#শৈবলিনী—-৫
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★সারাদিনের সব কর্মব্যস্ততা শেষে নিজ গৃহে পা রাখলো নূর। শরীর মন দুইই যেন ক্লান্ত। তবে ওর যে ক্লান্ত হওয়া মানায় না। পরিবারের সুখের জন্য ওকে ক্লান্ত হওয়া চলবেনা। বসার ঘরে মাকে বসে থাকতে দেখে নিজের চেহারায় জোরপূর্বক হাসি এনে ক্লান্তির প্রতিচ্ছবি দূর করার বৃথা চেষ্টা করলো। সোফায় বসা মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো নূর। এটাই পরম শান্তির স্থান। মা লতিকা মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় স্বযত্নে হাত বুলিয়ে দিলো। মায়াময় সুরে বলল,
–কীরে মা, খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে গেছিস?

–আরে না মা,তোমার বাঘিনী কখনো ক্লান্ত হয় নাকি?

–মাকে মিথ্যে বলবি? আমি কি দেখতে পাইনা?

মৃদু হাসলো নূর। আসলেই মায়ের কাছ থেকে কিছু লুকানো যায় না। সব বুঝে যায় সে। লতিকা মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
–অনেক চাপ পরে গেছে নারে তোর ওপর? ছোট কাঁধে আর কতো বোঝা নিবি? এখন একটু নিজের ব্যাপারেও ভাব।

–নিজের ব্যাপারে আবার আলাদা করে ভাবার কী আছে মা? তোমরাই তো আমার সব। তোমরা ভালো থাকলে আমার আর কী চাই। আমি আমার জীবনে ভালোই আছি।

–কী ভালো আছিস? এটাকে ভালো থাকা বলে? সবসময় ছেলেদের মতো চলাফেরা করিস। একটুতো সাধারণ মেয়েদের মতো সখ-আল্লাদ, ঘোরা-ফেরা একটু সাজুগুজু করতে পারিস।

–মা,তুমিতো জানোই আমার ওসব ন্যাকামি একদম ভালো লাগে না। আমি যেমন আছি তেমনই ভালো। এখন এসব ছাড়তো। খেতে দাও ক্ষুধা লেগেছে। আচ্ছা মা পল্টু আমার ফোন দিয়ে গেছে? একটু সমস্যা হয়েছিল। ওকে সারতে দিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় দিয়ে যাওয়ার কথা।

–ওই ভাঙ্গাচুরা ফোন আর কতো ঠিক করবি? একটা নতুন কিনলেই তো পারিস। এখনকার মেয়েরা কেমন স্মার্ট ফোন ব্যাবহার করে। ফেসবুক,টিকটিকি কত কী চালায়। আর তুই সেই বাবা আদমের জামানার একটা বাটন ফোন চালিয়ে যাচ্ছিস। তুইও একটা স্মার্ট ফোন নিয়ে নেনা।

নূর হেঁসে উঠে বলল,
–টিকটিকি না মা,টিকটক বলে। আর আমার ওসবের দরকার নেই। ফোন কথা বলার জন্য দরকার। আর আমার ওই বাটন ফোনেই কাজ চলছে তাহলে শুধু শুধু টাকা নষ্ট করবো কেন? তবে হ্যাঁ, একটা ল্যাপটপ কেনা দরকার। ভাবছি পল্টুকে দিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ পাওয়া যায় কিনা খোঁজ নিবো। কিছু টাকা গুছিয়ে একটা ল্যাপটপ কিনবো।

–সেকেন্ড হ্যান্ড কেন নিবি? একটা নতুন কিনিস। সবসময় আমাদের পরিপূর্ণ দিয়ে নিজে জোড়াতালি দিয়ে চলিস। ভালো কোনো কাপড়চোপড় কিনিস না, নিজের জন্য ভালো কোনো জিনিস নিস না। আর কতো সমঝোতা করে চলবি?

–আচ্ছা যাও নতুন ল্যাপটপই কিনবো। এবার খুশিতো!

–হ্যাঁ, অনেক। এখন যা হাত মুখ ধুয়ে আয়। খাবার দিচ্ছি আমি।

খাবার টেবিলে অমালিয়াকে না দেখে নূর মাকে জিজ্ঞেস করলো।
–মা, লিয়া কোথায়? খাবেনা ও?

লতিকা বেগম প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে বললেন,
–ওর কথা আর বলিসনা। কোন বান্ধবীর নাকি জন্মদিনের পার্টি আজ। সেখানেই গেছে। রাতে নাকি ওখান থেকেই খেয়ে আসবে।

–তাই বলে এতো রাতপর্যন্ত! কই আমাকে তো কিছু বললোনা।

ইভান পাশ থেকে বলে উঠলো।
–বললে কী তুমি যেতে দিতে? মা এই লিয়াকে কিন্তু বেশি ছুট দিয়ে ফেলছো। ওকে এখন একটু শাসন করা দরকার। যখন যা মন চায় করে। আপু এখানে সবার জন্য খেটে মরছে আর ওই মেয়ে এইসব মজমাস্তিতে অযথা টাকা উড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

–আমিতো বলিই। কিন্তু আমার কথা শুনলে তো।

–পিঠের ওপর দুই চার ঘা পড়লে ঠিকই শুনবে।

নূর বলে উঠলো।
–আহ্, থামতো ইভান। এতো রাগ দেখালে হিতে বিপরীত হবে। লিয়ার বয়সটাই এমন। এই বয়সে এইসবই ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বাস্তবতা, খারাপ, ভালো ফারাক করতে পারে না। তাই ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। রাগারাগি করলে চলবেনা।

খাওয়া শেষে মিছরি নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
–আপু, আমার কোচিং এর ফি দিতে হবে। স্যার কালই নিয়ে যেতে বলেছে।

আজকে ওই নায়কের গাড়ির পেমেন্ট পেয়েছিলো নূর। ভেবেছিলো আরও কিছু গুছিয়ে একটা ল্যাপটপ কিনবে। কিন্তু এখন মিছরির কোচিংএর ফি দেওয়া জরুরি। যথারীতি নূর নিজের প্রয়োজনটা প্রাধান্য দিলো না। মিছরিকে বলল,
–ঠিক আছে,সকালে যাওয়ার সময় নিয়ে যাস আমার কাছ থেকে।

–আচ্ছা।

রাত দশটার পর অমালিয়া বাসায় ফিরলো। নূর বসে অপেক্ষা করছিলো ওর ফেরার।ইভান আর লতিকাও আছে। এতো রাত হওয়ায় নূর এবার নিজেও কিছুটা রেগে আছে। মেয়েটাকে এবার সত্যিই কিছু বলতে হবে। এতরাত করে বাইরে থাকার মানেটা কী। কিছুক্ষণ পর অমালিয়া ফিরলো বাসায়। সবাইকে এভাবে বসে থাকতে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল সে। ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো। নূর ডাক দিলো,
–দাঁড়া লিয়া। এদিকে আয় কথা আছে তোর সাথে।

লিয়া ঢোক গিলে ধীরে ধীরে নূরের সামনে এসে দাঁড়াল। মিনমিনে গলায় বলল,
–হ্যাঁ বলো আপু।

নূর শান্ত থমথমে কন্ঠে বলে উঠলো।
–এখন কয়টা বাজে? এটা তোর বাড়ি ফেরার সময় হলো? জানিস আমাদের কতো চিন্তা হচ্ছিল?

–আরে শুধু শুধু চিন্তার কী আছে। আমিতো মাকো বলেই গিয়েছিলাম আসতে একটু দেরি হবে। আসলে বন্ধুরা পার্টি থেকে আসতেই দিচ্ছিলো না। তাই একটু দেরি হয়ে গেছে।

–একটু দেরি? এটাকে একটু দেরি বলছিস তুই? রাত এখন এগারোটা বাজে।

–হ্যাঁ তো কী হয়েছে? এখনকার যুগে ছেলেমেয়েরা এমন রাত করেই পার্টি করে। এতো ওভার রিয়্যাক্ট করার কী আছে?

–অন্যরা যা খুশি করুক। কিন্তু তুই ওদের পথে কেন হাঁটবি? আর এসব কী বেশে বাইরে গেছিস তুই? তোকে না কতবার বলেছি এসব আলট্রা মডার্ন পোশাক পড়ে বাইরে বের হবিনা?

–আপু প্লিজ, এখন কী আমাকেও তোমার ছেলেদের মতো থাকতে বলো?

ইভান এবার রেগে উঠে বলল,
–এই লিয়া তুই কিন্তু সীমা ছেড়ে যাচ্ছিস। তোর সাহস কী করে হলো আপুর সাথে এভাবে কথা বলার? থাপ্পড় মেরে মাথার সব তার ঠিক করে দিবো।

নূর এক হাত উঠিয়ে ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–আহ্ থাম ইভান, আমি কথা বলছিতো। দেখ লিয়া, তোকে আমার মতো হতে বলছিনা। তবে আমরা তোর ভালোর জন্যই সব বলছি। বাস্তবতার সাথে তুই এখনে তেমন পরিচিত হোসনি। তাই তোর ধারণা নেই বাইরের ক্রূরতা সম্পর্কে। মানুষ রুপি হায়েনাদের চিনা যায় না। কখন কোন রুপে সামনে আসবে জানতেও পারবিনা তুই । আর যখন জানতে পারবি তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোকে যাতে এমন কোন বিপদে না পড়তে হয় একারণেই তোকে বারবার বারণ করি। সাবধান করি তোকে।নূরের কথার কোন প্রভাব অমালিয়ার ওপর পড়লো বলে মনে হলোনা। সে আত্মগর্ব করে বলল,
–ওহ প্লিজ, আমি এতটাও অবুঝ না যে, নিজের ভালোমন্দ বুঝতে পারবোনা। এতটাও বোকা না আমি। আমার টায়ার্ড লাগছে আমি রুমে গেলাম।

–ঠিক আছে যা।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নূর। তার এই বোনটার মাথায় যেন একটু সৎ বুদ্ধির উদয় হয়।
__

ডিনার টেবিলে রাতের খাবার খাচ্ছিল সবাই। মাহমুদ বাবলুকে ডেকে বলল,
–বাবলু আমার জন্য একটু আচার আনতো।

বাবলু যথারীতি রোবটের মতো করে বলল,
–কিসের আচার স্যার?

–আমের আচার।

–কাচা আমা না পাঁকা আম?

–পাকা আমের আবার আচার হয় নাকি গাধা? আচার সবসময় কাঁচা আমেরই হয়।

বাবলু হাতের তর্জনী আঙুল আর মাথা নাবোধক নাড়িয়ে বলল,
–এমনটা জরুরি নয় স্যার। আমার মা তো পাকা আমেরও বানাতো।

–কী আচার?

–না জুস। আমাকে দিতো। আমি খেতাম।

–আর আচার?

–না না আচার আমার একদম পছন্দ না। আচার আমাকে দিতো না।

–আরে আচার বানাতো কী দিয়ে?

–সেটাতো যে আচার বানাতো সে জানে আমাকে কেন বলছেন? আপনারও না আর বুদ্ধি আক্কেল হলো না।

মাহমুদ দাঁত কিড়মিড় করে রাগে কড়মড় করে বলল,
–চুপ কর বদমাইশ। সরে যা আমার চোখের সামনে থেকে।

–কোথায় যাবো স্যার?

–জাহান্নামে যা।

–জাহান্নাম কোথায় স্যার? ঠিকানা দেন আর যাওয়ার ভাড়া দেন। ভাড়া ছাড়া কেমনে যাবো? আর ওখানে গিয়ে কী করবো সেটাও বলেন।

মাহমুদের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কোন কুলক্ষণে যে এই আপদ কপালে জুটেছিল? মাহমুদ রেহনুমার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলল,
–আমি যদি কোনোদিন হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাই তারজন্য তোমার নমুনাই দাই থাকবে। এমনটাই লিখে রেখে যাবো আমি।

আহানা খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে হি হি করে হাসতে লাগলো। অন্য সময় হলে আদিত্যও এই হাসিতে যোগদান করতো। তবে আজ যেন সে অন্য খেয়ালেই ডুবে আছে। এদের কথাবার্তায় মনোযোগ নেই তার। রেহনুমা ব্যাপার টা খেয়াল করছে। আদিত্যর কোনো ব্যাপার তাঁর চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। তাঁর ছেলের ছোট থেকে ছোট পরিবর্তনও তার নজরে পড়ে। আজকে আদিত্যকে একটু অন্যমনস্ক লাগছে। যেন অন্য কোনো খেয়ালে ডুবে আছে সে। রেহনুমা আদিত্যর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,
–আদি, কী হয়েছে তোর? কোথায় হারিয়ে গেছিস?

মায়ের কথায় আদিত্য একটু থতমত খেয়ে গেল। জোরপূর্বক হেসে বলল,
–কী হবে মা? কিছুই না। ওই ফিল্মের বিষয়ে একটা জিনিস নিয়ে ভাবছিলাম। আর কিছু না।

আদিত্য খাবারে মনোযোগ দিলো। রেহনুমা মাহমুদের হাঁটুতে খোঁচা দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো। আসলে সে আদিত্যকে বিয়ের ব্যাপারে বলতে বলছে। মাহমুদ ইশারা বুঝতে পেরে গলা ঝেড়ে আদিত্যের উদ্দেশ্যে বলল,
–তা বয়স তো ভালোই হলো আদি। আর আল্লাহর রহমতে ক্যারিয়ারও মাশাল্লাহ ভালোই চলছে। তা এখন বিয়ে শাদির ব্যাপারে কিছু ভেবেছ? তোমার মা তো তার বউমার মুখ দেখতে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। তা আমরা কী মেয়ে টেয়ে দেখবো? নাকি তোমার নিজের কোনো পছন্দ টছন্দ আছে? থাকলে বলো আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

মাহমুদের শেষের কথায় খাবার মুখের কাছে নিয়েও থেমে গেল আদিত্য। হঠাৎ কেন যেন নূরের কথা মনে পড়লো ওর। যদিও নূরের খেয়াল কাল থেকেই ওকে অনেক পেরেশান করে যাচ্ছে। আজকে যেন এর মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছে। আদিত্যর মৌনতা দেখে রেহনুমা বলে উঠলো।
–কীরে বললি নাতো। সামাইরাকে কিন্তু আমার খুব পছন্দ। তোদের জুটির সব ছবিগুলো কতো হিট হয়। তোদের জুটিকে সবাই খুব পছন্দ করে। রিল লাইফের মতো রিয়েল লাইফেও তোরা সত্যিকারের জুটি হয়ে গেলে কতো ভালো হবে। আমাদের পরিবারের সাথে এমন বউই দরকার। কী বলিস তুই?

হঠাৎই মেজাজটা কেমন বিগড়ে গেল আদিত্যর। আদিত্য খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–আমার খাওয়া শেষ। আমি রুমে গেলাম। আর হ্যাঁ, আমার বিয়ে নিয়ে এতো উতলা হওয়ার কিছু নেই। যখন হবার হয়ে যাবে।

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল আদিত্য। আদিত্যর এমন বিহেভিয়ার কিছুটা সন্দেহজনক মনে হলে রেহনুমার কাছে। হুট করে এভাবে রেগে গেল কেন?

রুমে এসে খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলো আদিত্য। খাটের পাশে ক্যাবিনেটের ড্রয়ার খুলে নূরের কানের দুলটা বের করলো সে। চোখের সামনে ধরে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। ধীরে ধীরে মাথা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো আদিত্য। দুলটা চোখের সামনে ঝুলিয়ে ধরলো। এই ছোট্ট বেজান পদার্থও যে এতো বিমোহিত করতে পারে তা আজ জানলো আদিত্য। এ কোন ইন্দ্রজালে জড়িয়ে যাচ্ছে সে? কোন অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছে তাঁর সর্বস্ব? অতলে নিমজ্জন হয়েও কেন তা বিষাদ লাগছে না? পরন্তু অনাবিল এক প্রশান্তি কেন ছেয়ে যাচ্ছে সর্বত্র? তবে কী সর্বনাশের প্রারম্ভ হয়ে গেল?
__

শুটিং এর ব্রেকে নিজের ভ্যানিটি ভ্যানে এসে আরাম করে একটু বসলো আদিত্য। জিদান কফির কথা জিজ্ঞেস করলে আদিত্য বলল,
–হ্যাঁ আনো। আর হ্যাঁ তোমাকে যে বলোছিলাম লোকেশনের ব্যাপারে ডিরেক্টরের সাথে কথা বলতে বলেছ?

–হ্যাঁ স্যার বলেছি। ডিরেক্টর আজই ভার্সিটির প্রিন্সিপালের কাছে পারমিশন নিবে বলেছে।

–দেখ আমি অতশত জানিনা। কাল থেকে যেন লোকেশন ওইটাই হয় দ্যাটস ইট।

–জি স্যার হয়ে যাবে।

কফি আনতে বেড়িয়ে গেল জিদান। স্যারের জন্য আজকাল তার চিন্তার পরিমান তার ঝুলে পড়া মোটা পেটের মতো বেড়েই চলেছে। ওই কুমিরের সরদারনীর সামনে রোজ যাবে এখন। কখন নাজানি স্যারকে জবাই করে উচ্চ দরে কেজি হিসেবে বিক্রি করে দেয়। অধিক লাভবান হবে নিশ্চয়। স্যারের যে ডিমান্ড। তার মাংস বিক্রি করেও কোটিপতি হওয়াটা অস্বীভাবিক কিছু না।

ইজি চেয়ারে পেছন দিকে একটু হেলে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলো আদিত্য। হঠাৎ মেয়েলী কন্ঠে কেউ বলে উঠলো।
–মে আই কাম ইন?

চোখ খুললো না আদিত্য। বুঝতে পারলো কে এসেছে। তাই ইচ্ছে করেই চোখ বুজে রইলো। এইমুহুর্তে সে এই মেয়েটার সাথে মোটেও কথা বলতে চাচ্ছে না। কারণ সৌজন্যের খাতিরে একবার কথা বললে মেয়েটা ঘাড়ে চেপে বসবে। অনুমতি চাইলেও সেটা এপ্রুভ হওয়ার অপেক্ষা করলোনা সামাইরা। কোমড় এঁকেবেঁকে ধীর পায়ে আদিত্যর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল সে। আদিত্যর কাধেঁ দুই হাত রেখে হালকা প্রেসারে চাপ দিয়ে মোহনীয় কন্ঠে বলল,
–আজ বোধহয় একটু বেশিই টায়ার্ড হয়ে গেছ? এতবার করে আমাকে উঠিয়ে নাচতে হয়েছে একটু তো টায়ার্ড হওয়ারই কথা। যদিও আমি জিরো ফিগার। তবুও কষ্ট তো হয়ই। আমি বরং মাসাজ করে দেই দেখবে ভালো লাগবে। আমি কিন্তু অনেক ভালো মাসাজ জানি।

আদিত্য চোখ খুলে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–নো নিড সামাইরা। আর তোমাকে কতবার বলেছি, হুট করে আমার ভ্যানিটিতে আসবনা। কখন আবার মিডিয়া ছবি তুলে মসলাদার নিউজ বানিয়ে দিবে। ইউ নো না আই ডোন্ট লাইক দিস।

সামাইরা মুখের হাসিটা আরেকটু প্রশস্ত করে বলল,
–নিউজ হলেই বা ক্ষতি কী? এমনিতেও আমাদের জুটি অনেক জনপ্রিয়। আমাদের প্রেমের সংবাদে জনতা খুশিই হবে। এমন নিউজ ভাইরাল হলে আমাদের বরং আরও উপকারই হবে। পাবলিসিটি বাড়বে আমাদের।

–আমার সস্তা পাবলিসিটির কোনো দরকার নেই। ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল। আমরা শুধুই প্রফেশনালি একজন আরেকজনের সহযোগী। তাছাড়া আর কিছুই না।

–আচ্ছা আচ্ছা রাগছ কেন? আমিতো শুধু মজা করছিলাম। আমিতো এখানে শুধু তোমার সাথে একটু কফি খেতে আসলাম। কী খাওয়াবেনা?

–ওকে বসো, আমি জিদানকে বলে দিচ্ছি।

সৌজন্যতার খাতিরে মানা করতে না পারলেও ভেতরে খুবই বিরক্তবোধ করছে আদিত্য। কোথায় শান্তিতে নিজের খেয়ালে একটু ডুবে থাকবে, তা না এর সামনে বসে থাকতে হচ্ছে। সামাইরা কফির কাফে চুমুক দিচ্ছে আর আদিত্যকে দেখছে। আদিত্য কবে যে ওর ফিলিংসটা বুঝবে সেটাই তার ভাবনা। এতো একটা সুন্দর মেয়ে সামনে থেকে এতো হিন্ট দিচ্ছে তবুও কী আদিত্য বোঝে না? সবসময় শুধু দূরে দূরে থাকে। ক্যামেরা অফ হতেই অপরিচিত মানুষের মতো ব্যবহার করে। আমার প্রতি কবে একটু সহৃদয় হবে? তবে আমিও এতো জলদি হাল ছাড়ছিনা। আমার ভালোবাসায় জড়াতেই হবে একসময়।
__

পরদিন আদিত্যর হুকুম অনুযায়ী নূরের ভার্সিটিতে শুটিংয়ের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। আজ সময়ের আগেই আদিত্য চলে এসেছে। যা দেখে জিদান এই নিয়ে তিনবার অজ্ঞান হয়ে হ্যাট্রিক কমপ্লিট করেছে। আজপর্যন্ত আদিত্যকে সমসময় কখনো শুটিংয়ে এত আগে আসতে দেখেনি। আজ কী তাহলে আগে আগে এসে মাঠের ঘাস পরিস্কার করবে সে? এই অতিব মহান প্রশ্ন মনে আসলেও মুখে জিজ্ঞেস করার হলোনা তার। অগত্যা সে আদিত্যকে সারাদিনের সিডিউল শোনাতে লাগলো।

শিখা আর নূর মাত্রই এসেছে। গিয়াসের জন্য অপেক্ষা করছে তারা। অনেকক্ষণ পর অনেক টা দৌড়ে দৌড়েই এলো গিয়াস। এসে বসতে না বসতেই নূর বলে উঠলো।
–ওই গ্যাসের বাচ্চা এতো দেরি করলি কেন? সিএনজিতে হাওয়া ভরছিলি নাকি? আমার নোট কই?

গিয়াস হাত ছড়িয়ে হতাশ সুরে বলল,
–ইয়ার তুই এমন ডাইনির শাশুড়ী আম্মার মতো কেনরে? আগের জনমে নির্ঘাৎ ডাইনোসরের দাদী আম্মা ছিলি। বেচারা জান টা মাত্র এলো। একটু তো মায়া মোহাব্বতের পুষ্প অর্পণ করতে পারিস। ওড়ানার আঁচল দিয়ে বাতাস করে পরানডা জুরাইয়া কুলফি করতে পারিস? জানিস তোর এই নোট করতে গিয়ে আমার কন্সটিপেশন হয়ে গিয়েছে,সোজা বাংলায় হাগু কষা হয়ে গিয়েছে। রাত জেগে কাজ করতে গিয়ে সকালে বাথরুমে আর কিছু ডাউনলোড হয়না। জমানো ফাইল ফিফটি পার্সেন্ট এসে আটকে গিয়েছিল। এটা যে কতটা বেদনাদায়ক তা কেবল যার হয় সেই জানে। গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ করেও এতো কষ্ট হয়না।

শিখা হাসতে হাসতে ঠোঁট চোখা করে চু চু শব্দ করে আপসোস জ্ঞাপন করে বলল,
–আহারে কী হৃদয়বিদারক ঘটনা। আমার তো নাকের পানি থামছেই না।

–আরে এইডাতো কিছুই না। আসার সময় দুটো সুন্দরী রমনী পেয়েছিলাম। ভাবলাম চাঞ্চ নিয়ে দেখি। উপরা ওয়ালা মেহেরবান হওয়ার জন্য তো আর সানডে মানডে দেখবে না। কিন্তু বিধিবাম আমার। এখানেও কন্সটিপেশন হয়ে গেল। দুই গালে পোস্টার লাগিয়ে তবেই এসেছি।
গিয়াসের এমন হাস্যকর কথায় নূর না হেসে পারলোনা। হাতের নোট টা দিয়ে গিয়াসের পিঠে মজার ছলে মারতে লাগলো।
আদিত্যর গাড়ি তখন ভেতরে ঢুকছিলো। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেল নূরের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা। প্রবল বেগে এক দমকা ঝড়ো হাওয়া আছড়ে পড়লো আদিত্যর সর্বাঙ্গে। এই প্রথম নূরকে হাসতে দেখলো সে। এরথেকে সুন্দর দৃশ্য বুঝি তৃ ভুবনে নেই। এই মুগ্ধতায় মুগ্ধ হতে গিয়েও আঁটকে গেল আদিত্য। নূরকে অন্য কারোর সাথে এভাবে ঘেঁষাঘেঁষি করে হাসতে দেখে হঠাৎই মেজাজের গতি মোড় নিলো। মুগ্ধতার জায়গায় জগতের ঈর্ষা আর ক্রোধ স্থান পেল। ক্রোধে কোমল চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। আমার সামনে তো কখনো এভাবে হাসে না। আমার সাথে কথা বলতে নিলে তো মনে হয় চারপাঁচ টা ভুত একসাথে চাপে তার ওপর। যেন আমি তার জাতশত্রু। তার পূর্বপুরুষের নিধন করেছি। অথচ এখন দেখ কত সুন্দর চৌষট্টি পাটি বের হাসছে। পারলে আরও চারপাঁচ জনের দাঁত ভাড়া করে নিয়ে হাসে।

জিদান বলল,
–স্যার প্রথমে কী করবেন?

–গুলি করবো। একেবারে কপালের মাঝ বরাবর।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here