#ললাট_লিখন
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:৪

ঐতিহ্য হাতের ওষুধটা গাছের উপরে ফেলে তাড়াতাড়ি করে আলমারির কাছে এগিয়ে গেলো। আরশী চোখমুখে আতঙ্কের ছাপ। ও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ঐতিহ্যের দিকে। ছেলেটা ওকে এভাবে নিয়ে এসেছে কেনো ও কিছুটা মনে হচ্ছে অনুধাবন করতে পারছে। ইনজেকশনটার জন্য ওর কি অবস্থা হতো ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে। ডাক্তার সাদমান লোকটা মানুষকে সুস্থ করার নামে অসুস্থ করতে চাইছে কিন্তু কেনো? লোকটার এতে কিসের লাভ? আরশীর ধ‍্যান ভাঙলো ঐতিহ্যর দেওয়া ডাইরির দিকে তাকিয়ে। ছেলেটা কাপা হাতে ওর সামনে ডাইরী ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরশী দ্রুত ওর থেকে ডাইরীটা নিয়ে চোখের সামনে ধরলো, বেশ সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে,
” বাঁচতে চাইলে পালাতে হবে”
আরশী লেখাটা পড়ে ঐতিহ্যের দিকে তাকালো। ছেলেটার চোখ মুখ কেমন উদাসীন। আরশী কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিঙ্গাসা করলো,
> আমার সঙ্গে কি হচ্ছে আপনি সব জানেন? সকালবেলায় আপনার মতো লোকটা কে ছিল? আর ওই ডাক্তার আমাকে মারতে চাইছে কেনো?

আরশীর প্রশ্ন শুনে ঐতিহ্য ডাইরীটা নিয়ে কিছু একটা লিখে ওর সামনে ধরতেই আরশী দেখলো সেখানে লেখা আছে,
> সে অনেক কথা সময় খুব কম। প্লিজ পালিয়ে যান। প্রশ্ন করবেন না আর সময় খুবই কম ।
আরশী ডাইরিটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে জিঙ্গাসা করলো ও এখান থেকে কিভাবে পালাবে? কারণ দরজা বন্ধ আর বাইরে দিয়ে গেলে তো সবাই ওকে দেখে নিবে। আরশীর কথার উত্তরের ঐতিহ্য কিছুই বললো না। ও আরশীর হাত মুষ্টিমেয় করে বেলকনির দিকে এগিয়ে গেলো। ঐতিহ্য বেলকনির রেলিংয়ের সঙ্গে একটা দড়ি বেধে ওর দিকে ইশারা করলো নেমে যেতে কিন্তু আরশী নিজের শাড়ির দিকে তাকিয়ে ওকে বলল, “শাড়ি পড়ে ও দড়ি দিয়ে কিছুতেই নামতে পারবে না” ঐতিহ্য কিছু একটা ভেবে দড়ি ধরে কিছুটা নেমে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। আরশী একবার ভাবলো লোকটার মাথায় সমস্যা আছে শুনেছিল তাহলে কি ওটা সত্যি ছিল না? নাকি এখন যা করছে এটা ওর পাগলামী থেকেই করছে। যদি তাই হবে তাহলে ডাক্তারের ঘটনাটা কি ছিল? ওর ভাবতে ভাবতেই দরজায় ধাক্কা পড়লো। আরশী আর অপেক্ষা করলো না তাড়াতাড়ি ঐতিহ্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। ঐতিহ্য ওকে ঝাপটে ধরে তরতর করে নিচে নেমে আসলো। মনে হচ্ছে ছেলেটা বহুদিন ধরে এই কাজের জন্য পটু। আরশীকে অবাক করে ছেলেটা একে নিয়ে দৌড়ে একটা গাড়িতে চেপে বসলো। গাড়িতে আগে থেকে চাবি ছিল। ঐতিহ্য চোখের পলকে গাড়ি ছেড়ে চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। আরশী ওকে বারবার জিঙ্গাসা করেও কোনো উত্তর পেলো না তাই ও চুপ করে তাকিয়ে থাকলো। গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যেই থানার সামনে গিয়ে দাড়ালো। ঐতিহ্য গাড়ি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি আরশীর হাত ধরে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যেতেই একজন লোক দৌড়ে ঐতিহ্যের সামনে এগিয়ে এসে জিঞ্জাসা করলেন,
> কি হয়েছে ঐতিহ্য? সব ঠিক আছে তো?
ঐতিহ্য মাথা নেড়ে বোঝাতে চাইলো কিছুই ঠিক নেই। ওর এমন আচরণে পুলিশ ওদের দুজনকেই ভেতরে নিয়ে গিয়ে ওদেরকে বসিয়ে দিলেন। ওখানে বসে ঐতিহ্য প্রচণ্ড ঘামতে শুরু করলো। আরশীর ভয় করছে। আরশী সামনে থাকা পানির গ্লাস ওর দিকে এগিয়ে দিলো কিন্তু ও নিলো না। পুলিশ ওর থেকে বিস্তারিত জানতে চাইলো ঐতিহ্য সামনে রাখা খাতায় কিছু লিখতে গেলো ঠিক তখনই ভেতরে আনেক গুলো লোক ঢুকে পড়লো। আরশী পেছনে ঘুরে দেখলো ওর শশুর আর শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওদের পেছনে একজন মহিলা আর ডাক্তার ছামাদ ও আছেন। আরশী ওদের দেখে ঢোক গিলল। ঐতিহ্য খাতা কলম নিয়ে বসে আছে কিন্তু লিখতে পারছে না। ওর হাতটা ঠকঠক করে কাঁপছে। আরশীর শাশুড়ি আরশীর কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
> আমার ছেলেটার জন্য তোমাকে বিপদে পড়তে হচ্ছে।বাড়িতে ফিরে তোমাকে বাবার বাড়িতে কিছুদিন রেখে আসবো।ছেলেটার ভালো চিকিৎসা হলে তখন তোমাকে নিয়ে আসবো। তুমি ঠিক আছো তো?
আরশী ভয়ে ভয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে ভরসা দিল ও ঠিক আছে। তবে কেনো জানি পুলিশের চোখেমুখে সন্দেহ। তবুও চৌধুরী সাহেব জোরকরে ঐতিহ্যকে গাড়িতে নিয়ে তুললেন। ছেলেটা কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। আরশীর মাথায় অন‍্যরকম চিন্তা ঘুরছে। ওর জানা মতে বোবারা কখনও কানে শুনতে পারে না।কিন্তু ঐতিহ্য শুনতে পাই এবং লিখতও পারে তাহলে ওর এই বোবা থাকার কারণ কি? ছেলেটা যে হাবাগোবা না এটা ও আজ খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে কিন্তু এর পেছনে কাহিনী কি? জানতে হলে ঐতিহ্যের সম্পর্কে জানতে হবে। আরশী ঠিক করলো কিছুতেই বাবার বাড়িতে যাওয়া চলবে না। আজ থেকে ও ঐতিহ্যের সঙ্গেই থাকবে। সারা রাস্তা ও এসব ভাবতে ভাবতে পার করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা বাড়িতে চলে আসলো। ঐতিহ্যকে আরশীর শাশুড়ি নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। আরশী ডাক্তার ছামাদকে চিনে কিন্তু ওর সঙ্গের ভদ্রমহিলাকে চিনে না। বাড়িতে ফিরে ও কাজের মেয়েটার থেকে ভদ্রমহিলার পরিচয় জানতে পারলো। উনি ঐতিহ্যের দূর সম্পর্কেল ফুপি হন। এই বাড়ি এবং ঐতিহ্যের দেখাশোনার দাঁড়িয়ে উনি সেই ছোট থেকেই পালন করে আসছেন। ভদ্রমহিলার স্বামী ছেলেমেয়ের কোনো সন্ধান নেই। বহুকাল আগে সংসার ছেড়ে চলে এসেছেন। এখানেই বাকী জীবন পর করার ইচ্ছে।। এই বাড়িতে কাজের লোক তিনজন আছে। দুজন ছেলে এবং একজন মেয়ে তাছাড়া আরও দুজন আছে যারা ঐতিহ্যের ফুফাতো ভাই এবং বোন। ঐতিহ্যের ফুপি মারা যাবার পরে ওরা এই বাড়িতে চলে আসে। আর চৌধুরী সাহেবও ওদেরকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। কখনও ওদেরকে আলাদা ভাবেন না। নিজের সন্তানের মতোই যত্ন করেন। আরশী একটু অবাক হলো যখন জানতে পারলো ঐতিহ্যের ভাই বোন ওর সঙ্গে পরিচয় করতে আসলো না কেনো আর বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে অথচ ওরা কোথায় আছে। আরশী কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে কাজের মেয়েটাকে বলল,
> আচ্ছা উনারা কোথায় বলতে পারেন?
> ঐশী আফার পরীক্ষা চলছে। উনি এবার বড় পাশ করা ডাক্তার হবেন তাই ভোরবেলায় উনি চলে গেছেন। আপনার সঙ্গে বাড়িতে ফিরে আলাপ করবেন। আর ভাইজান ও সকালবেলায় অফিস গেছেন। আজ রাতে অনুষ্ঠান আছে তো তাই জন্য।
আরশী ওকে যেতে বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। এই বাড়িতে ডাক্তার ছামাদকে ওর শশুর ডেকেছিল তাহলে উনকি জেনে বুঝে আমার ক্ষতি চাইছেন নাকি মুখোশের আড়ালে অন‍্য কেউ আছে? তাছাড়া শাশুড়ি আম্মাই কেনো নিজের ছেলের বউকে মারবেন? সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। আরশী নিজের ঘরে যেতে গিয়েও ওর শাশুড়ির রুমে ঢুকে পড়লো। ঐতিহ্য বিছানার মাঝখানে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। আরশী আস্তে পা ফেলে ঐতিহ্যের মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ওর শাশুড়ি পাশ থেকে বললেন,
> রাতে বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে কিছুক্ষণের মধ্যেই লোক আসবে তোমাকে সাজানোর জন্য। তুমি বরং নিজের রুমে যাও।
> আম্মা আমি ঠিক আছি আপনি চিন্তা করবেন না। যদি অনুমতি দিতেন তাহলে একটা কথা জিঞ্জাসা করতাম।
> অনুমতির কি আছে বলো কি জানতে চাও।
> উনি কি জন্ম থেকেই এমন?
> না রে মা। আমার ছেলেটা আগে একদম এমন ছিল না। পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে অফিসে বসত। হঠাৎ কোথা থেকে কি হলো।
কথাটা বলেই উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আরশী চোখে মনে হলো কিছু বিষ্ফোরণ ঘটেছে। ওর গলাই চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে সামনে আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
> তারপর কি হলো বলেন না আম্মা খুব জানতে মন চাইছে?
> ছেলেটা একদিন ঝাড় বৃষ্টিতে ভিজে অনেক রাতে বাড়িতে ফিরেছিল।

সকাল থেকে জ্বর শুরু হলো। ডাক্তার দেখানো হলো কিন্তু কোনো উন্নতি হলো না। দিন দিন ও আরও অসুস্থ হয়ে পড়লো। দুদিন পরে দেখি ও হঠাৎ কথা বলতে পারছে না। কেমন পাগলামি করে। সেবার জ্বর তো সেরেছিল কিন্তু ছেলেটা কখনও আর কথা বলতে পারলো না।।
> কতবছর হবে এটা?
> এই বছর দুয়েক হবে। ডাক্তার বলেছে ও আর কখনও কথা বলতে পারবে না।
> আমি জানতাম উনি জন্ম থেকেই এমন। আচ্ছা উনাকে এখন কোন ডাক্তার দেখছেন?
> ডাক্তার ছামাদ দেখছে।
আরশী ভ্রু কুচকে ফেলল। কেমন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। ঐতিহ্য সামান্য জ্বর থেকে বোবা হয়ে গেলেন কিভাবে ওর মাথায় ঢুকছে না। আচ্ছা পরিকল্পনা করে ঐতিহ্য কে পাগল করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল? হতেই পারে কিন্তু এরকমটা কে করতে পারে?

চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

(আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here