#সময়ের_পালাবদল
শামসুল ইসলাম
পর্বঃ- ৭
.
তালহাকে তাহেরার সাথে বিয়ে দিয়ে তাঁদের সাথে তাহেরার দুই মাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো।
তালহা প্রাথমিকভাবে অনেক দুমড়ে মুচড়ে গেছিল, কিন্তু বর্তমানে নিতান্ত আল্লাহপাকের কঠিন পরিক্ষা ভেবে অনেকটা সংবরণ করে নিয়েছে।
তালহা মনেমনে এটা ভেবেও বেশি হতাশ হয়নি যে, “ আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় বান্দাদের বেশি পরিক্ষা করেন, আর অপ্রিয় বান্দাদের ক্ষমতা সম্পদের অহংকার দিয়ে পরিক্ষা করে এবং একপর্যায় তাঁরা সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়।”
এসব ভেবে পরেরদিন সকালে প্রয়োজনীয় কয়েকটি জিনিসপত্র তাঁদের দেওয়া হলো, বাকি সব হাসুর নামে হস্তগত করা হলো। তালহা বিপাকে পড়ে গেছে, এখন কোথায় যাবে তাঁদের নিয়ে!
এদিকে তাঁর গ্রামে যাবে তা আর উপায় নেই, কারন তাঁর পিতা গত বছর মারা গেছেন মাও অনেক আগে মারা গেছেন।
তালহার গ্রামটা ছিলো নদীর পাশে, বর্তমানে তালহাদের সমস্ত ভিটেমাটি সব নদীর গহ্বরে ধ্বংস হয়ে গেছে।
তাঁর ভায়েরা কে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে তা ঠিকমতো জানা যাইনি। শুধুমাত্র একটি বড়ো ভাই আছেন, তাকেই অভিভাবক হিসাবে মান্য করতো। কিন্তু গ্রামের এসব অপ্রিতিকর ঘটনাতে শেষ আশ্রয়স্থলটুকু হারাতে হয়েছে।
তাহেরা গত দুদিনে কিছু খাইনি ও একটা কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিনি, অনবরত কেঁদেকেটে বুক ভাষিয়েছে। মটেই প্রস্তুত ছিলোনা এতোবড় আঘাত সইবার, তবুও এতকিছুর মধ্যে তালহাকে পেয়ে বুকের মাঝে কিছুনা শান্তি অনুভব করছে।
তাহেরা মনেমনে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাঁর প্রিয়তমের প্রতি অত্যাচার মিথ্যা অপবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি কথা ভেবে।
তালহা ভেবে পায়না!! কোথায় যাবে।
রুবির হঠাৎ মনে পড়লো! আব্দুল মজিদ তাঁর দুই স্ত্রীর নামে চার বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছিল। জমিটা হচ্ছে চরের ভিতরে, চারিপাশে নদী মাঝখানে চর। এই চরের বয়স প্রায় ২০ বছর, ভাঙ্গনের সম্ভাবনা খুবি কম। অনেক বড়ো চর! কিন্তু বসতি তেমন নেই। সবাই চাষাবাদ করে উপারে নিয়ে চলে আসে।

তালহা সহ তাহেরা ও তাঁর দুই মাকে নিয়ে নবচরে নৌকাতে পৌঁছাল। তালহার কাছে কিছু টাকাপয়সা ছিলো, তা দিয়ে দিনের ভিতরে দুইটা ঘর দাড় করালো।
যতোটুক সম্ভভ বাড়ির চারিপাশে কলাপাতা দিয়ে ঘিরলো।
মোটামুটি একটা আবাস্থল হলো, তালহা আল্লাহর কাছে প্রশংসায় মাথা নুইয়ে দিল। যখন গ্রাম থেকে বিতাড়িত করলো, কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই। ঠিক তখন আল্লাহপাক একটা বন্দবস্ত করে দিলেন।
এই চরটা গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দুরে, খুবি শান্তশিষ্ট পরিবেশ, পলি মাঠি ফসল চাষের জন্য খুবি উপযোগী।
সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটাখাটি করে সন্ধার সময় তালহার দেহ অবসন্ন হয়ে এলো, এর মাঝে রুবি তাহেরার সাথে রাতের জন্য কিছু খাবার রান্না করলো।
তাহেরা ঘরে এসে দেখালো তালহা ঘুমিয়ে পড়েছে, তালহার চেহারাটা দেখে তাহেরার খুব মায়া হলো। খেয়াল করলো! তালহার গায়ে গেঞ্জিটা গরমে ঘামে ভিজে গেছে, খুলে দিবার উপায় নেই। তাই হাতপাখাটি নিয়ে পাশে বসে তালহাকে বাতাস করতে লাগলো।
এভাবে অনেকক্ষণ বাতাস করার পর হঠাৎ তালহা ঘুম থেকে জাগ্রত হলো, খেয়াল করলো তাহেরা বাতাস করছে। তাহেরা সারাদিন তালহার সাথে কোনো কথা বলিনি, মনের চাপাকষ্টে স্বাভাবিক থাকতে পারিনি সে। বিষয়টা তালহা বুঝতে পেরে সেউ কথা বলিনি, স্বাভাবিক ভাবে সময় দিয়েছে তাহেরাকে।
এসব বাড়ি তৈরির কাজকাম শেষ হলেই নিরিবিলি বসে তাহেরাকে সব বুঝিয়ে মনটাকে শান্তকরে দিবে।
যাইহোক! তাহেরা তালহার জাগ্রত হওয়া বুঝতে পারলো, লজ্জাই আর বাতাস না করে দ্রুতবেগে বাইরে বের হয়ে যাবে এমন সময় তালহা খপকরে তাহেরার হাত ধরলো।
তালহার হাতের স্পর্শে তাহেরা আর নড়াচড়া করলো না, চুপটি মেরে মাথা নিচু করে বসে থাকলো।
তালহা পাসে মিটিমিটি ল্যাম্পের আলো জ্বলে, তা হাতে করে তাহেরার মুখের কাছে এগিয়ে ধরে বলল-
« কি ব্যাপার বরকে দেখে বউ কখনো এতো ভয় পায়?
তাহেরার অন্তরাত্মায় কাঁপাকাঁপি ধরে দিছে। তবুও স্বাভাবিক হয়ে বললো-
« না ভয় পাচ্ছিনে।
« তাহলে চলে যাচ্ছ যে?
« সারাদিন কিছু খাননি, তাই খাবার আনতে যাচ্ছিলাম।
« খাবার লাগবে না, একটু তোমাকে আত্মাভরে দেখলেই আমার পেটের খিদে চুকে যাবে।
তাহেরা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো-
« আমাকে ক্ষমা করে দিন, আজ আমার পরিবার ও আমার জন্যই আপনার এতো অপমান অপদস্থ হতে হলো। সবকিছু সর্বশান্ত করে দিয়েছে তাঁরা, কিছুই রইলো না আমার। তবুও আপনি আমার মতো একজন এতিম অসহায় মেয়েকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা কষ্টের সাথে জড়িয়ে নিয়েছেন। কখনোই চাইনি আপনার জীবনে এমন কিছু হোক! কিন্তু আল্লাহপাক কেনজানি সব ভালোভাবে ঘটার পূর্বেই অঘটন ঘটিয়ে দিলেন।
তালহা তাহেরাকে বুকের ভিতরে টেনে নিয়ে বললো –
« চুপ করো! তোমার মত স্ত্রী পেয়েছি তাতেই আমার হবে, সুখেদুঃখে পাসে থেকো একটু ভালোবাসার পরশ দিও তাতেই হবে। আর এসবের জন্য তুমি ও তোমার পরিবারের কেউ দায়ী নও, সব আল্লাহ পাকের পরিক্ষা। সুতরাং আর কখনো ভুলেও নিজেকে দোষী ভাববে না, ধৈর্যধরো অতি শিঘ্রয় আল্লাহপাক আমাদের কানাইকানাই ভরিয়ে দিবেন ইনশাআল্লাহ্‌।
তাহেরা তালহার বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে তাঁর গেঞ্জি ভিজিয়ে দিয়েছে, তালহা দুইহাত দিয়ে তাকে উঠিয়ে চোখেচোখ রেখে বললো-
« ইশ!! আমার বউটা না খেয়ে চেহারাটা নষ্ট করে ফেলেছে, যাও খাবার আনো খাবো।
« এশার সালাত আদায় করে খেলে ভালো হতো।
« এই যে দিন শেষে একটা উত্তম বউর মতো কথা বললে।
তাহেরা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো, কিছুক্ষণ চুপথেকে তালহার দিকে দুহাত বাড়িয়ে বললো-
« আপনি হাত দুইটা উচু করুন, আপনার গায়ের গেঞ্জিটা খুলে দিই। ঘেমে গেছে এই ঘাম শরিরে বসে ঠান্ডা লাগতে পারে।
তালহা সশব্দে বললো-
« আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল, আল্লাহপাক আমাকে উত্তম সঙ্গী দান করেছেন।
তাহেরা মুচকি হাসি দিয়ে বললো-
« চলুন নদী থেকে পানি এনে ওযু করে সালাত আদায় করি।

রাতের খাওয়াদাওয়া পর্ব পরিসমাপ্তি করে এবার ঘুমানোর পালা।
তাহেরার হৃদপৃন্ড মৃদু প্রস্ফুরণ হচ্ছে, রাতের খাবার খেয়ে তাহেরা আর রুবির কাছ থেকে যাচ্ছেনা।
রুবি জিজ্ঞেস করলো-
« কিরে মা তালহার ঘরে যা এমন করছিস কেন?
তাহেরা চুপ করে রইলো, মনেমনে ভয় পাচ্ছে। ব্যাপারটা রুবি বুঝতে পেরে তাহেরার বামহাত ধরে তালহার ঘরের দিকে হাটা শুরু করলো।
দরজার সামনে যেয়ে রুবি তালহাকে ডাকলো-
« তালহা?
« জ্বি চাচিমা!
রুবি অবাক হয়ে বললো-
« সে কি বাবা!! আমি তোমার শাশোড়ি, আমাকে মা বলে ডাকবে আজ থেকে। এই নাও বাবা! আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলাম, আল্লাহপাক তোমাদের সুখে শান্তিতে রাখুক দো’আ করি। নানান সমস্যার প্রতিকূলতায় তোমাদের পরিণয়টা শান্তিতে দাতে পারলাম না।
কথাটি বলে রুবি কেঁদে দিলো, তালহা বুঝিয়ে শান্তকরে তাঁকে বিদায় করলো।
তাহেরাকে ঘরের ভিতরে আসতে অনুরোধ করলো, তাহেরা চুপিসারে প্রবেশ করলো। তালহা জিজ্ঞেস করলো-
« ভয় পাও কেন এতো! আমি কি অন্য কেউ? তোমার স্বামী আমি। ভয়ের কোনো কারন নেই।
তাহেরা চুপচাপ বসে থাকলো, তালহা বললো-
« চলো দুই রাকা’আত সালাত পড়ে নিই, সাথে নববিবাহিত দম্পতীদের কিছু করণীয় আছে তা পালন করি।
তাহেরা তালহাকে অনুসরণ করলো। সালাত পড়ে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা কাজকাম শেরে শুয়ে পড়লো দুজনে।
কিছুক্ষণ পর সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটাখাটির পর ক্লান্ত অবসন্ন দেহে দুজনে গভীর ঘুমে লুটিয়ে পড়লো……(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here