হৃদমোহিনী
পর্ব ২১
মিশু মনি
.
২৬.
সূর্যাস্ত পর্যন্ত সৈকতে কাটিয়ে হোটেলে ফিরলো মেঘালয় ও মিশু। নাস্তা করার পর রুমে এসে মিশু আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলো।

মেঘালয় বিছানায় বসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মিশুর দিকে। তারপর উঠে এসে আয়নায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তোমাকে কিছু কথা বলার আছে। নেগেটিভ ভাবে নেবে না তো?’

মিশু চমকে উঠে বললো, ‘আপনি কি নেগেটিভ ভাবে নেয়ার মত কিছু বলেন নাকি? আপনার উচ্চারিত প্রত্যেকটা বাক্যই তো আমার কাছে শিব খেরার বানী মনেহয়।’
– ‘হা হা হা। মিশু সিরিয়াসলি কিছু কথা বলবো। তোমাকে এগুলো বলার এখনই উপযুক্ত সময়।’
– ‘হুম বলুন।’

মেঘালয় এগিয়ে এসে মিশুকে ধরে বিছানায় নিয়ে গিয়ে বসালো। তারপর মিশুর মুখোমুখি হয়ে বসে বললো, ‘আমার কথাগুলো সহজভাবে নেবে মিশু।

মিশু তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘গুরু যেমন তার শিষ্যও তেমন। বলুন না শুনি?’

মেঘালয় একটু থেমে বললো, ‘তুমি নিজেকে কতটা স্মার্ট ভাবো?’

একবার মেঘালয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মুহুর্তেই আবারও দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো মিশু। এর উত্তর চট করে দেয়া যায়না। অন্য সময়ে হলে মিশু অবশ্যই নিজেকে স্মার্ট বলে দাবি করতো। কিন্তু মেঘালয়ের কাছে স্মার্টনেসের সংজ্ঞা শোনার পর থেকে আর নিজেকে সরাসরি স্মার্ট বলতে পারছে না। একটু চুপ থেকে বললো, ‘উহু, আমি ততটা স্মার্ট নই।’

মেঘালয় মুচকি হেসে মিশুর হাতদুটো চেপে ধরে বললো, ‘মিশু, আমার সাথে থাকতে হলে যে তোমার নিজেকে একটু বদলাতে হবে।’

চোখ তুলে মেঘালয়ের দিকে তাকালো মিশু। চোখে অজস্র প্রশ্ন। অবাক হয়ে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললো, ‘নিজেকে বদলাতে হবে?’

মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘আমার কথার ভূল অর্থ দাড় করিয়ো না। আগে ভালো করে বোঝো। আমরা সবাই বলি যে, আমরা যেমন আছি সেরকমই থাকবো। যে আমাদেরকে ভালোবাসবে সে এভাবেই ভালোবাসবে। কথাটা একদম সত্যি, কিন্তু তুমি যে লেভেলে আছো সেই লেভেলের কেউই তোমাকে ভালোবাসবে। তোমার চেয়ে একটু উপরের কারো ভালোবাসা পেতে চাইলে তোমাকে অবশ্যই তার মতই হতে হবে। মনে করো, একটা মেয়ে শুধুমাত্র একজন স্টুডেন্ট, স্কুল যায় খায় আর ঘুমায়। তার জীবনে কোনো বিশেষ লক্ষ্য নেই, স্বপ্ন পূরণের তাগিদ নেই। বড় হওয়ার তীব্র ইচ্ছা তার মাঝে নেই। তুমি ঘুমাতে প্রচুর ভালোবাসো। কোন জায়গায় কিরকম কথা বলতে হয় সেই জ্ঞানটাও তোমার নেই। তোমাকে এমন একজন ছেলেই ভালোবাসবে যার নিজেরও জীবনে সেরকম কিছু করার স্বপ্ন নেই। কিন্তু যে ছেলেটা আজীবন নিজেকে গড়ে তুলেছে, লড়াই করেছে, প্রত্যেকটা স্বপ্ন দৃঢ়তার সাথে পূরণ করেছে সে কি এরকম একটি মেয়েকে ভালোবাসবে? কখনোই না। সে সবসময়ই চাইবে তার লেভেলের একটি মেয়েকে গ্রহণ করতে। বুঝতে পেরেছো?’

মিশু নিশ্চুপ হয়ে শুনছে। তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। মেঘালয় একটু বাদে আবারও বললো, ‘আমি আমাকে গড়ে তুলেছি পাক্কা দেড় বছর সময় নিয়ে। আমার এই এথলেটদের মত বডি বানাতে গিয়ে আমাকে কম পরিশ্রম করতে হয়নি। আমি আমার মানসিক অবস্থা এমন জায়গায় এনেছি যেখানে দুশ্চিন্তা আমাকে কাবু করতে পারেনা। সবসময়ই আমি প্রসন্ন আর সব জায়গায় সমাদৃত। তুমি হয়ত জানো যেকোনো ব্যক্তি একবার আমার সাথে কথা বললে আবারো কথা বলার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারণ আমার গলার স্বর স্পষ্ট, আমার উচ্চারিত প্রত্যেকটা বাক্যই অন্যকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। আমি এই মেঘালয়কে গড়ে তুলেছি পাক্কা দেড় বছর সময় নিয়ে। আমি যে মেয়েটাকে নিয়ে চলাফেরা করবো সে যদি আমার মত না হয় তাহলে আমার সম্মান ক্ষুন্ন হবে। কারণ, লোকজনের সামনে যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলে তখন আমার ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগবে। আমি তোমাকে নিয়ে কমফোর্ট ফিল করবো না।’

মিশুর চোখ ভিজে উঠেছে। মেঘালয় যা বলছে সবই সত্যি। মেঘালয়ের কথা একবার শুনলে আবারো শুনতে ইচ্ছে করে, অকপটে সত্য বলতে পারে মানুষটা। আর গলার স্বরেও রয়েছে মাধুর্যতা যা দ্রুত আকর্ষণ করে। হাঁটাচলা, কথা বলার স্টাইল সবকিছুতেই অন্যরকম বিনয়ীভাব ফুটে উঠে। তাই ওকে সবার থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। আর সবার থেকে আলাদা মানুষটা কখনওই যে সে মেয়েকে গ্রহণ করবে না। সে চাইবে তার পাশে তার মতই কেউ থাকুক যে তাকে বুঝবে। শৈল্পিক এই মানুষটা নিশ্চয়ই যাকে তাকে নিয়ে চলতে পারবে না। ভাবতে ভাবতে চোখের জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।

আমরা নিজেকে যা ভাবি আমরা সেটা নই। বরং আমরা যা চিন্তা করি আমরা সেটাই। চিন্তাশক্তি আর ধ্যানধারণা, জ্ঞান এসবই বলে দেয় আমি আসলে কি? আমি যা চিন্তা করবো সে অনুযায়ী ই আমার মুখ দিয়ে বের হবে, সেটাই আমার আচরণে প্রকাশ পাবে। আর এর দ্বারা মানুষ বুঝতে পারবে আমি আসলে কি? মেঘালয়ের চিন্তাশক্তি ও ধ্যান ধারণা অনেক উঁচু মানের। সে স্বাভাবিকভাবেই তার মতই কাউকে ভালোবাসবে। আনমনা হয়ে এসব ভাবছে মিশু আর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

মেঘালয় মিশুর মুখটা ধরে আলতো করে ঠোঁট রাখলো মিশুর চোখের নিচে। আর গভীর আবেশে মিশুর চোখের জল নিজের ওষ্ঠে তুলে নিলো। মিশু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মেঘালয় ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘এই পাগলী কাঁদছো কেন?’
– ‘আপনি অনেক বড় মনের মানুষ। আমি কখনও আপনার মত হতে পারবো না।’
– ‘শোনো মেয়ে, আমাদের হার্টটা আল্লাহ দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু হৃদয়টাকে বড় করতে পারার ক্ষমতাটা আমাদের মধ্যেই আছে। শুধুমাত্র অভ্যেস আর অনুশীলন দরকার।’
– ‘আমার তেমন কোনো ভালো অভ্যেস নেই।’
– ‘খারাপ অভ্যেস আছে?’
– ‘তা আছে।’

মেঘালয় বললো, ‘আমরা যা করি সেটাই আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। আর অভ্যাস আমাদের চরিত্র গঠন করে। আমার এতদিনের সমস্ত অভ্যাসের গুণেই আজ সবার কাছে আমি ভালোবাসার পাত্র। আমাদের বিয়ের সময় যদি একবার আমাকে কথা বলার সুযোগ দিতো বিয়েটা কিছুতেই হতোনা। তোমার বাবা তো ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।’

মিশু কিছু বললো না। শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা সত্যি। মেঘালয় বললো, ‘আমি অবশ্য এরজন্য আফসোস করিনা। কারণ ভাগ্যের উপরও বিশ্বাস রাখতে হয়। আজকে তোমার আমার বিয়েটাও নিশ্চয়ই ভালো কিছুর জন্যই হয়েছে।’

মিশুর কিছুই বলার নেই। একটা মানুষ কতটা ভালো হলে এত সুন্দর করে ভাবতে পারে? মেঘালয়ের পাশে থাকতে পারার মত সৌভাগ্য অর্জন করে সত্যিই ভাগ্যবতী মনেহচ্ছে নিজেকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here