#সময়ের_পালাবদল
শামসুল ইসলাম
শেষ পর্বঃ
.
তালহা বাজারে বিক্রি করে প্রচুর মুলধন উপার্জন করলো।
তাঁর ফসল বিক্রি করা টাকা দিয়ে আশেপাশে আরো কয়েক বিঘা জমি চুক্তি করে নিলো। সেখানেই আবার চাষাবাদ শুরু করলো, এভাবে তালহার উপার্জন দিনদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তালহা কখনোই একটা পয়শা ফাকি দেইনি, সম্পদের যা যাকাত হয় তা পরিপুর্ন আদায় করেন।
এভাবে তাঁদের সংসারে শুখ ফিরে আসে, তালহা আর তাহেরার সংসার চলতে থাকে।
এভাবেই কয়েকবছর অতিবাহিত হলো, তাহেরার কোলজুড়ে প্রথম কন্যা সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়েছে। দ্বিতীয় সন্তান ছেলে আবার তাহেরা গর্ভবতী।
তাহেরার দুই মা তাঁর সন্তানদের নিয়ে তাঁদের দিন অতিবাহিত হয়, তাঁদের সংসারে মনে হয় জান্নাতী হাওয়া বয়ে যাই।
তালহা প্রথমে চরের উপরে একটা মসজিদ দাড় করাই, ক্রমান্বয় তা নিজ অর্থায়ন ও সাথে চরের লোকজনের সহযোগীতায় মসজিদটা পাকা করেন। এভাবে তালহা সেই মসজিদে ফ্রি টাকায় ইমামতি করেন, প্রতিবেশিদের সন্তানদের ফ্রি কোরাআন শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।

তালহা মসজিদে মক্তব খোলে ভোরে ফজরের সালাতের পরে শিশুদের ফ্রি কোরআন শিক্ষা দেই এবং রাতে মাগরিবের পর বয়স্কদের কোরআন শিক্ষা দেই।
তালহাকে সবায় বেতন দেওয়ার জন্য অনেক খোশামোদ করেন, কিন্তু সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন বিনিময় গ্রহন করতে চান না।
তালহা তাঁদের বলেন- ” আল্লাহপাক আমাকে যা দিয়েছেন তাতেই অনেক, আর চাইনা।”

তালহা এখন আর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন না, তাঁর সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর গোয়াল ভরা গরু মাঠভরা ফসলের সমাহার, তাঁর ক্ষেতখামার দেখাশোনার জন্য সর্বদা কয়েকজন উপস্থিত থাকেন।
সমস্ত কাজকাম এখন টাকার বিনিময়ে করান, দিনদিন তালহার সম্পদ এভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।

হাসুর দিনকাল ভালোই যাচ্ছে, তবে মনের ভীতরে চাপাকষ্টে সে দগ্ধ! কারন সে নিঃসন্তান। এভাবে প্রায় ২০ বছর পাড়ি দিয়েছে, দ্বিতীয় বিয়ে করার সাহস পাইনি কারন হাসুর শারিরিক সমস্যা।
প্রথমদিকে হাসু হাসিকে দায়ি করতো সন্তান না হবার কারনে, কিন্তু যখন বিষয়টা ডাক্টারের মাধ্যমে জানতে পারলো তাঁর সমস্যা সেদিন থেকে হাসির ওপরে অমানবিক অত্যাচার প্রত্যাহার করে নেই।

হাসুর অক্ষমতার খবর গ্রামের মানুষের কানেকানে পৌঁছে গেছে, তাঁর এমন দুর্বলতার জন্য গ্রামের মাতব্বারি থেকে নাম কাটা পড়েছে।
গ্রামের মানুষ এখন আর কেউ তাকে মুল্যায়ন করেনা, হাসুর যে ক্ষমতা আর অহংকার সম্পদের দাপোট ছিলো তা ক্রমান্বয় হ্রাস পাচ্ছে।
মানুষের কাছে নানান উপায়ে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় তৈরি করে, তা মানুষের দির্ঘশ্বাস আর চোখের পানিতে নষ্ট হয়ে যাবার উপক্রম।
হাসি হাসুকে ছেড়ে চলে যাবার জন্য পাড়াপড়শিরা অনেক কুপরামর্শ প্রদান করেও কাজ হয়নি, তাঁর মুখে একই কথা বিয়ে জীবনে একবারই হয়। যদি এসমস্যা আমার হত তাহলে তো সে হয়তো ছেড়ে চলে যেত না।
এসব বুঝ দিয়ে নিজেকে শান্তনা দিয়ে এখনো হাসুর সংসারে টিকে আছে।
গ্রামের ভিতরে এখনো হাসুর সব থেকে সম্পদশালী, গ্রামের যেখানেই পা দিবে মানুষ সেখানেই হাসুর জমি পাওয়া যাবে।

এভাবে দিন অতিবাহিত হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ হাসু অসুস্থ অনুভব করলো, কিন্তু তাঁর অসুস্থতার প্রতি তেমন গ্ররুত্বরোপ করলো না।

এভাবে বেশ কয়দিন অতিবাহিত হওয়ার পর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ডাক্টার দেখালে রোগ নির্ণয় করতে পারেনা তবে তাঁর অসুস্থতা দিনদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
হাসুর হাতে নগত সমস্ত টাকা পয়সা খরচা হয়ে যায় তাঁর অসুস্থতার জন্য।
এভাবে গোয়াল ঘরের গরু, গুদামজাত করে রাখা ফসল, পুকুরভরা মাছ সব ক্রমান্বয় শেষ হয়ে যায় কিন্তু তাঁর অসুস্থতা কি রোগের কারন! তা নির্ণয় করতে সকল ডাক্টার ব্যর্থ হয়ে যায়।

হাসু টাকার অভাবে এখন জমিতে হাত দিয়েছে, টুকটাক করে জমিজমা বিক্রি শুরু করে গ্রামের ধনী ও গরিব চাষিরা কিছু জমি ক্রয় করেন। সে টাকা দিয়ে হাসু চিকিৎসার খরচ বহন করে, কিন্তু সুস্থ হয় না।
তাঁর আরো টাকার প্রয়োজনে জমি বিক্রি করবে কিন্তু কেউ কিনতে পারছে না কারন যাদের যা পুঁজি ছিলো তা দিয়ে তাঁরা সামার্থনুযায়ী হাসুর থেকে জমি কিনেছে।
এখন হাসুর অনেক টাকার প্রয়োজন চিকিৎসার জন্য, কিন্তু কেউ জমিজমা কিনতে পারছেনা।
হঠাৎ একটা লোক খবর দিলো, চরের তালহা নামের এক ধনী মানুষ জমি কিনতে আগ্রহী।
হাসুর আর বুঝতে বাকি নেই কোন তালহা সে!
উপায় না পেয়ে তালহাকে খবর দিলো, সে এসে প্রথমে জমি কিনে গ্রামের অসহায় দরিদ্রের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেন যার সম্পুর্ন চিকিৎসা ফ্রি।
সাথেসাথে একটা এতিমখানা স্থাপন করেন, সেখানে গরিব পুলাপানের ফ্রি হিফজ করার সুব্যবস্থা করে দেন নিজ অর্থায়নে।


হাসুর সমস্ত জমিজমা সব তালহার কাছে বিক্রি করতে বাধ্যহয়েছে। সর্বশেষ হাসির কিছু গহনাগাঁটি ছিলো, তা গোপনে চুরি করে অন্যত্র বিক্রি করে চিকিৎসা নেই। কিন্তু কোন চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয় করতে পারিনি, তার একটাই সমস্যা প্রচন্ড পেটব্যথা।
এই পেটব্যথায় তাঁর সমস্ত সম্পদ ভক্ষণ করেছে। হাসু এখন পথের ভিখারি, গ্রামের কোন চায়ের দোকানে বসলে তাকে এক কাপ চা খেতে দেইনা কারন সে বিল পরিশোধ করবে পারবেনা।
হাসি এখন মানুষের বাড়িতে কাজ করে তাঁর পেট চালাই।
তালহা গ্রামের অসহায় নারীদের জন্য একটি হস্তশিল্পের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। হাসু মানুষের বাড়ি কাজ না করে তালহার প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন, এভাবে তাঁর দিন অতিবাহিত হয়।
হাসু এখন প্রায় হাফপাগল অবস্থায় ঘোরাফেরা করে গ্রামে, ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করেনা।
তাঁর রোগটা তালহার তৈরি হাসপাতালের ফ্রি চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় হয়ে যাই।
হাসু জীবনে কি থেকে কি হয়ে গেলো এসব চিন্তাভাবনায় তাকে মানসিক রোগী করে তুলেছে।
ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করেনা, কেমন যেন দেবদাসের মত চলাফেরা।
এভাবে কিছুদিন পর হাসি হাসুকে প্রায় শেষ বয়সে তালাক প্রদান করে।
হাসুর আর কোথাও একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই হয়না, পেটে একমুঠ দানাপানি দেওয়ার অবস্থা থাকে না।
তালহা ইতিমধ্যে গ্রামের একচ্ছত্রাধিপত্য হয়ে ওঠে মানুষের ভালোবাসা ও দো’আর মাধ্যমে।
তালহা ও তাহেরার মোট পাঁচ সন্তান, তাঁর ছেলেরা কেউ ডাক্টার কেউ দ্বীনের বড়ো দায়ি আর মেয়েগুলো বড়ো মাপের আলেমা আবার তাঁদের জামায়গুলো প্রখ্যাত আলিম।
তো যাইহোক, তালহা তাঁর গ্রাম সহ তাঁদের এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। সকলের মুখেমুখে তাঁর নাম, তালহার ব্যবহার দ্বীনদারিতা দান-খইরাতের হাত গোপনে প্রকাশ্যে মানুষরে সহযোগীতা করার ফলে মানুষ অন্তর থেকে মন উজাড় করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার কাছে দো’আ করেন, যার ফল স্বরুপ আজ গ্রামের ছোটখাটো ইমাম থেকে আজ উপজেলার ভিতরে সবথেকে বড়ো দাতা।

আজ হাসুর করুন অবস্থা! যে সম্পদ তালহার প্রাপ্য ছিলো সেটা আল্লাহপাক তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তেমনি গ্রামের হতদরিদ্র কৃষকদের সম্পদ তাঁদের কাছে পৌছে দিয়েছেন।
এভাবেই সময়ের পালাবদল ঘটিয়ে দিবে দিচ্ছেন ও ভবিষ্যতে দিবেন।
সর্বশেষ হাসুর শেষ আশ্রয়স্থল হয় দিগন্তবিস্তৃত মাঠের একটা ঝোপঝাড়ের ভিতরে গলিত লাশ উদ্ধার করে গ্রামবাসী।
পরে জানা যাই, হাসু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে মাঠের ভিতরে চলে যাই, এবং কোন কারনে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শেয়াল কুকুরের তাঁর লাশকে ছিড়ে লন্ডভন্ড করে করে দেই। শুধুই মুখের আকৃতিটা মানুষ চিনতে পারেন, যে এটাই সেই হাসু!!!
যার প্রভাব ক্ষমতার অহংকারে গ্রামের সমস্ত মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত থাকতো আর আজ তাঁর লাশটা নিজের জাইগাই দাফনকাফন করার মত সম্পদ নেই।
এটাই #সময়ের_পালাবদল।
.
___সমাপ্ত___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here