#শৈবলিনী—৫২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★এরই মাঝে আরও এক সপ্তাহ কেটে গেছে। সবার জীবনেই অনেক টা পরিবর্তন ঘটছে। নূর এখন তার জীবনের সবচেয়ে সুখময় অধ্যায় পার করছে। আদিত্যর ভালোবাসা, যত্ন আর দুষ্টুমিতেই কাটে তার প্রতিটা ক্ষণ। জীবনে সে এখন সর্বসুখী। আদিত্য ফ্যামিলি বিজনেস জয়েন করেছে। চলচ্চিত্র জগৎ পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে অফিসে যাওয়া শুরু করেছে সে। আদ্র আর অমালিয়ার মাঝে তেমন উন্নতি না হলেও কোনো অবনতিও হয়নি। বরং অমালিয়া আগের থেকে এখন একটু নরম হয়েছে। আদ্রকে আর তেমন কঠিন কথা শোনায় না আর। আহানাও তার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত আছে এখনো। আবিরকে সে ভালোবাসার মর্ম বোঝানোর হার না মানা চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও এখনো সে সফল হয়নি। প্রতিবারই আবির ওকে বকাঝকা করে ফিরিয়ে দেয়। তবুও আহানা হার মানবে না। আবিরের মনোভাব একসময় পাল্টাতে সক্ষম হবেই সে। সেই আশায়ই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে সে।

বেলা তখন সন্ধ্যা প্রায়। নূর ঘুমিয়ে ছিলো একটু। ঘুম ভেঙে সে নিজের রুম থেকে নিচে আসতেই ভ্রু কুঁচকে এলো তার। সোফায় আদিত্য একটা মেয়ের সাথে সোফায় বসে কথা বলছে। তাও আবার এক হাতে মেয়েটাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে নিয়ে কথা বলছে। মেয়েটাকে চিনতে ভুল হলোনা নূরের। এটাতো সেদিনের সেই নায়িকাটা যার সামনে আদিত্য ওকে ভ্যানিটি থেকে বের করে দিয়েছিল। আর এটা দেখেই নূরের পায়ের র,ক্ত তড়াৎ করে মাথায় উঠে গেল। ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো মাথায়। কত্তবড় সাহস লোকটার! বাসার ভেতরে বাইরের মেয়েকে কীভাবে নির্লজ্জের মতো জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আবার দাঁত বের হাসা হচ্ছে! শরীর টগবগ করে জ্বলছে নূরের। রাগে নিশপিশ করছে হাত পা। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা, এখুনি তোমার আশিকিগিরি ছুটাচ্ছি আমি। সেদিন আমাকে বের করে দিয়েছিলে না! আজকে দেখ তোমার কি হাল করি! তিব্র ক্রোধে নূর হনহন করে নিচে গিয়ে রান্নাঘরের ভেতর থেকে ঝাড়ুটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। অগ্নিমূর্তির মতো ঝাড়ু হাতে তেড়ে আসতে লাগলো আদিত্যর দিকে। সেটা দেখতে পেয়ে চোখ কপালে উঠে গেল আদিত্যর। অবস্থা বেগতিক দেখে সে দ্রুত উঠে সরে যেতে যেতে ভীতু স্বরে বলতে লাগলো,
–ন নূর সোনা, কি হয়েছে তোমার? কি করতে চাচ্ছ তুমি?

নূর ঝাড়ু তাক করে আদিত্যর দিকে ছুটে যেতে যেতে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
–এখুনি দেখাচ্ছি তোমাকে কি করতে চাইছি আমি। অনেক আশিকির ভুত চেপেছে তাইনা? এখুনি সব ভুত ঝেড়ে দিচ্ছি। শুধু দাঁড়াও একবার।
নূরকে এভাবে আক্রমনাত্মক হতে দেখে ভয়ে দৌড়াতে লাগলো আদিত্য। দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগলো,
–আরে আরে কি বলছ এসব? দেখ তুমি ভুল বুঝছ। তুমি যা ভাবছ এমন কিছুই না। আমাকে একবার বলারতো সুযোগ দাও।

নূর ঝাড়ু নিয়ে আদিত্যর পেছনে দৌড়াচ্ছে। আর আদিত্য বেচারা নিজের জান বাঁচাতে ছুটছে। এদের কান্ড দেখে সোফায় বসা মেয়েটা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।নূরের রাগ এবার ওই মেয়েটার উপর ট্রান্সফার হলো। সে এবার ঝাড়ু নিয়ে তেড়ে গেল ওই মেয়েটার দিকে। মেয়েটাও এবার ভয়ে ভোঁ দৌড় দিলো। নূর ওর পেছনে যেতে যেতে বলতে লাগলো,
–এই এই ডাইনি,দাঁড়া। কোথায় যাচ্ছিস? আমার বরের সাথে টাঙ্কি মারা হচ্ছে? এখুনি তোর সব শখ মিটিয়ে দিচ্ছি।
মেয়েটা নিজের জান বাঁচাতে একসময় মেইন ডোর দিয়ে বাইরে দৌড় দিলো। নূর এবার মেয়েটাকে ছেড়ে আবারও আদিত্যর পেছনে পড়লো। সারাবাড়ি জুড়ে দৌড়াচ্ছে দুজন। ধীরে ধীরে পরিবারের বাকিরাও নিচে চলে এলো। তারাও এসব দেখে হাসতে লাগলো। আহানা আর আদ্র আরও নূরের জোস বাড়িয়ে দিয়ে চিয়ার করে বলতে লাগলো,
–কাম অন ভাবি গো ফর ইট। আজ জিতা চাই আপনার। ভাবি তুমি এগিয়ে যাও আমরা আছি তোমার সাথে।
আদিত্যর বাবাও ছেলের বউকে সাপোর্ট করে বলল,
–হ্যাঁ বউমা, দেখিয়ে দাও নারীশক্তির পাওয়ার।
শুধু রেহনুমাই একটু ছেলের চিন্তা করে বলল,
–বউমা একটু আস্তে মেরো আমার ছেলেটাকে। হাত পা ভাঙার দরকার নেই কেমন।

আদিত্য নিজের পরিবারের এমন মীরজাফর গিরি দেখে দৌড়াতে দৌড়াতে আপসোসের সুরে বলতে লাগলো,
–কি বলছ তোমরা এসব? ওকে থামানোর বদলে আরও উস্কে দিচ্ছো? আরে ও লিমুকে নিয়ে ভুল বুঝছে। ওকে বুঝাও একটু তোমরা।

আদিত্যর বাবা বলল,
–যার যার বউ তার তার প্যারা। আমরা কেন ওসবে পড়তে যাবো। নিজের টা নিজে দেখে নে।
নূর এখনো ছুটছে আদিত্যর পেছনে। আদিত্য আর উপায় না পেয়ে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেল। নূরও ওর পেছনে পেছনে গেল।রুমে এসেও দুজন ছুটতে লাগলো।নূরের হাত থেকে বাঁচার জন্য আদিত্য ছুটে একবার খাটের উপর উঠছে তো আবার অন্য জায়গায় ছুটছে। নূর তাড়া করতে করতে বলছে,
–কি হলো এখন পালাচ্ছ কেন? ওই ডাইনির সাথে রাসলীলা করার আগে মনে ছিলোনা যে আমি তোমার কি হাল করবো? এতো সাহস তোমার? সেদিন একবার ওই ডাইনির সামনে আমাকে বের করে দিয়েছিলে। আর আজ বাড়িতেই নিয়ে এসেছ? কেন এক বউয়ে বুঝি মন ভরছে না? এখুনি তোমার সব আশিকি গিরি আমি বের করছি। দাঁড়াও, দাঁড়াও বলছি।

এই পর্যায়ে আদিত্য আর ছুটলো না। বরং নূরকেই থামিয়ে দিলো। নূরের হাত ধরে নূরকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে হালকা ধমকের সুরে বলল,
–হুঁশ, কি আবোলতাবোল বলে যাচ্ছ তখন থেকে! আরে বাবা আমাকে বোঝানোর সুযোগ তো দিবে। তুমি ভুল ভাবছ। নিচে যাকে দেখেছ সে আমার বোন। আমার মামার মেয়ে। ওর নাম লিমু। আহানার মতো ও আমার ছোট বোন।

নূর এবার থতমত খেয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কিন্তু সেদিনতো তোমার নায়িকা ছিলো। ও কি সিনেমায় কাজ করে।

–আরে নারে পাগলী, সেদিন ও আমার কথামতো তোমার সামনে নায়িকা হওয়ার অভিনয় করেছিল। তুমি কি করে ভাবলে আমি আমার নূরকে বাইরের লোকের সামনে ছোট করবো? যতোই রেগে থাকিনা কেন আমার নূরকে আমি কখনো বাইরের লোকের সামনে ছোট করতে পারবোনা৷ জিদানকেও আমি আগেই সব বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। তো এই হলো আসল কাহিনি। এটাই তোমাকে কখন থেকে বলতে চাচ্ছি কিন্তু তুমি শুনলে তো। ঝাঁসির রানির মতো ত,লো,য়া,র বের করে হামলা করে দিলে।

নূর দুই হাতে আদিত্যর কলার চেপে ধরে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–তো কি করবো? তোমাকে অন্য কারোর সাথে দেখলে মাথা গরম হয়ে যায় আমার। তুমি শুধু আমার বুঝেছ? শুধু এই নূরের তুমি। এটা তোমার মগজের ভেতরে সুপার গ্লু আঠা দিয়ে লাগিয়ে নাও। যাতে কখনো ভুলতে না পারো। আদিত্য শুধুই নূরের।

আদিত্য বাঁকা হেঁসে নূরের মুখের খুব কাছে ঝুঁকে দুষ্টু সুরে বলল,
–আচ্ছা? তো তোমার হয়ে থাকলে এতে আমার কি লাভ? আমি কি পাবো? এ যুগে কোনোকিছুই মাগনা পাওয়া যায় না ম্যাডাম। সবকিছুরই মূল্য লাগে। তো বলো আমাকে তোমার হয়ে থাকার বদলে কি দিবে? কোনো আকর্ষণীয় অফার দিলে তবেই থাকবো।

নূর মেকি হেঁসে বলল,
–হ্যাঁ তাতো দিতেই হবে। তোমাকে দিবো নাতো কাকে দিবো। চোখ বন্ধ করো এখুনি দিচ্ছি।

আদিত্য খুশিতে গদগদ হয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। ভাবলো তার বউ বুঝি আজ অনেক রোমান্টিক হবে। সেই প্রত্যাশায় সে ঠোঁট দুটো চোখা করে নূরের দিকে এগুতে লাগলো। নূর নিচে পড়ে থাকা ঝাড়ুটা উঠিয়ে। ঝাড়ুর গোড়া দিয়ে আদিত্যর পায়ে দিলো একটা বাড়ি মেরে। আদিত্য হকচকিয়ে উঠে পা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
–আউচ! এটা কি হলো! এখন আবার মারছ কেন?

নূর তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
–কেন? ভুলে গেছ সেদিনের কথা? আমাকে বের করে দিয়েছিলে না? আজ সেই রাগের শোধ তুলবো আমি৷ এটাই হলো তোমার গিফট। দাঁড়াও আরও দিচ্ছি গিফট।
বলেই আবারও আক্রমনাত্মক হলো নূর। আদিত্য নিজেকে বাঁচাতে আবারও ছুটতে লাগলো। নূর আদিত্যর পেছনে ছুটতে ছুটতে বলল,
–কেন? নিবে না তোমার গিফট? পালাচ্ছ কেন? আমার সাথে নাটক হচ্ছিল তাইনা? ভাই বোন মিলে আমাকে ইচ্ছে করে জ্বালাচ্ছিলে তাইনা? আজ হারে হারে উসুল করবো সবকিছু।

আদিত্য নূরের কাছ থেকে বাঁচতে বাঁচতে বলল,
–সরি সরি,ভুল হয়ে গেছে। আর বাপের জন্মেও এমন কাজ করবোনা। প্লিজ মাফ করে দাও এবারের মতো। দয়া করো একটু আমার উপর।
__

লিমু বাইরে এসে গার্ডেনে লুকিয়ে রয়েছে নূরের ভয়ে। কেন যে সেদিন আদিত্য ভাইয়ার কথা মানতে গিয়েছিল। আজ এই বয়সে ওকে পটল খেতে না যেতে হয়৷ কি ভয়ংকর বউ বিয়ে করেছে ভাইয়া। আল্লাহ, একবার বাঁচিয়ে দাও। আর জীবনেও এমন কাজ করবোনা।

ঠিক তখনই ইভান বাসার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বোনদের অনেক দিন দেখেনা। তাই দেখা করতে এসেছে ওদের সাথে। ভেতরের দিকে যেতে নিলেই হঠাৎ একটা মেয়েকে এভাবে গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসলো তার। মেয়েটা কে? আর এভাবে লুকিয়ে আছে কেন? এবাড়ির সবাইকে তো চেনে সে। একেতো কখনো দেখেনি। তাহলে কি আবার চোর টোর নাকি। এভাবে তো চোররাই লুকিয়ে থাকে। নাহ,মেয়েটাকে ধরতে হবে। বোনের শশুড় বাড়ির ক্ষতি হতে দিবেনা সে। এই ভেবে ইভান এগিয়ে গেল মেয়েটির কাছে। কাছে গিয়েই সন্দেহজনক কন্ঠে বলল,
–এই মেয়ে কে তুমি? চুরি করতে এসেছ এখানে? বের হও এখান থেকে নাহলে কিন্তু এখুনি পুলিশ ডাকবো আমি।

লিমু ক্ষেপে গিয়ে বলল,
–হোয়াট! চোর আর আমি? এই ব্যাটা ছাগল, আপনার কপালে কি মানুষের চোখ আছে নাকি উল্লুকের চোখ লাগিয়ে রেখেছেন?আমাকে কোন দিক থেকে চোর মনে হয় আপনার?

–চোর চিহ্নিত করার জন্য কি শরীরে কোনো স্পেশাল পার্টস থাকে নাকি যে দেখে বোঝা যাবে? চোর আর সাধারণ মানুষ তো একই রকম দেখা যায়। তুমি চোর না হলে এখানে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কি করছ?

–আরে আজব! আমার ফুপির বাড়ি। আমি যেখানে খুশি সেখানে থাকবো। সেটা আপনি বলার কে? আপনি কে হ্যাঁ? বলা নেই কওয়া নেই সোজা চোর বানিয়ে দিলেন? আরে আমার মতো একটা সুন্দর মেয়েকে চোর বলার দায়ে সবার আগে আপনার চৌদ্দ বছরের জেল হওয়া উচিত। এটা কতবড় অন্যায় করেছেন আপনি জানেন? দেখুন আমাকে ভালো করে। তারপর বলুন আমার মতো নিষ্পাপ মেয়েকে চোর বলার অপরাধে আপনার কি করা উচিত?

মেয়েটির কথায় ইভান সত্যি সত্যিই মেয়েটাকে খুঁতিয়ে দেখতে লাগলো। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী বলা চলে। বিশেষ করে চোখ দুটো খুব সুন্দর। বড় বড় ডাগরডোগর চোখ। চোখের পাপড়ি গুলো ঘনকালো। আজকালকার মেয়েরা যেসব নকল পাপড়ি লাগিয়ে ঘোরে তার থেকেও সুন্দর। যেন শিল্পীর আঁকানো কারুকাজ। এখনতো মনে হচ্ছে সত্যি করে এতো সুন্দর মেয়েটাকে চোর বলার অপরাধে ওর সোজা ফাঁ,সি হওয়া উচিত। ইভানের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে লিমু বলে উঠলো,
–হয়েছে হয়েছে আর দেখতে হবে না। বেশি দেখলে প্রেমে পড়ে যাবেন।

বলেই চুল ঝটকা মেরে চলে গেল লিমু। ইভান মুচকি হাসলো। সেতো সোজা হোঁচট খেয়ে পড়লো বোধহয় প্রেমে।
___

সকাল থেকে মনটা কেমন উশখুশ করছে আবিরের। সেদিনের পর থেকে আহানা রোজ সকাল চলে আসে ওর বাসায়। এতো মানা করে, বকাঝকা করে তবুও মানে না। বারবার চলে আসে। ওকে ভালোবাসায় বিশ্বাস করাতে চায়। কিন্তু ভালোবাসায় বিশ্বাস করা কি এতোই সহজ? নিজের নির্মম অভিজ্ঞতার পরেও কীভাবে ভালোবাসায় বিশ্বাস করবে সে। মেয়েটাকে এতবার ফিরিয়ে দেই। তবুও বারবার চলে আসে। আমার আগে পিছে ঘুরতে থাকে। বিরক্ত হয়ে কতো বকাঝকা করি তবু্ও হাসিমুখে আবারও একই কাজ করে। তার কাজে বিরক্ত হয়ে যাই। কিন্তু আজ যখন মেয়েটা রোজকার মতো সকাল সকাল জ্বালানোর জন্য আসেনি তখন এমন লাগছে কেন? মনটা ভীষণ অশান্ত হচ্ছে। অস্থির লাগছে। মেয়েটা ঠিক আছে তো? কিছু হয়নি তো ওর? মেয়েটা ইচ্ছে করে এমন করছে। বেয়াদব একটা। আমাকে জ্বালানোর নতুন কুবুদ্ধি করেছে। করুক যা খুশি তাই। আমিও মাথা ঘামাবো না। নিজেকে এসব বুঝাতে চাইলেও কেন যেন পারছেনা সে। এই অস্থিরতা থেকে কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছেনা। এভাবে বসে থাকলে মাথা ফেটে যাবে ওর। তারচেয়ে বরং ওদের বাড়িতে গিয়েই দেখি। আজকে গিয়ে ঠাটিয় একটা চড় মারবো ওকে। ওর সব কুবুদ্ধির পোকা মাথা থেকে বেড়িয়ে যাবে। এই মনোস্তাপ নিয়েই বের হতে নিলো সে। হঠাৎ দরজা দিয়ে ওর বাবাকে আসতে দেখলো। খানিক চমকালো আবির। আজ কতবছর পর ওর বাবা এই রুমে ঢুকলো তা মনে পরছেনা। আবিরের বাব এগিয়ে এসে নরম সুরে বললেন,
–তোর সাথে একটু কথা ছিলো আবির।

আবির নজর সরিয়ে বলল,
–আমি বাইরে যাবো এখন। পরে শুনবো।

–পরে দেরি হয়ে যাবে আবির।এমনিতেও অনেক দেরি করে ফেলেছি। আর দেরি করতে চাইনা। প্লিজ, শুধু পাঁচটা মিনিট বয় আমার সাথে।

বাবার কথায় যেন আজ এক অসহায়তার আভাস পেল আবির। তাকে আর উপেক্ষা করতে পারলোনা সে। মাথা ঝাকিয়ে বলল,
–ঠিক আছে বসো। বলো কি বলবে।

আবির আর ওর বাবা বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে পাশাপাশি বসলো। আবিরের বাবা মলিন সুরে বললেন,
–আমি জানি আমি একজন ভালো বাবা হতে পারিনি। আমার দায় দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম হয়েছি আমি। সেসব অতীত তো আর চাইলেও ঠিক করা সম্ভব না। তবে তোর বাবা হিসেবে তোর অনাগত একটা সুন্দর ভবিষ্যত দিতে চাই আমি। আমাদের কারণে তোর মনে অনেক খারাপ একটা প্রভাব পড়েছে। তাই তোকে কিছু কথা বলতে চাই। তোর মা আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়তাম। সে ছিলো খুবই স্টাইলিশ আর ফ্রী মনোভাবের মেয়ে। তাকে দেখে বাকিসব ছেলের মতো আমারও পছন্দ হয়ে যায়। আর সেও আমাকে পছন্দ করে ফেলে। আর এই পছন্দের মাঝেই আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই। আর এটাই ছিলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল সিদ্ধান্ত। যে ভুলটা আমরা পরে বুঝতে পারি। বাহ্যিক আকর্ষণকেই আমরা ভালোবাসা ভেবে বিয়ে করে ফেলি। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই আমাদের মাঝে মতভেদ শুরু হয়ে যায়। কথায় কথায়ই ঝগড়াঝাটি শুরু হতে লাগলো। দুজনের প্রতি কেমন অনিহা আসতে লাগলো। এরইমাঝে তুমি আমাদের জীবনে এলে। তোমার আগমনের খুশিতে আমাদের মাঝে সমস্যা কিছুটা কমলো। কিন্তু মনথেকে তেমন কোনো টান ছিলো না। এরপর একদিন তোমার মা অন্য কারোর সাথে চলে গেল। আর এটা আমার জন্য খুবই অপমানজনক ছিলো। আমি এই অপমান নিতে পারছিলাম না। তাই আমিও ভুল পথে পা দিলাম। এসব কারণে তুমি ভালোবাসাকে বিশ্বাস করোনা৷ তবে আমাদের মাঝে তো কখনো ভালোবাসা ছিলোই না। ভালোবাসা থাকলে কখনো এসব হতোই না। সত্যিকারের ভালোবাসা এতো সহজে বিচ্ছিন্ন হয়না। তোমার মায়ের উপর অনেক রাগ ছিলো। তবে এখন আমি বুঝতে পারি। ও নিশ্চয় ওর সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়ে গিয়েছিল তাই হয়তো চলে গিয়েছিল। তাই বলছি বাবা,তোমার মনে ভালোবাসার প্রতি যে ভুল ধারণা সেটা দূর করে দাও। আমার মতো ভুল তুমিও করোনা। বাপ হয়ে ছেলের জীবন নষ্ট হতে দেখতে পারছিনা আমি। জানি আমি তোমার ভালো বাবা হতে পারিনি। তাই বলে ছেলেকে চোখের সামনে ভুল পথেও ঠেলে দিতে পারি না।তোমাকে খুশি দেখতে চাই আমি। নিজের চিন্তাধারা পাল্টাও আবির। দেখবে অনেক সুখী হবে। ঘৃণা কখনো কাউকে সুখ দেয়না আবির।ঘৃণা তিলেতিলে মানুষকে শেষ করে দেয়। আজ কতদিন হলো দেখছি মেয়েটা তোকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। ওকে আর ফিরিয়ে দিসনা।আমি জানি তুমিও মেয়েটাকে ভালোবাসো। আমি তোমার বাবা, এতটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার আছে। তাই বলছি মেয়েটাকে আর অবজ্ঞা করোনা। নাহলে একসময় দেখবে চাইলেও আর ওকে ফিরে পাবে না। আমি চাইনা আমার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমিও সারাজীবন শুধু পস্তাও। আমার কারণে আমার ছেলের জীবন নষ্ট হয়ে গেলে নিজেকে কখনো মাফ করতে পারবোনা আমি। ভেবে দেখ আমার কথা।

বলেই উঠে চলে গেল আবিরের বাবা। যেতে যেতে তার চোখের পানি দেখতে পেল আবির। সেটা লুকাতেই হয়তো এভাবে চলে গেলেন। থমকে বসে রইলো আবির। তার বাবা কি বলে গেল এসব। তবে কি আমার ধারণাই ভুল? ভালোবাসা কি সত্যিই ভালো হয়? আমিও কি ভালোবাসায় বিশ্বাস করবো?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here