#শৈবলিনী—২৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★ঘন্টাখানিক শুট করে ভ্যানিটিতে চলে এসেছে আদিত্য। ভালো লাগছেনা ওর। শুটে বারবার ভুল হচ্ছিল। তাই ডিরেক্টর একটু আরাম করতে বলেছে। তবে আদিত্য আজকের শুটিং ক্যান্সেল করে দিয়েছে। মন মেজাজ তিক্ত হয়ে আছে। ভেতরটা প্রচুর অস্থিরতায় ছেয়ে আছে। শরীরও খারাপ লাগছে।মন অশান্ত থাকায় কাল রাতে ঘুমুতে পারেনি ঠিকমতো। সকাল থেকেই জ্বর জ্বর ভাব। তবে কাউকে সে এই ব্যাপারে কিছু বলেনি। জ্বর শরীরেই শুটিংয়ে চলে এসেছে। হয়তো মনের কোনে ক্ষীণ আশা ছিলো।শুটিং-এর উদ্দেশ্যে ভার্সিটিতে আসলে নূরকে দেখতে পাবে। তার দর্শনে মনের অশান্ত ঢেউ একটু হলেও শান্ত হবে। তবে তা আর হলো কই। নূর আসেনি। দেখতে পায়নি তাকে কোথাও। এটাই যে হবে তা হয়তো বুঝতে পেরেছিল আদিত্য। কালকের ঘটনার পর নিশ্চয় আর নূর আসবেনা। সেটা তার কালকের কথাতেই বোঝা যাচ্ছিল। বেহায়া মন তবুও একটু আশা করছিলো, সে আসবে। নিজের ভাবনার উপর নিজেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আদিত্য। বেহায়া মনকে কীভাবে সত্যের বিষ সেবন করাই? নাছড় মন একদিন আমার জান নিয়েই মানবে।

মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে আদিত্যর। জ্বরটাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। চোখের পাতা লাল হয়ে উঠছে। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে রইলো আদিত্য। সবকিছু অসহ্য,যন্ত্রণাদায়ক লাগছে তার। পৃথিবীটা হঠাৎই কেমন বিষন্নতায় ভরে উঠেছে যেন। নাহ,আর এখানে থাকতে মন চাইছে না তার। নূরতো আর আসবেনা, তাহলে আর এখানে বসে থেকে কী লাভ। হতাশ মনে এখান থেকে চলে যাওয়ার পূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলো আদিত্য। ঠিক তখনই সুপরিচিত সেই কন্ঠটি কানে এলো।
–আসতে পারি?

ঝট করে মাথা তুলে চকিত নজরে তাকালো আদিত্য। দরজার সামনে নূরকে দেখে দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় তার। নূর কী সত্যিই এসেছে? নাকি আবারও কোনো ভ্রম হচ্ছে তার। আদিত্যর ভাবনার মাঝেই নূর এগিয়ে এসে দাঁড়াল। আদিত্য উপলব্ধি করলো নূর সত্যিই এসেছে। হঠাৎই যেন অভিমানে মন ভার হয়ে উঠলো আদিত্যের। কালকের নূরের কথাগুলো মনে পড়লো তার।নূরকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঠুর মেয়ের স্থানে বসিয়ে দিলো আদিত্যর অভিমানী মন। আর বলে উঠল,
–তুমি??

নূর নিজের মনোভাব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
–হ্যাঁ আমি। নূর তার কথায় কখনো বরখেলাপ করেনা। আপনাকে যেহেতু কথা দিয়েছি ত্রিশ দিন আসবো। তাই যাই হয়ে যাক সেই কথা রক্ষার্থে আমি আসবোই। আর তাছাড়া আমার উপর আপনার ঋণের ভারও তো আছে। তাই আসতেতো হবেই আমাকে।

নূরের কথায় যেন আদিত্যর অভিমানে আরও খোঁচা দিয়ে দিলো। আদিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–ওও, তাহলে ঋণ পরিশোধের দায়ে এসেছ। নাহলে কী আর এমুখো হতে! ঠিক আছে। এখন থেকে তোমাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। এখন থেকে যা দরকার হয় জিদানকে বলে দিবো। সে জেনে আসবে তোমার কাছ থেকে। নাহয় ই-মেইল করে দিও। তাহলে আর আমার কারণে তোমার লাইফ হেল হবেনা।

নূর বুঝতে পারলো কালকের কথায় হার্ট হয়েছে আদিত্য। লোকটার এসব কথা খুব পোড়াচ্ছে নূরকে। নূর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সোফায় ধুম করে বসে বলে উঠলো,
–আপনি এই নিব্বা নিব্বিদের মতো এতো ঢং কীভাবে করতে পারেন? আমি আপনার সাথে কাজ করছি, আপনার সেক্রেটারির সাথে নয়। এখন এমন রস বের হওয়া লেবুর মতো মুখ না বানিয়ে , কী কাজ করতে হবে বলুন।

আদিত্যর জ্বর বাড়ছে। জ্বরের ঘোরে স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পাচ্ছে তার। কেমন মাতালের মতন হয়ে যাচ্ছে। আদিত্য বাচ্চাদের মতো অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিতো শুধু ঢং-ই করি। আমিতো দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ লোক। তো যাও, কেন বসে আছ আমার মতো লোকের কাছে? থাকতে হবেনা তোমার আমার সাথে।

আদিত্যর আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে নূরের কাছে। স্বাভাবিক স্বর মনে হচ্ছে না। লোকটার কী কিছু হয়েছে? আদিত্য হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে কোথাও যেতে চাইলো। তখনই হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠল আদিত্যর। ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে নূর চমকে উঠে দ্রুত ধরে ফেললো তাকে। ধরতেই আৎকে উঠলো নূর। লোকটার শরীরতো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আদিত্যর চোখে তাকাতেই বুকের মাঝে কেঁপে উঠল নূরের। লাল চোখ জোরা দিয়ে যেন অগ্নি ঝরছে। নূর ঘাবড়ে গিয়ে আদিত্যকে ধরে বসতে বললো। আদিত্য অভিমানের ভারে ডুব দিয়ে ঢুলুঢুলু কন্ঠে বলল,
–বসবো না আমি। ছাড় আমাকে।

–দেখুন, শরীরের অবস্থা ভালোনা আপনার। জেদ না করে বসুন এখানে। নাহলে পড়ে যাবেন।

–গেলে যাবো, তাতে তোমার কী যায় আসে। বরং আমি মরে গেলেই তুমি খুশি হবে। খুশিতে সারা শহরে মিষ্টি বিতরণ করবে। তোমার জীবনের আপদ সারাজীবনের জন্য চলে যাবে তাইনা?

নূরের বুকে তীব্র বেগে অদৃশ্য এক ছু,রি বিঁধল যেন। অন্তর কম্পিত হলো তার। পীড়াদায়ক অনুভূতি হলো বুক জুড়ে। হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হলো নূরের। ক্রোধিত হয়ে নূর জোর করে ধরে আদিত্যকে ধুম করে সোফায় বসিয়ে দিলো। আদিত্য আবারও বিদ্রোহ করতে চাইলে, নূর আদিত্যর মুখের সামনে আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল,
–চুপ,একদম চুপ। আর একটা কথা বললে বা এখান থেকে উঠার চেষ্টা করলে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবো একদম। চুপচাপ এখানে বসে থাকুন।

আদিত্য জ্বরের ঘোরে মাতাল অবস্থায় ঠোঁট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
–দেখেছ, আবারও বকছ তুমি আমাকে। সবসময়ই খালি বকঝকা করো। একটুও ভালোবাসোনা আমাকে। একটুও না।খুব পঁচা তুমি। থাকবোনা আমি এখানে। এখুনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিবো। বিদায় দুনিয়া, দুয়াওমে ইয়াদ রাখনা।

নূরের বিরক্তির মিটার হাই হয়ে গেছে। নূর এবার চোখ গরম করে আদিত্যর মুখের সামনে ঝুঁকে গিয়ে আরও রাগান্বিত স্বরে বলল,
–এই নায়কের বাচ্চা নায়ক, চুপ। আর একটা কথাও বলবিনা।

আদিত্য অবাক বিস্ময় ভরা নজরে তাকিয়ে চোখ জোরা দ্রুত গতিতে পিটপিট করে বলে উঠলো,
–ওসব তো ঠিক আছে।কিন্তু বাচ্চা কোথাথেকে আসলো? বাচ্চাতো নেই তাহলে চুপ করাবো কী করে? চলো আগে বাচ্চা করি, তারপর নাহয় চুপ করাবো। তুমি চিন্তা করোনা। বাচ্চা পালার দায়িত্ব আমার। তোমাকে কিচ্ছু করতে হবেনা।

ভড়কে গেল নূর।অসহ্যকর বিরক্তিতে মাথার রগ ফেটে যাচ্ছে তার। রাগে কটমট চোখে আদিত্যর ওপর আরেকটু ঝুঁকে গেল সে। নূরের এই অগ্নিমূর্তি আবতার নিয়ে নিজের দিকে আসতে দেখে ভয়ে আদিত্য পেছন দিকে ঝুঁকে গেল। চোয়াল চিবিয়ে চিবিয়ে নূর বলল,
–আর একটা কথা বললে এখুনি তোর মুখে নর্দমার পানি ঢেলে দিবো আমি।

এবার ভয় পেল আদিত্য। ভয়ে পেছন দিকে ঝুকে গিয়ে ভীতু চোখে তাকালো নূরের দিকে। মুখের ওপর আঙুল রেখে বুঝাল সে আর কথা বলবেনা। ভাবটা এমন যেন বলছে, থাপ্পাড় সে ডার নেহি লাগতা নূর,নর্দমার পানি সে লাগতাহে। হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো নূর। আদিত্যর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
–ফার্স্ট এইড বক্স আছে এখানে? শুধু মাথা নেড়ে বলেন।

আদিত্য মুখে আঙুল রেখেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। নূর জানতে চাইলো কোথায় রেখেছে। আদিত্য হাতের ইশারায় ছোট কেবিনেট টা দেখালো। মানে ওটার ভেতর আছে। নূর উঠে গিয়ে কেবিনেট থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এলো। থার্মোমিটার বের করে আদিত্যর ঠোঁটের মাঝ দিয়ে মুখের ভেতর পুরে দিলো। আদিত্য থার্মোমিটার মুখে নিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে রইলো। এই ভঙ্গিতে আদিত্যকে দেখতে অনেক ফানি লাগছে। নূর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিরবে হালকা হাসলো। কিছুক্ষণ পর থার্মোমিটার বের করে দেখলো ১০৩ ডিগ্রি জ্বর উঠে গেছে। ঘাবড়ে গেল নূর। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকলে জ্ঞান হারাতে পারে আদিত্য। কী করবে বুঝতে পারছেনা নূর। উঠে গিয়ে জিদানকে ডেকে আনলো নূর। আদিত্যর অবস্থা বয়ান করে বলল,
–উনাকে এখুনি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। নাহয় ডাক্তারকে এখানে আনতে হবে।

জিদান আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
–কী বলেন ম্যাম। কিন্তু কীভাবে যাবো? বাইরে রাস্তায় ভার্সিটির দুই ছাত্রদলের মাঝে ভীষণ সংঘর্ষ বেঁধেছে। কোনো গাড়ি যাতায়াত করতে পারছেনা৷ ডাক্তারও এর মধ্যে আসতে চাইবেনা।
চিন্তায় পড়ে গেল নূর। সব কী একই সময় হওয়ার দরকার ছিল। লোকটাকে এইভাবে রাখলে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। জিদান হঠাৎ বলে উঠল,
–ম্যাম, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ডাকবো? স্যারের কথা বললে নিশ্চয় চলে আসবে।

চিন্তার মাঝে জিদানের এমন উদ্ভট কথায় বিরক্তি এবার সপ্তমে। দাঁতে দাঁত চেপে নূর বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন নয়। এক কাজ করুন অপারেশন থিয়েটারও বুক করে ফেলুন। ওপেন হার্ট সার্জারীও করা লাগতে পারে।

–একদম ঠিক বলেছেন ম্যাম। আমি এখুনি বুক করছি।

নূর রাগে চোখ বুজে ধমকের সুরে বলল,
–শাট আপ ইডিয়ট। আপনার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এতে চাপ নিতে হবেনা। স্ট্রোক খেয়ে বসবেন। এক কাজ করুন, আপাতত আপনি গিয়ে নাপা এক্সট্রা নিয়ে আসুন। আর উনার জন্য খাওয়ার কিছু নিয়ে আসুন। বাকিটা আমি দেখছি।

–জি ম্যাম এখুনি আনছি।

আদিত্যর শরীরের তাপমাত্রা কমানো এইমুহুর্তে ভীষণ জরুরি। জ্বর আসলে নূর দেখতো ওর মা,ওদের মাথায় পানি ঢালতো, ঠান্ডা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে আর অতিরিক্ত তাপমাত্রা হলে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিতো। এতে শরীরের উচ্চতাপমাত্রা কমে যেত। এখন আদিত্যকেও এমন কিছুই করতে হবে। তবেই তাপমাত্রা কমবে। নূর আদিত্যর বাহুতে ধরে বলল,
–উঠুন, চলুন ওয়াশরুমে যেতে হবে।

আদিত্য দুষ্টু নজরে তাকিয়ে বলল,
–দুজন একসাথে যাবে ওয়াশরুমে? ওয়াও তুমিতো দেখছি সোজা মেইন সিনে চলে গেছ।

নূর দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
–নর্দমার পানি মনে আছেতো?

আদিত্য চুপচাপ লক্ষি ছেলের মতো উঠে দাঁড়াল।নূর ওকে ধরে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে গেল। ওয়াশরুমে এসে আদিত্যকে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে দিলো নূর। তারপর শাওয়ার চালু করে দিলো। আর নিজে সরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়াল।জ্বরের শরীরে শাওয়ারের পানি পরতেই ঠান্ডায় শিরশিরিয়ে উঠল আদিত্যর শরীর। শীতে লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল।পানিতে ভিজে কাঁপতে লাগলো শরীর। হঠাৎ মাথায় দুষ্টুমি চাপলো আদিত্যর। আচমকা নূরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো আদিত্য। শাওয়ারের পানিতে ভিজে গেল নূরও। নূর ভড়কে গিয়ে বলল,
–আরে আরে কী করছেন? আমাকে কেন ভেজাচ্ছেন?

–আমি ভিজছি, আর তুমি শুকনো শুকনো দাঁড়িয়ে আছ। কেমন ব্যাড ম্যানার্স দেখায়। আর তুমিতো জানোই আমি গুড বয়ের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর।

–ফালতু কথা বন্ধ করুন। আর ছাড়ুন আমাকে।

আদিত্য ছাড়ল না, বরং আরও শক্ত করে ধরলো।জ্বরের ঘোরে ওর হুঁশ নেই এখন। নেশায় মাতাল হওয়ার মতো হয়ে আছে এখন সে। এক হাতে নূরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে ওয়াশরুমের দেয়ালে আঁটকে ফেললো।আরেক হাত দিয়ে নূরের হাত দুটো দেয়ালে চেপে ধরলো। শাওয়ারের পানি ভিজিয়ে দিচ্ছে দুজনকে। আদিত্যর চোখে নেশা। মারাত্মক নেশাময় চোখে তাকিয়ে আছে সে নূরের পানে। আদিত্যর ওই নেশাময় নজর নূরকে বিবশ করে দিচ্ছে। অন্তরস্থল ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে যেন। কারোর চাহুনিও এতোটা ধারালো কীভাবে হতে পারে। নূর তাকাতে পারছেনা ওই চোখে। না পারছে সরে যেতে। শরীরের শক্তি কেমন হ্রাস পাচ্ছে ওর। আর এই অসুখটা কেবল এই লোকটার কাছেই আসলে ইদানিং হয় ওর। এমনিতেতো একাই একশটাকে কপোকাত করার ক্ষমতা রাখে ও।কিন্তু এই লোকটার কাছে আসলে এতো দূর্বল হয়ে যায় কেন ও? মনে হয় শরীরে শক্তিবল বলতে ওর কিছুই নেই। আদিত্য নূরের কপালে কপাল মেশালো। তপ্ত গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে নূরের মুখে। অদ্ভুত শিহরণে চোখ বন্ধ করে নিলো নূর। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন৷ মৃদু কম্পন ঘটলো অঙ্গ জুড়ে। আদিত্য নেশালো কন্ঠে বলল,
–ছাড়বোনা নূর। কিছুতেই না। তোমাকে হারালে বাঁচব কী করে? তুমি কেন একটু বোঝো না আমাকে? আমি কী এতটাই খারাপ? একটুও কী ভালোবাসা যায়না আমাকে? ভালো না হয় নাই বাসলে, একটু নাহয় দয়াই করো আমার ওপর। এই যন্ত্রণা যে জান নিয়ে নিচ্ছে আমার।

আদিত্যর হৃদয় নিংড়ানো আকুতি নূরের পীড়াদায়ক অনুভূতিকে আরও একদফা নাড়িয়ে দিলো। অজান্তেই চোখের কোনে জল জমলো তার। শাওয়ারের পানিতে যা দৃশ্যমান হলো না। হৃদপিণ্ডে ভীষণ কোলাহল চলছে। সেই কোলাহলের প্রবনতা নূরকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে কেমন। আদিত্য নূরের নাকে নাক লাগিয়ে বলল,
–তখন আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিলেনা। বলোনা, আমি মরে গেলি কী তুমি সত্যিই খুশি হবে? এক বিন্দুও কষ্ট হবেনা তোমার।? মনে পড়বেনা আমার কথা?

হঠাৎ যেন রাগটা আবার মাথা চারা দিয়ে উঠল নূরের। লোকটা বারবার এই কথা কেন বলছে। নূরের মোটেও ভালো লাগছেনা। অসহ্য রাগে গা জ্বলে উঠল ওর। রেগে উঠে পা দিয়ে আদিত্যর পায়ের ওপর পাড়া মারলো। আচমকা এমন হওয়ায় ব্যাথা পেয়ে নূরকে ছেড়ে পা উঁচু করে দাপাতে লাগলো আদিত্য। নূর সেই সুযোগে আদিত্যকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,
–মনে হচ্ছে আপনার মরার খুব শখ জেগেছে। এক কাজ করি, চলুন আপনার শখ আজ পুরন করেই দেই। এখানেই আপনাকে গলা টি,পে মেরে দেই। তারপর জিব কেলিয়ে এখানেই পড়ে থাকুন।

আদিত্য হেঁসে উঠে বলল,
–ইয়া সিওর। ইট ওয়াজ মাই প্লেজার। তবে এভাবে রেগে না। ভালোবেসে বলো। ভালোবেসে বললে তো হাজার বার তোমার নামে জান কুরবান করে দিবো।

নূর চোখ মুখ বিকৃত করে করে বলল,
–ছিহ..এতো থার্ড ক্লাস ডায়লগ আপনার দারাই সম্ভব। এসব বন্ধ করে বলুন, এইযে পানি পানি খেললেন। এখন আমি পড়বো কী?

–আরে চিন্তা করোনা। কাবার্ডে অনেক কাপড়চোপড় আছে। ওখান থেকে কিছু পড়ে নাও।

–ঠিক আছে। আপনি দাঁড়ান। আমি আপনার জন্য কাপড়চোপড় এনে দিচ্ছি। চেঞ্জ করে নেন।
নূর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে গিয়ে। কাবার্ড থেকে আদিত্যর জন্য আর নিজের জন্য টিশার্ট আর টাওজার বের করলো। আদিত্যরটা আদিত্যকে ওয়াশরুমের ভেতর দিয়ে দিলো। তারপর বাইরে থেকে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে। ভেতরে নিজে চেঞ্জ করে নিলো। চেঞ্জ শেষে আবার দরজা খুলে দিলে আদিত্য বেরিয়ে এলো। ততক্ষণে জিদানও ঔষধ আর খাবার নিয়ে চলে এলো। তবে আদিত্য আর নূরকে এই অবস্থায় দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। মস্তিষ্কের রেলগাড়ী চালু করে ছুটলো তাদের এই অবস্থার বিবরণ খুঁজতে। অতঃপর তার মস্তিষ্ক যেটা খুঁজে পেল তা ভেবে ভেবেই লজ্জাজনক হাসলো সে। স্যারতো জ্বর কমানোর ভালোই পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। নূর জিদানের এই ঠোঁট টিপে হাসা দেখে ওর ভাবনা কোন এলাকায় দৌড়াচ্ছে তা বুঝতে পারলো। নূর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–এইযে মিঃ পাতিহাঁস, মাথায় ব্রেইন নামক যে পঁচা আলুর গোদাম আছে তা আর ছড়ানোর দরকার নেই। আপনার স্যারের জ্বর কমানোর জন্য গোসল করাতে গিয়ে দুজনেই ভিজে গেছি। আর কিছু না।

জিদান থতমত খেয়ে ঔষধ আর খাবারের প্যাকেট দিয়ে আবার বাইরে চলে গেল। নূর আদিত্যকে সোফায় বসিয়ে বলল,
–সকালে কিছু খেয়েছেন?

আদিত্য মাথা নেড়ে না বোঝাল। নূর প্যাকেট থেকে একটা স্যান্ডুইচ বের করে আদিত্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–নিন এটা খেয়ে নিন। তারপর ঔষধ খাবেন।

আদিত্য নাক শিটকিয়ে বলল,
–খেতে ইচ্ছে করছে না আমার।

–ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। খালি পেটে ঔষধ খাওয়া যাবেনা। নিন ফটাফট খেয়ে নিন।

–কিন্তু খাবো কী করে? আমার হাতে না শক্তি পাচ্ছি না। হাত নাড়াতে পারছিনা। এই দেখ।

আদিত্যর এসব শক্তিহীনতা দেখানোর উদ্দেশ্য ঠিকই বুঝতে পারছে নূর।এসব যে নূরের হাত থেকে খাওয়ার ফন্দি তা ভালোই বুঝতে পারছে সে। বিরক্তিতে শরীর জ্বলছে তার। এতো পরিমাণ জ্বালা সে কারোর সহ্য করেনি।আজ কীভাবে পারছে সে? অথচ এই লোকটাকে ফেলেও যেতে পারছেনা সে। লোকটাকে এমন অসুস্থ অবস্থায় রেখে তার মন কোনমতেই যেতে পারছেনা। অগত্যা না পেরে নূর স্যান্ডউইচ টা আদিত্যর মুখের কাছে ধরে বলল,
–নিন, খান।

আদিত্যর খুশি দেখে কে। আদিত্য ফট করে খাবার মুখে নিলো। খেতে খেতে দুষ্টু হেঁসে বলল,
–আমার না তোমাকে আজ একদম বউ বউ লাগছে। যেমন বউ স্বামীর কেয়ার করে ঠিক সেভাবেই করছ তুমি। আমার স্বামী স্বামী ফিলিং হচ্ছে। আহা কী অপূর্ব অনুভূতি। আচ্ছা শোন,তুমিতো আমাকে ভালোবাসনা তাহলে আমার এতো কেয়ার করছ কেন? বলো বলো? তবে কী সামথিং সামথিং??

–ঘোড়াথিং, ঘোড়াথিং। বেশি খেয়ালিপোলাও বানানোর দরকার নেই। চুপচাপ খেয়ে নিন।

খাওয়া শেষে নূর ঔষধ খাইয়ে দিলো আদিত্যকে। তারপর বেডের ওপর নিয়ে এসে শুয়ে আরাম করতে বলল আদিত্যকে। আদিত্য শুয়ে পড়লো। নূর সরে যেতে নিলেই আদিত্য হাত ধরে আবেগী কন্ঠে বলল,
–প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা। এখানেই থাকোনা আমার পাশে।

আদিত্যর এই আকুতি ভরা আবদার মানা করতে মন সহমত হলো না। কেমন মায়া হলো তার। অগত্যা আদিত্যর পাশে বসে রইলো সে। আদিত্য নূরের হাতটা মুঠোয় নিয়ে নিজের গালের নিচে হাতটা জড়িয়ে ধরে কাত হয়ে শুয়ে রইল। নূরের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় প্রশান্তিতে ঘুম নেমে এলো চোখে। আদিত্যর ভারী নিঃশ্বাসের ভাব দেখে নূর বুঝতে পারলো আদিত্য ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকালো নূর।চোখ আটকে গেল আদিত্যর মায়াবী মুখমন্ডলে। কতো নিষ্পাপ লাগছে তাকে এখন। মায়ার রাজ্য যেন তার এই চেহারায়। নূরের হাত ধরে সে কতো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে। অজান্তেই নূরের খোলা হাতটা চলে গেল আদিত্যর গালে। আলতো করে ছুঁইয়ে দিল। লোকটার মায়ায় সত্যি সত্যিই জড়িয়ে যাচ্ছে সে। তবে কী ভালোবাসা নামক অসুখে সেও জড়িয়ে পরলো? হঠাৎ হাত ছিটকে সরিয়ে নিলো নূর। না না, এটা সম্ভব না। এই মায়ায় তার জড়ানো যাবেনা। কিছুতেই না। এই মায়াজালে আবদ্ধ হতে পারবেনা সে। নূর ধীরে ধীরে আদিত্যর ধরে রাখা হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। আদিত্যর দিকে কতক্ষণ মায়াবী চোখে তাকিয়ে থেকে তারপর সরে গেল সে। ফোন করে শিখাকে সব খুলে বলল আর ওর পড়ার জন্য কিছু কাপড় আনতে বললো। একটু পরে শিখা কাপড়চোপড় নিয়ে এলে নূর সেটা পড়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে আরও একবার দেখে নিল আদিত্যর মুখটা। তারপরই চলে গেল সে।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here