#শ্রাবণের_শেষ_সন্ধ্যা
#১৫তম_পর্ব

ক্যাম্পফায়ারটা একটু দূরে হওয়ায় খানিকটা পথ হেটে যেতে হবে নবনীতাকে। রিসোর্টের আলো ততটা জ্বলছে না। পাহাড়ে কোনো বিদ্যুৎ কানেকশন নেই। উপরন্তু এখানে রাত হতে না হতেই প্রকৃতি শান্ত এবং নীরব হয়ে উঠে। নবনীতা তাই একটু দেখে শুনেই এগোতে থাকে। যেহেতু রিসোর্টের সব পর্যটক ক্যাম্পফায়ারে। তাই রিসোর্ট এর পরিবেশ একটু বেশী ই নীরব হয়ে গিয়েছে। ক্যাম্পফায়ারের কলরবের ধ্বনি আসছে। হঠাৎ নবনীতার মনে হয় কেউ তার পিছু নিয়েছে। ঘাসের উপর মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পায় সে। হুট করেই মনটা ভয়ে কেঁপে উঠে। নবনীতা পেছনে না তাকিয়েই পায়ের গতি বাড়ায়। পিছু নেওয়া লোকটিও তার গতি বাড়ায়। লোকটি খুব কাছে এসে পড়লেই নবনীতা তার ছোট ব্যাগে লুকানো এন্টিকাটারটি বের করে। তারপর চোখ বন্ধ করেই হামলা করে বসে পেছনে অবস্থান করা লোকটির উপর। অতর্কিতে হামলা হওয়ায় লোকটি খানিকটা ভয় পেয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিয়ে পড়ে যায়। তারপর চিৎকার করে বলে,
“ভাবী আমি, আমি শ্রাবণ।“

শ্রাবণের কাঁপা কন্ঠে কর্ণবিবরে যেতেই চোখ খুলে নবনীতা। সে এখনো কাঁপছে। ভয়ে তার হাত পা জমে গিয়েছে। গলাটা যেনো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রীতিমতো হাপাচ্ছে সে। চোখ খুলে দেখতে পেলো শ্রাবণ মাটিতে বসে আছে। তার চোখ বিস্ফোরিত রুপ নিয়েছে। তার গালের এক পাশে সামান্য চিরে গেছে। তা থেকে ফোটায় ফোটায় রক্ত বের হচ্ছে। শ্রাবণের চোখ বিস্ফোরিত রুপ নিয়েছে। নবনীতা এখনো শান্ত হতে পারছে না। ভীত চোখে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের দিকে। এখনো তার এন্টিকাটার তাক করে আছে শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ এবার একটু সাহস করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ধীর কন্ঠে বলে,
“ভাবী রিল্যাক্স, আমি।“
“এগোবেন না, আমি আবার আপনাকে আঘাত করতে বাধ্য হবো।“

কাঁপা স্বরে কথাটা বলে নবনীতা। নবনীতার অবিশ্বাসের দৃষ্টি বুঝতে সময় লাগে না শ্রাবণের। সে ধীর স্বরে বলে,
“আমি আপনাকে কিছুই করবো না। ট্রাস্ট মি।“
“তাহলে পিছু নিয়েছিলেন কেনো?”
“আমি আমার রুমে যাচ্ছিলাম, ডিএসএলআর এর ম্যামোরি কার্ডটা রুমে ছিলো। আমি সত্যি আপনার পিছু করছিলাম না। দেখুন এই যে আমার গলায় ক্যামেরা।“
“………”
“ভাবী, প্লিজ কাটারটা নামান। ভয় লাগছে।“

এবার নবনীতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে শ্রাবণের দিকে। সত্যি তার গলায় ক্যামেরা। হাতে রুমের চাবি, হয়তো সত্যি সে নিজের রুমে যাচ্ছিলো। তখন নবনীতার নজর যায় তার গালের দিকে, স্নিগ্ধ স্মিত আলোতে রক্তের রেখাটা বোঝা যাচ্ছে। নবনীতা এবার কাটারটা নামিয়ে নেয়। কিন্তু সন্দেহের সূক্ষ্ণ দেয়ালটা ভাঙ্গে না। এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না শ্রাবণকে। ভয়ে তার পা শক্ত হয়ে এসেছে। হাটুতে ভর করে একটু জিড়ায় নবনীতা। পা যেনো মাটির সাথে আঁকড়ে গেছে। শ্রাবণ তখন একটা রুমাল বের করে নিজের গালের রক্তটা মুছে নেয়। আর একটু হলে হার্ট এট্যাক করতো সে। রক্ত মুছতে মুছতে বলে,
“অদ্ভুত ডেঞ্জারাস মেয়ে তো আপনি, ব্যাগে কাটার লুকিয়ে রাখেন। একটু হলে তো খুনাখুনি হয়ে যেতো। আল্লাহ বাঁচাইছেন। নয়তো আগামীকাল হেডলাইন হতো, সাজেকে এক যুবকের গলা কেটে খুন।”

শ্রাবণের কথায় বেশ বিরক্ত হলো নবনীতা। কিন্তু প্রকাশ করলো না। বিরক্তি গিলে বললো,
“সরি”
“ইটস ওকে। কিন্তু একটা কথা বুঝলাম না, কি এমন হলো যে একদম এট্যাক করে বসলেন আপনি। ভয় পাওয়াটা নর্মাল কিন্তু এভাবে এট্যাক করাটা হজম হচ্ছে না। আর আপনি কি সবসময় ব্যাগে এন্টিকাটার রাখেন? না মানুষ নরমালি, মোবাইল, হেডফোন, টাকা রাখে ব্যাগে। আর আপনি এন্টিকাটার রাখেন। তাই কৌতুহল হলো আর কি!”
“আপনি অতিরিক্ত ফাও কথা বলেন। বেশি কৌতুহল ভালো না, জানেন তো! আমি ইচ্ছে করে তো আপনাকে আহত করি নি। সেলফ ডিফেন্স ছিলো সেটা।“

বলেই হনহন করে রুমের দিকে হাটা দেয় নবনীতা। তার বুক এখনো কাঁপছে। ভয়টা গাঢ় জাল বিছিয়েছে মনের আঙ্গিনাতে। ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে গিয়েছে তীব্রভাবে। আজ এক অস্বাভাবিক কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে সে। আর একটু হলে বড় সড় ঘটনা ঘটে যেতো। তখন প্রকাশ না করলেও শ্রাবণের গালের আঁচড় দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো নবনীতা। তাই দ্রুত গতিতে পা চালালো সে। এদিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নবনীতার যাবার পানে তাকিয়ে থাকলো শ্রাবণ। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো তার। চোখ জোড়া রহস্যময় ভাবে চিকচিক করছে। যেনো বহু খুঁজে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। গালের রক্তটা আঙ্গুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বিষ্মিত কন্ঠে বলে,
“Interesting, quite interesting”

তার হাসিটি বিস্তৃত হয়, তারপর আবার নবনীতার দিকে তাকায় সে। নবনীতা রুমে প্রবেশ করেই ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়।

আধা ঘণ্টা হয়ে যাবার পরও নবনীতার ফেরার নাম নেই। শান্তের নজর কিছুক্ষণ বাদ বাদ ঘড়ির দিকে যাচ্ছিলো। নবনীতা এখনো ফেরে নি দেখে, খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লো শান্ত। যদি সর্বোচ্চ দেরিও হয় তাহলে মিনিট পনেরো হতে পারে। অথচ এতোটা দেরি হয়ে যাবার পর ও নবনীতার কোনো খবর নেই বলে দুশ্চিন্তার রেখা ভেসে উঠলো তার কপালে। তার মনে হলো নবনীতাকে একা ছেড়ে দেওয়াটা উচিত হয় নি। তাই দেরি না করে উঠে দাঁড়ালো সে। পাশে বসে থাকা, ফাইয়াজ
তখন বলে উঠলো,
“একি উঠে যাচ্ছো যে?”
“নবনীতা এখনো ফিরে নি ভাই। একটু দেখে আছি।“

ফাইয়াজ এবং নন্দিনী মিটিমিটি হাসলো। তাদের চোখের ভাষা বুঝতে দেরি হলো না শান্তের। তারপর ফাইয়াজ বললো,
“যাও, যাও। দেখো বউটি তোমার হারিয়ে গেলো কি না?”

শান্ত মুচকি হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সেখানে শ্রাবণ এলো। তার ঠিক মিনিট দুয়েক বাদেই নবনীতার আগমন ঘটে। শান্ত দৌড়ে তার কাছে যায়। ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“এতো দেরি করছিলে কেনো? আমি তোমাকে খুজতেই যাচ্ছিলাম।“
“মোবাইল টা খুজে পাচ্ছিলাম না। তাই দেরি হয়ে গিয়েছে।“
“এখন পেয়েছো?”
“হু, চলেন গিয়ে বসি।“

শান্ত খেয়াল করলো নবনীতার চুল গুলো ভেজা। বোঝা যাচ্ছিলো সে মাত্র মাথা ভিজিয়ে এসেছে। কিন্তু শান্ত কোনো প্রশ্ন করলো না। সে জানে নবনীতা উত্তর দিবে না। তাই কথা না বাড়িয়ে ক্যাম্পফায়ারের কাছে গিয়ে বসলো তারা। বারবিকিউ রেডি, এখন সার্ভ করা হচ্ছে। শ্রাবণ সবার ছবি তুলছে। সে শান্ত এবং নবনীতার ও কিছু কাপল পিক তুলে দিতে জোর করলো। ফলে একটু বাধ্য হয়েই নবনীতা এবং শান্তকে একসাথে ছবি তুলতে হলো। শান্ত এবং নবনীতা একটু দূরত্ব রেখে ছবি তুলছিলো। তখন শ্রাবণ মজার ছলে বলে,
“আরে ভাই অন্যের বউকে জড়িয়ে ধরবি না। নিজের ই বউ। একটু কাছে যা। এটা কাপল পিক, তোদের কেউ পানিশমেন্ট দিচ্ছে না।“

শ্রাবণের কথা শুনে শান্ত বা হাতে নবনীতার কোমড় টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে; এদিকে শান্তের শীতল হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে নবনীতা। হৃদস্পন্দনটা বেঁড়ে যায় খানিকটা। শীরদাড়া বেয়ে শীতল রক্তের ধারা বয়ে যায়। অবাক নয়নে শান্তের দিকে তাকায় সে। তখন শান্ত ও তার দিকে তাকায়। সেই সময়ে শ্রাবণ ছবিটা তুলে। হেসে বলে,
“পারফেক্ট।“

ক্যাম্পফায়ার শেষ হবার পর শ্রাবণের সাথে গল্প জুড়ে দেয় শান্ত। এদিকে নবনীতাও পলি এবং নন্দিনীর সাথে গল্প করছিলো। তারা ভরা সাজেকের অন্ধকার নগরীতে গল্প করার যেনো আলাদা নেশা রয়েছে। রাত বাড়ছে, গল্প ও জমে গেছে। হঠাৎ শান্ত করলো শ্রাবণের গালে কাটার দাগ। রক্তগুলোও তাজা। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর গালে কি হয়েছে দোস্ত? কেটে গেছে কিভাবে?”

গালের প্রসঙ্গ তুলতেই শ্রাবণ কিছু একটা ভাবে, তারপর নবনীতার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
“ও কিছু না, একটা জংলী বিলাই আঁচড় দিছে”

তারপর চাহনী সরিয়ে নেয় শ্রাবণ। শ্রাবণের কথা শুনে শান্ত বলে,
“তুই কি অহেতুক বিরক্ত করছিলি ওকে?”
“নারে, আমি তো শুধু কৌতুহল দেখাতে গিয়েছিলাম সামান্য। কৌতুহল কাল হয়ে গেছে।“

বলে হেসে উঠে সে। তারপর কথা ঘুরিয়ে ফেলে শ্রাবণ। মাঝে মাঝে শুধু নবনীতাকে আর চোখে দেখে যাচ্ছিলো সে।

সকাল ৫টা,
অভ্যাসের জন্য ঘুম ভেঙ্গে যায় নবনীতার। এখনো সূর্য উঠে নি। রুম অন্ধকারে ছেয়ে আছে। শীতলতার স্নিগ্ধ পরশ আলতো করে ছুয়ে যাচ্ছে নবনীতার গাল। ওড়নাটা টেনে উঠে বসে সে। শান্ত তখনো ঘুম। নবনীতা তাকায় বারান্দার দিকে। মেঘেরা এসে ভিড় করেছে সেখানে। তাই ফ্রেস হয়ে দাঁড়ায় সে বারান্দায়, ঠান্ডা তুলো গুলো চোখের সামনে ভাসছে। যেনো হাত বাড়ালেই ছুয়ে দিবে। সকালের দিকে মেঘের আসর “মেঘ মাচাং” এর বারান্দায় বসে। সেখান থেকে পাহাড়ের ভিউ টা অসাধারণ লাগে। বুকের কাছে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে থাকে নবনীতা। মুগ্ধ নয়নে দেখছে সে, পাহাড়ের মেঘের খেলা। সাজেক না আসলে হয়তো এই মেঘের লীলা দেখা হতো না। আজ হেলিপ্যাডে সূর্যোদয় দেখার কথা ছিলো তাদের। কিন্তু নবনীতার যেতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে সে। ঠান্ডাটা বাড়ছে। একটা শাল থাকলে মন্দ হতো না। ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ শাল জড়িয়ে দেয় তাকে। নবনীতা পাশে ফিরতেই দেখে ঢুলু ঢুলু নয়নে তার পেছনে শান্ত দাঁড়িয়ে আছে। শালটা জড়িয়ে দেবার পর ও শান্তের হাতের বেস্টনি নবনীতাকে ঘিরেই থাকে। হুট করেই বলে,
“আমি হয়তো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি নবনীতা। আমার একটা রোগ হয়েছে। খুব জটিল রোগ।“

শান্তের কথাটা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে নবনীতার। অবাক চোখে তাকাতেই সে বলে,
……………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here