হৃদমোহিনী
পর্ব ১৯
মিশু মনি
.
২৩
সাদা তুলতুলে পশমী সোয়েটার ও লাল টুপিতে মিশুকে খরগোশের বাচ্চার মতন লাগছে৷ ঠোঁট দুটো অসম্ভব রকমের গোলাপি, কালো জিন্সের উপর সাদা সোয়েটার। মাথায় লাল রঙা টুপি, পায়ে কালো কেডস, কানে সাদা ইয়ারফোন। একেবারে খুকি খুকি ভাব চলে এসেছে চেহারায়।
বাস ছাড়ার পর থেকেই মিশু কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে৷ ছোটবেলার গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে মেঘালয়কে। মিশু ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বকবক করতো। বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে নিজের বাড়ি পেড়িয়ে অনেক দূর চলে যেতো। এরপর যখন বুঝতে পারতো বাড়ি পার হয়ে এসেছে তখন আবার ফিরে আসতো। কথা বলতে প্রচুর ভালোবাসে এই মেয়েটা। তন্ময়ের প্রতারণার শিকার হওয়ার পর থেকে হুট করেই কেমন যেন চুপসে গেছে৷ মেঘালয় খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে মিশুর কথাগুলি। মেয়েটা কথা বলার সময় সমানতালে দুহাত নাড়াতে থাকে৷ ভালোই লাগে ব্যাপারটা।
মিশু কথা থামিয়ে বললো, ‘এই কি দেখছেন এভাবে?’
– ‘তোমাকে আজকে খরগোশের বাচ্চার মতন লাগছে।’
– ‘আমার আব্বুকে আপনার খরগোশ মনেহয়?’
– ‘ছি ছি আমি মোটেও এরকম বলিনি।’
– ‘আমি বুঝি। আমাকে পুতুলের মতন লাগছে না?’
– ‘হুম। ইচ্ছে করছে কোলে বসিয়ে নিয়ে আদর করি।’
– ‘কোলে উঠি?’
মেঘালয় মুচকি হেসে বললো, ‘রাত নামুক। বাসের লাইট নিভিয়ে দিলে কোলে নিবো।’
মিশু লজ্জায় মাথাটা ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মেঘালয়কেও আজ দারুণ হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। গালের খোঁচা খোঁচা চাপদাড়ি গুলো আগের চেয়েও সুন্দর দেখাচ্ছে। মিশুর ইচ্ছে করছে গালটা ওর গালের সাথে ঘষে দিতে৷ রাত কখন নামবে?
মেঘালয় বললো, ‘আমি এজন্মে কখনও ভাবিনি এভাবে আমার বিয়ে হবে। কি অদ্ভুতভাবে সবকিছু ঘটে গেছে। অবশ্য যা হয়েছে ভালোই হয়েছে৷ শীতকালে এরকম একটা কোলবালিশ দরকার ছিলো।’
মিশু মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে বললো, ‘আপনি অনেক ভালো।’
মেঘালয় মিশুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার ঠোঁটদুটো এত লোভনীয় লাগছে কেন? ইচ্ছে করছে কামড়ে শেষ করে দেই।’
শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করলো মিশু। কি সব বলে এই লোকটা! একটুও লজ্জা নেই। লাজুক স্বরে আমতা আমতা করে মিশু বললো, ‘আমার একটা অদ্ভুত ইচ্ছে আছে।’
মেঘালয় কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো কি ইচ্ছে? মিশু বললো, ‘আমার খুব ইচ্ছে একটানা একদিন ধরে শুধু চুমু খাবো।’
মেঘালয় অবাক হয়ে অস্ফুট স্বরে বললো, ‘চব্বিশ ঘন্টা! একটানা চব্বিশ ঘন্টা? এটা কি আদৌ সম্ভব?’
– ‘হুম। আলতো করে স্পর্শ করলেই সম্ভব। এই একদিন গোসল বন্ধ, রুম থেকে বের হওয়া বন্ধ। এমনকি খাওয়াদাওয়াও বন্ধ, শুধু চুমু খেয়ে থাকবো।’
মেঘালয় হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো, ‘ওকে ডান। কক্সবাজারে পৌঁছাতে দাও আগে। তোমার সমস্ত ইচ্ছে পূরণ করা হবে। আর কিছু আছে?’
মিশু মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘না।’
– ‘আমার আছে। চাপ সামলানোর জন্য প্রস্তুত হও।’
মিশু দুহাতে মেঘালয়ের বুকে কিল বসাতে বসাতে বললো, ‘খারাপ। প্রচন্ড রকমের খারাপ।’
– ‘তুমি বললে কিছুনা আর আমি বললেই খারাপ?’
– ‘হ্যা। আপনি একটা জঘন্য।’
– ‘এই জঘন্য লোকটাকেই গ্রহণ করতে হবে।’
– ‘চুপ করুন দোহাই লাগে৷ আমার লজ্জা করছে।’
– ‘বাহ! তোমার একটানা চব্বিশ ঘন্টা লাগবে সেটা বলতে লজ্জা নাই আর আমি বললে লজ্জা?’
মিশু মেঘালয়ের বুক বরাবর একটা ঘুষি দিয়ে বললো, ‘চুপ। একদম চুপ। আমরা খুব অশ্লীল হয়ে গেছি।’
– ‘হা হা হা৷ বর বউ বুঝি কখনো অশ্লীল হয়?’
– ‘আপনি আমার বর টর না। এবার চুপ করে বসুন তো। একটু শান্তি দিন।’
– ‘ওকে। তুমিও আমার বউ টউ না। আমরা একে অপরকে চিনিনা। ডান?’
– ‘ওকে ডান।’
দুজনেই মুচকি হেসে দুজনের মত দুদিকে মাথা রেখে বসে গেলো। মিশু একেবারে জানালার কাছে মাথা রেখে বসে পড়লো আর মেঘালয় সিটের একেবারে এক কোণায় বসলো। দুজনের মাঝে এক হাত ফাঁকা জায়গা। কেউ আর কারো দিকে তাকাচ্ছে না। এমন ভাব যেন কেউ কাউকে চেনেও না।
মিশু ইয়ারফোনে গান ছেড়ে দিয়ে জোরে সাউন্ড দিয়ে শুনতে লাগলো। জানালা দিয়ে শিরশির করে বাতাস এসে গায়ে লাগছে। ঠান্ডা লাগলেও ভালো লাগছে অনেক। এদিকে মেঘালয়ের কাছে কোনো ফোনও নেই। সে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কেউ কারো সাথে কথা বলেনি এখনো। দুজনেই জার্নিটাকে এনজয় করছে। সন্ধ্যা নামার পর বাসের জানালা বন্ধ করে দিতে হলো। মেঘালয় একবার মিশুর দিকে তাকাচ্ছেও না। বাইরে অন্ধকার নেমেছে বলে আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকাও যায়না। মিশু কান থেকে ইয়ারফোন খুলে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এক্সকিউজ মি?’
মেঘালয় চমকে উঠে বললো, ‘অফ কোর্স।’
– ‘হাই, আমি মিশু। আপনি?’
– ‘মেঘালয় আহমেদ।’
– ‘বাহ! নাইস নেম। ইউ লুকিং সো হ্যান্ডসাম।’
– ‘ইউ আর সো হট।’
মিশু ক্ষেপে গিয়ে মুখটা বাঁকা করে তাকালো অন্যদিকে। লোকটা অনেক খারাপ। মেঘালয় হেসে উঠলো মিশুর মুখের ভংগী দেখে। তারপর বললো, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’
মিশু মেঘালয়ের দিকে না তাকিয়েই বললো, ‘কক্সবাজার। আপনি?’
– ‘আমিও। হানিমুনে যাচ্ছি।’
– ‘আমি জিজ্ঞেস করিনি।’
– ‘ওহ আচ্ছা। আপনি দেখতে খরগোশের বাচ্চার মতন।’
– ‘থ্যাংকস ফর ইয়োর লেফট হ্যান্ডেড কমপ্লিমেন্ট।’
মেঘালয় হেসে বললো, ‘কলা খাবেন?’
– ‘হোয়াট?’
– ‘ব্যানানা। উইথ ব্রেড।’
বলেই দুষ্টুমি হাসি হাসলো। মিশু হেসে বললো, ‘নো, থ্যাংকস।’
এরপর দুজনেই সামনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। মিশু বললো, ‘আপনি কি করেন জানতে পারি?’
– ‘বউয়ের সেবা করি। আপনি?’
– ‘বরের সেবা গ্রহণ করি। নাথিং ইলস।’
– ‘গ্রেট।’
আবারও দুজনেই মুখ টিপে হাসলো। বাসের লাইট নিভিয়ে দেয়া হলো খানিক বাদেই। এখনো দুজনের মাঝে এক হাত দূরত্ব। যে যার মত বসে আছে চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো।
রাত নেমেছে। অন্ধকারে এক ধরণের ভালোলাগা কাজ করছে। বাস ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে৷ মেঘালয় ব্যাগ থেকে চাদর বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো৷ মিশু বুঝতে পেরে বললো, ‘এক্সকিউজ মি?’
– ‘ইয়েস।’
– ‘আমি কি আপনার চাদরটা শেয়ার করতে পারি?’
– ‘শিওর।’
মেঘালয় একটু কাছে এগিয়ে এসে চাদরটা মিশুর গায়ের উপরেও টেনে নিলো। মিশু একদম মেঘালয়ের শরীর ঘেষে বসে বললো, ‘আমি কি আপনার কাঁধে মাথা রাখতে পারি?’
– ‘শিওর৷ আমার কাঁধ তো আপনাদেরকে সেবা দেয়ার জন্যই ম্যাম।’
– ‘আপনাদেরকে মানে?’
– ‘আমার মিসেসকে আর আমার মিশমিশকে।’
– ‘ওকে। থ্যাংক্স।’
দুজনেই আবারো মুখ টিপে হাসলো৷ মিশু মাথা রাখলো মেঘালয়ের কাঁধের উপর। মেঘালয় সিটটা লম্বা করে দিয়ে শুয়ে পড়লো। মিশুও শুয়ে পড়লো মেঘালয়ের বুকের উপর৷ দুজনেই শুধু মুখ টিপে হাসছে। মিশু অন্ধকারেই মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘হেই হোয়াটস ইয়োর প্রবলেম?’
– ‘সরি?’
– ‘হাগ মি।’
মেঘালয় মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো মিশুকে। মেয়েটাও দুষ্টুমিতে কম না। একে অপরকে জড়াজড়ি করে অর্ধশোয়া অবস্থায় সিটে হেলান দিয়ে রইলো৷ অনেক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর মিশু মাথা তুলে বললো, ‘এত সুখ সুখ লাগে কেন?’
উত্তরে মেঘালয় নিচু হয়ে নিজের ঠোঁট দিয়ে মিশুর ঠোঁটে মৃদু চাপ দিলো। সুখে ভেসে যেতে লাগলো মিশু। দুহাতে মেঘালয়ের জ্যাকেট খামচে ধরতে লাগলো৷ মেঘালয় একহাতে মিশুর কোমরটা জাপটে ধরে অন্যহাতে চাদরের ভেতরে দুষ্টুমি চালিয়ে যেতে লাগলো৷ আটাশ বছরের এক যুবক আর আঠারো বছরের এক তরুণী, দুজনের সমস্ত সত্তা যেন এক হয়ে মিশে যেতে আরম্ভ করেছে। দুজনের ইচ্ছে, ভালোলাগা, ভালোবাসা সবকিছু একইধারায় মিশে যাচ্ছে। ভালোবাসা আর স্পর্শ যেখানে অটল, বয়স আর অন্যসমস্ত ব্যবধান সেখানে তুচ্ছ।