#শৈবলিনী—-২০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★রাত তখন প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই। আকাশে চাঁদের দেখা নেই। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেছে হয়তো।ফার্মহাউসের সুইমিং পুলের পাশে ছাতা বিশিষ্ট লম্বা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আদিত্য। পাশেই আছে আবির আর জিদানও। তিনজনের হাতেই বিয়ারের ক্যান। এর আগেও কয়েকটা খালি করে দিয়েছে। খালি ক্যানের সংখ্যা আদিত্যের খাতাতেই বেশি আছে। তখন নূরের সাথে যা হয়েছিল তারপর থেকে আদিত্য প্রচুর অশান্তিতে ছিলো। কিছুই ভালো লাগছিলো না ওর। তাই একটু রিল্যাক্স হতে ফার্মহাউসে এসেছে আদিত্য। জিদান আদিত্যের মুড অফ দেখে আবিরকে ফোন করে ডেকে আনে। আবিরও চলে আসে সাথে সাথে। বর্তমানে তিনজনই নেশায় মাতাল অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আদিত্য মাতাল কন্ঠে দুঃখপ্রকাশ করে বলে উঠলো,
–ইয়ার আবির, মেয়েরা এমন কেন হয়? সো আনপ্রেডিক্টেবল। এদের বোঝাই মুশকিল।
আবির বাবা তার জ্ঞানের ভান্ডার থেকে জ্ঞান বিতরণ আরম্ভ করলো। মাতাল কন্ঠে বলল,
–শোন মেয়েদের বুঝতে গেলে তুই নিজেকেও বুঝতে ভুলে যাবি। মেয়েদের বুঝতে পারা দুনিয়ার কোনো বুঝদার ব্যক্তির বোঝার আয়ত্তের বাইরে। তাদের বুঝতে যাওয়া মানে বোঝাকে বোঝার ওপরই বোঝা(ভারী) করে দেওয়া। তাই এসব বোঝাবুঝির চক্করে পরিসনা। এসব বোঝাবুঝির খাতা খুললে তোর বোঝা বুঝতে পারার ক্ষমতায় থাকবেনা। বুঝতে পেরেছিস আমি কী বোঝাতে চাইছি?
জিদানের মাথার উপর মনে হলো তিন চারটা কাক একসাথে ঠোকাতে শুরু করলো। বেচারা বেকুবের মতো মাথা চুলকিয়ে বলল,
–স্যার আপনি কী বোঝাইলেন, নাকি বোঝার চাউমিন বানাইলেন? মাথার ভিতরেতো তারাগুলো ছিড়ে শর্ট সার্কিট হয়ে গেল।
–আরে মিঞা সার্কিট করবা বড় পরিসরে করো।সেটাও আবার শর্ট করে করো কেন? তুমি মিঞা কিপ্টার কিপ্টাই থাইকা গেলা।
আদিত্য ধমকে উঠে বলল,
–এই চুপ করবি তোরা! এখানে আমার বুকে জ্বলছে আর তোরা আছিস তোদের স্টুপিট কথা নিয়ে।
জিদান বলে উঠলো।
–স্যার আপনার বুক জ্বলছে আগে বলবেন না। এই দেখেন আমার কাছে সেকলো আছে। একটা খান এখুনি বুক জ্বালাপোড়া সেরে যাবে।
–জিদান, তুমি যদি আর একটা কথাও বলেছ তাহলে বাকি সেকলো আর তোমার খাওয়ার সাধ্য হবেনা।
চুপ হয়ে গেল জিদান বেচারা। আজকাল ভলো মানুষের দামই নেই দুনিয়ায়। আদিত্য আবারও মাতাল সুরে আপসোসের সহিত বলল,
–ইয়ার আবির, ও আমার সাথে এমন করে কেন বলনা? লুক অ্যাট মি, কী কমতি আছে আমার মধ্যে?
–দেখ, অনেস্টলী তো দেখতে গেলে সব দিক দিয়ে পারফেক্ট তুই।কিন্তু এখন তোর অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যাক্তিগত সমস্যা আছে কিনা আমি কী করে বলবো।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বলল,
–মানে? কী বলতে চাচ্ছিস তুই?
–এখন কী হাতে কলমে বোঝাব তোকে? মানে,হতে পারে তোর পার্সোনাল প্রোপার্টিতে দূর্বলতা আছে। যেটাই বুঝতে পেরেছে নূর।
আদিত্য ক্ষেপে গিয়ে বলল,
–শাট আপ ইডিয়ট। মাথায় খালি অশ্লীলতা ছাড়া কিছু নেই তোর। নূর কী আমার পার্সোনাল প্রোপার্টি এসে পরিদর্শন করে গেছে নাকি যে ও দূর্বল কী সবল জানবে?
–তারমানে কী তুই সত্যিই দূর্বল? মানে বংশের বাতির লাইট ফিউজ? দেখ চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি কালই তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। দেখবি লাইট আবার জ্বলে উঠবে।
–ডাক্তার দেখানো দরকার তোর। আমার সব ঠিক ঠাকই জ্বলছে।
–কেমনে বুঝলি? কখনো এক্সাম হলে গিয়েছিস? তাহলে বুঝলি কী করে তুই পাশ না ফেল? আচ্ছা চল একটা টেস্ট নেই তোর। সঠিক উত্তর দিতে পারলে তুই সবল পুরুষে ভেরিফাইড হবি। রেডি?
আদিত্য নড়েচড়ে আঁটিসাঁটি হয়ে বসে বলল,
–রেডি মিলর্ড ।
–ওকে তো তোর প্রথম প্রশ্ন ; নূরকে দেখলে তোর কেমন লাগে? আই মিন তোর কী করতে মন চায়?
আদিত্য বাচ্চাদের মতো হেঁসে বলল,
–আমার না ওকে দেখলে….ওকে দেখলে….ওকে দেখলে……….
আবির অতি আগ্রহের সহিত বলল,
–হ্যাঁ বল, ওকে দেখলে কী?
–ওকে দেখলে…আরও দেখতে মন চায়। মন চায় ওকে চোখের সামনে বসিয়ে রেখে শুধু দেখতেই থাকি।
আবিরের উৎসুক মুখটার ফুসস করে হাওয়া বেড়িয়ে গেল। কিন্তু হাল ছাড়ল না সে। তদন্ত জারি রেখে বলল,
–শুধু দেখতেই মন চায়? আর কিছু মন চায়না?
আদিত্য হঠাৎ কিছু মনে আসার মতো করে বলল,
–হ্যাঁ, আরেকটা জিনিস করতে মন চায়।
আবিরের উৎসুক নজর আবার দিগুণ আগ্রহ নিয়ে বলল,
–কী মন চায় বল?
–মন চায়…মন চায় তার ওপর ফুল চন্দনের বর্ষণ করি। দ্বীপ জ্বালিয়ে তার আরতি করি।
আবির আরও একবার নিরাশ হয়ে মেজাজ খারাপ করে বলল,
–ধ্যাৎ, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। এক্সামে একেবারে জিরো পেয়ে ফেইল করলি তুই।
আদিত্য বাচ্চাদের মতো মুখ কালো করে বলল,
–আরে ফেইল কী করে হয়ে গেলাম? তুই এক্সামই নিতে জানিস না। টিচার নামের কলঙ্ক তুই।
–হ,এক্সামে পাশ না করতে পারলে এখন টিচারের দোষ। মানবিকতা আজ কোথায়!
একটু পরে আদিত্য একটু লাজুক হেঁসে বলল,
–আচ্ছা শোন, আমার না আরও একটা জিনিস করতে মন চায়।
আবির ভাবলো আদিত্য আবারও আগের মতোই কিছু বলবে। তাই দায়সারা ভাবে বলল,
–কী?
–মাঝে মধ্যে না ওকে আমার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে মন চায়।এক্সুয়ালি মাঝে মধ্যে না। সবসময়ই ওকে আমার বুকের মাঝে জড়িয়ে নিতে মন চায়। আমার হৃৎস্পন্দনের ধ্বনি শোনাতে মন চায়। যাতে ও বুঝতে পারে আমার প্রত্যেকটা স্পন্দন শুধু ওর নামেই ধ্বনিত হয়। আবার মাঝে মধ্যে না, চুমুও খেতে মন চায়। সেদিন বৃষ্টির মাঝেও অনেক জোরে চুমু আসছিল আমার। কতো কষ্ট করে যে চুমুকে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম তা শুধু আমি জানি।চুমুতো ঠেলেঠুলে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছিল। যেন বলছিল,এই ব্যাটা সর যেতে দে আমাকে। আমাকে আমার কাঙ্ক্ষিত স্থানে যেতে দে। একেবারে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে বেড়িয়ে আসতে চাইছিলো। সর্বশক্তি দিয়ে তাকে প্রতিহত করতে হয়েছে। ইটস ভেরি টাফ ব্রো।
আবির এবার প্রফুল্লিত হলো। আদিত্যের হাতে হ্যান্ডশেক করে বলল,
–আরিব্বাস, এ হুই না বাত। এখন হলি তুই গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে পাশ।
–থ্যাংকস ইয়ার।
পরমুহূর্তেই আদিত্য মুখ গোমড়া করে বলল,
–কিন্তু এতো ভালো মার্ক পাওয়ার পরও, তাও নূর কেন আমাকে ভালোবাসে না? কেন আমাকে উপেক্ষা করে বলনা?
–দেখ এমনিতেতো এসব ভালোবাসা টালোবাসায় আমার চুল পরিমাণও বিশ্বাস নেই। কিন্তু ওইযে কথায় আছে না বন্ধু যাই করুক তাতে সহযোগিতা করা আরেক বন্ধুর পরম কর্তব্য। আর আমি সেই কর্তব্য অবশ্যই পালন করবো। ক্রাইম ইন পার্টনার বলে কথা। আমিও দেখছি নূর তোকে ভালো না বেসে কোথায় যাবে।আরে দ্য সুপারস্টার সাদমান শাহরিয়ার আদিত্যকে ইগনোর করার মতো কেউ পয়দা হয়েছে নাকি। এমনি এমনি কীভাবে ইগনোর করবে তোকে? তারজন্য যথাযথ কারণ দর্শিত করতে হবে। বিশ্লেষণ করে পয়েন্ট টু পয়েন্ট প্রমাণ করতে হবে। নাহলে ইগনোরেন্স অগ্রহণযোগ্য যোগ্য হবে। উপেক্ষা বাতিল ঘোষিত করা হবে। আমাদের রায় না মানলে দরকার হলে আদালতে যাবো আমরা। হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, শার্ট-কোট,পেটিকোট সব জায়গায় যাবো আমরা। তোর জন্য নূরের ভালোবাসা আদাই করেই ছাড়বো। এবারের সংগ্রাম তোর মিঙ্গেল হওয়ার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম তোর পরাধীনতার সংগ্রাম।
জিদানও আবিরের তেজে তেজ দেখিয়ে বলল,
–জয় লাভ গুরু, জয় আবির বাবা। কিন্তু স্যার আদালতে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। ওরাতো বেঈমানী করে। যা বলে তা করেনা।
–কেন? তুমি কীভাবে বুঝলে?
–আরে স্যার আমিও এক কেসের কারণে আদালতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরাতো বেঈমানী করে। জজ লোকটা একটু পরপরই অর্ডার অর্ডার বলে চিল্লায়। অথচ আমি এতবার করে তারে খাবারের অর্ডার দিলাম। সে খাবার আনলই না। তাইলে কন, নিজেই অর্ডার নেওয়ার জন্য চিল্লায়, অথচ অর্ডার দিলে তখন আর আনে না। এইডা কোনো কথা? নিজরাই বেইমানী করে ওরা, তাইলে আর মানুষের বিচার কীভাবে করবে?
আবির হো হো করে হেঁসে উঠে বলল,
–ইউ আর এ অ্যান্টিক পিচ জিদান মিঞা।
__
মাঝখানে একদিন গত হয়ে গেছে। ছুটির দিন ছিলো গতকাল। তাই আর নূরের সাথে দেখা হয়নি আদিত্যর। ওদিকে আদিত্যর গ্যাং-এর যে লোককে খোঁজ নিতে বলেছিলো সেও তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো খবর দিতে পারেনি। তবে চেষ্টায় আছে। তেমন কোনো খবর জানতে পারলে জানাবে আদিত্যকে। শুটিং-এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে বসে আছে আদিত্য। পাশেই জিদান বসে রোজকার মতো ডাইরি দেখে আদিত্যর সারাদিনের সিডিউল শোনাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তার মাঝে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বলল,
–কী শফিক, গাড়ি থামালে কেন?
–স্যার, মনে হচ্ছে গাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে। গাড়ি স্টার্ট হচ্ছে না। আমি চেক করে দেখছি।
ড্রাইভার নেমে গিয়ে গাড়ী চেক করে এসে বলল,
–স্যার, ইঞ্জিনে সমস্যা হয়েছে। গাড়ি এখন আর চলবে না।
–হোয়াট? এখন এই মাঝরাস্তাই কী করবো আমি?
জিদান বলল,
–স্যার, অন্য গাড়িকে আসতে বলি?
–না না, রাস্তায় অনেক জ্যাম। বাসা থেকে অন্য গাড়ি এসে পৌঁছাতে সময় লেগে যাবে। শুটিংয়ে দ্রুত পৌঁছাতে হবে আমাকে। এক কাজ করো তোমরা গাড়িটাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি বরং টেক্সিতে করে এটুকু চলে যাবো।
–ওকে স্যার।
আদিত্য মাস্ক আর ক্যাপ পড়ে নিজেকে আড়াল করে গাড়ি থেকে বের হলো। ভাগ্যবশত নামতেই রাস্তার পাশে একটা হলুদ ট্যাক্সিক্যাব দেখতে পেল। আদিত্য দ্রুত গতিতে গিয়ে ট্যাক্সির দরজা খুলে ভেতরে বসে পড়লো। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আদিত্য ।এখানে কেউ চিনে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,
–চলুন।
–কোথায় যাবেন স্যার?
কন্ঠটা কর্ণগুহে পৌঁছাতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল আদিত্য। চকিত নজরে তাকালো ড্রাইভিং সিটে বসা ব্যক্তির পানে। সামনে ঘুরে থাকায় তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাথায় ক্যাপ পড়ে আছে সে। আদিত্য এখুনি যে কন্ঠ শুনতে পেল সেটা কী সত্যি নাকি আবারও ভ্রম হয়েছে ওর? ভ্রমই হবে,নাহলে নূর এখানে কী করে আসবে।
–কী হলো স্যার বলুন কোথায় যাবে…..
বলতে বলতে পেছনে ঘুরে প্যাসেঞ্জারের সিটে আদিত্যকে দেখে চমকে গেল নূর। এই মুহুর্তে এই লোকটাকে মোটেও আশা করেনি সে। গ্যারেজ বন্ধ হওয়ায় পরিবারের খরচ চালানোর জন্য নূরের উপার্জনের জন্য অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করতেই হতো। তাই সময় নষ্ট না করে নূর যেহেতু ড্রাইভিং জানে আর লাইসেন্সও আছে।তাই পরিচিত এক চাচার কাছ থেকে টেক্সি ভাড়ায় চালানোর জন্য নেয় সে। আজই প্রথম টেক্সি নিয়ে বের হয়েছে। আর প্রথম প্যাসেঞ্জার হিসেবে এই লোকটাতেই আসতে হলো! নূর ভেবেছিল রোজকার সময় অনুযায়ী গিয়ে এই লোকের কাজ করে দিয়ে আসবে। ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত দায় আছে যে সে। কিন্তু উনি নিজের গাড়ি রেখে টেক্সিতে কী করছে? এখন এই লোক নিশ্চয় জেরা শুরু করে দিবে। এবং হলোও তাই। নূরকে এই বেশে দেখে অবাক হয়ে গেল আদিত্য। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল,
–তুমি ? এখানে? এসব কী নূর? তুমি টেক্সি কেন চালাচ্ছ?
নূর সোজা হয়ে বসে অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
–আমার ইচ্ছা। আমার মন চাইছে তাই চালাচ্ছি। আপনার কোনো সমস্যা আছে? থাকলেও আমার কিছু করার নেই।
আদিত্যর রাগ এবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এমনিতেও সেদিন নূরের উপর চাপা রাগ জমে ছিলো। আর আজ নূরের এই বেখাপ্পা আচরণ আদিত্যর রাগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আদিত্য চোখ মুখ কঠিন করে থমথমে কন্ঠে বলল,
–নূর এনাফ নাউ। ডোন্ট ট্রাই মাই পেশেন্স। সত্যি সত্যিই বলো কী হয়েছে। নাহলে আমি কী করবো আমি নিজেও জানি না।
নূর এবার একটু ঘাবড়ে গেল। রাগের বশে আবার লোকটা কোনো সিন ক্রিয়েট না করে বসে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে নূর বলল,
–দেখুন অযথা এতো ফুলকো লুচি হওয়ার দরকার নেই। আমার বেশি বেশি টাকা উপার্জনের ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই পার্ট টাইম কাজ হিসেবে টেক্সি চালাচ্ছি।
–কিন্তু তোমার গ্যারেজ তো আছে। ওটার কী হয়েছে?
–ও ওটাও আছে। পল্টু আর আরেকটা ছেলে আছে ওরা সামলাবে গ্যারেজ। আর আমি টেক্সি চালাবো আর ভার্সিটির কাজ করবো। আসলে আপনাকেতো বলেছিলাম আমি গাড়ি বানাতে চাচ্ছি। তো ওটার সরঞ্জামাদি কেনার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন এখন আমার। তাই বেশি বেশি টাকা উপার্জনের জন্য এসব করছি। এখন বুঝেছেন? বুঝে থাকলে বলুন কোথায় যাবেন? আর না যেতে চাইলে নেমে যান।
নূরের কথা কেন যেন কনভিনিয়েন্স মনে হচ্ছে না আদিত্যর। এখনো মনে হচ্ছে কিছু লুকাচ্ছে মেয়েটা। যাইহোক সত্য তো আমি বের করেই ছাড়বো। আপাতত নূরকে হাতছাড়া করবেনা কিছুতেই। তাই আদিত্য বলল,
–এইসময় কোথায় যাই তা তুমি ভালো করেই জানো। ক্যাম্পাসে চলো। আর তুমি ক্যাম্পাসে যাবেনা?
–না আজ যাবোনা। তবে চিন্তা করেন না। আপনার কাজে সময়মত চলে আসবো আমি।
মেয়েটা ক্লাস বাদ দিয়ে টেক্সি চালাবে? আদিত্য সেটা হতে দিবেনা কিছুতেই। তাছাড়া নূরের প্যাসেঞ্জার হিসেবে অন্য লোক এসে বসবে তা কীভাবে মেনে নিবে আদিত্য। বিষয়টা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে হানা দিতেই আদিত্য দ্রুত বেগে জিজ্ঞেস করে উঠল,
–এক মিনিট! তুমি কবে থেকে টেক্সি চালানো শুরু করেছ? আমার আগে অন্য কেউ বসেছিল?
–না, আজই বের করেছি। আর আপনিই আমার প্রথম প্যাসেঞ্জার।
আদিত্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। নূরের প্যাসেঞ্জার হওয়ার অধিকার শুধু আদিত্যর আছে। আর কারোর না। নূর প্রশ্ন করলো,
–বাইদা ওয়ে আপনার গাড়ি করা হয়েছে? এতো দামী গাড়ি থাকতে টেক্সিতে কেন উঠলেন?
–রাস্তায় নষ্ট হয়ে গেছে গাড়ি। তাই টেক্সিতে উঠতে হয়েছে। থ্যাংক গড গাড়ি নষ্ট হয়েছিল। নাহলে তো এই বিষয় জানতেই পারতাম না।
শেষের কথাটা মনে মনে আওরালো আদিত্য। কিছু একটা ভেবে বলল,
–শোন, আজকের সারাদিনের জন্য আমি তোমার ট্যাক্সি বুক করলাম। সারাদিনের যা ভাড়া আসে তা দিবে আমি।
–কেন? আপনার গাড়ির কী অভাব পড়েছে? একটা নষ্ট হয়েছে তো কী হয়েছে আরেকটা ডেকে পাঠান।
আদিত্য আমতাআমতা করে বলল,
–আমার সব গাড়িই নষ্ট হয়ে গেছে। কবে ঠিক হবে জানি না। তাই টেক্সিতেই চলতে হবে। আর আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো আর ট্যাক্সি ডাকতে পারবোনা তাইনা? তাই এটাই বেস্ট হবে। এখন থেকে তোমার টেক্সি বুক করে নিলাম আমি। রোজ সারাদিনের যা ভাড়া হবে সেটা বলে দিও। তোমার ভাড়া তুমি পেয়ে গেলে হলো তাইনা? তাহলে তো আর সমস্যা থাকার কথা না।
আদিত্য যে সব ইচ্ছে করে করছে তা ভালোই বুঝতে পারছে নূর। একসাথে উনার সব গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল? যতসব বাহানাবাজি। যাকগে আমার কী, আমার ভাড়া পেয়ে গেলে মিটে গেল। সারাদিন কয়টা ভাড়া পাবো না পাবো। সেখান থেকে আবার টেক্সি মালিককে জমাও দিতে হবে। তারপর নিজের কিছু পাবো। তার থেকে এটাই ভালো আছে। প্যাসেঞ্জার কে হলো সেটা এখন দেখার বিষয় না। পরিবারের খরচ চালাতে এখন আমার টাকার প্রয়োজন। আর গাড়ি তৈরি করার জন্যেও টাকার প্রয়োজন। তাই পার্সোনাল ইস্যু নিয়ে ধরে বসে থাকলে চলবেনা আমার।তাছাড়া প্র্যাকটিক্যালি তার কাছ থেকে তো আমি এমনি এমনি টাকা নিচ্ছি না। কাজের পরিবর্তেইতো টাকা আসছে, সেটা যেখান থেকেই আসুক তাতে কী যায় আসে। ভাবনার হিসাব নিকাষ শেষে গাড়ি স্টার্ট দিতে নিলেই হঠাৎ আদিত্য বলে উঠল,
–নূর,দাঁড়াও এক মিনিট।
বলেই গাড়ি থেকে নেমে গেল আদিত্য। তারপর সামনে এসে সামনের দরজা খুলে নূরের পাশের সিটে বসে বলল,
–হ্যাঁ, এখন চলো।
–সামনে কেন বসলেন? প্যাসেঞ্জাররা তো পেছনেই বসে।
–প্যাসেঞ্জার আমি। ইচ্ছেও আমার। আমার এখানেই বসার ইচ্ছে হয়েছে। এখন কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালাও।
নূরও আর কথা বাড়াল না। জানে এই লোকের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। গাড়ি স্টার্ট দিলো সে। আদিত্য মনে মনে বলল,তোমার সহযাত্রী হতে চাই নূর। তাইতো পিছে নয় সঙ্গে চলতে চাই তোমার।
বিশ মিনিট পর ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছাল নূরের ট্যাক্সি। আদিত্য দরজা খুলে নামতে নিয়ে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
–শোনো, শুধু শুধু বসে থাকার চেয়ে গিয়ে ক্লাস করো। তারপর সময়মত আমাকে হেল্প করতে চলে এসো। ভেবোনা তোমাকে হেল্প করার জন্য আমি বলছি। আসলে তোমাকে চালাকি করতে দিবোনা আমি। এদিকে আমার কাছ থেকে সারাদিনের ভাড়া নিবে। আবার এই সময়ের ভেতর গিয়ে অন্য ভাড়াও চালাবে সেটা হতে দেবোনা আমি। তাই গিয়ে ক্লাস করো।
বলেই বেড়িয়ে গেল আদিত্য। হঠাৎ এক সুক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো নূরের ঠোঁটের কোণে। আদিত্য যে ওকে ঠিকমতো ক্লাস করানোর জন্যই এতসব ফন্দি এঁটেছে তা বুঝতে একবিন্দুও সময় লাগাল না নূরের। হঠাৎ লোকটার প্রতি এক সুপ্ত অনুভূতির সৃষ্টি হলো যেন। সেটা শ্রদ্ধাবোধ নাকি অন্যকিছু তা অস্পষ্ট নূরের কাছে।
চলবে….