#হঠাৎ_দেখা
#পর্ব_২৭

বাবা নামের সম্পর্কটা সকলের হৃদয়ে এমন এক ছাপের নাম যেখান থেকে একজন মানুষ বিশ্বাস, ভরসা,আস্থা শব্দগুলো বুঝতে শেখে।কিন্তু রাবেয়া কখনো এই শব্দগুলোর মমার্থ তার বাবা নামক মানুষটার কাছ থেকে পায়নি।তবুও সে ভালোবাসে মানুষটাকে।সে কৃতজ্ঞ এই মানুষটার প্রতি কারন রাবেয়াকে অপছন্দ হওয়ার শর্তেও তিনি তার ভরনপোষন করেছেন,লেখাপড়া করিয়েছেন।হ্যা,হয়তো কখনো মাথায় হাত রেখে ভরসার বুলি শুনাননি কিন্তু একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল তাকে দিয়েছে।কালকে আসাদের বলা শর্তেও হাসান সাহেবের সামনে যায়নি রাবেয়া।পাছে যদি ওকে দেখে উত্তেজিত হয়ে শরীর খারাপ হয় তাই।কিন্তু মনে কোনো শান্তি পাচ্ছেনা সে।একবার যদি বাবাকে দেখতে পেতো!সকালের সময়টাতে হাসান সাহেব হয়তো ঘুমিয়ে থাকবেন। রাবেয়া ভাবলো এই সুযোগে বাবাকে দেখে আসতে পারবে।

জানলা দিয়ে কেবিনের ভিতরে তাকিয়ে আছে রাবেয়া। হাসান সাহেব সজাগ।বাবাকে সুস্থ দেখে মনে শান্তি পেল সে।হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছনে ফিরে তাকালো সে।রাবেয়ার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে আসাদ।
“আপনি এতো সকাল সকাল!”
“সারা রাত ঘুমাওনি তাই না।”
রাবেয়া কিছু না বলে চুপ করে রইলো।কালরাতটা সে হাসপাতালেই কাটিয়েছ। বাবা মা কে একা ফেলে যেতে পারেনি সে।

কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো আসাদ।
তখন হাসান সাহেব বেডে আধা শোয়া অবস্থায় বসে ছিলেন।আর নিলুফা বেগম তার ঔষধপত্র ঘাটাঘাটি করছিলেন।

“আপনার সাথে আমার স্ত্রী দেখা করতে এসেছে।ইনি হলেন আমার স্ত্রী ডা.সাবিহা নূর রাবেয়া।” কথাটা বলে আসাদ রাবেয়ার হাত ধরে পিছন থেকে সামনে এনে দাড় করালো।এক অজানা ভয়ে কাপঁছিল রাবেয়া তখন।তা বুঝতে পেরে আসাদ আরো শক্ত করে তার হাতটা ধরলো যার অর্থ ‘কিছু হবেনা আমি আছি।’
এতোবছর পর রাবেয়াকে সামনে দেখে খুব আবাক হলেন হাসান সাহেব।মেয়েটা আজ ডাক্তার।গর্বে মনটা ভরে গেল হাসান সাহেবের।কিন্তু এই গুনধারী মেয়েটার জন্য গর্ববোধ করার অধিকার তিনি অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছেন।ছয় বছর আগে মেয়েটাকে খুব কষ্ট দিয়েছিলেন।যা একজন বাবা কখনোই করতে পারেনা এমন নির্মম ব্যবহার করেছেন তিনি।আল্লাহ সবাইকে এই সুযোগ দেয়না।তাকে দিয়েছে।হ্যা,কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ।যদি এই দুর্ঘটনায় তিনি মারা যেতেন তাহলে এখনও কি ক্ষমা চাইতে পারতেন রাবেয়ার কাছ থেকে। আজ এই সুযোগ তিনি পেয়েছেন।আজ তিনি ক্ষমা চাইবেন নিজের মেয়ের কাছ থেকে তাহলে হয়তো পাপের বোঝা কিছুটা কমবে তার।সাথে মনেরও একদিন মেয়েটাকে শুধুমাত্র গায়ের রঙের কারনে আপদ মনে করে….।আর সেই মেয়ে কিনা আজ তাঁকে বাচাঁলো।

রুমে নিরবতা ছেয়ে গেল।তা দেখে আসাদ নিলুফা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,’মা আপনার হয়তো নাস্তা করা হয়নি চলুন আমি আর আপনি ক্যান্টিননের দিকে যায়।বাবার চিন্তা করেবন না।রাবেয়া আছে তো।”
কথাটা বলে আসাদ আর নিলুফাবেগম রুম হতে বের হয়ে গেলেন।বের হওয়ার আগে রাবেয়া আসাদের হাত ছাড়ছিলো না তা দেখে আসাদ রাবেয়াকে বলেছিল,”আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিন্তু আত্নীয়র সম্পর্ক ছিন্নকারীকে পছন্দ করেন না।”

রাবেয়া সেই জায়গায় স্থির দাড়িয়েছিলো।হাসান সাহেবের কন্ঠ শুনে সেদিকে তাকালো।
“কেমন আছিস মা?” এই প্রথম বাবার মুখ থেকে নিজের জন্য আদুরে কোন শব্দ শুনলো সে।
“আমি জানি তোকে মা বলে ডাকার অধিকার আমি হারিয়ে ফেলেছি।বাবা হিসেবে খুব খারাপ আমি।তা না হলে কি নিজের মেয়ের সাথে এমন ব্যবহার করতে পারতাম।আমাকে ক্ষমা করে দে মা।আমাকে ক্ষমা করে দে।এখন আমি বুঝতেছি তুই আমার কি ছিলি।তোর মামা ঠিক বলেছিল এখন আমার আফসোস করা ছাড়া আর কোন পথ নেই।আমাকে ক্ষমা করে দে মা।” হাতজোড় করে কেঁদে ফেললেন হাসান সাহেব।বাবাকে এই প্রথম কাঁদতে দেখলো রাবেয়া তাও তার জন্য।বাবার কাছে এসে হাতজোড়া ধরে বলল,
“বাবা!আপনি খারাপ বাবা নন।কোনো বাবা কখনো খারাপ হতে পারেনা।আমি আপনার কোন ব্যবহারে কষ্ট পাইনি।”
“এটা তোর বড়ত্ব যে তুই এমনটা ভাবলি।কিন্তু আমার মনটা হালকা হচ্ছে নারে মা।একবার বল তুই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস তাহলে হয়তো মনটা হালকা হবে আমার।”
“আপনি এমন কেন মনে করছেন?আপনি আমার বাবা।আপনার কারনে এই পৃথিবীর আলো দেখতে পেরেছি আমি।প্লীজ আর ক্ষমা চাইবেন না আপনি।সব ভুলে যান।যেমনটা আমি গিয়েছি।আর শান্ত হোন তা না হলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে আপনার।”কথাটা বলে হাসান সাহেবকে বেডে শুয়ে দিল রাবেয়া।
আসাদ আর নিলুফা বেগমও ফিরে এসেছেন রুমে।রাবেয়ার মুখের হাসি দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল আসাদ।হাসান সাহেবেও আসাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলল।আসাদের সাথে কথা বলে মনে মনে শান্তি অনুভব করলেন হাসান সাহেব।যাক মেয়েটার তার ভালো জীবনসঙ্গী পেলো।নার্সের ডাকে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাসান সাহেব রাবেয়াকে ডাক দিলেন আর বললেন,”বাবার সাথে নিজ ঘরে যাবি না।”প্রতিউত্তরে রাবেয়া শুধু হেসেছিলো।আর সেই হাসিটা ছিলো সুখের হাসি।

দুইদিন পর হসপিটাল থেকে রিলিজ করা হলো হাসান সাহেবকে।আজ তিনি একা ঘরে ফিরে আসেননি সাথে এসেছেন মিনহাজ চৌধুরীর পুরো পরিবার ও রাবেয়া আসাদ।প্রথমে রাবেয়াকে সে ঘরে পাঠাতে রাজী ছিলেন না মিনহাজ চৌধুরী। পরে হাসান সাহেবের হাতজোড় করে মিনতিপূর্ণ বাক্যের সামনে ঝুঁকতে হলো তাকে।হাজার হলোও মেয়ের বাবা তিনি।নিজের ভুল বুঝতে পেরে যখন মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন সেখানে খারাপ কি।
এতো বছর পর নিজ বাসায় এসে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লো রাবেয়া।সেই চেনাপরিচিত তার রুম,পড়ার টেবিল।রাতে হাসান সাহেবকে দেখতে আসলেন শামীম মীর ও সেলিনা মীর।মেয়ের শশুর বাড়ীর মানুষ বলে অাপ্যায়নে কোন কমতি রাখেননি নিলুফা বেগম।হাসান সাহেব মনে মনে কৃতজ্ঞবোধ করলেন মিনহাজ চৌধুরির প্রতি ।মেয়েকে এতো ভালো পরিবারে বিয়ে দেওয়ার জন্য। সবার উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হলো যে হাসান সাহেব একটু সুস্থ হলে ওয়ালিমা অনুষ্ঠিত হবে।হাসান সাহেবও খুশি মনে মেয়ের বিদায়ের প্রস্তুতি নিবে বলে জানালেন।

খুব ঝঁমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হলো রাবেয়া আসাদের ওয়ালিমা।বিদায়ের সময় মা,বাবা,মামা,মামী ও তুলিকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপে চোখের জল ফেলেছে রাবেয়া।গাড়ীতে আজ বর কনে একা।আসাদ কাউকে সাথে নেই নি।কারন গন্তব্য এখন মীর ভিলা না।
আসাদ ড্রাইভ করছে আর তার পাশে বসে আছে রাবেয়া।অনেক্ষন ধরে ড্রাইভ করছে আসাদ তা দেখে রাবেয়া জিজ্ঞেস করলো,”কই যাচ্ছি আমরা?”
“সারপ্রাইজ বলা যাবে না।” মুচকি হেসে বলল আসাদ।
“জানেন আপনার হাসিটা কতো সুন্দর!” আসাদের দিকে তাকিয়ে বলল রাবেয়া।
“এই আমাকে ডিসট্রেক করিও না তো।দেখছো না ড্রাইভ করছি।”
আসাদের কথা শুনে সশব্দে হসে উঠলো রাবেয়া।

আগামী পর্বে সমাপ্য…..
©নওশিন সালসাবিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here