#ললাট_লিখন
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:৬

আরশীর কথায় ঐতিহ্য মলিন হেসে ওর চোখের দিকে তাঁকালো। আরশী ওর চোখে ভরসার ছায়া দেখতে পাচ্ছে । মানুষ বড়ই বিচিত্র এক প্রাণী, যার মনের ভাষার সঙ্গে মুখের ভাষার তেমন মিল পাওয়া যায় না। মন যদি ডানে যেতে চাই তবে তাঁর শরীর যায় বামে। সে নিজের ইচ্ছেতে হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক।হাজার বছর পাশে থেকেও কাছের মানুষটাকে সঠিকভাবে চেনা যায় না। আবার হঠাৎ পাওয়া মানুষকে আপন করে কাছে নিতে দুবার ভাবতে হয়না। আরশীর জীবন ছিল উদ্দেশ‍্যহীন। ভেবেছিল চলছেতো এভাবেই চলুক না। নিয়তি যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকেই ওর গন্তব্য বাধা থাকবে। জীবন থেকে কিছু চাওয়ার ছিল না। ভেবেছিল এইতো আছি বেশ। মানুষের চাওয়া পাওয়ার উপরে তার সুখ সুবিধা গুলো নির্ভর করে। চাওয়া পাওয়া গুলো যত বেশি কম থাকবে ততবেশি সুখ পাওয়া যাবে। আকাশ সমান চাহিদা নিয়ে সুখের আশা করা বোকামি। আরশী কথাগুলো ভেবে চনচল হয়ে উঠলো। ঐতিহ্যের ঘুমের দরকার আছে। পর্যাপ্ত ঘুম হলে তবেই মাথা ভালো কাজ করবে। তাছাড়া মানুষটার উপরে কোন ঔষধের কি প্রভাব পড়েছে তার ঠিক নেই। আরশী ওর পাশ থেকে উঠে গিয়ে বিছানা ঠিক করে জানালা বন্ধ করে দিলো। ঐতিহ্য সেখানেই বসে আছে। পূর্ব আকাশে গোলাকার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। আরশীর জোছনা দেখতে ভালো লাগে তবুও আজ ইচ্ছে করছে না। ও ক্লান্ত হয়ে ঐতিহ্যের পাশে গিয়ে বসতে বসতে বলল,

> ঘুমাতে হবে। আমাদের বিছানাটা খুব ছোট। আপনি উপরে ঘুমানোর চেষ্টা করেন, ভয় পাবেন না।আমি নিচে আছি।
আরশীর কথা শুনে ঐতিহ্যের খুব হাসি পেলো। এইটুকু একটা মেয়ে ওকে ভরসা দিচ্ছে।ভয় না পাবার জন্য আবার পাহারাও দিচ্ছে। কিন্তু ওতো এমন ছিল না। কেমন অথর্বের মতো চলতে হচ্ছে। জীবনটা কত কঠিন। আগে ভাবতো জীবন হয়তো সহজ। কোথাও কোনো দুঃখ কষ্ট নেই। কথটা ভেবে ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে খাতা কলম নিয়ে কিছু লিখে আরশীর সামনে তুলে ধরলো,
> নিচে ঘুমাতে হবে না আপনি আমার সঙ্গেই ঘুমাবেন। শীত পড়ছে, ঠান্ডায় ঘুমিয়ে নিজে অসুস্থ হলে তখন আমাকে কিভাবে সুস্থ করবেন ম‍্যাডাম?
আরশী লেখাটা পড়ে চিন্তিত মুখে তাঁকিয়ে বলল,
>তা ঠিক কথা,কিন্তু!
আরশী কথাটা বলে ভেবে বিছানায় উঠতে উঠতে বলল,
> বর বোবা হলে কিন্তু একটা সুবিধা আছে সংসারজীবন সুখের হয়। আমি একাই বকবো আপনি চুপচাপ আমার অত‍্যাচার মাথা পেতে নিবেন। কথাটা আগে কেনো যে ভাবিনি আল্লাহ্ জানেন। একটা কথা কী জানেন তো? আল্লাহ্ যা করেন বান্দার ভালোর জন‍্যই করেন। আমরা মাঝখানে বুঝতে না পেরে ভাগ‍্যের দোষারোপ করি।
আরশী কথাটা বলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ছোট একটা টিনের ঘর। কাঠের চৌকি আর সামান্য একটা টেবিল ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো আসবাবপত্রের বালাই নেই। তবুও খুব যত্ন নিয়ে গুছিয়ে রাখা। এই ঘরটাই আরশীর সুখ দুঃখের সাথী ছিল। কত রাত যে চোখের পানিতে এঘরে পার করেছে,ঘরটা যদি কথা বলতে পারতো তবে নিশ্চয়ই সাক্ষী হিসেবে তাকে দাড় করানো যেতো। কথাগুলো ভেবে ও চোখের পাতা বন্ধ করলো। সারাদিনে ধকলের জন্য আরশী ক্লান্ত ছিল তাই ও চোখ বন্ধ করতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। মাঝরাতে তর্কাতর্কির আওয়াজ পেয়ে আরশীর ঘুম ভাঙলো। পাশের রুমে ভাই ভাবির কিছু একটা নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক চলছে। আরশী কখনও কারো কথায় আড়ি পাতে না কিন্তু বারবার ঐতিহ্যের নামটা কানে আসার জন্য ও বাধ্য হলো উঠে গিয়ে দুঘরের মাঝখানে বন্ধ করা জানালায় কান পাততে। জুলেখা বেগম স্বামীর সঙ্গে ঝামেলা করছে। বারবার বলছে,

> ঐতিহ্য এমনিতেও বোবা ওর সঙ্গে তোমার বোন কখনও সুখে থাকবে না। তার থেকে বরং তুমি ঐই লোকের কথায় রাজি হয়ে যাও। এতগুলো টাকা পেলে আমারা বড়লোক হয়ে যাবো। তখন তুমি বোনকে অন‍্য কোথাও বিয়ে দিতে পারবে সমস্যা কোথায়?
> শুনো সমস্যা হচ্ছে আমার মন সাড়া দিচ্ছে না। তাছাড়া পুলিশের ঝামেলায় ফেসে গেলে কি হবে ভেবেছো? আমি পারবো না লোভ করে নিজের ক্ষতি করতে।
> কাপুরুষ একটা। তোমাকে না পুরুষ মানুষ ভাবতে লজ্জা লাগে। এইটুকু একটা কাজ তাতে আবার পুলিশ টানছো। এই যাওতো তোমার সঙ্গে কথা বলায় বোকামি।
> জুলেখা বুঝতে চেষ্টা করো। বোনের স্বামীর ক্ষতি করতে কোন ভাইয়ের ভালো লাগবে? বোনটাকে কখনও ভালো কিছুই দিতে পারিনি।
> বোবা হাবা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বোনকে তুমি উদ্ধার করে দিয়েছো। ছোটলোক কাকে বলে তোমাকে দেখে উদাহরণ দিতে মন চাইছে। পাগলেও নিজের ভালো বুঝে।
> তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো। কি চাইছো বলবে?
> আচ্ছা সরি আমার ভুল হয়েছে। তোমার যা ইচ্ছে করো। তবে আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকতে পারবো না। চলে যাবো বাপের বাড়ি।
> তোমার চলে যাবার কথা আসছে কোথা থেকে?
> যেখানে আমার কথার কোনো দাম নেই এখানে কেনো থাকবো।
> তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। আচ্ছা আমি রাজি তোমার কথায়। উনি ওষুধ সকালবেলায় পাঠিয়ে দিবেন তুমি খাবারের মধ্যে মিশিয়ে দিও।
ভাই ভাবির কথা শুনে আরশীর চোখ ছানাবড়া। ও ভাবছে,এরা কি মানুষ? সুতার জাল কেটে এখন দেখি লোহার জালে ধরা পড়লাম। এখানে থাকা যাবে না কিছুতেই না। এখন রাতটা ঠিক কতো ওর জানা নেই। তবে সময় যায় হোক তাতে ওর কিছু যায় আসে না। কথাটা ভেবে ও হন্তদন্ত হয়ে বিছানার কাছে ফিরে এসে দেখলো ঐতিহ্য পা ঝুলিয়ে বসে আছে। ছেলিটার চোখ মুখে কেমন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব। আরশীর এখন হাউমাউ করে কাঁদতে মন চাইছে। এই বিপদে ও এখন কাকে পাশে পাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ওর চাপা কান্নাটা ফুপিয়ে বেরিয়ে আসলো। ও ঐতিহ্যের পাশে গিয়ে বসতেই ঐতিহ্য ওর মাথাটা নিজের কাঠে নিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলো। ওরা দুজন বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে আরশী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
> চলুন এখানে আর না। আকাশে চাঁদ আছে। তাছাড়া ল‍্যামপোষ্টের আলোতে আমাদের চলতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। বিশাল আকাশের নিচে দুজনের থাকার জায়গা নিশ্চয়ই হবে।।
ঐতিহ্য উঠে গিয়ে খাতায় লিখলো,,
> পাগল হয়েছেন? এতো রাতে কোথায় যাবো? ভাগ‍‍্যে যা আছে হবে। আমার জন্য আপনাকে বিপদে ফেলতে পারবো না।
আরশী ওরা লেখাটা পড়ে বেজায় রেগে গেলো। ও ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চৌকির নিচ থেকে লাগেজ বের করে ওর হাত ধরে বলল,
> অনেক ভেবেছেন আর না। এবার আমাকে ভাবতে দিন। চলুন নয়তো কিন্তু রেগে যাবো তখন বুঝবেন।
আরশীর রাগ দেখে ঐতিহ্যের হাসি পেলো। তবুও এই সময় উদ্দেশ্যেহীনভাবে বেরিয়ে পড়াটা বোকামি হবে কি ভাবছে। কিন্তু করার তো কিছুই নেই। এখানে থাকলে মৃত্যু অবধারিত। কথাটা ভেবে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশীর সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। দুরের পাড়া থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। নির্জন রাস্তায় হাত ধরে দুজন মানব মানবি এলোমেলো হেটে চলেছে। সামনে কি হবে অজানা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here