#হঠাৎ_দেখা
#পর্ব_১৫
মীর ভিলাকে আজ এক অন্যরূপে সাজানো হয়েছে।শামীম আফজাল মীর ব্যস্ত গেস্ট সামলানোতে।আর সেলিনা মীর ব্যস্ত তার বন্ধুমহলে আসাদের সাথে।নিজের এত প্রসংশা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আসাদ।ইশারা ইঙ্গিতে অনেকবার সে মাকে থামাতে চেয়েছে।কিন্তু পারছেনা।মনে মনে দুয়া করতে লাগলো যেন তার বন্ধুরা এসে তাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।কিন্তু আজ তার দোয়া কবুল হলোনা।আসাদের ইচ্ছা করছে এখান থেকে পালিয়ে যেতে কারন মায়ের বান্ধবী মিস রোজিনা হায়দারের মেয়ে ঈশিতা সে কখন থেকে তার দিকে চেয়ে আছে।ছেলেদের চোখের লাজ শরম নাই বলে এতদিন জানত আসাদ।আজ সে দেখছে কিছু মেয়েদেরও চোখের লাজ শরম থাকেনা।
অনেক কষ্টে মাকে বুঝিয়ে সরে এলো সেখান থেকে।সোজা লন পেরিয়ে পিছনের বাগানে চলে আসলো আসাদ।কিছুক্ষন একা থাকা প্রয়োজন তার।নিজের মনের অস্থিরতা কমাতে আজ সকালেও গিয়েছিল সে হসপিটালে।যদিও তার জয়েনিং ডেট আরো দুই সপ্তাহ পরে।তবুও সেখানে গেল যদি আবার দেখা পাওয়া যায় মেয়েটার।কেননা আসাদের বার বার মনে হচ্ছে মেয়েটা রাবেয়া।কিন্তু ওর তো এখানে থাকার কথা নয়।যতক্ষন পর্যন্ত সে নিশ্চিত হচ্ছেনা ততক্ষন পর্যন্ত শান্তি পাবেনা সে।কিন্তু কোথাও দেখা মিলল না সেই মেয়েটার।একবার ভাবলো জিহানের সাথে কথা বলে ইনফরমেশন বের করবে।পরে আবার সে চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেই খোঁজখবর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে।হসপিটালের কর্মচারীদের গতকালের রক্তদান কর্মসূচি সম্পর্কে জিজ্ঞেসা করে জানতে পারলো দুই হাসপাতালের যৌথ উদ্যােগে এই কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল।সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিডফোর্ড হাসপাতালের নতুন ডাক্তাদের যৌথ উদ্যােগে এই রক্তদান কর্মসূচি হয়েছে।আসাদ মনে মনে ভাবলো মেয়েটা হয়তো এই মেডিকেলের না হলে মিডফোর্ডের ডাক্তার।যেহেতু এখানে এসে রাবেয়া নামের কাউকে খুঁজে পাইনি তাছাড়া রাবেয়ার সম্পূর্ন নামও তার জানা নেই।তাই সে ভাবলো হয়তো মেয়েটা মিডফোর্ড হসপিটালের ডাক্তার।হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সে সোজা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।গন্তব্য এখন মিডফোর্ড হসপিটালের দিকে।
“কিন্তু কেন যাচ্ছে আমি?” মনে এই প্রশ্ন আসাতে মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে দিল আসাদ।এইসব করে সে কি জানতে চাচ্ছে।মেয়েটা রাবেয়া কিনা?কিন্তু রাবেয়ার তো বিয়ে….না এইরকম করা ঠিক হবেনা।এইসব করে সে মনের অশান্তি আরো বাড়িয়ে তুলছে।তাছাড়া মা বিয়ের জন্য অলরেডি পাত্রী দেখে রেখেছেন।ড্রাইভিং সিটে কিছুক্ষন বসে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল সে।কিছু প্রশ্নের উওর অজানা থাকাই ভালো।বাড়ির পিছনের বাগানের দোলনায় বসে এইসব ভাবছিল আসাদ।
“তুই এখানে বসে আছিস।আর আমরা তোকে খুঁজে মরছি।” পিছন থেকে জিহানের কন্ঠ ভেসে আসলো। সেদিকে তাকিয়ে আসাদ বলল,
“এতক্ষনে আসার সময় হলো তোদের?”
“আর বলিস না।তুই তো জানিস আমি ড্রাইভ করতে পারিনা পায়ের জন্য।আর অফিসের গাড়িটা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করিনা।তাই জিহান আমাকে পিক করবে বলল সাতটায়।সেই বান্দা আমাকে পিক করতে আসলো আটায়।তাই তো এতো দেরি।”
“সাব্বির তোর দেরি হয়েছে আমার কারনে আর আমার দেরি হয়েছে শাহিনার কারনে।মেয়েদের যে এত সময় লাগে তৈরী হতে।অসহ্য!”
জিহানের কথা শুনে সাব্বির আর আসাদ না হেসে পারলোনা।হাসি থামিয়ে সাব্বির বলল,
“ওর কথা বাদ দে।তুই বল,পার্টিতে না গিয়ে এখানে বসে ছিলি কেন?”
“আর বলিস না।ওখান থেকে বেঁচে এখানে এসে বসলাম।”
“বেঁচে আসলি মানে?”জিহান বলল।
“মায়ের বান্ধবীর মেয়ের কড়ানজর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে আনলাম।কি যে হেজিটেশন ফিল হচ্ছিল বলতে পারবোনা।”
আসাদের কথা শুনে এইবার জিহান আর সাব্বির হাসা শুরু করলো।জিহান বলল,”বলিস কি!সত্যিই নাকি!!”
সাব্বির বলল,”হতেই পারে।এতো নতুন কিছুনা।সেই কলেজ লাইফ থেকে মেয়েরা তোর জন্য পাগল ছিলো।তুই তো পাওা দিতি না।”
“হা হা হা…এক মিনিট এক মিনিট…. এই সাব্বিরর তোর মনে আছে আমাদের আসাদ একবার প্রেমে পড়েছিল।”
“কিসব শুরু করলি তোরা বলতো!”
“আরে হ্যা! তুই তো এই ব্যাপারে আমাদেরকে আর কিছুই বললিও না।”
“৬ বছর আগের কথা নিয়ে তোরা কি শুরু করলি এখন?”
“সেদিনও তুই এই বিষয়টাকে এড়িয়ে গিয়েছিলি।আজও যাচ্ছিস।কেন আসাদ?” ভ্রু জোড়া কুঁচকে
জিজ্ঞেসা করল সাব্বির।
“তেমন কিছুই আমি করছি না।”শান্তদৃষ্টি রেখে জবাব দিল আসাদ।
“তেমনই কিছু।না হলে তুই এইভাবে আমাদের কাছ থেকে কেনো লুকাচ্ছিস।”
“কি বলব!এইটা যে ৬ বছর আগে একজনকে হঠাৎ দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি।আর হারিয়েও ফেলেছি।কিন্তু আজও সেই ভালোবাসাকে মনে পুষে রেখে নিশ্বাস নিচ্ছি।”একনাগাড়ে কথাগুলো বলল আসাদ।সে
আর নিজের মধ্যে কথাগুলো চেপে রাখতে পারছিলনা।আসাদের কথা শুনে চুপচাপ দাড়িয়ে রইল জিহান ও সাব্বির।
“এইসব কি বলছিস তুই?ছয় বছর আগে হারিয়ে ফেললি,এখনো মনে পুষে রাখলি।” সাব্বির বলল।
তারপর আসাদ রাবেয়ার সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে রাবেয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে থাকা,বিদেশে গিয়েও ওকে ভুলে থাকার চেষ্টাতে ব্যর্থ হওয়া এবং গতকাল একটা মেয়েকে রাবেয়া মনে করে আজ তার খোঁজ নিতে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলল জিহান ও সাব্বিরকে।
“তুই তখন কেন আমাদের এইসব বললি না। কেন?” উচ্চস্বরে বলল জিহান।
“জানিনা তখন কেন এমনটা করলাম।”
“তোর উচিত হয়নি আমাদের কাছ থেকে কথাগুলো লুকানো।সেদিন যদি তুই আমাদের বলতি তাহলে আমরা মেয়েটাকে খুঁজে বের করে বিয়েটাকে আটকাতাম।” সাব্বির বলল।
“যা হওয়ার সব আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়েছে।হয়তো আমি আর রাবেয়া একে অপরের জন্য না।তাই এমনটা হয়েছে।আমার আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে।তিনি যা করেন সব আমাদের ভালোর জন্য করেন।আর আমি তা মনে প্রানে বিশ্বাস করি।” দুই হাত পকেটে রেখে উদাস দৃষ্টিতে দূর আকাশে তাকিয়ে কথা গুলো বলল আসাদ।
আসাদের এইকথা শুনে জিহান আর সাব্বির আর কিছু বলল না।আসলেই কিছু হৃদয়ভঙ্গনের কোন শব্দ হয়না।
_____________________________
সাফা সে কখন থেকে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু প্রিয় মানুষটার দেখা পাচ্ছেনা সে।এদিকে তুলি আর তার পরিবারও এখনো আসেনি।হঠাৎ সাফার চোখ গেল বারান্দার দিকে।সেখানে সে দেখতে পেল তার পরান প্রিয়কে।পরক্ষনে চোখ সরিয়ে নিল সে।
“না সাফা আর না।এইবার তোকে শক্ত হতেই হবে।” কথাটা নিজেকে নিজে বলে চলে গেল সেখান থেকে।বারান্দায় দাড়িয়ে আসাদ আর বাকি কলেজ লাইফের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলল সাব্বির।কিন্তু তার চোখজোড়া নিবদ্ধ ছিল সাফার উপর।মেয়েটা আজ বড় হিজাবে আপদামস্তক ঢেকে রেখেছে।দেখে ভালো লাগল সাব্বিরের।পরে মনে পড়ল আজ সাফাকে সরি বলতে হবে তার।সকালে একটু বশি ধমক দিয়ে ফেলেছিল সে।মাথা গরম থাকলে হুটহাট এমন ব্যাবহার করে ফেলে সে। বস্তুত রাগ মানুষের জীবনকে সহজেই বিষাক্ত করে তুলতে পারে। তাই রাগ হলে আলেমরা ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম’ পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যখন তোমাদের কারও রাগ আসে, তখন সে দাঁড়িয়ে থাকলে যেন বসে পড়ে। তাতে যদি রাগ দমে না যায়, তাহলে সে যেন শোয়ে পড়ে। ’ -তিরমিজি
আবু দাউদ শরীফের একটি হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রাগ আসে শয়তানের কাছ থেকে। শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন নেভাতে লাগে পানি। তাই যখন তোমরা রেগে যাবে, তখন অজু করে নেবে। ’ আর মুসলিম শরীফের এক হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে রাগের সময় নিজেকে সামলে নিতে পারে, সেই প্রকৃত বাহাদুর। আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, রাগ দেখানোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আল্লাহতায়ালা তাকে কিয়ামতের দিন পুরস্কৃত করবেন।
সাব্বির ভাবলো,না মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। এমনিতে কম কষ্ট দিচ্ছেনা সে সাফাকে।তাই ভাবলো সকালের ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিবে সে।কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠছিলো না।
গেট দিয়ে তুলিকে ঢুকতে দেখে সেদিকে গেল সাফা এবং সেলিনা মীর।তুলির সাথে এসেছে তার মা স্বপ্না চৌধুরি ও বাবা মিনহাজ চৌধুরি।তাদের সাথে মিষ্টি আপুকে দেখতে না পেয়ে তুলিকে জিজেস করল সাফা,”কিরে আপু আসেনি?”
“আসলে আপা,মেয়েটার সকাল থেকে জ্বর।তাই আসতে পারেনি।”সেলিনা মীরকে উদ্দেশ্য করে বললেন স্বপ্না চৌধুরি। এই কথা শুনে সেলিনা ও সাফার দুইজনের মন খারাপ হয়ে গেল। মিনহাজ চৌধুরিকে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলেন শামীম সাহেব। মোসাফা করেই তাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। স্বপ্না চৌধুরিকে একা পেয়ে সেলিনা বেগম বললেন,”আপা আমি তো চেয়েছিলাম আজকেই দুইজনের দেখা করিয়ে দেবো।তারপর না হয় কি করতে হবে সেটার কোন সিদ্ধান্ত নিবো।কিন্তু…..”
“আরে আপা এতো টেনশন নিয়েন না তো।আপনারা একদিন সবাই আমাদের বাসায় আসবেন।সেদিন না হয় আসাদের সাথে দেখা করিয়ে দেবো আমাদের সাবিহাকে।”
“ঠিক আছে আপা।সেটাই করতে হবে।আসেন আসাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।”
মায়ের পরিচিত করে দেওয়া মেহমানদের সালাম দিল আসাদ।আর মিনহাজ চৌধুরির টুকটাক প্রশ্নের উওর দিতে লাগলো।রীতিমত একটা ভাইভা দিলো আসাদ।এইরকম তার মনে হলো। আসাদকে খুব পছন্দ হয়েছে মিনহাজ ও স্বপ্না চৌধুরির।নিজের মেয়ে সম ভাগ্নির জন্য এত যোগ্য পাত্র পেয়ে খুব খুশি হলেন তারা।আসাদকে দেখেই তুলি বলল,”তুই তো কখনো বলিসনি তোর এতো হ্যান্ডসাম একটা ভাই আছে।”
“ভেবে কথা বলো তুলি রানী।সব ঠিক থাকলে তোর হবু দুলাভাই সে। মনে রাখিস।”
“হুহ…ঢং।জানি জানি।হ্যা রে সাফা, মিষ্টি আপুর সাথে দারুন মানাবে তোর ভাইকে।”
“দেখতে হবেনা কে পছন্দ করেছে!”
“ঢং…..আচ্ছা এই কথা বাদ দে।তোর হিরো কই?”
“জানি না।” মুখটা নামিয়ে উওর দিলো সাফা।
“কেন আসে নাই নাকি?”
“আসছে।”
“তাহলে?”
“উফ!!বাদ দে তো উনার কথা।”
“আমিতো অনেক আগে থেকেই বাদ দিতে বলছি তারে।তুই তো শুনচ্ছিস না।”
“এই বাদ সেই বাদ না!এইটা সাময়িক বাদ।সারাজীবনের জন্য ওনাকে বাদ দিতে পারবোনা আমি।ভালোবাসি তাকে আমি।”
চলবে……
®নওশিন সালসাবিল।