#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#পর্ব৫

অরণী কলিংবেল টিপেই যাচ্ছে। তর সইছে না যেন। হুমায়রা বেগম অবাক হোন, সবে বাজছে সাড়ে এগারোটা, এই সময় কে আসবে! কাজের সহকারী কাপড় ধুচ্ছিল, তাই নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।

“অরণী, তুই এখন? ক্লাস হয়নি আজ?”

“ক্লাস হচ্ছে আম্মু, আমি চলে এসেছি।”

“কেন? শরীর খারাপ নাকি? আর তুই কান্নাকাটি করছিস নাকি? চোখমুখ ফোলা ফোলা লাগে।”

“আম্মু আজ ভাইবা পরীক্ষা ছিল। ভালো হয় নাই, ম্যাডাম সবার সামনে বকা দিয়েছেন, তাই কান্না করছি। ভালো লাগছিল না দেখে চলে এসেছে।”

“আরে পরীক্ষা খারাপ হয়েছে কেন? আর বাকি ক্লাস যে না করে চলি আসলি সেটা সমস্যা হবে না? কলেজে কী বলবে?”

“আম্মু, এখন তো স্কুলে পড়ি না যে হঠাৎ চলে আসলে টিচাররা অস্থির হয়ে খোঁজাখুঁজি করবে। অনেকেই পছন্দ মাফিক ক্লাস করে।”

“তোর আব্বু এসব একদম পছন্দ করে না অরণী। পছন্দ মাফিক ক্লাস করা মানে কী? সব ক্লাস করবি। এইসব ফাঁকিবাজি করছিস দেখে পরীক্ষা খারাপ হয়েছে।”

মা মেয়ের কথার মাঝে অরণীর দাদী মোমেনা খাতুন এসে দাঁড়ান, “জামিলের বৌ, তোমার অসুখ বিসুখের জ্বালায় মাইয়ার লেখাপড়া মাথাত উঠছে। এখন মেয়েরে বকো ক্যান। সকালেও বিছানাত পইড়া ছিলা, আমার নাতনি নাস্তা রেডি কইরা কলেজ গেল। অথচ আগে ঘুম থেইক্কা উঠলে একটু পড়তে বসতো। এখন বাসার কাম কইরা কুল পায় না, পড়বো কী। এইটুকু মাইয়ারে রান্ধন বান্ধনে লাগাই দাও। আসলে ডাক্তারি পড়ার মূল্য তুমি কী বুঝবা, তোমগো বংশে কেউ ডাক্তারি পড়ছেনি।”

“আম্মা, আপনি আর আপনার ছেলে কিছু হইলেই খালি আমাকে দোষ দেন। ছেলেমেয়েগুলো যখন ভালো রেজাল্ট করে তখন বাবার ব্রেন পাইসে, ফুপুদের মতো হইছে। আর খারাপ করলে আমার বংশ নিয়ে টানাটানি। ডাক্তারি না পড়লেও আমার দুইভাই মাস্টার্স করছে। বকলম না কেউ।”

অরণী আসলে পথে আসতে আসতে ভাবছিল কী বলবে। তাছাড়া মা একনজর দেখলে বুঝে যাবে যে অরণী কান্না করেছে। একটু কাঁদলে অরণীর চোখমুখ ফুলে যায়। শেষে ঠিক করে পরীক্ষা খারাপ হয়েছে বলবে। মা হয়তে একটু বকবে কিন্তু কান্না আর অসময়ে বাসায় আসার বিষয়টা সামলে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটাও সহজ সমাধান ছিল না। দাদী এই কথা বাবাকে অবশ্যই বলবে। আজ বাসায় একটা অশান্তি হবে। এই একটা জিনিস অরণীর অসহ্য লাগে, এই বাসায় কোন কিছু যেন কেউ সহজ করে গ্রহণ করতে পারে না। তার কত ক্লাসমেট আইটেম আর কার্ড ফাইনালে পেন্ডিং খায়, মেডিকেলে তো এগুলো মামুলি ব্যাপার, কত মানুষ বছর বছর সাপ্লি খেয়ে পাঁচ বছরের কোর্স সাত আট বছরে শেষ করছে। স্যার ম্যামদের কাছে পাশ করার চেয়ে ফেল করা সহজ। সবাই বলে ডাক্তারি পাশ এত সহজ নয়। কিন্তু অরণীর বাসায় কোন কিছু সহজে গ্রহণ করবে না। এখনো রেজাল্ট হলে বাবা জিজ্ঞেস করবে কত মার্কস পেয়েছে, রোল কত হলো, আরও ভালো হলো না কেন। যেখানে পাশ মার্কসই একশোতে ষাট, সেখানে একবারে প্রফের পুলসিরাত পার হওয়াই এভারেস্ট জয়ের আনন্দের মতো। কিন্তু বাসায় কেউ বোঝে না। একশোতে সত্তর কেনো পেয়েছে, নব্বই কেনো পেলো না, এই নিয়ে যেন অসন্তোষ। অরণী বোঝাতে পারে না যে এটা তো স্কুলের লেখাপড়া না। এই যে আজ এই পরীক্ষা কান্ড শেষ পর্যন্ত কই যায় কে জানে।

“দাদী, আপনি আম্মুকে দোষ দেন কেন? আমি নিজেই পড়ি নাই। রাতে তো পড়তে পারতাম, আমিই পড়ি নাই। ছোট পরীক্ষা ছিল, ভাইবা দশ মার্কসের। এত জরুরি কিছু না। আমাদের প্রতিদিনই কোন না কোন আইটেম থাকে। এটা এত চিন্তার কিছু না।”

হুমায়রা বেগম আর মোমেনা খাতুন তাও শান্ত হোন না। অরণীর এবার সত্যি চিন্তা হচ্ছে। এদিকে সাইলেন্ট ফোনে একের পর এক ম্যাসেজ এসে জমছে। ম্যাসেজর রিপ্লাই না পেয়ে রিদম ফোন করা শুরু করছে। অরণী ফোনটা বন্ধ করে দেয়।

****

অরণীর উপর রাগ করে রিদম তখন উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলেও একটু পর মাথা ঠান্ডা হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় অস্থিরতা। বারবার মনে হচ্ছে অরণীকে অতগুলো কড়া কথা না বললেও হতো। অরণী কেমন পরিবারের মেয়ে তাতো তার অজানা নয়। ফয়সালের উপর রাগ হয়, শালা কয়দিন ধরে বন্ধুরা ক্ষেপাচ্ছিল যে কী প্রেম করিস, এখনো রুম ডেটতো দূর হাতও ঠিক মতো ধরতে পারলি না। শুরুতে রিদম কানে নিতো না। কিন্তু ইদানীং ফয়সাল বোঝাচ্ছে যে একদম ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়, দু একটা প্রেমের প্রমাণ হাতে রাখতে হয়, না হলে অরণীর মতো বাবা মায়ের কথামতো চলা গুড গার্লরা হঠাৎ পল্টি খায়, আর সুন্দরমতো বাবা মায়ের পছন্দের ছেলে বিয়ে করে অন্যের ঘরণী হয়ে যায়। বেচারা প্রেমিকগুলো না বৌ পায়, না প্রেমিকা, কারণ প্রেমের সময় এই মেয়েগুলো এত নেকু থাকে যে হাতও ধরতে দিতে চায় না। খামোখা সময়, টাকা আর ইমোশন নষ্ট।

দিনের পর দিন ফয়সালের বয়ান শুনে রিদমের ব্রেনওয়াশ হয়ে গিয়েছে। গত বেশ কিছুদিন ধরেই রিদম অরণীকে বাইরে নিয়ে পার্কে যাওয়ার জন্য জোরাজোরি করছিল। কোন দামী রেস্টুরেন্টে নেওয়া এই মুহূর্তে তার পক্ষে সম্ভব না। পকেটের অবস্থা ভালো না, তবে শান্তি এটাই যে অরণী এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি কখনো। দামি উপহার, ভালো রেস্তোরাঁ এসব নিয়ে কখনোই চাপ দেয়নি। রিদমের সাথে টঙের দোকানের চা সিঙ্গারায় সন্তুষ্ট থাকে। তারপরও ফয়সালের কথায় মনে হয় আসলেও তো এখনও অরণী এত বাবা মায়ের ভয়ে অস্থির থাকে, এই মেয়েকেতো একটু চাপ দিলেই সুরসুর করে বিয়ে করে ফেলবে। রিদমের অরণীকে চাই, ভালোবাসা না অবসেশন ও জানে না। কিন্তু অরণী তারকাছে এক মাদকের নেশার মতো। সেই টোল পড়া হাসি সে আর কারও সাথে ভাগ করতে চায় না, অরণীর একমাথা চুলে যদি কেউ নাক ঢুবিয়ে শ্বাস নেয়, তবে তা রিদমই হবে। এই শ্যামল বরণ মায়াবী মেয়েটার চোখের কাজলে শুধু তারই নাম লেখা থাকবে। আর তারজন্য যদি অরণীকে একটু চাপ দিতে হয় তাও দিতে রাজি।
তাই তো ফয়সাল যখন বলে, “শোন অরণী নরম ধরনের মেয়ে। তুই ওকে একটু হাতে নিতে পারলে আর তোকে ছাড়তে পারবে না।”

“দোস্ত আমি অরণীকে যতটুকু ভালোবাসি, ও আমাকে তারচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আমার চেয়ে বেশি বিয়ের কথা অরণীই বলে।”

“আঁতেলে মতো কথা বলিস না তো রিদম। তুই শালা ওই চোখে দেখে মন ভরাবি, মা* নিয়ে টান দিবে অন্য কেউ”

“ফয়সাল, মুখ সামলে কথা বল।”

“আচ্ছা স্যরি। আরে আমার মুখ দিয়ে এসব কথা এমনি বের হয়। তুই রাগতেছিস কেন। শোন একটু ঘনিষ্ঠ ছবিটবি হাতে থাকলে ভালো। ও তোকে কোন নু*স পাঠিয়েছে আজ পর্যন্ত? পাঠায়নি তাই না? তারমানে ও তোকে বিশ্বাসই করে না।”

“আমি ওকে কখনো পাঠাতে বলিও নাই। প্রযুক্তির কোন বিশ্বাস আছে? আমার ফোন চুরি হলে এইসব ছবির কী হবে জানিস?”

“আচ্ছা ছবি বাদ দে। তোর সাথে সেলফি তে তুলতে পারিস।”

“ও ভয় পায়, ফেসবুকে দিলে কেউ দেখে ফেললে ওর বাসায় সমস্যা হবে।”

“তাহলে তোর কাছে প্রেমের প্রমাণ কী আছ? ঐ চ্যাটবক্স? শোন ভবিষ্যতে সব অস্বীকার করে বলবে আইডি হ্যাক হইছে। না হলে বলবে শুধু বন্ধু ভাবতো তোকে। সময়ে সময়ে এই সব নিরীহ মেয়েরা শেয়ালের চেয়েও ধূর্ত হয়।”

অতঃপর ফয়সালের কথায় একসম রিদমের মনে হয়, আসলেও তো টুকটাক ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা বলাতো প্রেমে অন্যায় কিছু না। চেষ্টাও করেছিল, দু একটা ফোনকল রেকর্ডও করে রাখবে ভেবেছে। কিন্তু অরণীর সাথে এসব কথা আগায় না। আর যেসময় এসব কথা আগানো যায়, অর্থাৎ গভীর রাতে, তখন অরণী ফোনই ধরে না, চ্যাটও করে না। পার্কে যাওয়ার জন্য বলতে বলতেও অরণী সাহস করে না। ভেবেছিল পার্কে একসাথে সময় কাটাবে, কিছু ছবি তুলবে। তাই তো আজ প্ল্যান করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। যখন থেকে মাথা ঠান্ডা হয়েছে অরণীকে ফোন আর ম্যাসেজ করে যাচ্ছে। অরণী বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে না এমনটাই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এখন ফোন বন্ধ পাওয়ায় রিদমের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়।

****
সন্ধ্যার পর বাসায় একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। জামিল সাহেব বাসায় ঢুকতেই মোমেনা বেগম অরণীর পরীক্ষায় খারাপ করার কথা জানালেন। জামিল সাহেব অরণীকে শাসন করার আগে হুমায়রাকে নিয়ে পড়লেন। কথায় কথায় কথা এতদূর বেড়ে গেলো যে হুমায়রার হাঁপানির টান উঠে গিয়েছে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here