

মেঘালয় থতমত খেয়ে বললো, “হাসছো যে?”
-“ব্যাপারটা সিনেম্যাটিক।”

মেঘালয় হা হা করে হাসি শুরু করে দিলো। মিশু আস্তে করে ওঠার চেষ্টা করলে মেঘালয় এক হাতে ওকে ধরে টেনে তুলে সোজা হয়ে বসলো। মিশুর মাথাটা এসে ঠেকলো মেঘালয়ের বুকের সাথে। একটা অন্যরকম অনুভূতি! আচ্ছা, মিশুর এত ভালো লাগছে কেন?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here