#শেষটা_সুন্দর পর্ব___৩০
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)

দরজা খোলার শব্দে দূর্বল শরীর নিয়ে পেছন ঘুরে তাকাল তরী। বিস্ফারিত নয়নে লক্ষ্য করলো অন্ধকার রুমে পুরুষ অবয়ব! সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ভেতর দিয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেল তার। ভেতরে ভেতরে সিটিয়ে গেল। দূর্বল গলায় দু বার উচ্চারণ করলো,

‘কে? কে আপনি?’

অবয়ব থেকে কোনো উত্তর এলো না। আস্তে ধীরে এগিয়ে আসতে নিতে তরী ভয়ে শিউরে উঠলো। মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারলো তার হিজাব নেই। তবুও গায়ের ওড়নাটা দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ পেঁচিয়ে ঢেকে ফেলল। দু হাতে ঠান্ডা ফ্লোর আঁকড়ে ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। পারলো না। বসে বসে পেছন দিকে সরে গেল। কিছুদূর যেতেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল। দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়াতে রুমে ক্ষীণ আলোর একটা লাইট জ্বলে উঠলো।

তরী চোখ বন্ধ করে নিল। এত অল্প পাওয়ারের আলো। তবুও চোখে ব্যথা সৃষ্টি করছে। তীব্র ভাবে লাগছে! না জানি কতদিন হলো সে অন্ধকারে বন্দী আছে। আলো সয়ে আসতে সে দ্রুত চোখ খুলল। চোখ খুলে দুটো জিনিস আবিষ্কার করলো। রুমের দরজা পুনরায় বন্ধ করা হয়েছে এবং পুরুষ অবয়বটি কার খুব কাছে চলে এসেছে। ঝাপসা চোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিটির মুখ দেখতে পেল তরী। গা গুলিয়ে উঠলো তার। নির্ঝর নয়, বিশ্রী মুখোশ্রীর মধ্যবয়স্ক এক লোক। জোঁকের মতো কুচকুচে ঠোঁট। কুৎসিত দাঁত বের করে হাসছে। মুখ থেকে চোখ সরাতে অবয়বটির হাতে চোখ পড়লো। হাতে একটা প্লেট! প্লেটের উপর একটা গ্লাস। গ্লাসে রঙিন একটা পানীয়!

পানীয়টার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তরী। তৃষ্ণায় নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া অল্প হাঁ হয়ে আছে। বদ্ধ রুমে অক্সিজেনের অভাব। তাকে টেনে টেনে শ্বাস নিতে হচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ শ্বাস নিতে পারবে সে? দেওয়াল ধরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না সে। ফ্লোরে বসে পড়লো। অস্ফুট স্বরে বলল,

‘আমি কোথায় এখন? কোথায় আটকে রেখেছেন আমাকে? কে আপনি? আমাকে ধরে রেখেছেন কেন? আশিক কোথায়?’

অবয়বটি বিশ্রী শব্দ তুলে হাসলো। সেই হাসির শব্দে তরীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। চোখ দিয়ে পুনরায় অশ্রু ঝরতে শুরু করলো। সে হাত জোড় করে বিনয়ের সহিত বলল,

‘প্লিজ, আমায় যেতে দিন এখান থেকে। একটু দয়া করুন। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ, যেতে দিন আমায়!’

‘যেতে দিবো সুন্দরী। যাবে তো! বিদেশ।’

‘বিদেশ?’

তরী ভয়ে এদিক ওদিক তাকালো। হাঁসফাঁস করতে করতে উঠার চেষ্টা করলো। কি বলছে এরা? তাকে বিদেশে পাচার করে দিবে? বেঁচে দিবে? আশিক কোথায়? আশিক কি তাকে বিক্রি করে দিয়েছে এদের কাছে?

তরী নড়ার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। দূর্বল গলায় সে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,

‘পানি দিন একটু। পানি খাব!’

লোকটা প্লেট থেকে গ্লাসটা হাতে নিয়ে তরীর দিকে বাড়িয়ে দিল। তরী একপ্রকার লুফে গ্লাসটা ছিনিয়ে নিল। মুখের কাছে নিতে তার নাক মুখ কুঁচকে গেল গন্ধে। গ্লাসের পানীয় দিয়ে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ বের হচ্ছে। সে সরিয়ে রেখে বলল,

‘এটা কি?’

মধ্য বয়স্ক লোকটি কুটিল হেসে বলল,

‘ফলের জুস! একটু খেয়ো দেখো। খুব ভালো লাগবে। মনে হবে স্বর্গে ভাসছো।’

‘খাব না আমি! গন্ধ!’

‘পানি এখানে পাওয়া যায় না। তৃষ্ণা মেটাতে চাইলে এটাই খেতে হবে গো!’

‘এ দূর্গন্ধের মতো জিনিস কি ভাবে খাব?’

‘দেখিয়ে দিবো?’

লোকটির শয়তানি হাসি চোখে পড়তে তরী দ্রুত হাতের গ্লাসটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে দিল। তার গা ঘিনঘিন করছে। এখান থেকে তাকে পালাতে হবে। যে করেই হোক, তাকে পালাতে হবে! সে আড়চোখে রুমের সর্বত্র চোখ বুলাল। ছোট্ট একটা রুম! আসবাব পত্র বলতে পুরনো একটা কাঠের চেয়ার, যার একটা পায়া ভাঙা। রুমের মাঝামাঝি জায়গা মাদুর বিছানো। তার উপর কভারবিহীন চটচটে একটা বালিশ। বাইরে বের হওয়ার দরজা একটাই! যেটা এখন বন্ধ। দক্ষিণের দেয়ালে একটা প্লাস্টিকের দরজা চোখে পড়লো। দরজা হাট করে একটু খোলা। ভেতর থেকে ভুসভুস করে গন্ধ আসছে। তরী বুঝতে পারলো ওটা বাথরুম!

বাথরুমের কথা মনে পড়তে তার তলপেটে তীব্র চাপ অনুভব করলো। বাথরুমে যেতে হবে তাকে। কিন্তু সামনের এই বিশ্রী মানুষটা কেন যাচ্ছে না? সে লোকটির লোলুপ দৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য উঠার চেষ্টা করলো। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি তার দু কাঁধ খামচে ধরলো। তরী বাঁধা দিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,

‘কি করছেন কি? ছাড়ুন! দূরে সরে যান।’

লোকটি দূরে গেল না। বাম হাতে মেঝে থেকে গ্লাসটা তুলে নিল। তরীর দিকে চেয়ে বলল,

‘আমি আদর করে এটা খাইয়ে দিই। মজা পাবে! হাঁ করো তো।’

তরী ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করলো। মাথাটা অন্য দিকে ঘোরাতে দরজায় টোকা পড়লো। বুকের ভেতর প্রাণ ফিরে পেল যেন সে। মৃত চোখজোড়ায় আশার আলো জেগে উঠলো। লোকটি ততক্ষণে কপাল কুঁচকে উঠে পড়েছে। হাতের গ্লাসটা মেঝেতে ফের নামিয়ে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তরী মনে মনে আল্লাহ কে স্মরণ করলো। সে খুব করে চাচ্ছে দরজার ওপাশের মানুষটা যেন নির্ঝর হয়। নির্ঝর হয়!

খট করে ছিটকিনি খোলার শব্দ কানে ভেসে এলো। দরজা সরাতে তরীকে অবাক করে দিয়ে ভেতরে ঢুকলো চল্লিশোর্ধ্ব এক মহিলা। ধবধবে ফর্সা শরীরে পাতলা জর্জেট শাড়ি পড়া। চেহারায় আধুনিকতার ছাপ। ঠোঁটে গাঢ় করে লাল লিপস্টিক মাখানো। তার পরনের পাতলা শাড়ির উপর দিয়ে শরীরের সব ভাঁজ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। স্লিভলেস ব্লাউজ পরিহিত মানুষ তরী এই প্রথম চোখে দেখলো। সে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। সাথে বুঝতে পারলো সে কোথায় আছে এখন! মুহুর্তে চোখ মুখ উপচে কান্না বের হলো তার। মহিলাটি কাছাকাছি দাঁড়াতে সে প্রায় হুমড়ি খেয়ে তার পায়ের উপর পড়লো। কান্না করতে করতে হবে,

‘আমায় যেতে দিন। প্লিজ! আমার বাড়ির সবাই চিন্তা করছে। আমার নতুন বিয়ে হয়েছে। স্বামী, সংসার আছে আমার। প্লিজ যেতে দিন আমায়। দয়া করে যেতে দিন আমায়।’

মহিলাটি নিচু হয়ে তরীকে টেনে বসালো। ভেজা দৃষ্টি মেলে তরী দেখলো মহিলার রক্তাক্ত ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি। অসহায় চোখ মেলে সে চেয়ে রইলো। এতক্ষণে লক্ষ্য করলো মহিলার পাশে কিশোরী বয়সের আরো একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির শরীরে দামী পোশাক জড়ানো। হাতে একটা প্লেট নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ওকে খাবারটা দে!’

মহিলার ভারিক্কি কন্ঠের হুকুম পেয়ে দ্রুত মেয়েটি নিচু হয়ে তরীর সামনে প্লেট রাখলো। প্লেটে দুটো রুটি আর সবজি দেখা যাচ্ছে। খাবার দেখে তরীর চোখ চকচক করে উঠলো। সে কারো হুকুমের অপেক্ষা না করে প্লেটটা কাছে টেনে নিল। সম্পূর্ণ রুটিতে সবজি ঢেলে সে গ্রোগাসে খাওয়া শুরু করলো। শুষ্ক, খটখটে রুটি গলা দিয়ে নামতে চাইছে না। আধ রুটি খেতেই তার কাশি শুরু হয়ে গেল। চোখ দিয়ে পানি বের হতে সে হাত ইশারা করে পানি চাইলো। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি দ্রুত সেই আগের গ্লাসটা তরীর হাতে ধরিয়ে দিল। সে চোখ বন্ধ করে গ্লাসে চুমুক দিল। কয়েক চুমুক খেতেই ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যেতে লাগলো। তরল পানীয়টা যেখান দিয়ে নামছে সেখান দিয়ে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে যেন। পাকস্থলীতে তীব্র জ্বলুনি! গ্লাসটা হাতে নিয়ে সে নিভু নিভু চোখে তাকাল সকলের দিকে। তাকে কি পানি বলে এসিড খাওয়ালো?

সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। মহিলাটি বিদ্রুপের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে বের হয়ে গেল। দরজা পুনরায় বন্ধ করতে তরী জড়ানো কন্ঠে বলল,

‘আমায় যেতে দিন। যে-তে দিন আমায়!’

বলেই পুনরায় রঙিন পানীয়ে চুমুক দিল।

__________

তখন শেষ রাত! ঢাকার বুকে নতুন সূর্য এখনো জেগে উঠেনি। শহর ঘুমন্ত। তবে প্রকৃতি জেগে উঠেছে। শহুরে পাখির আনাগোনা খুব একটা না থাকলেও দু চারটে কাক থেমে থেমে কাঁ কাঁ করছে। কিছু সময় কেটে যেতে পূর্ব কোণ ঘেঁষে উঁকি দিল রক্তিম সূর্য। তার আলোর ঝলকানিতে শহুরে অন্ধকার কেটে যেতে লাগলো। শুধু অন্ধকার কাটলো না পুরান ঢাকার এক ঘিঞ্জি এলাকার ছোট্ট এক রুমে। যে রুমে দুজন অল্প বয়সী মেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে আছে। পাশেই অল্প দামের মদের বোতল, আর ড্রাগ সরঞ্জাম পড়ে আছে। রাতভর মদ্যপান আর ড্রাগ নিয়ে এখন হাওয়ায় ভাসছে তারা! রুমে এলোমেলো ভাবে সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আশপাশের রুম থেকে বহু মেয়েলি স্বর ভেসে আসছে।

_____________

‘নির্ঝর! নির্ঝর?’

মমতাজ বেগম ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন। নির্ঝর প্রতিত্তর করল না। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্ঝরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মমতামিশ্রিত চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালেন। নির্ঝর বর্তমানে আছে ঢাকার একটা প্রাইভেট হসপিটালে। আঠারো দিন ধরে সে বিছানাগত।

তরীর না ফেরার দিনগুলো একে একে আঠারোর কোঠা পেরিয়েছে। আজ উনিশ দিন হলো তরী নিখোঁজ। শুধু তরীকে হারিয়ে ফেলেনি তারা। সেই সাথে নির্ঝর মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছে এতগুলো দিন। দুদিন হলো একটু সুস্থ সে!

সেদিন তরীর মিসিং হওয়ার খবর শুনে নির্ঝর নিজের মাঝে ছিল না। মাঝরাতে একা একা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিল। অস্থির মন নিয়ে ড্রাইভ করে সিলেট পেরিয়েছিল। কিন্তু ভোরের আলো ফোটার আগেই ঢাকার পথে ভয়াবহ দূর্ঘটনার শিকার হয়। সেদিন থেকে আজ আঠারোটা দিন হলো সে হসপিটালাইজড্! তিনটা দিন নির্ঝরের সেন্স ছিল না। সেন্স ফেরার পর যখন জানতে পারলো তরীকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি, মূলত তখন থেকে পাগলামি শুরু করে। তার পাগলামি রুখতে এতগুলো দিন শুধু ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছিল। গত দুদিন হলো কোনো পাগলামি করছে না। কেমন থম মেরে গেছে। কারো সাথে কথা বলছে না, হাসছে না, কাঁদছে না! একেবারে অনুভূতি শূন্য হয়ে গেছে যেন। টানা সাত দিন সে নিজ ইচ্ছায় কোনো খাবার মুখে তুলেনি। স্যালাইনের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপর থেকে একটু আধটু খেলেও সবসময় ছোঁড়াছুড়ি করতো। গত দুদিন হলো সব বন্ধ হয়ে গেছে।

‘বড় মা!’

নির্ঝরের ক্ষীণ স্বরের ডাকে মমতাজ বেগম চমকে গেলেন। নির্ঝর চোখ না খুলেই ডাকছে। তিনি ঝটপট করে উত্তর দিলেন,

‘হুঁ, বল! কিছু লাগবে? কোথায় অস্বস্তি হয়?’

নির্ঝর চোখ খুলে মমতাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি করুণ সে চাহনি! ছেলেটার চোখ বসে গেছে, মাথার এলোমেলো চুলগুলো যত্নের অভাবে কপাল ছুঁয়েছে, চোখের নিচে কালি, দাঁড়ি গুলো না কাটার ফলে বড় হয়ে গেছে। এ কদিনে শুকিয়ে মরার মতো অবস্থা!

নির্ঝর পুনরায় চোখ বন্ধ করলো। মনে মনে বলল,

‘অস্বস্তি হচ্ছে বড় মা! ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে বারংবার মরে যাচ্ছি আমি। এতবার মৃত্যু যন্ত্রণা সইতে পারছি না যে! এসব থেকে চিরমুক্তি চাই আমি। চিরমুক্তি চাই!’

নির্ঝরের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু বের হয়ে কানের কাছে পৌঁছাল। সেটা মমতাজ বেগমের চোখের অগোচরে রইলো না। বিগত দিনগুলো তিনি নিয়ম করে এসব দেখে আসছেন। ঘুমের মধ্যেও ছেলেটা কাঁদে! মমতাজ বেগমের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে। একে তরীকে হারানোর যন্ত্রণা, তার উপর আবার চোখের সামনে নির্ঝরেরর এই অবস্থা! তিনি আর কত সহ্য করবেন!

ফোন বেজে উঠতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। প্রতিবার ফোন বাজলে তিনি উদগ্রীব হয়ে থাকেন। এই বুঝি কেউ তরীর খোঁজ দিল! কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থ হতে হয় তাকে। তরীকে সাধ্যের মধ্যে যতটুকু খোঁজা যায়, তার চেয়ে বেশি খোঁজা হয়েছে। পুলিশ ফোর্স সহ এতগুলো মানুষের কেউ তরী অবধি পৌঁছাতে পারলো না! এদিকে আশিকও উধাও! কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছে যে সে ইন্ডিয়ার বর্ডার ক্রস করেছে।

দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে তিনি ফোনের স্ক্রিণের দিকে তাকালেন। দেখলেন জীবন ফোন করেছে। তরীর নিখোঁজের পর থেকে তিনি ঢাকায় আছেন। রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলে কেবিনের বাইরে বের হয়ে গেলেন।

তিনি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্ঝর চোখ খুলল। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে দরজার দিকে তাকালো। মাথার ডান পাশে হাত বুলাল। এখানে তরী প্রথম আঘাত করেছিল, দুটো স্টিচ দিতে হয়েছিল। জায়গাটাতে এখনো চিহ্ন হয়ে আছে। সময় সুযোগ পেলে সে ওখানে হাত বুলোয়। গত দিনগুলোতে সে শয়নে, স্বপনে শুধু তরীকে দেখেছে৷ মাথার ভেতর তরী ছাড়া কিচ্ছু নেই! আধো ঘুমের মধ্যে তরীকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে কখনো কখনো বাস্তবে ফিরেছে! বাস্তবে তরী নেই, অথচ ঘুমের মধ্যে আছে! কি নির্মম সত্যি!

বাম পা টা হালকা করে নাড়ালো নির্ঝর। পায়ে মারাত্মক ইনজুরি হয়েছিল তার। তিন দিন হলো ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েছে। এখন একটু নাড়াতে পারে! সে সাবধানে উঠে বসলো। পরণের ঢিলেঢালা ফতুয়া টেনে সে উঠে দাঁড়ালো। ডান পায়ে সম্পূর্ণ ভর রেখে এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো সে। কেবিনের বাইরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে সে দ্রুত করিডোর ধরে হাঁটতে লাগলো। মা-বাবা, বগ মা, নিনাদ কেউ নেই! তাকে পালাতে হবে! এতদিন ধরে তাকে হসপিটালে একপ্রকার জোর করে আটকে রেখেছে। যাতে তার সাথে নতুন করে অঘটন না ঘটে। কিন্তু তাকে বাইরে বের হতে হবে। তরীকে নতুন করে খুঁজতে হবে। সে জানে, তার তরীরাণীর কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু হতে পারে না!

সিঁড়ি মাড়িয়ে ছয়তলা থেকে পাঁচ তলায় নামতে নির্ঝর হাঁপিয়ে উঠলো। একে তো প্রচন্ড দূর্বল শরীর। তার উপর পায়ে ব্যথা। সে আর সহ্য করতে না পেরে পাঁচ তলার করিডোর ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে গেল। বাঁক ঘুরতে এটাচ চেয়ারের সারি নজরে এলো। এগিয়ে গিয়ে তার একটাতে বসে ঘন ঘন শ্বাস নিল সে। তার মুখ বরাবর সামনে অনেকগুলো ছোট ছোট ইমার্জেন্সি কেবিন। সবগুলোতে দরজা ভিড়ানো। কয়েক হাত সামনের কেবিনে দরজা খোলা। শুধু পর্দা ঝুলছে। থেকে থেকে পর্দা উড়ে চলেছে। পর্দা সড়ার ফাঁকে সে দেখলো, রুমের মাঝামাঝি বেডে একজন রোগী শুয়ে আছে। সম্পূর্ণ একা! আশপাশে আত্মীয় স্বজন নেই। কপাল কুঁচকে গেল তার!

কিছুক্ষণ পর নির্ঝর কৌতূহল নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পা এগিয়ে উঁকি দিতে তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। মাথা চেপে ধরে সামনে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

‘তরী? তরী!’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here