হৃদমোহিনী
পর্ব ২৫
মিশু মনি
.
৩১.
হোটেল থেকে বেড়িয়ে মেরিন ড্রাইভের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো ওরা। মিশু একটা হালকা গোলাপি রঙের জামা পড়ে পুতুলের মত সেজেছে। মেঘালয়ের পাশে বসে উৎসুক চোখে বাইরে তাকিয়ে রইলো ও।
মেরিন ড্রাইভ রোডে গাড়ি ওঠার পর থেকেই মিশু ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগলো। একদিকে সমুদ্র, একদিকে পাহাড়! নীলাকাশ সাগরের নীলে নেমে এসেছে দেখে এক মু্ুহুর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। নেমে যাওয়ার জন্য লাফালাফি শুরু করে দিলো মিশু। মেঘালয় গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো মাঝ রাস্তায়।
রাস্তাটা মোটামুটি ধরণের চওড়া, একদিকে গাছের সাড়ি। সমুদ্রের ঢেউ আচড়ে পড়ছে তীরে আর অপরদিকে পাহাড়। একবার পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আরেকবার সমুদ্রের দিকে তাকালো মিশু। কোনদিকে যাবে বুঝে উঠতে পারলো না। মেঘালয় ওকে হাত ধরে সমুদ্রের দিকে নিয়ে গেলো। সমুদ্রে এসে দূরন্ত কিশোরীর মত পা ভিজিয়ে দৌঁড়াতে লাগলো মিশু। এখানে সমুদ্র অনেক শান্ত, কিন্তু রূপ যেন আরো অনেক বেড়ে গেছে। মেঘালয় সেলফি তোলার জন্য পকেটে হাত দিয়ে মুখটা করুণ করে বললো, ‘ধেৎ আমার তো ফোনই নেই।’
মেঘালয়ের মুখ দেখে প্রচন্ড খারাপ লাগলো মিশুর। ও বললো, ‘মন খারাপ করবেন না প্লিজ। সব আমার জন্য হয়েছে।’
মেঘালয় মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘পাগলী টা এভাবে বলেনা। তোমার জন্য আমি জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি সেখানে একটা ফোন?’
মিশু হেসে বললো, ‘আপনি খুব ভালো। আচ্ছা আমার ব্যাগে তো মৌনি আপুর ফোনটা আছে, ওটা দিয়ে সেলফি তুলি?’
– ‘আচ্ছা তুমি এখানে থাকো আমি গাড়ি থেকে ফোনটা নিয়ে আসি।’
মিশু বাঁধা দিয়ে বললো, ‘আমার একটু চুলগুলো ঠিক করতে হবে। আপনি এখানে থাকুন, আমিই ফোনটা নিয়ে আসছি।’
– ‘আচ্ছা।’
মেঘালয় একটা পাথরের উপর বসে সমুদ্রের জলে পা ভেজাতে লাগলো। দূরে দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত সমুদ্র আর পাহাড়। এখানে নীল ছাড়া আর কিছুই নেই। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনটা কেমন যেন করে ওঠে।
মিশু গাড়িতে উঠেই বুঝতে পেলো ফোনে রিং হচ্ছে। দ্রুত ব্যাগের চেইন খুলে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো একটা নাম্বার থেকে কল আসছে, Oyontika নামে।
মিশু একটু ভেবে কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটা মিষ্টি স্বর ভেসে আসলো, ‘হ্যালো আপু..’
মিশু কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো, ‘হ্যালো..’
ওপাশের মিষ্টি কণ্ঠের মেয়েটি বললো, ‘আপুউউউ। আমি কতবার ফোন দিলাম রিসিভ কেন করলে না? তোমরা এত নিষ্ঠুর কেন?’
মিশু চুপ করে শুনে গেলো। যখনই বলতে যাবে আমি আপু নই। তার আগেই মেয়েটি বললো, ‘আপু গো, মেঘের নাম্বার বন্ধ কেন পাঁচদিন ধরে? বাধ্য হয়েই তোমাকে কল দিলাম। মেঘের কি হইছে আপু? কিছু বলছো না কেন?’
মিশু চমকে উঠলো এবার। কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা নিয়ে মেয়েটি প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। সে এত করে মেঘালয়ের খোঁজ করছে কেন? প্রশ্নটা কানে আসতেই খটকা লাগলো বুকে। মিশু আরেকবার বললো, ‘হ্যালো।’
মেয়েটি বললো, ‘আপু বলোনা মেঘ কোথায়? ওর নাম্বার কেন বন্ধ? সবাই মিলে সেই যে বিয়ে বাড়িতে গেলে তারপর থেকেই বন্ধ। আচ্ছা ও এতটা স্বার্থপরের মত আচরণ কিভাবে করতে পারে? আমার সাথে একবার যোগাযোগ করবে না? পূর্ব ভাইয়াকে কল দিলাম সেও রিসিভ করলো না। আমার প্রচুর টেনশন হচ্ছে আপু।’
মিশুর বুকটা চিনচিন করে উঠলো। কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন যেন অস্থির লাগতে শুরু করেছে। মেঘালয়কে নিয়ে অন্যকেউ টেনশন করবে সেটাও অসহ্য লাগবে ওর। কে এই মেয়েটা?
মিশু বললো, ‘একটু কথা বলার সুযোগ দিন প্লিজ। আমি মৌনি নই, আপুর ফোনটা আমার কাছে।’
মেয়েটি দ্রুত জবাব দিলো, ‘মানে! আপনি আবার কে?’
মিশু কিছু না ভেবেই বললো, ‘আপনি কে?’
– ‘আমি মৌনি আপুর রিলেটিভ। আমার নাম বললেই আপু চিনবে।’
– ‘আপু এখানে নেই। উনি ঢাকায় গেছেন।’
– ‘মানে! আপু ঢাকায় আর আপুর ফোন রংপুরে? আপনি কে? আপনার কাছে আপুর ফোন কেন? একজনের নাম্বার বন্ধ, আরেকজনকে পাওয়া যাচ্ছেনা। সে ফোন রংপুরে রেখে ঢাকায় এসেছে। এসব হচ্ছেটা কি?’
মিশু বললো, ‘একটু কথা বলার সুযোগ দিলে সবকিছু বলি?’
মেয়েটি ঝটপট জবাব দিলো, ‘সরি। আসলে আমি প্রচুর টেনশনে আছি তাই এত প্রশ্ন করছি। খুলে বলুন তো কি হয়েছে?’
মিশুর খুব অস্থির লাগছিলো মেয়েটির কথা শুনতে শুনতে। তবুও বললো, ‘আমিও ওনার রিলেটিভ। আমাকে চিনবেন না। আপুর একটু দরকারে বাসায় যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। আর ওনার ভাইয়ের ফোনটা হারিয়ে গেছে বলে ওনার ফোনটা ভাইকে দিয়ে গেছেন।’
মেয়েটি অবাক হয়ে বললো, ‘হারিয়ে গেছে! উফ শিট। এনিওয়ে মেঘ কোথায়? তাকে ফোনটা দিন না।’
মিশুর বুকে এসে বিঁধলো কথাটা। ঢোক গিলে বললো, ‘উনি একটু দূরে আছেন। আমি ওনাকে আপনার কথা বলে কল দিতে বলে দিচ্ছি।’
– ‘প্লিজ এক্ষুণি যদি বলতেন? মেঘ ভালো আছে তো?’
– ‘হুম।’
মিশুর কেমন লাগছে সেটা নিজেই বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটা কে হতে পারে আন্দাজ করতে পারছে ও। তবুও একবার প্রশ্ন করেই ফেললো, ‘আচ্ছা আপনি মেঘালয়কে নিয়ে এত টেনশন করছেন কেন?’
মেয়েটি বললো, ‘ওইটা আমার কলিজা। আমার সবকিছু। আমি টেনশন করবো না তো কে করবে? এত্তদিন ধরে ফোন অফ আর সে একবার ফোনও দিচ্ছেনা। কাইন্ডলি একটু তাকে ইনফর্ম করুন। প্লিজ? ‘
মিশুর বুকে যেন সমুদ্রের ঢেউ আচড়ে পড়লো এসে। একটা মেয়ে এতটা ভালোবাসে অথচ তাকে ভূলে দিব্যি নতুন বউকে মেনে নিয়েছে। এমন ভাব ধরছে যেন এর আগে কখনও কারো প্রেমে পড়েনি। মেঘালয়ের প্রেমিকা থাকতে পারে কথাটা কখনও ভেবে দেখেনি মিশু। এখন কোনো এক অজানা কারণে খুব কষ্ট হচ্ছে। যদিও মেঘালয় এখন ওর। কিন্তু এত নিঁখুত অভিনয় কেউ কিভাবে করতে পারে! মেয়েটাকে ভূলে গিয়ে… আর ভাবতে পারছে না মিশু। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে এলো।
মেঘালয়ের কাছাকাছি আসতেই বুকের ভেতরটা আরো বেশি চিনচিন করছিলো। মেঘালয় এমন একটা মানুষ যাকে ভালো না বেসে থাকা যায়না। আর ভালোবাসলে তাকে নিয়ে কেউ টেনশন করুক সেটাও সহ্য হয়না। সবকিছু কেন এমন হলো! ওর একটা পুরনো প্রেমিকা না থাকলে কি এমন হতো?
মেঘালয় বললো, ‘কি সমস্যা?’
মিশু চমকে উঠে ফোনটা এগিয়ে দিলো মেঘালয়ের দিকে। মেঘালয় ক্যামেরা অন করে সেলফি নিতে যাবে এমন সময় মিশু বললো, ‘পরে ছবি তুলুন। আগে একটা জরুরি কল করে নিন।’
মেঘালয় উৎসুক চোখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেউ ফোন দিয়েছিলো?’
– ‘হুম, অয়ন্তিকা নামে একজন।’
চমকে উঠলো মেঘালয়। চোখাচোখি হয়ে গেলো মিশুর সাথে। মেঘালয়ের বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। মিশুর চোখেমুখে অন্যরকম একটা চাপা অভিমান ফুটে উঠেছে। তারমানে অয়ন্তিকা কিছু উলটা পালটা বলে ফেলেছে! এমনিতেই মিশু অনেক সেনসিটিভ একটা মেয়ে, অয়ন্তিকা আরেক পাগলী। দুজনের মনের অবস্থার কথা ভেবে এদিকে সেদিক তাকালো মেঘালয়।
মিশু মেঘালয়কে রেখে ধীরেধীরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেলো। সমুদ্রের তীর ঘেষে হাঁটতে লাগলো আর নানান প্রশ্ন জাগতে লাগলো মনে। ভীষণ মন খারাপ লাগছে হুট করেই। কেন এই মেয়েটার উদ্ভব হলো! মিশু শুধু নিজের মনের কথা ভাবছে না। মেঘালয়ের অপ্রস্তুত হওয়ার কথা, অয়ন্তিকার মনের অবস্থা সবটাই ভেবে দেখছে। সব ভেবে প্রচন্ড খারাপ লাগছে ওর।
মেঘালয় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মিশু হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে গেছে। তীর ঘেষে হাঁটছে আর মাঝেমাঝে নিচু হয়ে শামুক কুড়িয়ে নিচ্ছে জল থেকে। পিছন থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা মেয়েটির মন খারাপ নাকি ভালো। তবে খুব চুপচাপ হয়ে গেছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
মেঘালয় অয়ন্তিকাকে কল দিয়েই বললো, ‘হ্যালো অয়ন, ফোন দিয়েছিলে? আমি আসলে একটু ঝামেলায় আছি।’
অয়ন্তিকা বললো, ‘তুমি কি মানুষ? একবার ফোন দিতে হয়না?’
– ‘অয়ন আমি বিয়ে করেছি।’
– ‘তো?’
তো বলার পরপরই চেঁচিয়ে উঠলো অয়ন্তিকা- ‘হোয়াট! বিয়ে মানে! ফাজলামি করছো?’
মেঘালয় বললো, ‘আমি সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে ফাজলামি করিনা। গত কয়েকদিন আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আরাফের নাম্বারে কল দিয়ে আপুর সাথে কথা বলে সবটা জেনে নিও। আমি এখন ওয়াইফের সাথে কক্সবাজারে আছি। এখন রাখি, আর হ্যা উলটা পালটা কিছু কোরো না।’
অনেক্ষণ অয়ন্তিকার কোনো কথা শোনা গেলো না। মেঘালয় আরেকবার বললো, ‘অয়ন উলটা পালটা কিছু কোরোনা।’
– ‘তুমি হুট করে বলবা বিয়ে করেছো আর আমি কিছু করবো না?’
– ‘তুমি আমার গার্ল ফ্রেন্ড নও যে তোমার কথা ভেবে আমাকে কিছু করতে হবে।’
অয়ন্তিকা হঠাৎ কেঁদে ফেললো, ‘এত নিষ্ঠুর ভাবে না বললেও পারতে মেঘ।’
– ‘অয়ন আমার ওয়াইফ কাঁদছে। মেয়েটা অনেকটা পাগলী আছে। বাচ্চা মেয়ে, কেঁদে বুক ভাসাবে। তুমি আর ফোন দিওনা।’
– ‘মেঘ, এরকম কেন হলো?’
– ‘কিছু করার নেই।’
অয়ন্তিকার কান্নাভেজা গলা শোনা গেলো। কিন্তু মেঘালয় কল কেটে দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো৷ এতটা নিষ্ঠুরভাবে না বললেও হতো। কিন্তু মিশুর কষ্টটা এখন অয়ন্তিকার কষ্টের চেয়েও বেশি মনেহচ্ছে। কারণ মেঘালয় মিশুকে ভালোবাসে। ব্যাপারটা এখানে মিটিয়ে দিলেই ভালো হয়।
আবারও বেজে উঠলো ফোনটা। ব্যাপারটা সত্যিই বেদনাদায়ক। প্রিয় মানুষটার হুট করে বিয়ের খবর শুনলে কোনো মেয়ের পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব না। মেঘালয় রিসিভ করে বললো, ‘অয়ন আমার ফোন নেই। তুমি ফোন দিলে এটাও বন্ধ করে রাখতে হবে।’
– ‘কিন্তু..’
– ‘প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো। সবটা আপুর কাছে শুনে নিও।’
কল কেটে দিয়ে মেঘালয় তাকালো মিশুর দিকে। তাকানো মাত্রই ভয়ে শরীর কাটা দিয়ে উঠলো মেঘালয়ের। আশেপাশে চারিদিকে শুধুই শূন্যতা। উপরে মহাশূন্য আর সামনে বিশাল সমুদ্র। মিশু কোথায় গেলো? বুকটা ধক করে উঠলো ওর। সমুদ্রে ততটা ঢেউও নেই, শান্ত হয়ে আছে সমুদ্রটা। তাহলে মিশুর কি হলো?
চিন্তিত মুখে পাগলের মত তাকাতে লাগলো এদিক সেদিক। মিশুকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। মেয়েটার মাথাটা এমনিতেই খারাপ, আবার রাগে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েনি তো? মেরিন ড্রাইভ রোডটাও ফাঁকা, আশেপাশে পাহাড় আর সমুদ্র চারিদিকেই ফাঁকা। কোথাও কোনো জনমানব নেই। একটা মেয়ে একা কোথায় চলে গেলো? এলাকাটাও তেমন সুবিধার না, প্রচন্ড রিস্কি। শংকায় বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো মেঘালয়ের।
চলবে..