#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#পর্ব৬

“আম্মু, ভাত খাবে আসো, ঔষধ খেতে হবে তো। আব্বু আর অমিয়ও খেয়েছে। দাদীকে রুটি আর ডাল সবজি দিয়েছি।”

“কয়টা বাজে?”

“দশটা বাজেনি এখনো। নয়টা পঞ্চাশ বাজে বোধহয়।”

“তাহলে সবাইকে খাবার দিতে এত তাড়াহুড়ো কেন তোর? খুব কাজ দেখানো শিখছিস না? দেখাস যে আম্মু কোন কাজের না, সব কাজ তুই করে উদ্ধার করিস।”

“আম্মু, এভাবে কথা বলছো কেন? আব্বু আর দাদুর রাগ তুমি আমাকে দেখাচ্ছ? আমি কী জানতাম আব্বু এভাবে তোমার উপর রাগ ঝাড়বে। আমি খারাপ করছি আমাকে বকার কথা। আর পরে তো আমাকেও আব্বু বকেছে।”

“পরীক্ষায় খারাপ করছিস নিজের দোষে, সারাদিন ফোন টিপিস। তোর আব্বু রেগে যাবে শুনলে, এই জন্য কখনো বলি না। আর তুই নিজে নিজে ক্লাস মিস করিয়, নিজের দোষে পরীক্ষা খারাপ করিস, সেজন্য কথা শুনতে হয় আমাকে। আমার বাসার কাজ আমি যখন পারি করবো, তুই চর কোন কাজ করতে আসবি না। তোর হাতে যেন ফোনও না দেখি।”

“আম্মু, সত্যি বলতে বাড়াবাড়ি আব্বু করে। সামান্য একটা আইটেম পরীক্ষা। এই ১০ মার্কসের চইটেম আমাদের সারাবছর চলে। এগুলো মেডিকেলের নিয়মিত ঘটনা। পরীক্ষা খারাপ হলে আবার পেন্ডিং দেওয়া যায়। এই সামান্য জিনিস নিয়ে এই লেভেলে কেউ হইচই করে না। এই বাসায় সবাই বেশি বেশি।”

“শোন, তোর আব্বু আর দাদী যা করেন, আল্লাহ একদিন ওদেরও তাই ফেরত দেবে। এই যে তোর বাপ কথায় কথায় আমার উপর রাগ ঝাড়ে, সবকিছুর জন্য আমাকে দায়ী করে, একদিন যখন তার মেয়ের জামাই যখন এই কাজগুলো করবে তখন সে বুঝবে কেমন লাগে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি এমন একটা মেয়ের জামাই তোর বাপের কপালে থাকুক।”

“আম্মু, তুমি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছ? তুমি আব্বুর শিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার জন্য বদদোয়া দিচ্ছ। সত্যি এমন মেয়ের জামাই পেলে শুধু আব্বুর কষ্ট হবে, তোমার হবে না? আচ্ছা যখন মন চায় খেও, আমি যাচ্ছি।”

হুমায়রা চুপ করে থাকেন, আসলে এতকিছু ভেবে কথাগুলো বলেননি। রাগের মাথায় মনে মনে অনেক বদদোয়া আসছিল জামিল সাহেব আর শাশুড়ির জন্য। ওনাদের সাথে মুখে জবাব দেওয়ায় তিনি বরাবরই দুর্বল। আজ যখন জামিল সাহেব প্রয়াত শ্বশুর শাশুড়িকে তাচ্ছিল্য করে, ব্যঙ্গ করে কথা বলছিলেন, কে যেন ছুরি দিয়ে ওনার বুকটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছিল। যখন অরণীর নানা নানী বেঁচে ছিলেন তখন যে জামিল সাহেব খুব ভালো ব্যবহার করতেন তা নয়। বরং সবসময় প্রতাপ দেখাতে পছন্দ করতেন। হুমায়রার বাবার বাড়ি দাওয়াত ছাড়া কখনো যেতেন না, হাতে করে নামমাত্র ফলমূল নিতেন, কিন্তু নিজের আপ্যায়নে সামান্য ত্রুটি পেলে সেটার ঝাল দেখাতে ভুলতেন ন। বহুবার টেবিলে বসে পছন্দসই খাবার না পেয়ে রাগ করে উঠে যাওয়ার নজির আছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা, হুমায়রার পিতা সাধ্য অনুযায়ী জামাই আদর করতেন, কিন্তু তারপরও তা জামিল সাহেবের মনপুত হতো না। মুরগী থাকলে, মাছ নেই বলে অভিমান দেখাতেন। মাছ মুরগী দুটোই থাকলে গরু খাসি করা হয়নি বলে কটাক্ষ করতেন। এমন না যে তিনি ভোজনরসিক, এই জিনিসটা শুধুমাত্র শ্বশুরবাড়ির লোকদের হেয় করে করে মজা পেতে করতেন। কোন সম্মানই ওনাদের কাছে যথেষ্ট ছিল না। উপহার দিলে শাশুড়ির পছন্দ হতো না, দাওয়াত দিলে আপ্যায়ন তাদের মনমতো হতো না। নতুন নতুন বিয়ের পর এই দোষ ধরা নিয়ে হুমায়রা আতংকে দিন কাটাতো। আস্তে আস্তে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। বুঝে গিয়েছিলেন সম্মান পেতে হলে যে সম্মান দিতেও হয়, তা এই মানুষগুলো জানে না। বাবা মা কেউ এখন বেঁচে নেই, আজ সেই মৃত মানুষদের টেনে এনে তাচ্ছিল্য করে বলা কথাগুলো যেন মনটা ভেঙে দিয়েছে। নিজের অজান্তেই মনের কষ্টগুলো বদদোয়া হয়ে ঝরছিল।

মুখের প্রতিবাদ করার শক্তি আগেও ছিল না, এখনো পারেন না। তার যে ভয় হয়। আগে সংসার ভাঙার ভয় করতেন, আর এখন নিরাপত্তাহীনতার ভয় পান। আগে শুধু দোয়া করতেন জামিল সাহেবের যেন মাথা ঠান্ডা থাকে, তিনি যেন হুমায়রার উপর খুশি থাকেন। এখন দোয়া করেন এই খারাপ ব্যবহারের শাস্তি যেন আল্লাহ ওনাকে দেন। আর এইভাবেই হয়তো আমাদের মনের অজান্তে আমাদের সঙ্গীর দোয়ায় আমাদের অবস্থান বদলে যায়, আর আমরা তা টেরও পাই না।

হুময়রার বাবা মা এখন আার বেঁচে নেই , ভাইবোনেরা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত, তারউপর এখন সারাবছর হুমায়রা অসুস্থ থাকেন। তারপরও মাঝেমাঝে তার মনে চায় সব লাথি মেরে চলে যেতে, কত লোকতো রাস্তায় ভিক্ষা করেও খায়। কিন্তু পারেন না অরণী আর অমিয়র কথা ভেবে। মাঝেমাঝে ভাবেন অরণীর বিয়ে হয়ে গেলে, আর অমিয় একটা চাকরি পেয়ে গেলে সংসার ডিউটি থেকে ছুটি নেবেন। অমিয়র উপর বড়ো আশা হুমায়রার, নিজের সমস্ত অপূর্ণ স্বপ্নের ভার যেন দেখতে পান অমিয়র ঘাড়ে। অরণী পরের ঘরের বৌ হবে, হয়তো বছরে এক দুখানা শাড়ি কিনে দিবে, একটু ভালোমন্দ এনে খাওয়াবে। এর বেশি অরণীর কাছে আশা করেন না। হুমায়রার অজান্তেই সমাজের এই বিরূপ চিন্তা তারও মজ্জাগত। এখনো মুক্তির স্বপ্ন দেখেন ছেলের কাঁধে চড়ে। তাই বলে মেয়ের খারাপ কখনো চান না। চান মেয়েটা সুখী হোক, যে সুখ তিনি পাননি। কিন্তু আজ কী যে হলো, মনে মনে স্বামীর শিক্ষা পাওয়ার কামনা করতে গিয়ে যে মেয়ের জন্য অভিশাপ চাইছেন, হতাশার মুহূর্তে তা মনেই আসেনি। নিজের হতাশা আর ক্রোধের কথাগুলোই অরণীর জন্য মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়।

কথাটা মনে হতেই একমুহূর্তে রাগ গলে পানি হয়ে যায়, বরং অপরাধবোধ হয়। ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যান, নামাজ শেষে মোনাজাতে হাত তুলে বলেন, “ইয়া আল্লাহ আপনি অভিশাপ দেওয়া এবং অভিশাপকারী দুটোই অপছন্দ করেন। আজ নিজের মনের কষ্টে আমি নিজের অজান্তেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে ফেলেছি। আমাকে আপনি ক্ষমা করুন আল্লাহ। অরণীর বাবাকে আপনি হেদায়েত দিন, হেদায়েত দিন।”

জামিল সাহেব শোবার ঘরে এসে হুমায়রাকে জায়নামাজে বসে কাঁদতে দেখেন। বহুদিন তিনি স্ত্রীকে কথার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন, আড়ালে আবডালে চড়ও মেরেছেন। পরে অপরাধবোধ হলেও ক্ষমা চাননি, ইগো ওনাকে ক্ষমা চাইতে দেয়নি। মনে মনে ঠিক করতেন আর এমন ব্যবহার করবেন না। কিন্তু মুখে এক কথাটা উচ্চারণ করতেন না। নিজের মতো স্বাভাবিক আচরণ করতেন, নিয়ম করে হুমায়রাকে কাছে টানতেন, যেন কিছুই হয়নি। হুমায়রা নিজের মতো চুপচাপ থেকে নিজে নিজেই স্বাভাবিক হয়ে যেত একসময়। জামিল সাহেবও মনে মনে করা ওয়াদা ভুলে আবারও স্বভাবজাত দুর্ব্যবহার করতেন। এই সাইকেল বছরের পর বছর চলেছে। এখন তো এসব নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে গিয়েছে, আগের মতো হুমায়রাও আর গাল ফুলায় না, বরং স্বাভাবিক ভাবে ঘরসংসার করে। আসলে জামিল সাহেব বুঝে ফেলেছেন শ্বশুর শাশুড়ির মৃত্যু হুমায়রাকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে, তাই তো এখন যখন তখন খারাপ ব্যবহার করতে আরও বাঁধে না। তবে আজ মনে হয় মৃত শ্বশুর শাশুড়িকে টেনে এনে গালিগালাজ না করলেই পারতেন মনে হলো। হুমায়রাকে আগে কখনো এভাবে নামাজের বিছানায় কাঁদতে দেখননি। একবার ক্ষমা চেয়ে নিবেন কিনা ভাবলেন, কিন্তু ঐ যে ইগো! সেটা তাকে ক্ষমা চাইতে দিল না, বরং গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললেন, “হুমায়রা, নামাজ পড়া হলে মশারি লাগিয়ে দিও, ঘুমাবো।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here