#হঠাৎ_দেখা
#পর্ব_১২
মেঘকে আড়াল করে মায়াবী সিডনিকে পেছনে ফেলে প্লেন চলছে কুয়ালালামপুরের দিকে।সেখান থেকে ঢাকা।প্লেনের জানালা দিয়ে আসাদ দেখতে পাচ্ছে শত শত মেঘপুঞ্জের মিলন মেলা।ধীরে ধীরে সবুজ প্রকৃতির সাথে দুরুত্ব সৃষ্টি হয়ে সাদা নীল মেঘের সাথে মিশে যাচ্ছে আসাদের দৃষ্টি।দেখা যাচ্ছে রাশি রাশি মেঘপ্লবদের। আসাদকে এয়ারপোর্টে সি অফ করতে এসেছিল এ্যাভা।আজ তার পরনে কোন ওয়েস্টার্ন ড্রেস ছিলো না।ছিল নীল রঙের স্লিক শাড়ী। এ্যাভাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল জীবনে প্রথম শাড়ী পড়েছে সে।কিন্তু কেন তার এতো আয়োজন তা বুঝতে অপরাগ আসাদ।চলে অাসার সময় একটি চিঠি আসাদের হাতে গুজে দিল এ্যাভ আর বলল,”আজ আমার এই সাজ শুধু তোমার জন্য এ্যাসাদ।”
এয়ারহোস্টেস এর ডাকে বর্তমানে ফিরে এলো আসাদ।হাতে তার এ্যাভার দেওয়া চিঠি।পরক্ষনে চিঠির ভাজ খুলে পড়তে শুরু করল সে,
প্রিয় এ্যাসাদ,
আমি জানি আজই আমাদের শেষ দেখা ছিল।দেশে ফিরে যাবার পর তুমি হয়তো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এই দেশে পা রাখবে না।আচ্ছা তোমার বিশেষ প্রয়োজনটা কি কখনো আমি হবো? হয়তো না।তুমি যেমন কাউকে ভালোবাসার সুযোগ না পাওয়াতে খুব দুঃখিত তেমনি আমিও।এইসব কথা বলে তোমাকে আর বিরক্ত করবো না।দোয়া করি তুমি যেন সেই মানুষটাকে কাছ থেকে ভালোবাসার সুযোগটা পাও।আমি না হয় দূর থেকেই ভালোবেসে গেলাম।বলবো না যে “আমি তোমার অপেক্ষায় আছি”শুধু বলবো,সর্বদা ভালো থেকো তুমি।
ইতি
এ্যাভা।
চিঠিটা ভাজ করে রেখে দিল আসাদ।আর মনে মনে বলল,”তুমিও ভালো থেকো এ্যাভা।”
_________________________________
“এইভাবে চালালে মনে হয়না ১০টার আগে এয়ারপোর্টে পৌছাতে পারবো।” চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে কথাটা বললো সাব্বির।
“আরে ব্যাটা এর থেকে জোরে মুই চালাতে পারুম না।তাছাড়া এইটা মার্সিডিজ না বুঝলি, আমার টয়োটা। আর চিন্তা করিস না তো এক্ষুনি পৌছে যাবো।”
“দেখ জিহান,আসাদ কিন্তু লেইট করা একদম পছন্দ করেনা।পরে যদি তোর কারনে আমাকে ঝাড়ি খেতে হয় তো দেখিস তুই।”
“আরে শুনতে হবে না।আজ ৬ বছর পর ওরে দেখবো। আমি তো জাস্ট নষ্টালজিক হয়ে যাবো রে।এক কাজ করবো পুরানো দিনের মতো তিন বন্ধু কোথাও থেকে একটা ট্রিপ মেরে আসবো একদম কলেজ লাইফের মতো।কি কস?”
“হুম করা যায়।এই ৬ বছরে খুব মিস করেছি ওরে।”
“আমিও মিস করেছি ওই শ্যালার ব্যাটারে।”
“বারবার কেন এই ফালতু ওয়ার্ডটা ব্যবহার করিস, একটু বলতো?”
“ওহ কেউ জ্বলছে দেখি!আরে শোন,শালা বলেই কি শালা হয়ে যায় নাকি?চিন্তা করিস না তোর রাস্তা একদম ক্লিয়ার,বুঝলি।তাছাড়া আসাদ তোর শালা হবে না তো।আসাদ হবে তোর…..”
“চুপ করবি।কি যা তা বকছিস।বলেছিলাম না এইসব ফালতু কথা যেন আর না শুনি তবুও তুই…বিরক্তিকর!”
“যতই বলিস না কেন বিরক্তিকর।সে কিন্তু তোকে ছাড়বে না।তোকে রাজি করিয়ে ছাড়বে।”
“ফালতু কথা বাদ দিয়ে ড্রাইভিং মন দে।” কথাটা বলেই জানালার বাইরে মন দিলো সাব্বির। মাঝে মাঝে কিছু মানুষ আমাদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে।কিন্তু আমরা সেই মানুষগুলোর জীবনে কালো ছায়া হয়ে দাড়িয়ে যাই। যার কারনে তখন তাদের জীবন হতে সরে আসাটা গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠে।
এতবছরের দূরত্বের পর তিন বন্ধুর দেখা হওয়াতে খুশির যেন ঠিকানা রইলও না তাদের।একে অপরকে জড়িয়ে ধরে এতবছরের দূরত্ব ঘুচানোর চেষ্টা করল তারা।মিলন পর্ব শেষ করে রওনা দিলো মীর ভিলার দিকে।গাড়ি যখন মীর ভিলার সামনে এসে দাড়ালো তখন সাব্বির বলল,”তোরা ভিতরে যা আমি পরে পার্টিতে দেখা করবো তোদের সাথে।”
“কেন এখন ভিতরে গেলে কি সমস্যা আর এক মিনিট পার্টি? কিসের পার্টি?”
“দিলি তো সারপ্রাইজ নষ্ট করে।আরে আংকেল তুই আসর খুশিতে ছোটখাট একটা পার্টি থ্রো করছেন।”
“কি প্রয়োজন এইসব করার।আচ্ছা বাদ দে।আর সাব্বির পরে কখন আসবি সেটা পরে দেখা যাবে এখন ভিতরে চল একসাথে লাঞ্চ করবো সবাই।তারপর যেখানে ইচ্ছে চলে যাস।”
আগ্যত আসাদের কথাই মানতে হলো সাব্বিরের।আসাদকে সাথে নিয়ে মীর ভিলার ভিতরে প্রবেশ করলো তারা।দরজা খুলে ভাইকে দেখে জড়িয়ে ধরলো সাফা।ছোটবোনকে দেখে আবেগপ্লুত হয়ে গেল আসাদ।কিছুক্ষন পর বোনকে ছেড়ে দিয়ে বলল,”এখনো তোর ভ্যা ভ্যা করে কান্না করার অভ্যাস গেল না।দিলি তো পুরা শার্ট ভিজিয়ে।”ভাইয়ের কথা শুনে ধুমধাম কয়েকটা কিল বসিয়ে দিল সাফা আসাদের হাতে।হঠাৎ পিছনে সাব্বিরকে দেখতে পেয়ে থমকে গেল সাফা।কতদিন পর মানুষটা দেখছে সে।সাফাকে দেখেই অন্যদিকে চোখ সরিয়ে ফেলল সাব্বির।নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের লোভ সেই আদিকাল থেকে।তাইতো বার বার নিষেধ করার স্বত্বেও দিন দিন আরো গভীরভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে সাফা সাব্বিরে সাথে।
“আসাদ….!”
মায়ের ডাকে সামনে চেয়ে তাকালো আসাদ।দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল সে।পরম মমতায় আসাদের কপালে চুমু খেলেন সেলিনা বেগম।
“আরে শুধু মাকে জড়িয়ে ধরলেই হবে?বাবা কি দোষ করেছে?” মাকে ছেড়ে দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো আসাদ।হয়তো পুরুষ মানুষ বলে আজ কাঁদতে পারলেন না শামীম সাহেব।অথচ তার পাশে দাড়িয়ে সমস্ত আবেগ অনুভূতি কান্নার মাধ্যমে জানান দিচ্ছেন তার স্ত্রী।
সবাই নিচে বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছিলো।শুধুমাত্র সাফা উপস্থিত ছিলনা সেখানে।এর পর সবাই লাঞ্চ সেরে ফেলল।জরুরি একটা ফোন আসাতে সাব্বির উঠে বারান্দায় চলে গেল।কয়েকমিনিট পর কথা শেষ করে পিছনে ফিরতেই দেখা হয়ে গেল সাফার সাথে।
“আপনি কেন আমার ফোন রিসিভ করছিলেন না?”
“তোমাকে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই।”
“আপনি কেন বার বার আমার ভালোবাসাকে অপমান করছেন?”
“এইটা কোন ভালোবাসা না। সাময়িক মোহ তোমার।”
“সেই ১৬ বছর বয়স থেকে আপনাকে ভালোবেসে আসছি।আর আপনি বলছেন এইসব সাময়িক মোহ আমার।”
“তা নয় তো কি?এই বয়সে তোমাদের মেয়েদের চোখে রঙিন চশমা থাকে।যা দিয়ে সব তোমাদের সুন্দর লাগে।যখন এই চশমা পড়ে যাবে তখন বুঝবে বাস্তবতা কোন পাখির নাম বুঝলে!”
“আমার সেই বাস্তবতা তে আমি আপনাকে চায়।কেন বুঝেন না আপনি?”
“কি দেখে প্রেমে পড়েছো আমার,কি দেখে?”
“সম্পূর্ন আপনাকে দেখে।ভালোবাসা বাসিতে কোন কারন লাগেনা সেটাতো মুহূর্তের ব্যাপার।”
“হু…বললাম না চোখে এখনও তোমার রঙিন চশমা।প্লিজ সরে দাড়াও।তোমাকে বুঝাতে বুঝাতে আমি ক্লান্ত।”
সাব্বির সাফাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল।তখন সাফার কথা শুনে থমকে গেল সে।
“আপনি কি আপনার পায়ের এই আঘাতের কারনে আমার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখছেন?”
“যখন বুঝতেই পারছো তাহলো কেন বারবার একই প্রশ্ন করো?”
সাফা হেসে সাব্বিরের সামনে এসে দাড়াল।আর বলল,
“আমার চোখে না হয় রঙিন চশমা কিন্তু আপনার চোখে যে অবহেলার চশমা।সেইটাকে কি বলবেন?আপনি সব দেখেও বুঝতে চাইচ্ছেন না।যদি আপনি মনে করেন আপনার পায়ের ক্ষত আমার, আপনার প্রতি ভালোবাসাকে বিন্দু পরিমানও কমাতে পারবে তাহলে বলব ভুল মনে করেন আপনি।আপনার সবটাকে ভালোবাসি আমি।সেটা আপনার আত্নসম্মান হোক কিংবা আপনার সাহসিকতা।কিন্তু আপনি কি জানেন আপনার এই অবহেলা কতটা কষ্ট দেয় আমায়।আমি আর আপনার কাছে কখনও আসবো না আমার ভালোবাসার দাবী নিয়ে।কখনও না।”
কথাটা বলেই চলে গেল সাফা আর সেখানে ঠায় দাড়িয়ে রইল সাব্বির।কিভাবে বুঝাবে এই মেয়েকে যে তাকে অবহেলা করতে কতটা কষ্ট হয় তার।এই পঙ্গু মানুষটার সাথে নিজেকে জড়ালে কখনো সুখী হবে না সে।ভালোবাসলেই যে কাছে থাকতে হবে এমন কোন নিয়ম তো নেই।দূর থেকে কি ভালোবাসা যায় না?
চলবে….
®নওশিন সালসাবিল
[“তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার পরিবার পরিজনের কাছে উত্তম। ”
– ইবনে মাজাহ♥
“নিশ্চই নিজের সন্তানকে উত্তম ব্যবহার শেখানো, গরিবকে শস্য দান করার চেয়েও উত্তম”
– মুসলিম ♥]